মানুষের জন্যই তো করছি
অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলেও শুরু থেকেই মনের মধ্যে একটা অদম্য প্রেরণা আর তাগিদ ছিল মানুষের সেবায় নিজের শিক্ষা আর মেধাকে কাজে লাগানোর। রাজশাহীর ক্যাডেট কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেই চলে আসি জার্মানি। বার্লিনের খ্যাতনামা হুমবল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করার পরে ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রিও নিই। প্রবাসের প্রথম জীবনে কষ্টও করেছি বিস্তর, বার্লিনে অনুবাদকের কাজ ও চাকরির পাশাপাশি পিএইচডি করেছি। এরপর শুরু হয় জার্মান ও মার্কিন মালিকানার নানা বিনিয়োগ সংস্থায় চাকরি।
একসময় ভাবতে শুরু করি, চাকরি বা ব্যাবসার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাজে লাগে, এমন কোনো বিষয়ে যুক্ত হলে মানসিকভাবে নিজের চাওয়া–পাওয়ার ব্যাপারটি মিলে যাবে। সেই ভাবনা থেকেই ২০০০ সালে জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা–বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘কাসা রেহা’তে যোগ দিয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানটি জার্মানজুড়ে বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়। বৃদ্ধাশ্রম হিসেবেও এটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। জার্মানজুড়ে এই সেবাপ্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১০ হাজার শয্যাবিশিষ্ট ৭১টি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র বা বৃদ্ধাশ্রম ছড়িয়ে আছে। আর এই কেন্দ্রগুলোয় কাজ করছেন প্রায় সাত হাজার মানুষ।
ইউরোপের উন্নত দেশগুলোয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে, পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ তো আর নতুন ঘটনা নয়। একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, জার্মানিতে এখন জনসংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ। প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ কমে গিয়ে ৪৫ বছর পর ২০৬০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা হবে সাড়ে ছয় থেকে সাত কোটির কাছাকাছি।
ইউরোপীয় বা জার্মান সমাজব্যবস্থায় বড় পরিবারপ্রথা ক্রমেই ভেঙে পড়ার কারণে সমাজের বিপুলসংখ্যক বয়স্ক নাগরিককে নিয়ে সরকারি নানা প্রকল্প চালু আছে। পরিবহন থেকে শুরু করে জাদুঘর, কনসার্ট, খেলার মাঠে বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে বয়স্ক নাগরিকেরা বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন, বয়স্ক নাগরিকদের আলাদা আবাসনের বাইরেও যাঁরা পরিবারের প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে থেকে সেবা পেতে চান, তাঁদের দেখভালের জন্য নার্সিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
জার্মানিতে বয়স্ক নাগরিকদের প্রায় ৭০ শতাংশ, এখনো পরিবারের সঙ্গেই রয়েছেন। বাকি ৩০ শতাংশের জন্য রয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। একটি জরিপ বলছে, এই মুহূর্তে জার্মানিতে নয় লাখ বয়স্ক নাগরিকের জন্য প্রায় ১২ হাজার বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে।
জার্মানিতে নানা সেবামুখী প্রতিষ্ঠান, যেমন: রেডক্রস, কারিতাস ইত্যাদির বাইরে ব্যক্তিগত খাতে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।
তবে মানুষের বৃদ্ধ বয়সে বিভিন্ন রোগবালাই, মনস্তাত্তিক সমস্যাসহ নানা কিছুর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ও সমাধান দিয়ে আর সার্বক্ষণিক নিয়মনীতি ও আইন মেনে এ ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। শনি ও রোববার ছুটির দিনগুলোতেও প্রায়ই আমাকে গাড়ি নিয়ে ছুটতে হয় জার্মানির নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা নিজেদের বৃদ্ধাশ্রমগুলোয়। বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত ব্যক্তিদের কাছে তাঁদের সুযোগ–সুবিধা ও সমস্যার কথা শুনে কাজের কৌশল নির্ধারণ করি৷
১৪ বছর আগে আমি যখন কাসা রেহাতে যোগ দিয়েছিলাম, তখন প্রতিষ্ঠানটি ছিল ছোট। গত কয়েক বছরে এই প্রতিষ্ঠান জার্মানির অন্যতম প্রবীণ সেবাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। শুরুর দিকে আমাদের প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়মূল্য ছিল দুই কোটি ইউরো, আর এখন তা ৮৯ কোটি ইউরো। ইতিমধ্যে কাসা রেহা জার্মানির সেরা ১০টি কর্মক্ষেত্রের একটি হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে।
এই তো দুই বছর আগের ঘটনা। জার্মান সামাজিক গণতন্ত্রী দলের সাবেক সভাপতি ও প্রভাবশালী রাজনীতিক ফ্রাঞ্জ মুনটেরফেরিং জার্মান পার্লামেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আলোচনা ও অনুরোধ করেছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার বয়স্ক মানুষের সেবার জন্য আরও একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ার উদ্দ্যোগ নিতে। জার্মানিতে আমাদের কাজের সাফল্য দেখে এখানকার রাজনীতিবিদ বা নগর পরিচালক মেয়রদের কাছ থেকে একই ধরনের আমন্ত্রণ প্রায়ই আসছে। এ ছাড়া চীন ও জাপান থেকেও সেখানে এই ধাঁচের বৃদ্ধাশ্রম গড়ার অনুরোধ আসছে। আমরা ইতিমধ্যেই চীনের এই ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেছি।
জার্মানিতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিপুল চাহিদার কথা চিন্তা করে আগামী তিন বছরে আরও পাঁচ হাজার শয্যা বাড়ানোর কথা ভাবতে শুরু করি। আর তার জন্য প্রয়োজন আরও ৪৫ কোটি ইউরো।
মনের তাগিদে নিজের দেশ বাংলাদেশে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য দেশের স্বকীয়তা ঠিক রেখে কিছু করতে চাই। কিছু চেষ্টাও করেছি, কিন্তু রাজনৈতিক আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কোনো ভালো উদ্দেশ্যকে সফল হতে দেয় না। অথচ জার্মানির পার্লামেন্ট সদস্য বা প্রভাবশালী রাজনীতিকেরা তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় বৃদ্ধাশ্রম গড়ার অঙ্গীকার নিতে আমাদের কাছে আসছেন।
সেই ছোট থেকেই মনে যে প্রেরণা ও তাগিদ ছিল মানুষের সেবায় কিছু করার, তা এখন ভিনদেশের নাগরিকদের জন্য করলেও সে তো মানুষের জন্যই করছি।
লেখক পরিচিতি
হুমায়ুন কবীর জার্মানির প্রবীণদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জন্ম ১৯৫৭ সালে, কুমিল্লায়। ১৯৭৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেই উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে পাড়ি। অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে জার্মান ও মার্কিন নানা বিনিয়োগ সংস্থায় কাজ করেছেন। বর্তমানে কাসা রেহা নামের জার্মানভিত্তিক সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: