>
শহিদুল আলম আলোকচিত্রী। তাঁর তোলা ছবি নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকসহ ছাপা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সান্ডারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অতিথি অধ্যাপক। পড়িয়েছেন হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শহিদুল আলমের কাজের ক্ষেত্র ফটোগ্রাফি। ৩০ বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি। করছেন নিজের মননের অন্তঃস্থিত শৈল্পিক সক্ষমতা দিয়ে। বাংলাদেশে আলোকচিত্রের গৎবাঁধা খোলনলচে বদলে দিয়েছেন তিনি। সাধারণ জনমানসের সঙ্গে সময়ের বিবর্তনে বেড়ে ওঠা শৈল্পিক সংবেদনশীলতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি এটি করতে পেরেছেন। কিন্তু কেমন করে এর শুরু হয়েছিল, কেমন ছিল শিল্পের এই বেড়ে ওঠা?
শিল্প এক রহস্য। শিল্পীও প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি। শিল্পের জন্ম হয় না মাথায়, না হৃৎপিণ্ডে, না সচেতন মনে। শিল্পের জন্ম হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে, যাকে নবোকভ (রুশ ঔপন্যাসিক ভ্লাদিমির নবোকভ) ‘মেরুদণ্ডে ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক অনুরণন’ বলে অভিহিত করেছেন। এই মেরুরজ্জুতে দেহের অন্য প্রত্যঙ্গরা এসে মিলিত হয়। সেখানেই শিল্প–প্রক্রিয়া সচেতন মনের অবধারিত আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। যদিও অবচেতন মনের মানচিত্রহীন সুবিশাল ভূখণ্ডে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, তাড়না, স্মৃতি ও কল্পনার ছোট ছোট টুকরো জোড়া লাগিয়ে এর শুরুটা হয়।
ঠিক সেভাবে শহিদুল আলমের শিল্পকর্ম এবং সেগুলোর উদ্ভব, বিকাশকে তার প্রতিবেশের সঙ্গে তাঁর তীব্র, চলমান ও জটিল মিথস্ক্রিয়ায় তৈরি শিল্পপণ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই শিল্প আন্দোলন ন্যায়শাস্ত্রসম্মত। এই শিল্প একটি থিসিস। এই শিল্প একটি অ্যান্টি–থিসিস এবং এর ধারাবাহিকতায় এটি সিনথিসিস বা সংশ্লেষণ, যার ধারাবাহিকতায় একই চক্রে আবার শিল্প ঘুরে ঘুরে আসে। নিরবচ্ছিন্ন, অনুসন্ধানী, চির–অতৃপ্ত মনোভঙ্গি নিয়ে তিনি নিজের শিল্পসীমানা অতিক্রম করতে চেয়েছেন।
শহিদুল আলম ১৯৭২ সালে ১৭ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যে যান। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন। কিন্তু তিনি তাঁর অধীত বিষয়ের মধ্যে আটকে থাকেননি। নানা পেশায় জড়িয়েছেন। অবকাঠামো নির্মাণের কাজ থেকে শুরু করে গবেষকের কাজ করেছেন। এমনকি, ক্লাবগুলোতে বাউন্সার (বিশেষত মদ্যপ হয়ে কেউ হইহল্লা করলে বাউন্সাররা তাদের সামাল দেন) হিসেবেও কাজ করেছেন।
নানা পেশায় যুক্ত থাকার সুবাদে নানান ধরনের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা কি শহিদুলের শৈল্পিক কল্পনা ও সংবেদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলেছিল? বিচিত্র সব কাজ করার সময় ঘটনাক্রমে শহিদুলের হাতে একটি ক্যামেরা আসে এবং তিনি ছবি তুলতে শুরু করেন। মানুষের জীবন, তাদের বেঁচে থাকার ধরন ইত্যাদি তিনি ফ্রেমে বন্দী করেন। পড়াশোনা, হাতে–কলমে শেখা ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি এ কাজে নিজেকে একটু একটু করে শিক্ষিত করে তুলতে থাকেন। তিনি বাণিজ্যিক ফটোগ্রাফিও করেছেন এর শৈল্পিক সম্ভাব্যতাকে মাথায় রেখে।
বাণিজ্যিক ছবি তোলার শুরুটা ছিল শহিদুলের শিল্পের থিসিস। এই থিসিস চলার সময়ই তাঁর মনে অ্যান্টি–থিসিস কাজ করছিল; তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর ছবি তোলার আসল জায়গা যুক্তরাজ্য নয়। যদিও তিনি সেখানে সহজে–স্বাচ্ছন্দ্যে একাডেমিক জীবন চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে ফিরে এক কঠিন অনিশ্চয়তার জীবন বেছে নেন। শিল্পী যখন জেনে যান তাঁর কাজের জায়গা কোথায়, তখন সেখানে যেতে তিনি বাধ্য। এটিই শহিদুলের শিল্পের সিনথিসিস বা সংশ্লেষণ।
পরবর্তী সময়ে শহিদুলের জীবনে বারবার তাঁর শৈল্পিক সংবেদনশীলতার সঙ্গে তাঁর পারিপার্শ্বিক জগতের অভিঘাত হয়েছে। এই জটিল দ্বন্দ্ব ও অভিঘাত তাঁর শিল্পদৃষ্টিকে সংজ্ঞায়িত করতে সহায়তা করেছে এবং তাঁকে নতুনের দিকে ধাবিত করতে সহায়তা করেছে।
শহিদুল আলম যা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন, তা বাংলাদেশের বাস্তব জগৎ ও বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা কল্পনার জগৎকে আরও সম্প্রসারিত করেছে।দেশে ফিরে শহিদুল বাণিজ্যিক ফটোগ্রাফির কাজ শুরু করেন। কিন্তু আবারও তিনি পুরোনো অ্যান্টি-থিসিসের প্রশ্নের মুখোমুখি হন। তাঁর মনে হতে থাকে, সমাজের অভিজাত শ্রেণির মনোরঞ্জনের জন্যই কি তাঁর কাজ করে যেতে হবে? নাকি তাঁর চারপাশের মানুষের আটপৌরে জীবনকে তাঁর কাজের অনুষঙ্গ বানাবেন? নব্বইয়ের দশকে জেনারেল এরশাদের সময় যখন রাজপথে সংগ্রামী মানুষেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, তখন তিনি এই প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলেন। যখন তিনি শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়ে ছবি তুলতে লাগলেন, যখন তিনি বিক্ষুব্ধ মানুষের উত্তাল শক্তির সান্নিধ্যে এলেন, তখন তাঁর মেরুরজ্জুতে শিল্প–বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন, তাঁর মধ্যে ফটোগ্রাফির অর্থ সম্পর্কে নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। পশ্চিমা জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জীবনযাত্রায় ফটোগ্রাফির উপযোগিতা কী, তা নিয়ে নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই প্রশ্নের (অ্যান্টি–থিসিস) মধ্যেই তাঁর জবাব (সিনথিসিস) রয়েছে। সেই সিনথিসিস হলো বাংলাদেশ! বাংলাদেশের মাটি, মানুষ, পথঘাট–বস্তি, এখানকার নদীনালা, খানাখন্দ, এখানকার জাদুময় বহুমাত্রিকতা।
এই উপলব্ধির পর তিনি তাঁর কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছেন। এই কাজের মধ্যেই তিনি জনগণের ভাবনাচিন্তার প্রচ্ছন্ন প্রকাশ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর ছবির মূল বিষয়ই হলো মানুষ। তাঁর ছবিতে উঠে এসেছে নারী, পুরুষ, শিশু। বস্তি। উনুন। সাইক্লোন। গান। চুলার আগুন। পথশিশু। বেলুন। শ্রমিক। দিনমজুর। ছেঁড়া কাপড়। বৃষ্টি। কারখানা। সবুজ শস্যের খেত। দেহের গভীর ক্ষত।
শহিদুল বিদেশে বিভিন্ন আলোকচিত্র উৎসব ও প্রদর্শনীতে যেতেন এবং ভাবতেন পশ্চিমাদের বিষয়ে আমরা এত কিছু জানি, কিন্তু তাঁরা আমাদের বিষয়ে কিছুই জানবে না, তা কী করে হয়? এই ভাবনাই দৃক গ্যালারি প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আমাদের প্রতিনিধিত্বের নেতৃত্বে আমরাই থাকব। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির ইতিহাসে তখনই প্রথমবারের মতো বিনির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হলো। ফটোগ্রাফির প্রথাগত ধারা ভেঙে দিয়ে নতুন এক ধারার সূচনা হলো, যেখানে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির আংশিক নয়, সমগ্র চিত্র দেখা যেতে লাগল। সেগুলো শুধু বঞ্চনার শিকার ও ভুক্তভোগীর নয়, বরং পরিবর্তন ও আন্দোলনের সৃষ্টিশীল প্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকল।
এই বিশ্বাসের ঘূর্ণাবর্ত থেকেই ‘পাঠশালা’র জন্ম, যেখান থেকে ‘ছবিমেলা’ নামের ফটো প্রদর্শনীর শুরু। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে প্রথমবারের মতো এই প্রদর্শনী হয়। ২০ বছর আগে এগুলো ছিল একেবারে বৈপ্লবিক ভাবনা। এই ভাবনাগুলোই শহিদুল আলমের সব চেষ্টা ও উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।
ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে চেনা ব্রহ্মাণ্ডের যে ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যাবলি নিয়ত অতিক্রম করতে করতে এক গভীর ভাবালুতা আমাদের ধ্যানমগ্নতার দিকে নিয়ে যায়, সেই ছিন্ন ছিন্ন দৃশ্যকে বিশুদ্ধ জ্যামিতি ও গ্রে স্কেলে ফেলে একটি সামগ্রিক চিত্র নির্মাণ হচ্ছে আমাদের মানসে। এ বিষয়টি বুঝলেই বোঝা যাবে, শহিদুলের যে ছবিগুলো আমরা দেখে প্রশংসামুখর হই, তাঁর যে ছবিগুলোতে বাংলাদেশের হাসি, কান্না, দারিদ্র্য, সম্ভাবনা ফুটে ওঠে; তার নেপথ্যে একুশ শতকের ফটোগ্রাফির কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উত্তরণের ছোঁয়া রয়ে গেছে।
শহিদুল আলম যা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন, তা বাংলাদেশের বাস্তব জগৎ ও বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা কল্পনার জগৎকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। এই অভিযাত্রায় তিনি আমাদের কাছে এবং বিশ্বের কাছে এই বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন যে আমরা নিজেরাই আমাদের নিজেদের ছবি এবং ভাষ্যের রূপ বিনির্মাণে সক্ষম। তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন, বাংলাদেশের খণ্ডিত ছবি দেখে বাংলাদেশের সমগ্রতাকে স্পর্শ করা যাবে না। খণ্ডিত রূপ দেখে বাংলাদেশকে বিচার করা যাবে না।
শহিদুল আলম কতটুকু অর্জন করেছেন, তা মুখ্য বিষয় নয়; সবচেয়ে বড় কথা, চারপাশের জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত তাঁর সৃজনশীল সত্তার বিরোধ ও সম্পৃক্ততাকে তিনি আজীবন ধরে রাখতে পেরেছেন। দেশ ও মানুষের সঙ্গে শহিদুলের যে নিরবচ্ছিন্ন অটুট আত্মিক বন্ধন, সেটিই তাঁর ফটোগ্রাফির হৃৎপিণ্ড। সেটিই তাঁর শিল্প। (ইংরেজি থেকে অনূদিত)
শহিদুল আলমের কর্মধারা
উদ্যোগ
১৯৮৯: দৃক ফটো গ্যালারি প্রতিষ্ঠা
১৯৯৮: আলোকচিত্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘পাঠশালা’ প্রতিষ্ঠা
২০০০: ‘ছবিমেলা’ নামে আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র চিত্রপ্রদর্শনীর সূচনা
স্বীকৃতি
১৯৮৩: হার্ভে হ্যারিস ট্রফি
১৯৯৩: মাদার জোন্স পদক
১৯৯৮: আন্দ্রে ফ্রাঙ্ক ফাউন্ডেশন ও হাওয়ার্ড চ্যাপনিক অ্যাওয়ার্ডস
২০১৪: শিল্পকলা পদক
২০১৭: চীনের ডালি ইন্টারন্যাশনাল চিত্রপ্রদর্শনীতে আজীবন সম্মাননা
২০১৮: লুসি ফাউন্ডেশন প্রদত্ত হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড
বই
মাই জার্নি অ্যাজ অ্যা উইটনেস
নেচারস ফিউরি
পোর্ট্রেট অব কমিটমেন্ট
খাদেমুল ইসলাম, বেঙ্গল লাইটস–এর সম্পাদক