মাদ্রাসাশিক্ষার ধারা ও উপধারা
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা লেজেগোবরে অবস্থা বিরাজ করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দীর্ঘ সংগ্রাম, অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেশটির অভ্যুদয় ঘটলেও দুর্ভাগ্যক্রমে এখনো আমাদের দেশে একক কোনো শিক্ষাব্যবস্থা নেই; বরং বহুবিভক্ত আমাদের শিক্ষাজগৎ। যে যার মতো চালাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম; জাতি হিসেবে ব্যর্থতার এই গ্লানি আমাদের সবার। শিক্ষা ব্যবস্থার বিভাজন আর পরস্পর বৈপরীত্যের কারণে জাতি হিসেবেও আমরা বিভক্তি আর অনৈক্যের বেড়াজালে আটকে রয়েছি। সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম আর মাদ্রাসাশিক্ষা—মোটা দাগে এই তিন ভাগে গোটা দেশের শিক্ষা কার্যক্রম চললেও এই তিন ধারার মধ্যে রয়েছে আরও বহু উপধারা।
মাদ্রাসাশিক্ষার মধ্যে রয়েছে সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কওমি মাদ্রাসা। আবার রয়েছে অসংখ্য নুরানি মক্তব, ফোরকানিয়া, কারিয়ানা আর হাফেজি মাদ্রাসা। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার অনাকাঙ্ক্ষিত বহুধাবিভক্তিই বিদ্যমান অচলাবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ।
বর্তমানে সারা দেশে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা ৯ হাজার ২৯৪টি। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ২০ লাখ ৪০ হাজারের বেশি। এ ছাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা আছে ৪ হাজার ৩১২টি। এগুলোতে শিক্ষার্থী প্রায় সাত লাখ। এ ছাড়া সারা দেশে কওমি মাদ্রাসা আছে ১৪ হাজারের মতো। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। আলিয়া মাদ্রাসায় আরবি বিষয়ের পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষার কিছু সাধারণ বিষয় পড়ানো হয়। বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তবে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সেই সুযোগ নেই। তাদের সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে সাম্প্রতিক সময়ে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও নিচের স্তর স্বীকৃতির বাইরে।
১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮ সালে) অনুমোদনক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার নতুন ধারা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৪ সালের পরবর্তীকালে। আর উপমহাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ সালে। এতে প্রতীয়মান হয় যে উপমহাদেশে সাধারণ শিক্ষা ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষা, তথা কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই আলিয়া নেসাবের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তাই গোটা ভারতবর্ষে আলিয়া মাদ্রাসা নেসাবের শিক্ষাব্যবস্থাটিই এতদঞ্চলের প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর ধারার সর্বপ্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা। সময়ের ব্যবধানে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে (১৯৪৯-৭০ খ্রি.) আলিয়া মাদ্রাসা ধারার এ শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একাধিক শিক্ষা কমিটি ও কমিশন গঠন করা হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আলিয়া মাদ্রাসা সিলেবাসে যেমন যুগোপযোগী হয়ে নানা বিষয়ের সংযোজন হয়েছে, তেমনি একটি গোষ্ঠী চতুরতার সঙ্গে বিতর্কিত ও অনুদার বিষয়াবলি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সরকারনিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসার কারিকুলাম ও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনুসন্ধিৎসু মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের পর্যালোচনায় যে ফলাফল এসেছে, তাতে প্রতীয়মান হয় যে মাদ্রাসা বোর্ডের প্রণীত শিক্ষাক্রম কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সহনশীল হওয়ার পরিবর্তে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উগ্রবাদী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মুিক্তযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসবোধের ঘাটতিসম্পন্ন লোকজন মাদ্রাসাশিক্ষাব্যবস্থায় কৌশলে তাদের প্রভাববলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। দাখিল শ্রেণি থেকে শুরু করে আলিয়া মাদ্রাসার উচ্চতর শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস বোর্ড কর্তৃক প্রণীত হলেও এসব বই তারা নিজেরা প্রকাশ করে না, এগুলো প্রকাশ করে থাকে বাইরের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। দেশে আলিম থেকে শুরু করে উচ্চতর শ্রেণির বইপুস্তক যারা প্রকাশ করে, তাদের অধিকাংশই ধর্মবিশ্বাসের রক্ষণশীল অংশের প্রতিনিধি; মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক সিলেবাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে সরকারের নিয়োগ করা ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিসহ প্রচুর কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, অথচ এ বিষয়গুলো নিয়ে কেন তাঁদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না, সেটিও আমাদের বোধগম্য নয়।
আলিয়া মাদ্রাসার কারিকুলাম ও সিলেবাস পর্যালোচনা এবং পাঠ্যপুস্তকের বিচার-বিশ্লেষণ করে যেসব চিত্র পাওয়া গেছে, তা সত্যিই হতাশা ও উদ্বেগজনক। যাঁরা মাদ্রাসাশিক্ষার শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা হয়তো অপরাপর মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশের কারিকুলাম বা সিলেবাস পর্যালোচনা করেননি অথবা আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন মনে করেননি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হলেও এ ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কোনো প্রভাব পড়েনি। এমনকি কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়াবলি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশের প্রাজ্ঞ আলেম সমাজের কাছেও এ সিলেবাস কখনো স্বীকৃতি পায়নি।
আলিয়া মাদ্রাসা সিলেবাসের প্রতি আমাদের অতিগুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণগুলোর মধ্যে মাদ্রাসা সিলেবাসভুক্ত বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং সেসবের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত পরিচিতি, ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কাজে লাগানো, মাদ্রাসা সিলেবাসের ত্রুটি ও অপূর্ণতার নানা দিক, মাদ্রাসা কারিকুলামের বইগুলোকে নিজস্ব দর্শন ও রাজনৈতিক কার্যসূচি বাস্তবায়নের মুখপত্র বানানো, বিভিন্ন বইয়ে তথ্যগত ভুল-বিভ্রান্তি ও অসংগতি, রচয়িতাদের যোগ্যতা-দক্ষতা ও আদর্শিক পরিচয়, বইয়ের মানগত অবস্থার অবক্ষয়, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর অপব্যাখ্যা প্রদানসহ বহু ক্ষেত্র চিহ্নিত করা যায়।
এসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার পাশাপাশি আমরা কিছু সুচিন্তিত মতামত ও সুপারিশ পেশ করছি—বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটি গঠন, লেখক নির্বাচন কমিটি গঠন, সম্পাদক ও সম্পাদনা পরিষদ নির্বাচন কমিটি গঠন, পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটি গঠন, শিক্ষা কার্যক্রমে সত্যিকারের ইসলামিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের অন্তর্ভুক্ত, বিতর্কিত বইগুলো বাজার থেকে প্রত্যাহার করা, বাজারে প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকের সহায়ক বইগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও উপযোগিতা যাচাই-বাছাই করার জন্য নিরপেক্ষ কমিটি গঠন, আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন, মাদ্রাসা বোর্ডের নিজস্ব বইগুলোর ত্রুটি এবং দর্শন ও আদর্শগত বিভ্রান্তি অবিলম্বে সংশোধন ও সর্বোপরি এসব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের সজাগ দৃষ্টি প্রদান এবং পাঠ্যপুস্তক–সংক্রান্ত বিষয়গুলোর উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহির আওতায় আনার সুপারিশ উল্লেখযোগ্য। আর এসব আবশ্যকীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে প্রথম যা প্রয়োজন, তা হলো ইসলাম ও আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন যোগ্য শিক্ষাবিদদের মাদ্রাসা বোর্ডের দায়িত্বশীল বিভিন্ন পদে নিয়োগদান, যাঁদের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় জরাগ্রস্ত এ শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে প্রকৃত জ্ঞানের আলো বিকিরণ করতে পারবে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।