মাছের স্রোতে বাংলাদেশ
মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ দারুণ সাফল্য অর্জন করেছে। এ বছর ৪২ লাখ ৭৬ হাজার টন মাছ উৎপাদন করে মাছে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছি আমরা। এখন মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬২ গ্রাম, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এ সাফল্য অর্জনের পেছনে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের ভূমিকারও প্রশংসা প্রাপ্য। তারা চাকরির জন্য না দৌড়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের হ্যাচারি ও খামার গড়ে তুলেছে, নিজে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং অনেকের চাকরির সংস্থান করেছে। সেই সঙ্গে নানা জাতের মাছের চাষ করে দেশকে মাছে স্বনির্ভর করেছে। জেলেদের অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে। তাঁরা কষ্ট সহ্য করে সরকারঘোষিত জাটকা সংরক্ষণ, মা ইলিশ রক্ষা এবং সাগরে নিষিদ্ধ সময়ে মাছ না ধরে নদ-নদী ও সাগরের মাছের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করেছে। শুধু ইলিশ সম্পদ বৃদ্ধির কারণেই আজ অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান তৃতীয়। কয়েক বছর আগেও এ ছিল অকল্পনীয়।
বর্তমানে চাষ থেকে ২৪ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৬ শতাংশ। চাষের মাছের মধ্যে কার্পজাতীয় মাছ, মানে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প ও গ্রাস কার্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। এর পরই বলা যেতে পারে বিদেশি পাঙাশ ও তেলাপিয়ার অবস্থান। নিবিড় ও উন্নত নিবিড় পদ্ধতিতে এ দুটো মাছের চাষের ফলে মাছের উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। এর বাইরে ভোজনরসিক বাঙালির প্রিয় মাছ শিং, মাগুর, কই ও পাবদার চাষেও ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আরও একটি বিষয় না বললেই নয়। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য মলা মাছ এখন কার্পের সঙ্গে পুকুরে এবং এককভাবে ধানখেতসংলগ্ন বা বসতবাড়ির লাগোয়া পুকুরে চাষ হচ্ছে। বাজারেও প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, হ্যাচারিমালিক ও মৎস্যচাষিরা নতুন নতুন মাছের প্রজনন ঘটিয়ে সেগুলো চাষের আওতায় আনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মৎস্য অধিদপ্তর এরই মধ্যে চীন থেকে উন্নত কার্পের পোনা এনে চাষিদের দেওয়ার জন্য লালন-পালন করছে। মাছ চাষ পদ্ধতিতে নানা উন্নতি হচ্ছে। পুকুর ও খাঁচায় চাষ ছাড়াও আরএএস, আইপিআরএস ও বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু হয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের লোনা পানির টাইগার চিংড়ি ও গলদা চিংড়ি উৎপাদনের প্রযুক্তি বহু পুরোনো। প্রায় তিন দশক ধরে এর চাষবাস চললেও সাফল্যের ইতিহাস নিরঙ্কুশ নয়। টাইগার চিংড়ির রোগবালাই এবং প্রতি একরে উৎপাদন অল্প হওয়ায় আজও বড় ধরনের আশার স্বপ্ন আমরা দেখাতে পারিনি। তবে সম্প্রতি পরীক্ষামূলক এসপিএফ পোনা মজুত ও ক্লাস্টার পদ্ধতির চাষ কিছু আশার সঞ্চার করেছে। একসময় ঘের পদ্ধতিতে সমন্বিত গলদা চিংড়ির চাষে সারা পৃথিবীতে আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু হ্যাচারির পোনা উৎপাদনে ব্যাপক মৃত্যুহার আমাদের সাফল্য ও টেকসই প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গলদা চিংড়ি হ্যাচারির মালিক ও চাষিদেরও হতাশ করেছে। উপকূলীয় এলাকায় কাঁকড়া চাষে সাফল্য দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন না করায় সুন্দরবনের নদ-নদী থেকে আহৃত পোনার ওপর কাঁকড়া চাষ নির্ভরশীল। এটি জীববৈচিত্র্যের সাংঘাতিক হুমকি। তবে বাংলাদেশের কাঁকড়ার স্বাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হোটেলগুলোতে কাঁকড়াভোজীদের দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
হাওর-বাঁওড়, বিল, প্লাবনভূমি ও নদ-নদী থেকে আহৃত মাছের হিসাবে আমাদের দেশ চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় অবস্থানে। এ এক অনন্য সাফল্য। এটি সম্ভব হয়েছে নদ-নদীতে সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তভিত্তিক ইলিশ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের ফলে। মোট অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে শুধু ইলিশ মাছ পাঁচ লাখ টনের বেশি উৎপাদন করার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। এ প্রচেষ্টা চলতে থাকলে এবং নদীর পানিপ্রবাহ সচল রাখতে পারলে ইলিশের উৎপাদন সাত লাখ টন পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ধারণা করা যায়। ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম জোরদার করায় নদীর পাঙাশের উৎপাদনও ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছে। এ ছাড়া হাওর ও বিলগুলো শনাক্ত করে সুফলভোগীদের সম্পৃক্ত করে সঠিক ব্যবস্থাপনা করা গেলে এর উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুিদ্রক সম্পদের ওপর আমাদের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের বর্তমান উৎপাদন দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের মধ্যে আমরা মাত্র ২৫-৩০টি মাছ ও চিংড়ি–কাঁকড়া বাণিজ্যিকভাবে আহরণ করে থাকি। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা অপ্রচলিত অমেরুদণ্ডী প্রজাতি, যেমন অক্টোপাস, সেপিয়া, লোলিগো ও শামুক আহরণ করে লাভবান হতে পারি।
সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের কার্পজাতীয় মাছের কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন আরও বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ফিশ একটি প্রকল্পের মাধ্যমে রুই জাতের মাছের উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে ৩০ শতাংশ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। তেলাপিয়া ও পাঙাশের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য কম মূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন খাবারের সংস্থান করতে হবে। দেশি ছোট মাছগুলো প্রকৃতিতে রক্ষা করা এবং চাষযোগ্য মাছগুলোর পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে চাষের আওতায় আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আগামী পাঁচ বছরে অন্তত পাঁচটি সামুদ্রিক মাছের প্রজনন করে বাণিজ্যিকভাবে পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সামুদ্রিক মাছের সুষ্ঠু প্রজনন ও সংরক্ষণের জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন সমুদ্রে সব ধরনের মাছ ও চিংড়ি ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে ইলিশসহ সাগরের মাছের উৎপাদন বাড়লেও জেলে সম্প্রদায় ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিষিদ্ধ সময়ের শুরু ও পরিব্যাপ্তি কিছুটা সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। আরও বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সময়কালটি নিখুঁতভাবে নির্ণয় করে তা বাস্তবায়ন করলে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে ব্যাপক সফলতার সম্ভাবনা আছে।
স্বাস্থ্যসম্মত মাছ ও মৎস্যদ্রব্যাদি, যেমন শুঁটকি, কাঁটামুক্ত ইলিশ, মাছের পাউডার ও ক্যানজাতীয় মৎস্যদ্রব্য উৎপাদনেও এখনই নজর দেওয়া দরকার। দেশীয় প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত মৎস্যসম্পদ বিদেশের বাজারে সুনামের সঙ্গে বিপণন করার সুযোগও আমাদের হাতে এসেছে। তার যথাযথ সদ্ব্যবহার আমাদের করতে হবে।
মো. আব্দুল ওহাব বাংলাদেশ কৃিষ িবশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক