মঞ্চ আমার কাছে পবিত্র জায়গা
আমার জন্ম লন্ডনেই। বাবা-মা তার আগেই ঢাকা থেকে লন্ডনে এসেছিলেন। আমি মেধাবী ছিলাম না কখনোই। দস্যি ছিলাম, তবে বোকা টাইপের। পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ই আমার সম্বল। আমার চেয়ে কিন্তু আমার বোন মুর্শিদা তুখোড় প্রতিভাবান। নাচেও ছিল ভীষণ রকম ক্ষিপ্র আর সাবলীল। ছোটতেই বুঝেছিলাম আমি মেধাশূন্য। অন্যরা ১০ মিনিটে যা করতে পারে, সেখানে আমার লাগত ঘণ্টা। তবে আমার জিদ ছিল প্রবল। কোনো কিছু জয় করার ক্ষুধা ছিল ভেতরে, হার মানা স্বভাবে ছিল না।
অন্যরা সহজে সবকিছু পারছে, অথচ আমি কেন পারছি না—এটাই জিদ বাড়িয়ে দিত। আমার শরীর নাচের জন্য ঠিক উপযুক্ত না। নাচের জন্য নমনীয় শরীর দরকার। আমার ঠিক উল্টোটা ছিল। ওই জিদের কথা বললাম, ওটাই আমাকে টিকিয়ে দিল।
নাচে আমার অভিষেক রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের জাঙ্গল বুকের জনপ্রিয় মুগলি চরিত্রে। নাচের জন্য সহপাঠীরা সব সময় আমাকে নিয়ে ঠাট্টা–তামাশা করত। ওদের ভাষ্য ছিল, নাচ মেয়েদের বিষয়। আমি ছেলে হয়ে কেন নাচতে যাব! বন্ধুদের কাছে নাচে অর্জনের সর্বোচ্চ সীমা ছিল মাইকেল জ্যাকসন ডিসকো নাচ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতা।
পরিবারে আমার মা নৃত্য–অন্তঃপ্রাণ মানুষ। বাবার আগ্রহ ততটা ছিল না। তিন বছর বয়সে মায়ের কাছেই আমার নাচের হাতেখড়ি। পরবর্তী সময়ে ধ্রুপদি নাচের তালিম নিতে নৃত্যশিল্পী শ্রী প্রতাপ পাওয়ারের কাছে আমাকে পাঠানো হয়। আমার মায়ের নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন ও চেষ্টা দুটোই ছিল। তবে তাঁর পরিবার কখনো চায়নি তাদের মেয়ে নর্তকী হোক। খুব গোপনে মা নাচের চর্চা করেছেন। ভাইদের টিফিন বক্সে খাবার নেওয়ার বদলে নাচের ঝুমুর লুকিয়ে নিয়ে যেতেন। আমার মামারা মাকে নাচ শিখতে সাহায্য করেছেন, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মাকে নাচের ঝুমুর কিনে দিয়েছিলেন! মায়ের কাছেই বাংলাদেশের লোকনৃত্য শিখেছি, উপজাতীয় নাচও। মা তাঁর সবটা উজাড় করে শিখিয়েছেন আমাকে। বয়স তখন আমার ছয়, বড়জোর সাত। যেখানেই যাই, সবাই নাচ দেখতে চাইত। আমিও মনের আনন্দে নাচতাম। শুরুটা এভাবেই।
ছেলেবেলায় আমার বন্ধুবান্ধব খুব একটা ছিল না। স্কুলে সব সময় নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা ছিল। জড়তা কেটেছে বিভিন্ন সময়ে সবার সামনে নাচতে গিয়েই। মাইকেল জ্যাকসন থ্রিলার বদলে দিয়েছে আমাকে। স্কুলের নাচের প্রতিযোগিতায় বন্ধুরা আমাকে খুব জোর করে ধরল নাচে অংশ নিতে। আমি তখন মাইকেল জ্যাকসনের সব মুদ্রাই অবিকল নকল করতে পারতাম। আমার পরিবেশনায় সবাই হতবাক! স্কুলে তো ছোটখাটো তারকাই বনে গেলাম সে সময়ে।
একটা সময় মায়ের ইচ্ছায় ও তাগাদায় কত্থক শিখতে হয়েছে। নৃত্যের উন্মাদনা আমাকেও পেয়ে বসে। তখন আমরা বাবার রেস্তোরাঁর ওপরের তলাতেই থাকতাম। আমার নাচের অনুশীলনের শব্দে রেস্তোরাঁয় যাঁরা খেতে আসতেন, তাঁরা বিরক্ত হতেন। শেষ পর্যন্ত বাবা আমার জন্য ফ্লোর বদলে দিয়েছিলেন। পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিল না। অবাক হতাম, যখন নাচ শুরু করতাম এক নিমেষেই মিশে যেতাম, একটা সময় নাচই আমার প্রাণ হয়ে গেল।
স্কুল ফাঁকি দিয়ে পুরো সময়টাই একা নাচের অনুশীলনে কাটিয়েছি। স্কুলের পোশাক আমার ব্যাগেই থাকত। মা–বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে আমি পেছনের উঠানে প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টা করে অনুশীলন করতাম। স্কুল ফাঁকি দিয়ে এভাবে এক বছর নাচ করেছি। কী করব, নাচতেই যে আমার ভালো লাগত! ধরা পড়ে যাই যখন স্কুল থেকে নালিশ আসে।
খ্যাতনামা নির্দেশক পিটার ব্রুকসের আন্তর্জাতিক থিয়েটার দলে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যাই একসময়। কৈশোরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামী নাট্যকর্মীদের সঙ্গে কাজ করেছি। দলের সঙ্গে নানা দেশে ঘুরে বেড়ানো চলেছে প্রায় দুই বছর। পিটার ব্রুকসের মতো নির্দেশকের সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য বিশাল একটি সুযোগ। অনভিজ্ঞ কর্মী হিসেবে একমাত্র আমি পিটার ব্রুকসের মহাভারত–এ সুযোগ পেয়েছিলাম। পিটার ব্রুকস আমাকে একবার বলেছিলেন, আকরাম, তুমি কিছু জানো না বলেই তোমাকে দলে নিয়েছি। তাঁর সেই কথাটা আমাকে খুব অবাক করেছিল। তবে পরে বুঝেছি। তিনি নিজেই বলেছেন, চরিত্রের প্রয়োজনে আমি কাদামাটির মতো, তিনি যা চাইবেন আমার কাছ থেকে তা–ই আদায় করতে পারবেন।
টানা দুই বছর পর ট্যুর থেকে বাসায় ফিরে আর কিছুতেই মন বসে না। নিজেকে অনেক বড় শিল্পী ভেবে বসে আছি। কোনো কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছিল ট্যুরেই ভালো ছিলাম। ওই সময়টা এখনো আমি খুব মিস করি।
লেইস্টারের দ্য মনফ্রন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পারফর্মিং আর্টে স্নাতক হই এর মধ্যে। পরে লিডসের নর্দার্ন স্কুলে সমকালীন নাচ নিয়েও পড়লাম। জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তটা তখনই নিতে হয়। নেশা ও পেশা হিসেবে নাচকেই বেছে নিলাম। এমন সিদ্ধান্তে ঘাবড়ে গেলেন আমার বাবা-মা। খালি নাচ করে আমার জীবন চলবে কী করে! এদিকে আমার প্রবল আগ্রহ পারকাশনে। ভাবলাম, বড় পারকাশন শিল্পী হব। ভাবনায় পরিবর্তন ঘটল। হতে চাইলাম তবলার বাদক। তাও হলো না। শেষমেশ মন চাইল পেশাদার নৃত্যশিল্পী হব। ধ্রুপদি নাচের কঠোর নিয়মে আমার মন আর বাধা মানল না।
জন্ম বাংলাদেশে না হলেও দেশের কিংবা শিকড়ের প্রতি টান কম তা কিন্তু নয়। আমার পরিবার দেশের বাইরে থাকলেও বড় হয়েছি বাংলাদেশকে ভালোবাসার মধ্যেই। আমার ভালোবাসা, রাগ আর ক্ষোভের মাঝেই ব্যক্তিগত প্রথম প্রযোজনা দেশ
পড়াশোনার শেষের দিকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে পেশাদার নাচের জগৎ কেমন হতে পারে, এই বিষয়ে আমাদের ধারণা দিতে এলেন একজন শিক্ষক। তাঁর পাঠদান শেষ হলো। আচমকা আমাকেসহ আরও চারজনকে আলাদা করে নিয়ে তিনি জানালেন, আমাদের দিয়ে নাচ হবে না। পেশা হিসেবে নাচের কথা ভাবাও আমাদের জীবনে বড় ভুল হবে! ভাবুন একবার, পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে যখন ভাবছি পেশাদার নৃত্যশিল্পী হব, তখন নৃত্যজগতের এক বিশেষজ্ঞের এমন ধারণায় বড় ধাক্কা খেলাম।
তবে আমি তো দমার পাত্র ছিলাম না, এখানেও কাজ করল জিদ। বন্ধু ও নৃত্যশিল্পী ফারুক চৌধুরীকে নিয়ে নাচের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলাম। পৃথিবীর খ্যাতনামা প্রযোজকেরা জড়ো হয়েছেন লেইস্টারের মিলনায়তনে। নামীদামি শিল্পীদের পরিবেশনা দেখছেন সবাই। আমার পরিবেশনার সময় আয়োজকেরা এক রকম বলে–কয়ে তাদের আটকে রাখতে চাইলেন। নতুন নাম, কী আর হবে! বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি কাজটি করে দেখাই। পরিবেশনা শেষ করে আনমনা আমাকে হুঁশে আনে ফারুক। প্রযোজকেরা অভিভূত আমার পরিবেশনায়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ডুবে থাকি কাজের মাঝে, এ এক পরম সাধনা। নাচটাকে আমি অনেক বেশি আধ্যাত্মিকভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পাই। মঞ্চই যেন আমার কাছে প্রার্থনা ঘর, পবিত্র জায়গা। ২০০০ সালের আগস্টে যাত্রা শুরু করে আকরাম খান কোম্পানি।
গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক—বাংলাদেশে নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের গগনবিদারী আহ্বান। গণমানুষের স্বাধিকার, মুক্তিসংগ্রামের চাওয়া, মৃতজনকের মাতৃভূমি, পূর্বসূরির শিকড়ের খোঁজ আর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের মহাকাব্যিক রূপ নিয়েই আমার প্রথম একক পরিবেশনা দেশ যুক্তরাজ্যে সেরা নতুন নৃত্য প্রযোজনা হিসেবে জিতে নিয়েছে লরেন্স অলিভার পুরস্কার।
জন্ম বাংলাদেশে না হলেও দেশের কিংবা শিকড়ের প্রতি টান কম তা কিন্তু নয়। আমার পরিবার দেশের বাইরে থাকলেও বড় হয়েছি বাংলাদেশকে ভালোবাসার মধ্যেই। আমার ভালোবাসা, রাগ আর ক্ষোভের মাঝেই ব্যক্তিগত প্রথম প্রযোজনা দেশ।
অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক ড্যানি বয়েল আমার প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনা ভার্টিক্যাল রোডের প্রদর্শনী দেখেছিলেন। তার কিছুদিন পর অফিসে ফোন করে দেখা করতে চাইলেন। ২০১০ সালের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় আমাদের দেখা হয়; আলাপচারিতার শুরুতেই বললেন, অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফি করে দিতে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যকরণীয় শর্ত হলো আমাকেও নাচতে হবে। বিস্মিত হই, একটু ভেবেচিন্তে বলি পুরো অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফি করতে পারব না। তবে নিজের একক পরিবেশনায় অংশ নেব বলে তাঁকে নিশ্চিত করি। সেই সময়টায় আমি মূলত দেশ প্রযোজনা নিয়ে মহাব্যস্ত। হঠাৎ অনুশীলন করতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পাই, সবকিছুই অগোছালো হয়ে পড়ে। কোম্পানির অনেক পরিবেশনা বাতিল করে দিতে হয় সে সময়। আমার আত্মবিশ্বাস আর ডাক্তারদের নিরলস চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সে যাত্রায় উতরে যাই।
আকরাম খানের জন্ম লন্ডনে ১৯৭৪ সালের ২৯ জুলাই। খ্যাতিমান কোরিওগ্রাফার ও নৃত্যশিল্পী। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর নৃত্যশৈলী উপভোগ করেছেন বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক। নৃত্যে অবদানের জন্য ২০০৯ সালে ব্রিটেনের রানির দেওয়া মেম্বর অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (এমবিই) খেতাব পেয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান আকরাম খান কোম্পানির বিভিন্ন পরিবেশনা ব্যাপক আলোচিত।
সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: