বিজ্ঞানের দীর্ঘপথ
নিজের ‘সফলতা’ নিয়ে লেখা বড়ই কঠিন ব্যাপার। আর আমি এখনো এমন কিছু ‘সফলতা’ পেয়েছি বলে মনে করি না, যা লেখার দাবিদার। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটালাম এই ভেবে যে আমার লেখাতে নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু থাকবে। তাই তাদের জন্যই লিখছি।
১৯৯৩ সালের ২৩ এপ্রিল। সারা দিন আমি আর আমার বন্ধু জাফর ছোটাছুটি করছি। উদ্দেশ্য প্রফেসর সালামকে একনজর দেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমরা। আমাদেরই কার্জন হলে তাঁকে সম্মানসূচক পিএইচডি দেওয়া হলো—আর আমরা কাছে ঘেঁষতে পারলাম না। টিএসসির পেছনের গেট টপকে ঢুকে তাঁর সম্মানে আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজেও তাঁকে পেলাম না—তিনি এলেন না অসুস্থতার কারণে। ধানমন্ডিতে আয়োজিত বিকেলের অনুষ্ঠানেও নয়। শেষে শমসের আলী স্যারের বদান্যতায় অনেক রাতে তাঁর সঙ্গে আমরা অনেকে মিলে দেখা করতে পারলাম শেরাটনে। তাঁর সঙ্গে কথা হলো। আজও প্রতিটি কথা মনে আছে।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় স্থির করে ফেলেছিলাম পদার্থবিজ্ঞান পড়ব। নিউমার্কেটে তখন স্টিফেন হকিংয়ের ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম দেখেছি; আম্মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বইটি কিনেছিও। তারও আগে সিলেট গভ. পাইলট হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আইনস্টাইন বইটি কিনেছিলাম। তাতে দেশের খ্যাতনামা পাদার্থবিজ্ঞানীদের লেখা ছিল। বেশি কিছু বুঝিনি, তবে বিশেষ আপেক্ষিকতা থেকে সাধারণ আপেক্ষিকতা বিষয়টি কঠিন, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। নবম শ্রেণি থেকেই আমার বন্ধু তারেকের সঙ্গে আমার বিজ্ঞান নিয়ে অনেক আলোচনা হতো টিফিন পিরিয়ডে। আধুনিক বিজ্ঞানের কাউন্টার-ইনটুইটিভ বিষয়গুলো আমাদেরকে ভীষণভাবে নাড়া দিত। অল্প তথ্যের সঙ্গে লাগামহীন কল্পনার সংমিশ্রণে অদ্ভুত উত্তেজনা বোধ করতাম। সিলেটে আমি কিছু অসাধারণ শিক্ষক পেয়েছিলাম—বাংলা থেকে বিজ্ঞান—সব বিষয়েই।
আমি বড় হয়েছি শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে। আমার বাবা শামসুদ্দিন আহমেদ দেশের বেশ কয়েকটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অধ্যক্ষ ছিলেন দীর্ঘদিন। আমরা যখন ফরিদপুরে, তখন আমার মা কমর আরা সুলতানা ‘তারার মেলা’ স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন আর সেখানে শিশু শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে শুরু হয় আমার স্কুলজীবন। আমার মা (যিনি পরবর্তীকালে আইনজীবী হন) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী—সুবক্তা ও সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। একই সঙ্গে সবার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। আমার সব ভালো কাজেই তিনি ও আমার বাবা উৎসাহ–আগ্রহ দেখিয়েছেন বরাবর। আমার জন্মের আগে বাবা ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এমএস করতে যান। সেটিও আমাকে প্রভাবিত করেছে।
ফরিদপুরের পরে আমরা ছিলাম ঢাকায়। চতুর্থ থেকে সপ্তম শ্রেণি পড়েছি সেখানেই, তেজগাঁও গভ. হাইস্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার ছোট খালু জন্মদিনের উপহার হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু ও ফেলুদার বই দিয়েছিলেন। প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনি ও চরিত্র আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। আব্বা যখন সিলেটে বদলি হলেন, তখন মনে হলো আমার প্রফেসর শঙ্কুর মতো গবেষণা করার এই তো সুযোগ। সিলেটের গাছগাছড়া আর পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে বিজ্ঞানের অনেক বিস্ময় লুকিয়ে আছে, যা কিনা আমি আবিষ্কার করব। সেটা ঠিক হয়ে ওঠেনি, তবে আমি বেশ কিছু তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা করেছি—যেমন কী করে কোনো জ্বালানি ছাড়াই নিরন্তর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় ইত্যাদি। তখনো তাপগতিবিদ্যার সূত্র শিখিনি—যাদেরকে এগুলো ব্যাখ্যা করতাম, তারাও জানত না। তাই উৎসাহ আর উত্তেজনাতেই দিনগুলো কাটত। এর মধ্যে দাবা খেলার নেশা হলো। আব্বা-আম্মাও উৎসাহ দিতেন। ঢাকা থেকে আব্বা বেশ কিছু বিদেশি বইও নিয়ে এসেছিলেন। একবার ঢাকায় গিয়ে রানী হামিদের সঙ্গে খেলেও এসেছি। তাঁকে হারাতে পারিনি—তবে তাঁকে হারিয়েছিলেন এমন একজনকে সিলেটের এক টুর্নামেন্টে হারিয়েছিলাম। এখনো সিলেট আমার দুর্বলতা।
আমি এলাম ঢাকা কলেজে, আব্বা-আম্মা গেলেন টাঙ্গাইলে। আমার বড় বোন অনেক আগে থেকেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়ছে। ঢাকা কলেজে নর্থ হোস্টেলে আমি থাকতাম। তখন থেকেই ‘ঢাকা কলেজ আর আগের মতো নেই’ কথাটি শুনতাম। সেটা হয়তো বা সত্যি। তবে কিছু অসাধারণ শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন, আর ঢাকা কলেজের ছাত্ররাই একজন আরেকজনের চালিকাশক্তি—হোস্টেলের ছেলেদের জন্য যা আরও বেশি প্রযোজ্য ছিল। লুৎফুজ্জামান স্যার ছিলেন গণিতের সবচেয়ে নামকরা অধ্যাপক। তার কাছ থেকে অনেক জটিল অঙ্ক শিখেছি। মনে আছে, তিনি একবার কম্বিনেশনের একটি জটিল সমস্যা দিয়েছিলেন, যা আমরা হাতে গোনা কয়েকজন করতে পেরেছিলাম। পরীক্ষায় কী আসতে পারে না পারে তার চেয়েও আমার আগ্রহ বেশি ছিল এসব জটিল সমস্যার প্রতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম যথারীতি। এখানেও শুনলাম ‘পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ আর আগের মতো নেই’। তবে কিছু অসাধারণ শিক্ষক পেয়েছি বলে আমি মনে করি। তাঁদের থেকে কতটুকু নিতে পেরেছি তা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই লেখা আমি আইনস্টাইন বইটাতে পড়েছি আর অনেককে টেলিভিশনে দেখেছি বিশেষত মুহাম্মদ ইব্রাহীম স্যারকে। লেখাপড়া বেশ আনন্দের সঙ্গে চলছিল প্রথম থেকেই। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় একটি ছোট ঘটনা আমার ভবিষ্যতের জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
আমি ছিলাম খোরশেদ কবীর স্যার আর আমেনা বেগম ম্যাডামের ল্যাবে। দ্বিতীয় বর্ষের ল্যাবে একটি অসিলোস্কোপ ছিল, যার লাইনগুলো স্বাভাবিক অবস্থাতেও ভূমির সমান্তরাল হতো না। এভাবেই চলেছে কয়েক বছর। সবাই অন্য অসিলোস্কোপগুলোই বেশি ব্যবহার করে। হঠাৎ একদিন মনে হলো এটি পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের জন্য হচ্ছে। উত্তেজনায় অনেক সকালে হাজির হলাম ডিপার্টমেন্টে। দেখলাম ব্যাপারটা ঠিক। বিকেলে ল্যাব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্যার ও ম্যাডামকে বললাম। তাঁরা খুবই আশ্চর্য ও খুশি হলেন। কবীর স্যারই কিছুদিন পরে বললেন, আমি কেমব্রিজে চেষ্টা করতে পারি—সেখান থেকে আমাদের অগ্রজ সাজ্জাদ নাসির (এখন নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে) ভাইয়ের চিঠিও পড়ালেন (তখন ই-মেইল শুরু হয়নি)। অতি উৎসাহের সঙ্গে পড়তে লাগলাম।
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, পদার্থবিদ্যা নিয়ে চিন্তা, আর সেই সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের নতুন নতুন বই নিয়ে অদ্ভুত স্বপ্নিল সময় তখন। একবার হুমায়ূন আহমেদের নিষাদ উপন্যাসের একটি ত্রুটি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমার রসায়নের ল্যাবেও ছিলেন—কিন্তু দেখেছি একদিন, আর তা নিয়েই আমাদের সে কী গর্ব। এ সময় বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে অনেক উৎসাহ পেয়েছি। এখন বুঝি আমাদের আমাদের দেশের মানুষের মন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থাতেই কেমব্রিজে আবেদন করলাম এই বলে যে যাওয়ার আগে আমার স্নাতক (সম্মান) শেষ হয়ে যাবে। বেশি আশা করিনি—ভাবছিলাম পরের বছর আবারও চেষ্টা করা যাবে। বিস্ময়করভাবে মাস্টার্সের ভর্তি ও বৃত্তি হয়ে গেল। আমাদের আগের ব্যাচের তীব্র আলী ও নূরুল হুদা ভাইয়েরও হলো। গোলযোগ বাধল আমার পা ভেঙে গিয়ে। সবাই হাল ছেড়ে দিল আমার আর যাওয়া হবে না—তবে আব্বা–আম্মা সঠিক সার্জন বের করে দেড় মাসের মধ্যে আমাকে সুস্থ করে তোলার ব্যবস্থা করলেন। হাতে একটা ক্র্যাচ নিয়ে অক্টোবর মাসের প্রথমে আমরা তিনজন প্লেনে চেপে বসলাম। তীব্র ভাই এখন কানাডার পেরিমিটার ইনস্টিটিউটে আর নূরুল হুদা ভাই ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট আরলিংটনে।
এত অল্প পরিসরে কেমব্রিজ নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। কেমব্রিজ আমার জীবনের এক বড় আনন্দ-বেদনার অধ্যায়। ফলিত গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সবচেয়ে নামকরা অধ্যাপকের নাম আগেই বলেছি—স্টিফেন হকিং। প্রফেসর সালামও এখানে ছিলেন ছাত্র ও অধ্যাপক হিসেবে কিছুদিন। আমাদের সবার প্রিয় প্রয়াত অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম স্যারও এ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক আহমদ শফি স্যার ও সুলতানা শফি ম্যাডাম কেমব্রিজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। মাস্টার্স শেষ করে হকিংয়ের গ্রুপেই সুযোগ পাই পিএইচডি করার। আমার সুপারভাইজর ছিলেন পিটার ডি’আথ—তিনি নিজেও হকিংয়ের ছাত্র ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করলেও তিনি সে সময় প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন যে ‘সুপারগ্র্যাভিটি’ (যা থিওরি অব রিলেটিভিটির এক সম্প্রসারিত রূপ)—‘সসীম’। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বইও বের করলেন, যাতে কিছু যুক্তি তিনি উপস্থাপন করেন। এই ফলাফলের অর্থ হবে স্ট্রিং থিওরি, যা সুপারগ্র্যাভিটির পরে এসেছে—তার কোনো দরকার নেই—সুপারগ্র্যাভিটিই ‘থিওরি অব এভরিথিং’। হকিংসহ অনেকেই তা একসময় ভেবেছেন কিন্তু সসীমত্ব প্রমাণ না করতে পেরে সবাই প্রায় স্ট্রিং থিওরির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
যাই হোক, প্রত্যেক পিএইচডি ছাত্রদের এক বছর পরে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। আমার কমিটিতে হকিং নিজে। তিনি সময় দিতে না পারায় দেরিতে হলো মিটিং। হকিং সাফ বলে দিলেন, পিটার ডি’আথ ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না সুপারগ্র্যাভিটি সসীম। বললেন আমাকে নতুন প্রকল্পে কাজ করতে। হকিং ডি’আথের কাজের উৎসাহদাতা ছিলেন, ধীরে ধীরে তিনি যে মত বদলেছেন তা বোঝা যায়নি। এক মাসের মধ্যে নতুন প্রকল্প তৈরি করলাম আমরা, যা সসীমতার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। তা গৃহীত হলো কিন্তু ডি’আথ ভীষণভাবে মুষড়ে পড়লেন। সে সময় থেকে পরের পুরো বছরই তার দেখা পেলাম না বলা যায়। এর মধ্যে বিয়ে করলাম। আমার স্ত্রীও বৃত্তি পেলেন ফলিত পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি করার জন্য। আমার সাফল্যে আমার স্ত্রী আমেনা খানের ভূমিকা অপরিসীম।
যাই হোক, আমার পিএইচডির নতুন কাজ বলা যায় শুরু হলো চতুর্থ বছরে। এর মধ্যে আমি অনেক দিকে নিজে নিজে পড়ালেখা চালিয়েছি। কাজ দ্রুত এগোতে লাগল কোয়ান্টাম বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব আর ব্ল্যাকহোলের কোয়ান্টাম আচরণের ওপর। আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও তাত্ত্বিকভাবে এরা একটি অপরটির সঙ্গে জড়িত। এ বছরই আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি লাগে। আগস্ট মাসে আমার মা হঠাৎ মারা যান। খবর যখন পাই, তখন আমি আমার বিভাগে নিজ অফিসে। অদ্ভুতভাবে সেদিন সেখানে আমার দুই সতীর্থ মাহবুব (গণিত অলিম্পিয়াডের ড. মাহবুব মজুমদার) আর মো. আমিরুল ইসলাম খান (বর্তমানে লিডস ইউনিভার্সিটিতে) উপস্থিত ছিল।
পিএইচডির শেষের দিকে সুপারভাইজার বদল করে গ্যারি গিবনসকে পাই। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটিতে তাঁর নামের জুড়ি নেই। এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমি নিজের উদ্যোগেই একটি নিবন্ধ লিখে ফেলেছি।
২০০৩ সালে পিএইচডি শেষ করি। এর মধ্যে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের সুযোগ পাই পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অভয় আস্তেকারের গ্রুপে। তারা বলা যায় কেমব্রিজের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ—কিন্তু এ প্রতিযোগিতা শ্রদ্ধাপূর্ণ। ‘আস্তেকার ভ্যারিয়েবলের’ প্রবক্তা অভয় আস্তেকার লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির স্রষ্টাদের একজন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী সুপারগ্র্যাভিটি অপ্রয়োজনীয়। প্রায় ১৫ বছর ধরে বিবাদ চলে আসছে। সমস্যা হলো, এসব তত্ত্ব আংশিকভাবে সফল—অন্তত সঠিক কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্ব থেকে যা পাওয়া দরকার, তার সব কটিই কোনো না কোনোভাবে এগুলো থেকেই পাওয়া যায়। যাই হোক, অভয় আস্তেকার আমাকে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করতে বাধা দেননি। আজও সত্যি বলতে আমি লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি পছন্দ করতে পারিনি। বিনয়ের সঙ্গে বলছি, আমার কাছে তত্ত্বটিকে সুন্দর মনে হয় না। সে তুলনায় স্ট্রিং তত্ত্ব বা সুপারগ্র্যাভিটি অনেক সুন্দর। সুন্দর হলেই যে সেসব সঠিক তত্ত্ব হবে তা নয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের সৌন্দর্যবোধও কিছুটা আপেক্ষিক বিষয়, তা নিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস।
এখানে থাকা অবস্থায় কানাডার পিমস ফেলোশিপ পাই ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টার গণিত বিভাগে কাজ করার জন্য। পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যে আমার স্ত্রীও পদার্থবিদ্যা বিভাগে পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ পান। এ সময় আমি এরিক উলগারের সঙ্গে সাধারণ আপেক্ষিতা আর রিচি ফ্লো—যা গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ, তার যোগসূত্র তৈরি করি। রিচি ফ্লো সমীকরণই গ্রেগরি পেরেলম্যান ব্যবহার করেছেন বহুদিনের আটকে থাকা একটি গাণিতিক অনুমান (পাঁয়নকারে কনজেকচার) প্রমাণ করার জন্য। আমার কাজ ধীরে ধীরে আরও গণিতমুখী হতে লাগল। এ সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রথম পূর্ণাঙ্গভাবে পড়াতে শুরু করি। কেমব্রিজে আমার সাধারণ আপেক্ষিকতার সুপারভিশন ক্লাস বেশ সফল হয়েছিল—সে ক্লাস পড়াতেন জন স্টুয়ার্ট—তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্য ছেড়ে প্রশংসা করেছিলেন। অনেক সময় অন্য ক্লাসের ছাত্রও আমার ক্লাসে চলে আসত। কানাডার তৃতীয় বছরে শুধুই পড়ালাম। এটি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আনন্দদায়ক বছর—আমার মেয়ের জন্ম হলো আমাদের বিয়ের আট বছর পর। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসে (ইউএনএসডব্লিউ) আরেকটি ফেলোশিপের অফার পেয়েছি। তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে—মেয়ের জন্মের কিছুদিনই পরেই সেখানে পাড়ি জমাই। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বলা যায় বাল্যকালের। আমার বড় মামা সেখানে যান আশির দশকের প্রথম দিকে। পরে ছোট মামাও যান। আমার আব্বা-আম্মা জীবনের এক কঠিন সময়ে সেখানে পাড়ি জমানোর কথা ভেবেছিলেন—যা শেষ পর্যন্ত হয়নি।
ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসে আমি ‘পিওর ম্যাথমেটিকস’ বিভাগে কাজ করি দুই বছরের বেশি। এ সময় লি গ্রুপস নিয়ে চিন্তাভাবনা করি আর ভাবি, সাধারণ আপেক্ষিকতা বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটিতে কীভাবে একে নতুনভাবে কাজে লাগানো যায়। আমার বর্তমানের কাজে এর প্রভাব লক্ষণীয়। এ সময় উচ্চতর টপোলজি ও ডিফারেনশিয়াল জিওমেট্রির ওপর কোর্স পড়ানোর সুযোগ আসে। সুযোগ লুফে নিই। কারণ জিনিসগুলো শেখা হবে। দুই বছর এই কোর্সটি পড়াই কিছু অসম্ভব ভালো ছাত্রছাত্রীকে। এর মধ্য থেকে প্রায় সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় গণিতে পিএইচডি করার জন্য, দুজন যায় অক্সফোর্ডে।
জানুয়ারি ২০১১ সালে আসি বর্তমান কর্মস্থল ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট ডালাসে (সংক্ষেপে ইউটিডি)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিতির বিশেষ প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের, বিশেষত বুয়েটের অনেক ছাত্রছাত্রী এখানে পড়ে। এ বছর ইউটিডির এক প্রাক্তন ছাত্র রসায়নে নোবেল পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ভিসা পেলাম শেষ মুহূর্তে, তড়িঘড়ি করে যাত্রা। আমার ক্লাসগুলো কয়েকজন সহকর্মী পড়াচ্ছিলেন। প্রথম ক্লাস নিলাম। পরের দিন বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা—অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। বললেন, ডিনের সঙ্গে দেখা করে যা কিছু চাওয়ার এখনই চাইতে। ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু শেষমেশ বললেন, কোন এক ছাত্র ডিন আর প্রোভস্টের (বাংলাদেশের ভাইস চ্যান্সেলরের মতো) কাছে ই–মেইল করে আমার ভূয়সী প্রশংসা করেছে। নতুন যাত্রা শুরু হলো।
আনন্দের মাধ্যমে পড়াতে লাগলাম পূর্ণোদ্যমে। ২০১৩ সালে ডিনের ‘টিচিং অ্যাওয়ার্ড’ পেলাম। পেলাম রিজেন্টস আউটস্ট্যান্ডিং টিচিং অ্যাওয়ার্ড। অস্টিনে গেলাম পুরস্কার নিতে স্ত্রী-কন্যাসহ সে বছরই। এই পুরস্কার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় ‘সিস্টেমের’ নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে যখন গণিত বিভাগে এসেছিলাম, তখন আমিই ছিলাম একমাত্র বাংলাদেশি। আজ গর্বের সঙ্গে আমরা আটজন—দুজন শিক্ষক (সহকর্মী ড. মো. কামরুল আহসান ও আমি), বাকিরা সবাই পিএইচডির শিক্ষার্থী। ২০১৫ সাল আরও গর্বের কারণ। কেননা আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়াতে প্রথম হয়েছে। আশা করি, এ সাফল্যকে আমরা আরও দূরে নিয়ে যেতে পারব।
পুরস্কারের সঙ্গে আসে দায়িত্ব। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সফল শিক্ষাদান’ কমিটির সদস্য করা হলো। গত বছর ছিলাম এর ভাইস চেয়ার। এই কমিটি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের শিক্ষাদান কী করে আরও কার্যকর করা যায়, তার বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তা করে।
যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাদানপদ্ধতি ও ছাত্রছাত্রীদের কী চাহিদা, তা বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। এমনকি স্কুল পর্যায়ে কী করে উন্নত শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব, তা নিয়ে সব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ই মাথা ঘামায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়েও স্কুলশিক্ষক (এখানে স্কুল বলতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বোঝায়) তৈরির কার্যক্রম চালু আছে। আমাকে সেই শিক্ষা বিভাগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য বানানো হয়েছে। টেক্সাস অঙ্গরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলশিক্ষা নিয়ে আমার কিছু ধারণা হয়েছে। কাজের মধ্যে আমার শ্রেষ্ঠ সময় ছাত্রছাত্রীদের সামনে যখন থাকি, সেই সময়টা। আমি জীবনে অনেক জ্ঞানী ও সফল শিক্ষক পেয়েছি ক্লাসরুমে, অনেক আনন্দে সময় কেটেছে ছাত্রাবস্থায়। আমি চাই, তারাও সেটা পাক। এর মধ্যে আমার একটি ছেলেও হয়েছে গত বছর, গবেষণার দায়িত্বও বেড়েছে অনেক গুণ।
কেমব্রিজে একজন বাংলাদেশি, যিনি কিনা বহু পূর্বে সিলেট থেকে এসেছিলেন—আমাকে কথাচ্ছলে বলেছিলেন, ‘আর আল্লায় যদি একবার ফছন করি লায়, তেতো অইসেউ’—অর্থাৎ আল্লাহ যদি একবার পছন্দ করে ফেলেন, তাহলে তো হলোই। আমি এখন সে পর্যায়ে যাইনি, যাকে নিয়ে এই মন্তব্য করা যায়। তবে জীবনে পেয়েছি অনেক আর তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
লেখক পরিচিতি
মো. মঈনুল আকবর পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছেন এখন গণিতের শিক্ষক। ঢাকা কলেজ উচ্চমাধ্যমিক শেষে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। সেখানে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের গবেষণা দলে। এরপর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা করে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট ডালাসে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির সেরা শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পেয়েছিলেন রিজেন্টস টিচিং অ্যাওয়ার্ড।
সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: