১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেল সুপার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে আমার আরাম-আয়েশের ব্যাপারে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। তিনি আমার সেলে এলেন এবং বিস্ময় প্রকাশ করলেন এই বলে যে এই কক্ষে কোনো হাতলওয়ালা চেয়ার এবং মেঝেতে কোনো কার্পেটও নেই বলে। তিনি আদেশ দিলেন অবিলম্বে তা সরবরাহ করতে। পার্শ্ববর্তী একটি সেল খুলে দেওয়া হলো। সেখানে সোফা সেট এল, যাতে আমি সেটা বসার কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। যখন আমার দুপুরের খাবার এল তখন আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, সেখানে বেশ খানিকটা শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। আমাকে ৯ মাস ধরে একটি টিনের বাটিতে ডাল ও নানরুটি দেওয়া হতো। আর এখন আমার খাবারের তালিকায় এল সবজি, মাংসের কারি, সঙ্গে ডাল এবং খাবার পরিবেশন করা হয়েছে চীনা মাটির পাত্রে। আমাকে বলা হলো, জেলের ডাক্তার আমাকে উন্নত মানের খাবার দিতে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন! জেল সুপার তখন আমাকে জেলচত্বর ঘুরে বন্দীদের বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনশীল কাজ পরিদর্শন করার আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে কারাবন্দীরা কার্পেট বোনা, কাঠমিস্ত্রির কাজ ও কারাচত্বরের দেখাশোনা করছিলেন।
তিনি আমাকে ব্যথিতচিত্তে বললেন, আমার মতো একজন রাজবন্দী সাধারণত বীর হিসেবে মুক্তি পান এবং উচ্চ রাজনৈতিক পদ লাভ করেন। জেল ছাড়ার আগে তাঁরা সাধারণত একটি গাছ রোপণ করে যান। তিনি অনুভব করলেন যে এমন একজনের মুক্তি আসন্ন, যিনি কোনো একটি রাজনৈতিক পদ লাভ করতে যাচ্ছেন। সে জন্য আমারও উচিত একটি বৃক্ষ রোপণ করা। আমাকে শ্রদ্ধা জানানোর এই সদিচ্ছা প্রকাশের জন্য আমি সন্তোষ প্রকাশ করি। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে তাঁর অনুরোধ ফিরিয়ে দিই। এর পরের সপ্তাহে জেল সুপার প্রায় প্রতিদিনই আমার ভালো-মন্দের খোঁজখবর নিতে এসেছেন। কিন্তু যখন আমি বাইরের বিশ্বের খবর জানতে চেয়েছি, তখন আমাকে বলা হলো, এ নিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর কথা বলার অনুমতি নেই। তিনি শুধু এটুকু বললেন, এখানে আমার থাকার মেয়াদ হয়তো আর প্রলম্বিত হবে না। এর প্রমাণ মিলল ২৮ ডিসেম্বরে এসে তিনি যখন বললেন, আমি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে পারি।
কারণ, তিনি আমাকে একটি ‘নতুন অবস্থানে স্থানান্তর’ করার আদেশ লাভ করেছেন। আমি আনন্দে উল্লসিত হলাম। কারণ প্রায় ৯ মাসের নির্জন বন্দিজীবনের অবসান হতে যাচ্ছে। কিন্তু এরপর আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে, সেই ভাবনাগত দুশ্চিন্তাও আমাকে গ্রাস করল। রোমাঞ্চকর অল্প কয়েক ঘণ্টা কাটানোর পর আমাকে জেলগেটের কাছে জেল অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার অল্প কিছু টাকা কারাগারে প্রবেশের সময়বিধি অনুযায়ী আমাকে জেল সুপারের কাছে রেখে আসতে হয়েছিল। সেটা আমি ফেরত পেলাম। আমাকে প্রায় অর্ধডজন বই দেওয়া হলো, যা আমার পরিবার পাঠিয়েছিল, কিন্তু যা আমাকে কারাগারে থাকার সময় কখনো দেওয়া হয়নি। আমি একটি রেজিস্টারে সই করে আমার কিছু কাপড় আর কয়েকটা নোটবুক পেলাম।
এসবের প্রাপ্তিস্বীকার করলাম। এসব আনুষ্ঠানিকতা যখন সম্পন্ন হচ্ছিল, তখন সাদা পোশাকধারী দুজন দীর্ঘকায় মানুষ প্রবেশ করলেন। চুলের ছাঁট থেকে বোঝা গেল তাঁরা সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাঁরা আমাকে তাঁদের সঙ্গে জেলগেটের দিকে যেতে বললেন। আমি তাঁদের অনুসরণ করলাম। আমাকে একটি ভক্সওয়াগন গাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি গাড়ির পেছনের আসনে বসা দুজন প্রহরীর একজনের পাশে বসলাম। অপরজন বসলেন চালকের পাশের আসনে। অল্প দূরে আমি একটি সামরিক ট্রাকে অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের দেখতে পেলাম। তারা আমাদের অনুসরণ করল। আমাদের গাড়িটি আমার জন্য এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিল।
গাড়িটি যখন মহাসড়কে প্রবেশ করল, তখন আমি এটা যে রাওয়ালপিন্ডি-পেশোয়ার হাইওয়ে, সেটা চিনতে পারলাম। গাড়ি রাওয়ালপিন্ডির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলাম যখন দেখলাম এটাকে বাইপাস করা হলো। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে এবং আমার কাছে গন্তব্য তখনো অজ্ঞাত।
হাইওয়ে ছাড়িয়ে কিছুদূর চলে এসে গাড়িটি হঠাৎ মোড় নিল এবং আমরা পড়লাম একটি কাঁচা সড়কে। আমি আমার এসকর্টের দিকে ফিরলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমার প্রশ্নের মধ্যে শঙ্কা থাকায় তিনি বললেন, ‘আপনি তা পছন্দ করবেন।’ আর তখনই আমি লক্ষ করলাম যে সশস্ত্র জওয়ানরা মেশিনগান তাক করে গাড়িটি ঘিরে ফেলল। বিপদ আসন্ন ভেবে আমি নির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি। একটি ছোট বাংলোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা হলো এবং এসকর্ট বললেন, আমরা ওখানে যাচ্ছি। তিনি আবারও বললেন, ‘আপনি সেটা পছন্দ করবেন।’ সশস্ত্র প্রহরীরা গাড়িটির জন্য পথ করে দিল এবং সেটি বাংলোর দিকে এগিয়ে গেল। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে আমাকে বাংলোতে ঢুকতে বললেন। আমি প্রবেশ করামাত্রই তিনি এক সারি কক্ষ দেখিয়ে আমাকে ১ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করতে বললেন। আমি তা-ই করলাম এবং আবেগের আতিশয্যে আপ্লুত হলাম, যখন আমি দেখলাম সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আমাকে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন, তিনি আমার জন্য সারা দিন অপেক্ষা করে ছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন, কেন এত দীর্ঘ সময় লাগল। আমি তাঁকে বললাম, আমি নিজেকে বিকেলেই প্রস্তুত করেছিলাম; কিন্তু সন্ধ্যার আগে চূড়ান্তভাবে ছাড়া পাইনি। আর এখানে পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা লেগে গেছে। জানতে পারলাম আমাদের অবস্থান শিহালা পুলিশ একাডেমি চত্বর; রাওয়ালপিন্ডি থেকে দূরে নয়। বঙ্গবন্ধুকে এখানে আনা হয়েছিল দুই দিন আগে। তিনি বললেন যে মিয়ানওয়ালি জেল থেকে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ১৬ ডিসেম্বরের অব্যবহিত পরেই। সেদিন কারাগারে উত্তেজনা উত্তুঙ্গে পৌঁছেছিল। কারণ মিয়ানওয়ালি ছিল জেনারেল নিয়াজির নিজের শহর, যিনি ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অনুভব করেছিলেন, এই জেলে থাকা বঙ্গবন্ধুর জন্য নিরাপদ নয়। তিনি (পুলিশ কর্মকর্তা) তাঁর নিজের দায়িত্বে পুলিশ প্রহরায় তাঁকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে তখন এমন একটি স্থানে নিয়ে যান, যেখানে একটি বড় প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে এবং একাধিক বাংলো সেখানে খালি ছিল।
সেখানে বঙ্গবন্ধুকে কয়েক দিন কাটাতে হয়। এরপর একটি হেলিকপ্টারে করে ২৬ ডিসেম্বর তাঁকে শিহালায় নিয়ে আসা হয়। তিনি আমাকে জানালেন, তাঁর পৌঁছানোর পরপরই ভুট্টো তাঁর সঙ্গে বাংলোতে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁকেও ‘ডিটেনশনে’ রাখা হয়েছে কি না। ভুট্টো তখন তাঁকে বললেন, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কী করে প্রেসিডেন্ট হলেন, যেখানে জাতীয় পরিষদে আপনার চেয়ে দ্বিগুণ আসন আমি লাভ করেছি?’ ভুট্টো বিব্রত হয়ে উত্তর দিলেন যে বঙ্গবন্ধু চাইলে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘না। আমি তেমন আকাঙ্ক্ষা করি না। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরতে চাই।’ ভুট্টো তখন তাঁকে বললেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তিনি করবেন। তবে এ জন্য কয়েক দিন সময় দরকার। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন, কয়েক মাস আগে তাঁর বিচারকালে উপস্থিত আইনজীবীদের (মি. ব্রোহি এবং অন্যান্য) আলাপ-আলোচনা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কামাল হোসেনকেও নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং তিনিও বিচারের সম্মুখীন। বঙ্গবন্ধু তখন অনুরোধ করলেন যে আমাকেও শিহালায় নিয়ে যাওয়া হোক। আর এভাবেই হরিপুর থেকে আমার মুক্তি এবং শিহালায় আমাকে নিয়ে আসার বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হলো।
এর পরবর্তী কয়েক দিন কেটে গেল বাংলাদেশে যাওয়ার অনুরোধ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করাতে গিয়ে। এটা স্পষ্ট ছিল যে যেহেতু ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দী, সেটাই বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা এবং আশু প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা দেবে। তাই প্রশ্ন দাঁড়াল এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করার। আজিজ আহমেদ তখনো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করছিলেন; তিনি আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তিনি বললেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে ভুট্টো করাচিতে অনুষ্ঠেয় একটি জনসমাবেশে ঘোষণা দেবেন। তিনি বললেন, একটি পাকিস্তানি বিমানে আমাদের বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে তাঁরা আগ্রহী। কিন্তু পাকিস্তানি বিমান ভারতের ওপর দিয়ে উড়তে পারবে না। তাই তিনি সুপারিশ করলেন, আমাদের প্রথমে পাকিস্তানি উড়োজাহাজে করে একটি তৃতীয় দেশে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানে পৌঁছে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি তেহরানে নেওয়ার কথা বললেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে তেহরানকে বেছে নেওয়া সঠিক হবে না। কারণ, এর ফলে পাকিস্তানি প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং আমাদের উচিত হবে জেনেভা বা ভিয়েনার মতো কোনো নিরপেক্ষ স্থান বেছে নিতে রাজি করানো। আমি বিষয়টি আজিজ আহমেদকে বললাম; কিন্তু তিনি নেতিবাচক জবাব দিলেন। যখন আমি আরেকটি বিকল্প প্রস্তাব করতে তাঁকে চাপ দিচ্ছিলাম, তখন তিনি লন্ডনের নাম প্রস্তাব করলেন। আমরা এতে তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, রেডিওর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি সমর্থন সৃষ্টিতে লন্ডন ছিল একটি সক্রিয় কেন্দ্র। আমাদের বলা হলো, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে। এ জন্য ৭ জানুয়ারির রাত নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হলো। আমাদের অবহিত করা হলো যে ভুট্টো আমাদের চলে যাওয়ার আগে প্রেসিডেন্টের অতিথিশালায় একটি নৈশভোজের আয়োজন করতে চান। আমাদের শিহালা থেকে প্রেসিডেন্টের অতিথিশালা পর্যন্ত গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হবে এবং নৈশভোজের পরপরই আমরা উড়োজাহাজে আরোহণ করব। ভুট্টো এসে পৌঁছালেন এবং প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে তিনি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সংযোগসূত্র বজায় রাখার অনুরোধ জানালেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, ‘যা কিছু হয়েছে এবং যত রক্তপাত ঘটেছে, তা সবই এড়ানো সম্ভব ছিল যদি আপনি আমাদের কথা শুনতেন। এর পরিবর্তে আপনারা একটি নিষ্ঠুর সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করেছেন। এখন দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যতিরেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আর অন্য কোনো সম্পর্ক রাখার সম্ভাবনা আমি দেখি না।’ ভুট্টো এরপরও তাঁর অনুরোধ বিবেচনা করার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার পর তিনি এর একটি উত্তর দেবেন। ভুট্টো তখন একটি অপ্রত্যাশিত দাবি নিয়ে হাজির হলেন এই বলে যে বঙ্গবন্ধুর বিদায় আগামীকাল সকাল পর্যন্ত বিলম্বিত করা হোক। কারণ, ইরানের শাহ পাকিস্তানে আসবেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন যে এটা একটা চাপ সৃষ্টির কৌশল, যেটা তিনি ইতিমধ্যে তেহরান হয়ে বাংলাদেশে ফেরার প্রস্তাব নাকচের মাধ্যমে প্রতিহত করেছেন। এরপর আমাদের প্রস্থান বিলম্বিত করতে আরেকটি অজুহাত খাড়া করা হলো। বলা হলো যেহেতু একজন রাষ্ট্রপ্রধান সকালে আসছেন, তাই পাকিস্তানের আকাশসীমা পুরো রাত রুদ্ধ থাকবে।
বঙ্গবন্ধু ও আমি তখন পরামর্শ করলাম। আমি বললাম যে আকাশসীমা রুদ্ধ রাখার অর্থ এই নয় যে একটি গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং তা উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে না। এর অর্থ হচ্ছে সব ফ্লাইটকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অনুমতি লাভ করতে হবে। আর এই উদ্দেশ্যে ভুট্টো নির্দেশনা জারি করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু তখন ভুট্টোর দিকে ঘুরে তাকালেন এবং বললেন, ভুট্টোর উচিত হবে এটা নিশ্চিত করা, যেন সেই রাতেই তাঁদের বহনকারী বিমান ছাড়ার অনুমতি লাভ করতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করলেন, তিনি শাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান না। যদি আগের কর্মসূচি অনুযায়ী নৈশভোজের পর তাঁদের প্রস্থান না ঘটে, তাহলে যেন অবিলম্বে গতাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভুট্টোর কারণেই যে শেখ মুজিব বিরক্ত হচ্ছিলেন, তা ভুট্টো বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বললেন, নৈশভোজের পর যাতে আমাদের প্রস্থান নিশ্চিত হয়, সে জন্য করাচি থেকে একটি উড়োজাহাজ নিয়ে আসার নির্দেশ দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু এ কথা শুনে খুশি হলেন।
এ কথা শোনার পর আমি করাচি থেকে ওই একই উড়োজাহাজে যাতে আমার স্ত্রী ও সন্তান, যারা আমি জেলে থাকতে সেখানে অবস্থান করছিল, তাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে ভুট্টোকে বলতে বঙ্গবন্ধুকে দ্রুত অনুরোধ জানালাম। এটা ছিল অলৌকিক কিছু চাওয়ার মতো একটি ঘটনা। কিন্তু এটা ঘটল। কারণ, ভুট্টো তখন স্পষ্টতই বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ নাকচ করতে চাননি। ভুট্টো এ বিষয়ে করাচিতে টেলিফোন করে আমার পরিবারকে ফ্লাইটে তুলে দেওয়ার জন্য উপস্থিত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন। আমি হামিদার কাছ থেকে জেনেছি, তাদের করাচি বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার মাত্র এক ঘণ্টা আগে এ ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছিল। এর ফলে তারা সামান্য কিছু কাপড়চোপড় সঙ্গে আনতে পেরেছিল। তাদের এটা বলা হয়নি যে তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে তারা রাওয়ালপিন্ডি যাচ্ছে এবং উড়োজাহাজে ওঠার পরই কেবল তাদের বলা হয়েছিল তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য রাওয়ালপিন্ডি নয়, বরং সেখান থেকে তাদের অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে।
আমাদের গাড়িতে করে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হলো। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত ‘এসকর্ট’ করে আনলেন। আমি বিমানে প্রবেশ করতেই দেখি, আমার স্ত্রী হামিদা এবং আমার দুই কন্যা সারা ও ডিনা সেখানে বসে আছে। আমরা এই পুনর্মিলনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার মনে আছে, আমার চার বছর বয়সী অথচ বয়স্কদের মতো বুদ্ধিমতী কন্যা সারা জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে কি জেলে ছিলে?’ আমরা ভ্রমণের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছিলাম ৯ মাসে কী ঘটেছে, তা জানতে। কারণ এ সময়টা আমরা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম।
আমাদের অবহিত করা হয়েছিল যে লন্ডন পৌঁছানোর এক ঘণ্টা আগপর্যন্ত আমাদের বিমানভ্রমণ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দেওয়া হবে না। আমাদের বহনকারী বিমান যেসব দেশের ওপর দিয়ে যাতায়াত করবে, তাদের বলা হবে এটি ‘স্ট্র্যাটেজিক কার্গো’ বহনকারী একটি পাকিস্তানি বিমান। লন্ডনের কাছাকাছি এলে একটি বার্তা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। তাতে বলা হবে, সকাল প্রায় সাতটার দিকে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন।
>আমাদের প্রথমে পাকিস্তানি উড়োজাহাজে করে একটি তৃতীয় দেশে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানে পৌঁছে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি তেহরানে নেওয়ার কথা বললেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে তেহরানকে বেছে নেওয়া সঠিক হবে না। কারণ, এর ফলে পাকিস্তানি প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
আমাদের উড়োজাহাজ থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত যখন এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ভিআইপি লাউঞ্জের বাইরে কর্তব্যরত একজন ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য আমি কখনো ভুলতে পারব না। তিনি আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘স্যার, আমরা আপনাদের জন্য প্রার্থনা করেছিলাম।’ বিশ্বসম্প্রদায় আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামকে কীভাবে সমর্থন জুগিয়েছিল, সেটা আমরা এই মন্তব্য থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।
আমি ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশ করতেই একটি ঘোষণা শুনলাম যে ‘শেখ মুজিবুর রহমানের’ জন্য একটি টেলিফোন কল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোনটি ধরতে বললেন। ফোনটি করেছিলেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা আমি স্মরণ করতে পারি। পরে স্যার ইয়ান সাদারল্যান্ড মস্কোতে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি আমাকে বলেন, ব্রিটিশ সরকার আমাদের পৌঁছানোর খবর মাত্র এক ঘণ্টা আগে পেয়েছে। তবে তিনি দ্রুত বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তিনি একটি গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন এবং সেটা যেন দ্রুত বিমানবন্দরে পৌঁছায়, সে ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে বলেছেন। আমরা যেন তাঁর পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করি; যেহেতু তিনি লন্ডনে আমাদের নিরাপত্তার এবং থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বললেন আমরা কীভাবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। তিনি আমাকে বললেন, বিচারপতি চৌধুরী এর আগের দিন ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ মিশনের দায়িত্বে ছিলেন রেজাউল করিম, যিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সহায়তা করেছিলেন, তিনি আছেন। আমরা ফোন করার আগেই রেজাউল করিম ফোন করে জানতে চান, তিনি আমাদের আগমনের যে খবর পেয়েছেন, সেটা সত্য কি না। যখন আমি তাঁকে বললাম যে এটা সত্য, তখন তিনি তাঁর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি এবং বললেন, তিনি দ্রুত বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন।
আমরা যখন তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন লন্ডনে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার নাসিম আহমেদ, যিনি একজন সাবেক সাংবাদিক, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি এখানে আপনাকে স্বাগত জানাতে এসেছি। দয়া করে আমাকে বলুন, আমরা আপনার জন্য কী করতে পারি?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আপনারা যথেষ্ট করেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ।’
কিছুক্ষণের মধ্যে ইয়ান সাদারল্যান্ড এসে পৌঁছালেন এবং অবহিত করলেন যে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। তিনি বললেন, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা ক্লারিজেস হোটেলে করা হয়েছে; সেখানে সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানেরাই থাকেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন, কিন্তু বললেন তাঁর থাকার ব্যবস্থা রাসেল স্কয়ারে কোনো মধ্যম মানের হোটেলে করা সম্ভব হবে কি না, যেখানে তিনি তাঁর আগের লন্ডন সফরগুলোর সময় অবস্থান করেছিলেন। যেসব লোক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবে, তাদের জন্য সেটাই হবে সুবিধাজনক জায়গা। সাদারল্যান্ড উত্তরে বললেন, ‘স্যার, আমি আপনার জন্য এই একটিমাত্র বিষয়ের ব্যবস্থা করতে পারি না। কারণ, ক্লারিজেস হোটেলে রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তাব্যবস্থা বিবেচনা সাপেক্ষে আপনাকে দেখতে আসা লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা আমরা করে দেব।’
ইতিমধ্যে রেজাউল করিম এসে পৌঁছালেন এবং গাড়িতে আমাদের হোটেল পর্যন্ত সঙ্গী হলেন। যেতে যেতে তিনি গত ৯ মাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন। লন্ডন থেকে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে পরিচালিত কূটনৈতিক তৎপরতা, অন্যান্য বৈদেশিক কেন্দ্র এবং বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের সক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারলাম।
ক্লারিজেস হোটেলে পৌঁছাতেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন। তাঁরা আমাদের অবহিত করলেন যে ঢাকা থেকে একটি বিমান লন্ডনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কিন্তু লন্ডনে পৌঁছাতে সেই বিমানের অন্তত দুই দিন লাগবে। তাঁরা আমাদের আরও জানান যে ভারতের জনগণ, যাঁরা আমাদের প্রতি তাঁদের সংহতি ও সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমাদের ঢাকায় ফেরার পথে দিল্লি ও কলকাতায় সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি আশা করেন।
আমাদের আরও জানানো হলো যে হোটেলের সবচেয়ে বড় মিলনায়তনে একটি বিরাট সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হবে। বঙ্গবন্ধু আমাকে কিছু মৌলিক নির্দেশনা দিয়ে একটি বিবৃতির খসড়া তৈরি করতে বললেন। তিনি বললেন, তিনি সব রাষ্ট্র ও জনগণকে ধন্যবাদ জানাতে চান যারা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে। তিনি রাষ্ট্রগুলোর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেও আহ্বান জানাবেন। তিনি বললেন, যেসব সরকার পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, তিনি অবশ্যই তাদের ধন্যবাদ জানাবেন না। তবে তিনি সেই সব দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে একটি পার্থক্য টানতে চান। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, অনেক সাংবাদিক ও নাগরিকেরা আমাদের দৃঢ় সমর্থন দিয়েছিলেন। এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট জাহাজে ডকশ্রমিকেরা অস্ত্র তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
ওই দিন সকালবেলা বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসন এবং তারপরেই বিবিসির ডেভিড ফ্রস্ট দর্শনার্থীদের মিছিলের অগ্রবর্তী ছিলেন। বেগম আবু সাঈদ চৌধুরী ফোনে আমাদের অবহিত করেছিলেন যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ইতিমধ্যে ঢাকায় চলে গেছেন। জনাব এ কে খানও ছিলেন প্রথম দিকের দর্শনার্থীদের অন্যতম। আমাদের হাজার হাজার নাগরিক সমবেত হতে শুরু করল হোটেলের বাইরে। লন্ডনের ওই অঞ্চলে এমন ঘটনা আগে কখনো দেখা যায়নি। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা হোটেলের প্রবেশপথে নজরদারি করছিলেন; তাঁদের দরকার হচ্ছিল প্রত্যেক ব্যক্তিকে ঢুকতে দেওয়ার আগে তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত করা। আমাকে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছিল, যাতে আমি নিচে নেমে তাঁদের কয়েকজনকে শনাক্ত করি। আমাদের অবহিত করা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে তাঁর গ্রামের বাড়ি চ্যাকার্সে রয়েছেন। আশা করা হচ্ছিল, তিনি শিগগিরই লন্ডনে ফিরে আসবেন এবং ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাবেন।
প্রধানমন্ত্রী হিথ সন্ধ্যাবেলা আমাদের স্বাগত জানালেন। তিনি বললেন, ব্রিটিশ সরকার ও তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং নীতিগতভাবে তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি অভিন্ন ঘোষণা দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় চান। ব্রিটেন যে সমর্থন ব্যক্ত করেছে, সে জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, তিনি ব্রিটেনের দেওয়া সহযোগিতার প্রশংসা করেন। প্রকৃতপক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীরা লন্ডনকে বাংলাদেশের জন্য একটি কূটনৈতিক প্রচারণার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এবং তার মূল্য ছিল অসামান্য। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সমর্থন প্রদানের আশ্বাসের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান। যখন প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমরা কি আপনার জন্য আর কিছু করতে পারি?’ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হ্যাঁ। আমার প্রতি আর একটি আনুকূল্য দেখাতে পারেন, যদি আপনি অনুগ্রহ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে একটি বিমান ব্যবহার করতে দেন।’ মি. হিথের উত্তর ছিল ইতিবাচক। তিনি তাঁর সচিবের দিকে তাকালেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিলেন তাঁর (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর) বিমানটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব কি না দেখতে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সচিব ফিরে এলেন এবং জানালেন যে পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিমান প্রস্তুত থাকবে। এটা প্রচলিত রীতি যে প্রধানমন্ত্রীর বিমানকে আরেকটি রিলিফ বিমান অনুসরণ করে থাকে, যাতে পথে কোনো কারিগরি সমস্যা দেখা দিলে তা মোকাবিলা করা যায়। তাই সকাল সাতটার মধ্যে দুটি বিমান আমাদের বহনের জন্য প্রস্তুত থাকবে।
আমরা হোটেলে ফিরে এলাম এবং অনতিবিলম্বে আমাদের সফরসূচি চূড়ান্ত করতে শুরু করলাম। আমরা হিসাব করে বের করলাম যে ঢাকায় পৌঁছাতে আমাদের কতটা সময় লাগতে পারে। আমরা ঢাকায় দিনের আলো থাকতে পৌঁছাতে চাইছিলাম। হিসাব করে বের করা হলো যে বিকেল তিনটার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব, যদি আমরা কেবল ভারতে একটি যাত্রাবিরতি করি। তাই ঠিক হয়েছিল যে আমরা কেবল দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করতে পারি এবং কলকাতার জনগণের কাছে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হবে যে যেহেতু এবার কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর যাত্রাবিরতি করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হবে কলকাতা। এই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়েছিল; জানুয়ারির শেষে বঙ্গবন্ধু কলকাতা সফর করেছিলেন। ভ্রমণসূচি-সংক্রান্ত আরেকটি বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে প্রধানমন্ত্রীর বিমানের অবতরণের জন্য ন্যূনতম রানওয়ের দরকার, আর সেটা ঢাকার বিমানবন্দরে রয়েছে কি না। সেটা মেপে আমাদের তা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এভাবেই আমরা ৯ জানুয়ারি সকাল সাতটার মধ্যে লন্ডন ছেড়ে আসতে পেরেছিলাম। তবে ঢাকার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতির আগে আমাদের দুটি জায়গায় জ্বালানি সংগ্রহের জন্য থামতে হয়েছিল। এর একটি সাইপ্রাসের রাজকীয় বিমানবাহিনীর ঘাঁটি, অন্যটি শারজায়।
দিল্লি বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মন্ত্রিসভার সব সদস্য, পার্লামেন্টের সদস্য এবং অন্যান্য গণ্যমান্য নাগরিকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন। সেটা ছিল একটি আবেগাপ্লুত মুহূর্ত, কারণ বঙ্গবন্ধুকে আনন্দাশ্রুসহযোগে সেখানে স্বাগত জানানো হয়েছিল। চিফ অব প্রটোকলের দায়িত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত আইএনএ ক্যাপ্টেন মেহবুব আহমেদ খান। তিনি বলেছিলেন, এ ধরনের একটি অভূতপূর্ব আয়োজনে কূটনৈতিক ‘প্রটোকল’ রক্ষা করা অসম্ভব। সেটা ছিল পরিবারের সদস্যদের একটি পুনর্মিলনের মতো।
এরপর আমাদের জানানো হলো যে বিমানবন্দরের পাশেই উন্মুক্ত স্থানে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। যেহেতু আমাদের যাত্রাবিরতির সময় ছিল সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা, বঙ্গবন্ধু সেই বিশাল সমাবেশে বাংলায় একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর (যিনি শান্তিনিকেতনে অধ্যয়ন করেছিলেন) জন্য তা অনুবাদের কোনো দরকার হয়নি। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামকে আমি চটজলদি অনুবাদ করে দিয়েছিলাম।
ইতিমধ্যে আমরা এটা জেনে খুশি হলাম যে ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে মাপা হয়েছে, আর সেটা প্রধানমন্ত্রীর জেট অবতরণের জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ। এর অর্থ ছিল যে আমাদের কোনো বিমান পরিবর্তন করতে হবে না। আমরা দিল্লি ত্যাগ করলাম যাতে আমরা দুপুরের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারি। আকাশ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে যে দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ল, তা ছিল সত্যিই অভূতপূর্ব। আকাশ থেকে চোখে পড়ছিল যেন একটি মানবসমুদ্র দোল খাচ্ছে। অবতরণের পরপরই বঙ্গবন্ধুকে একটি ট্রাকে তোলা হলো, যেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং দলের নেতারা ও ছাত্রনেতারা ছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই ট্রাকে করে নগরে পৌঁছানোর। আমি লক্ষ করলাম, আমাদের বন্ধু আমীর-উল ইসলাম ও জিয়াউল হক টুলু আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন, যাতে করে হামিদা ও সন্তানেরা তাঁদের সঙ্গে বাড়ি যেতে পারে।
ট্রাকটি উল্লসিত জনতার ঢলের মধ্য দিয়ে সেইকালে পরিচিত রেসকোর্সে পৌঁছাল, যেখানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই স্থানটির দ্রুতই নামকরণ করা হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণের মধ্যে উপচে পড়েছিল তাঁর অসীম আনন্দ, যা ছিল তাঁর সারা জীবন উৎসর্গের ফলে চূড়ান্ত ও পরম লক্ষ্য অর্জনের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর ভাষণের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার মনে পড়ে। প্রথমে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন তাঁদের প্রতি, যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দ্বিতীয়ত, যেসব রাষ্ট্র ও বিদেশের জনগণ স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি সব রাষ্ট্রের কাছে সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। এরই সূত্রে কোনো ধরনের একটি সম্পর্ক রাখার জন্য ভুট্টো যে অনুরোধ করেছিলেন, তারও স্পষ্ট উত্তর দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করলেন, গত ৯ মাসে যে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ এখানে ঘটে গেছে, যে অকল্পনীয় দুর্ভোগ আমাদের জনগণের জীবনে বয়ে গেছে, আমাদের মাতৃভূমির ওপর যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সে বিচারে এখন পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হতে পারে কেবল দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। তিনি বললেন, তিনি পাকিস্তানের জনগণের মঙ্গল কামনা করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কতিপয় মহল, যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী, তাদের থেকে সাধারণ জনগণের পার্থক্য পরিষ্কার করেন। এরপর তিনি বললেন, বাংলাদেশের মাটিতে অনেক রক্ত ঝরেছে। আর এখন তিনি চান রক্তপাত বন্ধ হোক। এরপর তিনি সর্বস্তরের জনগণের কাছে আবেদন জানালেন, প্রতিশোধ গ্রহণ না করতে। জনগণের বিরুদ্ধে যারা অমানবিক অপরাধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। বললেন, আমাদের আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে, যারা এ জন্য দায়ী, তাদের আইন অনুসারে বাংলাদেশের মাটিতে বিচার করা হবে। তিনি গর্বিত কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘বঙ্গমাতা’য় বর্ণিত বাঙালিদের উদ্দেশে লেখা তাঁর হতাশার কথা উল্লেখ করেন: ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছ বাঙালি করে—মানুষ কর নি।’ তিনি বললেন, বাঙালি জাতি ৯ মাস ধরে যে সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তাতে কবিগুরুর এ কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ভাষণে বিমোহিত হয়েছিলাম, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। তিনি সেই ভাষণে আমাকে লক্ষ করে একটি বাক্যে উল্লেখ করেছিলেন যে কী পরিস্থিতিতে আমি সে সময় কারাগারে আবদ্ধ ছিলাম। এই জায়গাতেই ১৯৬৯ সালে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সেই একই স্থানে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাঙালি জাতি তাঁকে বরণ করে নিয়েছিল ‘জাতির জনক’ হিসেবে।
অনুবাদ: মিজানুর রহমান খান
সূত্র: বাংলাদেশ: স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সন্ধানে, প্রথমা প্রকাশন, ২০২০
কামাল হোসেন: বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ‘ঐ মহামানব আসে’ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। ক্রোড়পত্রের সেই লেখাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।