পোশাকশিল্প নিয়ে সতর্ক ও দূরদর্শী হতে হবে: রুবানা হক
পোশাকশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি রুবানা হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
প্রথম আলো: রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকের ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?
রুবানা হক: তিন মাস ধরে পোশাক রপ্তানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। আসলে যেটা হচ্ছে, বৈশ্বিক চাহিদায় একধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিদেশের ক্রেতারা বেছে বেছে কিনছেন, কম কিনছেন। তাঁরা ভ্যালু অ্যাডেড (মূল্য সংযোজন বেশি) পোশাক চাচ্ছেন। সেটির জন্য হয়তো আমরা এখনো প্রস্তুত না। তা ছাড়া ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠতেও আমাদের সমস্যা হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করব ও ব্যবসা কীভাবে বাড়াব, সেসব আমাদের ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে সামনের দিকে এগোতে হবে।
প্রথম আলো: পোশাক খাতের বর্তমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য কী করা দরকার? এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কি কোনো ধরনের সহায়তার প্রয়োজন আছে?
রুবানা: কিছু নীতিসহায়তা এখনই দরকার। কারণ আমাদের পণ্য বহুমুখীকরণে যেতে হবে। যাঁরা নতুন পণ্যে যাবেন কিংবা বেশি মূল্য সংযোজিত হয় এমন পণ্য উৎপাদন করবেন, তাঁদের প্রণোদনা দরকার। ক্ষুদ্র–মাঝারি কারখানারও সহযোগিতা দরকার। গত ৯ মাসে ৫৯টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়েছে। তাতে ২৯ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। যেহেতু অনেক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত, তাই এই শিল্পকে নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে এবং দূরদর্শী হতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, যেসব রাজস্ব নীতি নেওয়া হচ্ছে, তা পোশাকশিল্পবান্ধব কি না? আশপাশের প্রতিযোগী সব দেশ ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। আমরা ধরে রেখেছি। এটি আমাদের একধরনের গর্ব। তবে আমাদের তো প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমাদের রপ্তানি আয়ের পুরোটার ওপর না দিলেও যেটুকু অর্থ দেশে থাকে, সেটির ওপর ডলারে ২ টাকা বেশি দেওয়া হতো তাহলেও একধরনের সমাধান আসত।
প্রথম আলো: যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে ভালো অবস্থানে পৌঁছেছেন, তাঁরা ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি মূল্যের পণ্য তৈরির দিকে যাচ্ছেন?
রুবানা: খুব অল্প। প্রথমে যখন শিল্পটি গড়ে ওঠে, তখন অনেকে কারখানা করে ফেলেছেন। ক্রয়াদেশেরও কমতি ছিল না। বৈশ্বিক চাহিদাও দ্রুত বদলাচ্ছিল না। এখন টেকসই পণ্যের দিকে সবাই নজর দিচ্ছে। সবাই এখন পরিবেশবান্ধব পণ্য চায়। সবকিছু মিলে চাহিদা বদলে গেছে। এটির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। খুব যে হিসাব করে আমরা ব্যবসা বাড়িয়েছি, তা–ও না। সবাই ১০০–২০০ লাইনের কারখানা করে বসে আছি। তারপর একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নেমে গেছি, দাম কমানোর জন্য। সব মিলিয়ে আমরা সুখকর অবস্থায় নেই। এখনো সময় আছে, আমরা একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। চীন–যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, তা থেকে আমাদের সুযোগ নেওয়ার কথা। তবে আমরা খুব কমসংখ্যক সেটি পারছি।
প্রথম আলো: ভাবমূর্তি–সংকটের কথা বলেছেন। রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত হয়েছে। এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা হয়েছে। তারপরও কেন আমরা ভাবমূর্তির উন্নতি করতে পারছি না?
রুবানা: অনেক কারণেই আমরা পারছি না। ইউরোপের সঙ্গে যা–ও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারছি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারতে কষ্ট হচ্ছে। একের পর এক নেতিবাচক খবর তারা প্রকাশ করছে। যেটি হয়, কোনো নেতিবাচক সংবাদ হলে আমরা চট করে উত্তরটা দিই না। অবশ্য এখন আমরা কাজটি করছি। ভাবমূর্তির উত্তরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
প্রথম আলো: আপনি অনেক চ্যালেঞ্জের কথা বললেন। সম্ভাবনার জায়গা কেমন?
রুবানা: যত চ্যালেঞ্জ থাকে, ততই সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমাদের ইনোভেশনে (নতুন উদ্ভাবনে) যেতে হবে। পোশাকের ডিজাইনে ইনোভেশন আনতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে চলে যাচ্ছি আমরা। সেটির জন্য প্রস্তুতি দরকার। তবে এসবের জন্য তাগিদটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রতি সপ্তাহে আমরা পোশাক রপ্তানির তথ্য নিচ্ছি। সেখানে আমরা দেখছি, আউটারওয়্যার (জ্যাকেট) অনেক বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে পণ্যটি তৈরি করে হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা। আমরা যে দেশে যাচ্ছি, সেখানেই দেখছি তাদের প্রধান ১০টি আমদানি পণ্যের সঙ্গে আমাদের সরবরাহের একটি বড় ফাঁক রয়ে গেছে। তাঁরা হয়তো কৃত্রিম সুতার (ম্যান মেড ফাইবার) পোশাক চাচ্ছেন, আমরা করছি তুলার। কৃত্রিম সুতার কাপড় তৈরি করতে হলে টেক্সটাইলে নতুন বিনিয়োগ দরকার। সেটি কি বিদেশি নাকি দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ হবে, সেটি আমাদের স্পষ্ট করতে হবে। যেকোনো মূল্যেই কৃত্রিম সুতা ও কাপড় উৎপাদনে যেতে হবে। না হলে আমরা হারিয়ে যাব।
প্রথম আলো: পোশাকশিল্পের বয়স চার দশক হয়ে গেছে। তারপরও শ্রম ইস্যুতে দায়িত্বশীল আচরণ দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মজুরি নিয়ে শ্রম আন্দোলনের ঘটনায় মামলা ও কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে পোশাকশিল্প বেশ চাপের মধ্যে আছে। শ্রম ইস্যুতে দায়িত্বশীল কবে হবেন মালিকেরা?
রুবানা: সব মামলা তুলে নেওয়া হবে। আমরা ছয় মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। শুরু থেকেই আমরা মামলার পেছনে লেগে আছি। আমরা চাই না কোনো মামলা হোক। এগুলো দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে। ট্রেড ইউনিয়ন যাঁরা করেন, তাঁরা অনেক সময় বোঝেনও না ঠিকমতো। এখানে শিক্ষার একটি বিষয় আছে। তাঁদের সচেতন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ওয়ার্কার রিসোর্স সেন্টার (ডব্লিউআরসি)। এটি হচ্ছে আইএলওর অধীনে এসডিআর প্রকল্পের একটি অংশ। পোশাক কারখানায় আট শতাধিক ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে। এগুলোর গুণগত মান নিয়ে আমি চিন্তিত। যাঁরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে আসছেন, তাঁদের একটি অংশ মনে করেন, কারখানায় ঢুকে বড় হইচই বাধাতে পারলেই তিনি বড় নেতা হয়ে যাবেন। সেটি যে ঠিক না, তা বোঝানোর দায়িত্ব ফেডারেশন নেতাদের। একটি কারখানায় ছয়টি ট্রেড ইউনিয়ন আছে, সেই উদাহরণ আমাদের দেশে আছে। সেখানেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়। কেন হবে? ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে তো তাদের একটি সম্মিলিত কণ্ঠস্বর আছে। তার মানে হলো, ভালো ট্রেড ইউনিয়নকে আমরা পুরস্কৃত করছি না। প্রণোদনা দিচ্ছি না। যেগুলো ভালো করছে না, তাদের পুঁজি করে আমরা মালিকেরা আবার বলছি, ট্রেড ইউনিয়ন আমাদের সমস্যা করছে। দুই দিকেই সমস্যা আছে। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে, উভয় পক্ষের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য কাউন্সেলিং করা দরকার।