পদার্থ আর চিকিৎসাবিদ্যার যুগলবন্দী
সেই স্কুলজীবন থেকেই গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় ছিল আমার প্রিয়। রাজশাহী বোর্ডের ১৯৭০ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার পর এই বিষয়টি নিয়ে পড়ার ঝোঁক পেয়ে বসে। বাড়ি থেকে বলা হলো চিকিৎসায় বা প্রকৌশলে পড়ার জন্য। ঠিক করলাম তড়িৎ প্রকৌশলী হব। ভর্তি হয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) এক বছর পড়াশোনাও করেছি। স্বাধীনতার পর জার্মান বৃত্তি পেয়ে সেই আবার ফিরে এলাম পদার্থবিজ্ঞানে। জার্মানিতে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকার সময় মলিকিউলার বায়োলজির জনক হিসেবে পরিচিত জার্মান বংশোদ্ভূত মার্কিন পদার্থবিদ ম্যাক্স ডেলব্রুকের এক বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, পদার্থবিদদের এখন পরমাণু বোমা গবেষণা বাদ দিয়ে মেডিসিনে আসা উচিত। হয়তোবা এটাও একটা কারণ। চলে এলাম চিকিৎসা পদার্থবিদ্যায়। কর্মক্ষেত্র হলো চিকিৎসাশাস্ত্রে।
চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা আমাদের দেশে নতুন, অনেকেই বিষয়টির গুরুত্ব বোঝেন না। তবে যাঁরা পদার্থবিদ্যা বোঝেন, তাঁদের জন্য তেমন কঠিন কিছু নয়। চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা মানুষের রোগনির্ণয় ও নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। ক্যানসারের চিকিৎসায় চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। হাসপাতালে আধুনিক যেসব যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করা হয়, তা থাকে চিকিৎসা পদার্থবিদদের তত্ত্বাবধানে। আমাদের ছাত্ররা চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা পড়া শেষ করে বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তার আর টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে একটি দলে ক্যানসার চিকিৎসা করছে। তা ছাড়া মেডিসিনের অন্যান্য বিষয়েও চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা নিজের স্থান করে নিয়েছে বা নিচ্ছে।
গত ১৫ বছরের অনেক চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফল গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আজকের মেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। আজ এই বিভাগ বাংলাদেশে চিকিৎসা পদার্থবিদ তৈরির পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। গত ১০ বছরে এখান থেকে পাস করা ছাত্ররা দেশের প্রায় সব হাসপাতালে ক্যানসার রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের ছাত্রের সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। আশার কথা, অনেক ছাত্রীও এই বিষয়ে এখানে পড়ছে। এই ছাত্রছাত্রীরা পাস করে বেরোলেই বাংলাদেশের চাহিদা আপাতত মেটানো যাবে। প্রথম থেকেই জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জার্মান ক্যানসার সেন্টারের সঙ্গে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক প্রশিক্ষণের এক চুক্তি করা হয়। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে জার্মান সরকারের খরচে প্রায় ২০ জন ছাত্র ও শিক্ষককে স্যান্ডউইচ প্রোগ্রামের আওতায় প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি দেওয়া হয়। এঁরাই আজ গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিভাগে শিক্ষক এবং দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা পদার্থবিদ হিসেবে কাজ করছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে আজ বাংলাদেশে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা প্রসারে এঁরাই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছেন। অনেকে ইতিমধ্যে পিএইচডি করেছেন। আমরা হিসাব করে দেখেছি, বাংলাদেশের সব ক্যানসার রোগীকে সুচিকিৎসার আওতায় যদি আনা যেত, তবে প্রায় ৮০০ জন চিকিৎসা পদার্থবিদের দরকার হতো। এর জন্য বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা কোর্স চালু করা দরকার। আমি বুয়েটে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার কোর্স চালুর চেষ্টা করেছি। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমলান্ত্রিক জটিলতার পাশাপাশি যে বিষয়টি ধরা পড়ে, তা হলো এ বিষয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকের অভাব। আমরা ২০১৩ সালে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও মানহাইম ক্যানসার হাসপাতালের সঙ্গে আরেকটি নতুন চুক্তি করেছি, যেটা ২০১৪ সাল থেকে চার বছরের জন্য কার্যকর হয়েছে। জার্মান সরকারি সংস্থা ডিএএডির অর্থায়নে পরিচালিত।প্রতিবছর আমাদের দুজন ভালো ছাত্র সরাসরি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ফিজিক্স ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে পারছেন। দুজন চিকিৎসা পদার্থবিদ জার্মান ক্যানসার হাসপাতালে তিন মাস হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন।একজন শিক্ষক স্যান্ডউইচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে পারবেন। আর দুদিক থেকে দুজন করে শিক্ষক পড়াশোনা করাতে ও সম্মেলনে যোগ দিতে যেতে পারবেন। এভাবে আগামী চার বছরে বাংলাদেশের জন্য আরও অনেক উচ্চতরের জনশক্তি সৃষ্টি হবে। আমার মনে হয়, তখন বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগগুলো চালু করা অনেক সহজ হবে।
বাংলাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। এই দুই খাতের সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়াতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অধিক অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান করার সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বাড়াতে হবে। উন্নয়নের প্রথম শর্ত হলো দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের সোনালি ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা একটি সুস্বাস্থ্য ও সুশিক্ষায় দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারব কি না তার ওপর। তা ছাড়া সরকারকে একটি সময়োপযোগী পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করতে আরও বেশি আগ্রহী হন। এখানে প্রবাসীদের টানতে চীন ও কোরিয়ার উদাহরণ অনুসরণ করা যেতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় তথা বাংলা সাহিত্য জার্মানদের প্রিয়। বাঙালি মনীষীদের কদর জার্মানিতে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই এ ব্যাপারে অবদান রেখেছেন। জার্মানিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা হয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে এগুলো একচ্ছত্র পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক হতো। নতুন প্রজন্মের লেখক-গবেষকদের বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এখানে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অবদান রাখতে পারে। আমরা বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আমি একজন বিজ্ঞানী। বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে শখের বসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা করি। জার্মানিতে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে অনেক সেমিনার, আলোচনা ও লেখালেখি করেছি। স্বাধীনতার পরপর প্রথম ব্যাচের ছাত্র হয়ে জার্মানিতে এসে ধমনিতে বইত স্বাধীনতার আশা–আকাঙ্ক্ষা। আমরা প্রত্যেকেই মনে করতাম, আমরা যেন একেকজন বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারক-বাহক। সেই গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি হাইডেলবার্গে বাংলাদেশের স্টাডি গ্রুপ, পরে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সেটাকে বাংলাদেশ স্টাডি ও ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে পরিণত করা হয়। এই সেন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও জার্মানিতে নানা কর্মকাণ্ড করা হয়। আমার লেখা ও সম্পাদনায় পাঁচটি বই বের হয়েছে। হয়তো এ জন্যই বাংলা একাডেমির এই প্রবাসী লেখক পুরস্কার। দুটি বাংলায়, তিনটি জার্মান। বাংলা বইগুলোতে জার্মানের জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশের ও বিদেশে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীকে উদ্দেশ করে। আর জার্মান বইগুলোতে নজরুল, রোকেয়া, রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মকে জার্মান পাঠক, বাংলা না জানা দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি পাঠক ও বাংলাদেশকে নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরকে প্রথমবারের মতো পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এখানে মনে রাখতে হবে, নজরুল ও রোকেয়াকে নিয়ে জার্মান ভাষায় এই প্রথম বই। পুরস্কার পেয়ে অনেক আনন্দ পেয়েছি, ভাবতেই পারিনি সাহিত্যে কোনো দিন পুরস্কার পাব। এই পুরস্কার আমার একার নয়, আমার সব বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টাডি ও ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রাপ্য। তাই বাংলা একাডেমিকে অনেক ধন্যবাদ। অভিভূত হয়েছি গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ’ আমাকে যে সংবর্ধনা দিয়েছিল। উপস্থিত অতিথিদের বক্তব্যে এবং আমার ছাত্রদের ভালোবাসার প্রকাশ কোনো দিন ভোলার নয়। সব হলে যেন আনন্দ ও সুখের জোয়ার এসেছিল। তা ছাড়া নওগাঁর মা ও শিশুকেন্দ্রের সংবর্ধনা অনেক দিন মনে থাকবে।
আমি আমার পেশার পাশাপাশি অবসর সময়ে যেটুকু সময় পাই লেখালেখি করি এবং দেশ ভ্রমণ করে আনন্দ পাই। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবকেও তো সময় দিতে হয়!
জার্মানে বসে দেশের কথা ভাবতে গিয়ে ছেলেবেলার দুরন্তপনার কথা অনেক মনে পড়ে। স্কুলের পাশাপাশি দুটি জিনিস আমার খুব প্রিয় ছিল—খেলাধুলা আর সিনেমা দেখা। খেলতে গিয়ে ভুলে যেতাম বাড়ি ফেরা, খাওয়াদাওয়ার কথা। মার্বেল খেলা যেন নেশা হয়ে গিয়েছিল। আর নওগাঁর সিনেমা হলে এসেছে এমন কোনো সিনেমা দেখিনি, এমনটা কখনো হয়নি। মুক্তি সিনেমা হলের ওপরতলায় তিন আনা দিয়ে টিকিট কিনে মহিলাদের বসার শ্রেণিতে হাফপ্যান্ট পরে সিনেমা দেখার কথা এখনো মনে পড়ে। যত দূর মনে পড়ে, আমার প্রথম হিন্দি ছবি ছিল দেবানন্দ ও ওয়াহিদা রেহমানের সোল বাছার। আর বাংলা ছবি ছিল মানময়ী গার্লস স্কুল।স্কুল আর পরিবারের পর সিনেমাই আমার জ্ঞানের উৎস ছিল। যে যুগে ছিল না রেডিও। ছিল না টেলিভিশন। সিনেমাই আমার দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।
ছেলেবেলার একটি মজার ঘটনা মনে হলে এখনো আমার হাসি পায়। ধামকুড়ি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে নওগাঁ কে ডি স্কুলে ভর্তি হই। বিরাট কক্ষ, অঙ্কের ক্লাস, শিক্ষক রায়চান বাবু। দেখলাম, সবার কাছে গিয়ে খাতা দেখছেন। আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার খাতা কোথায়?’ উত্তর না দিয়ে ভয়ে থমকে আছি। পাশের এক ছাত্র বলে, স্যার, ও আজ নতুন এসেছে। রায়চান বাবু বলে উঠলেন, ওকে এক চড়ে আজ পুরাতন করে দিব। মনে নেই চড় দিয়েছিলেন কি না।
আমার ছেলেবেলার কয়েকজন বন্ধু এর মধ্যেই মারা গেছে। যারা আছে, গিয়ে দেখা করি। ছেলেবেলার গল্প করে সেই দিনগুলোতে ফিরে যাই। মনে হয় ওদের সঙ্গে আবার সিনেমায় যাই। তুলসী গঙ্গা নদীতে মাছ ধরি। পুকুরে গোসল করি। তবে নওগাঁয় স্কুল আর মা শিশুস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজের ব্যস্ততায় এগুলো করার সময় থাকে না। স্কুলজীবনের বন্ধু বুলবুল, জাহাঙ্গীর, বাচ্চু—এদের সঙ্গে দেখা না করলে বাসে ঢাকা ফেরার পথে অনেক খারাপ লাগে।
আমার পড়াশোনার জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। প্রাইমারি, উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ আর জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়। সবার কথা বলা সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষকের জ্ঞান, দক্ষতা ইত্যাদির প্রভাবে আজকের আমার জীবন গড়ে উঠেছে। এঁদের সবার কাছে আমি ঋণী। স্কুলজীবনের যে ঘটনা আমাকে এখনো নাড়া দেয়, তা হলো মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের দিনটি। এক ক্লাসমেট এসে খবর দেয়, সে স্কুলে শুনেছে যে আমার নাম রাজশাহী বোর্ডের মেধাতালিকায় রয়েছে। বাড়িতে আমরা সবাই রেডিও নিয়ে গোল হয়ে বসে পড়লাম। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়—না, আমার নাম নেই। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। শেষ পর্যন্ত দশম স্থানে আমার নাম এবং স্কুলের নাম আসে। জীবনে প্রথমবারের মতো রেডিওতে নিজের নাম শুনে বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। এত দিন শুনতাম কে ডি স্কুল থেকে ব্রিটিশের সময় কলকাতা বোর্ডে হুমায়ুন কবির দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, নওগাঁর অনেক শিক্ষিত মানুষ আমাকে দেখলে বলে—জাকারিয়া না? তোমার তো মাধ্যমিক পরীক্ষায় রোল ছিল ২৩৬৩।
বিজ্ঞানী হওয়ায় তাই বিজ্ঞান শিক্ষা, চর্চা ও গবেষণার সংস্কৃতি আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে। তবে জার্মান সাহিত্য ও দর্শন আমার অনেক প্রিয়। সুযোগ পেলে এগুলো আমি পড়াশোনা করি। জার্মানিদের বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কারিগরি দক্ষতা প্রবাদসম। প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন, সিমেন্স, ডাইমলার বেঞ্জসহ শত শত বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আধুনিক সভ্যতার গর্ব। শুনে আশ্চর্য হবেন, জার্মানিরা কিন্তু নিজেকে ‘ডিসটার ও ডেঙ্ককারের জাতি’ অর্থাৎ বাংলায় ‘কবি ও চিন্তাশীলের জাতি’ বলতে গর্ববোধ করে। গ্যেটে, শিলার, হাইনেলেসিং ফনটানে, মান ও ব্রেশটের মতো কবি সাহিত্যিকেরা যেকোনো জাতীয় গর্বের ধন। অন্যদিকে কান্ট, হেগেল ফিসটে, সেলিং, মার্ক্স, হাইডেগারসহ অনেক জার্মান দার্শনিক মননশীল বিদ্যাবুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়েছেন। জার্মান ভাষায় এ পর্যন্ত প্রায় ১২ জন কবি-সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এঁদের কর্ম বাংলা ভাষায় অনুবাদ হওয়া দরকার। জার্মান সাহিত্য ও দর্শন আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছে। আজও করছে।
গত ২৫ বছর বাংলাদেশে ও জার্মানিতে বাংলাদেশের ওপর কাজ করে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেসরকারি ও সরকারি লেভেলে কাজ করেও অনেক কিছু জেনেছি। এখনো দেশে–বিদেশে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রী আছে। আমি মনে করি, সবাই আমার কাজে এগিয়ে আসবে। আমি নিজে বাংলাদেশে উচ্চমানের একটি ‘মেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট’ করে যেতে চাই। আর এর সঙ্গে থাকবে একটি ক্যানসার হাসপাতাল। সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এ দেশের মানুষের জন্য এটাই হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। আশা করি, আমাকে সহায়তা করতে সবাই এগিয়ে আসবেন।
বাংলাদেশ সেই দেশ, বয়স অনুপাতে কোনো কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যেখানে সবচেয়ে বেশি। আমরা যদি তরুণদের সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে ছেড়ে দিতে পারি, তাহলেই এরা দেশে থেকে বা বিদেশে গিয়ে নিজের কর্মের ভেতর দিয়ে তার মাতৃভূমিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। জার্মান মহাকবি গ্যেটে বলতেন, বাবা–মায়ের সন্তানদের প্রতি একটিই দায়িত্ব তা হলো ‘শিকড় আর পাখা দেওয়া’। তাঁর কথাকে উপমা হিসেবে নিয়ে আমি বলব, আমাদের নতুন প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো ‘ঐতিহ্য, সুশিক্ষা ও স্বাধীনতা’ দেওয়া।
লেখক পরিচিতি
গোলাম আবু জাকারিয়া চিকিৎসা পদার্থবিজ্ঞানী। স্বাধীনতার পর বৃত্তি পেয়ে জার্মানিতে পদার্থবিদ্যা পড়া শুরু করেন। পদার্থবিদ ম্যাক্স ডেলব্রুকের বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যায় আগ্রহের শুরু। প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা পদার্থবিজ্ঞান বিষয় চালু করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: