তাঁর ফেরার দিনে
বৃক্ষ বলছে, ‘আগে এসো পিতা আমাদের কাছে,
তুমি বলেছিলে দুর্গ গড়তে, স্মরণে কি আছে?
আমরা দুর্গ গড়েছি কঠিন বনে, অরণ্যে
আমরা আদেশ পালন করেছি, এসো সে জন্যে।’
নদী বলে, ‘পিতা, এসো তুমি আগে আমাদের কূলে
পানিতে মারব, বলেছিলে তুমি, আমরা তা ভুলে
যাইনি কখনো। সব নদনদী একসাথে গড়ি জলের দুর্গ
হাঙরে–মাইনে শত্রুকে রুখি! কী অপূর্ব!’
মৃত্তিকা বলে, ‘আমরা গড়েছি বাংকার কত,
আমাদের দাবি সবচেয়ে বেশি, আমাদের মতো
ভালো কে বেসেছে ভীষণ তোমাকে—
আমাদের মতো ত্রিশ লক্ষ মানুষের লোহু
রেখেছে জমা কে?
আমাদের কাছে আগে এসো পিতা
আমাদের দাবি সবচেয়ে বেশি
মনে মনে তুমি জানোনি কি তা?’
মেঘেরা বলছে, ‘তুমি বলেছিলে, প্রস্তুত থাকো
যা আছে তা নিয়ে;
আমরা ঢেলেছি বজ্র বিজুলি, তৈরি ছিলাম বৃষ্টি বানিয়ে।’
পাখিরা বলছে, ‘আমরা পাখায় পালকে নিবিড়
যুদ্ধের যত গোপন বার্তা পৌঁছে দিয়েছি মুক্তিশিবির।’
বত্রিশে যত পায়রারা একা নয় মাস ছিল চর্যাবিহীন
বাকুম বাকুম ডাকে আপনাকে আজকে
তাদের ডাকবার দিন
বাংলার যত ফুল ও ফসল, বাংলার মাটি, বাংলার জল,
আপনাকে ডাকে, কাছে এসো পিতা,
তোমার স্বপ্ন করেছি সফল।
আপনি গেলেন সবচেয়ে আগে রেসকোর্সে নামা
মানুষের ঢলে;
মানুষ দাবায়ে রাখতে কে পারে, স্মৃতি ভেসে যায়
আবেগের জলে!
আপনার চোখে ভেঙে যায় যত অশ্রুর বাঁধ,
‘আজকে আমার পূর্ণ হয়েছে জীবনের সাধ’
অশ্রুগমকে কথা ভেঙে যায়, মনে পড়ে যায়, রক্তের ঋণ
‘আজকে আমার সোনার বাংলা হয়েছে মুক্ত,
হয়েছে স্বাধীন।’
মনে পড়ে যায়, পাকিদের জেলে সেলের পাশেই
খুঁড়েছে কবর,
মৃত্যুদণ্ডে সই হয়ে গেছে, আপনারও জানা নিঠুর খবর!
‘মারতে চাইছ, মারতেই পারো, মৃত্যুর ভয় পাই না যদিও
মিনতি করছি, অনুরোধ রেখো, বাংলার বুকে
লাশটা পাঠিও।’
‘একটাই কথা জেনে রাখো খালি,
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলব, আমি বাঙালি,
বাংলা আমার ভাষা আর শোনো বাংলা আমার দেশ,
জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা অনিঃশেষ।’
লক্ষ লক্ষ মানুষ কাঁদছে কাছে পেয়ে তার
জাতির পিতাকে!
একজন শুধু রেডিও শুনছে, আপনার মনে
পড়ছেই তাঁকে।
ধানমন্ডির ভাড়ার বাসায় একাকী ছিলেন এতদিন তিনি,
রেনু নামে যাকে ডাকেন আপনি,
যার কাছে জমা যাবতীয় ঋণই
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলাদেশের আকাশ বাতাস
পিতাকে বরণ করবে বলে দুহাত বাড়িয়ে করে উচ্ছ্বাস
‘মানুষের কাছে আগে তুমি যাও’
রেনু সব বোঝে, বুঝবে এটাও।
বাংলার ঘরে যত ভাইবোন, পিতার জন্য দুহাত বাড়িয়ে;
আপনার বুক হাহাকার করে ত্রিশ লক্ষ স্বজন হারিয়ে
এই রেসকোর্স সাক্ষী রয়েছে দিয়েছেন কথা উনসত্তরে—
‘রক্ত দিয়ে মুক্ত করেছ রক্তের ঋণ যাব শোধ করে’
রক্তই দেব নিশ্চিত থেকো
মুক্ত করব দেশ মনে রেখো
মানুষের কাছে রক্তের ঋণ শোধ করবেন রক্ত দিয়েই
সে কথা ভাবতে বুক ভেঙে যায়, পদ্য লিখছি
সে শোক নিয়েই।
মহানায়কের ফিরে আসবার দিনটিতে ভাবি দুহাজার বিশে
স্বাধীন দেশের ধমনি শিরায় আপনি আছেন সততই মিশে
আপনার ফেরা মহাবিক্রমে আজ লিখি তার নৈবেদ্য!
আসলে আপনি গেলেনই বা কবে—
জাতি আর পিতা অবিচ্ছেদ্য।