বিজ্ঞানী মো. আবদুস সালাম উচ্চফলনশীল ২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। দেশের মোট উৎপাদিত ধানের শতকরা ৫৫ ভাগই বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের। এ দুই জাতের উদ্ভাবনকারী দলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। পাদপ্রদীপ থেকে দূরে থেকেছেন সারা জীবন। গণমাধ্যমে কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন। সাক্ষাৎকারের জন্য সময় দিয়েছেন নিরবচ্ছিন্ন পীড়াপীড়ির পর। নির্দিষ্ট দিনে গুলশানে তাঁর দপ্তরে পৌঁছালে দোতলার অফিসঘর ছেড়ে একতলায় নেমে দরজা খুললেন নিজে। কিন্তু দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বিনয়ী বিজ্ঞানী বললেন, আচ্ছা, সাক্ষাৎকার না নিলে হয় না? বললাম, ঠিক আছে, আপনার কাজ নিয়ে গল্প করি। তা-ই হলো। দুই ঘণ্টার সেই আড্ডা মানবিকে পড়া এই সামান্য লেখকের জন্য অসামান্য হয়ে উঠল। বললাম, আপনার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা দিয়েই আমাদের ধানের গল্প শুরু হোক। কালবিলম্ব হলো না। যেন সব সেলুলয়েডে ধারণ করা। শুরু করলেন, আমি জেনেটিকস অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিংয়ের ছাত্র। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে ৩ জানুয়ারি আমি আমার থিসিস জমা দিই।
কত সালে?
১৯৭৭ সালে। হল ছেড়ে উঠেছি লজিংয়ে। একদিন ক্যাম্পাসে গেলে জুনিয়র ছাত্ররা বলল, আপনি এখানে ঘুরঘুর করছেন! সবাই তো চাকরি নিয়ে চলে গেছে। আমি বললাম, মানে? ছাত্ররা বলল, আপনি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন না? বললাম, সে তো ছয় মাস আগে। তারা জিজ্ঞেস করে, চাকরি পাননি? অবাক হয়ে জানতে চাই, মানে কী? ছাত্ররা বলল, তাড়াতাড়ি হোস্টেলে যান।
আমি হলে গেলাম। রুমমেট কেউ নেই। পাশের রুমের একজন বলল, আপনার চিঠির বাক্সটা দেখেন। হয়তো ওখানে আপনারটা পড়ে আছে। সত্যিই তা-ই। চিঠি নিয়ে গিয়ে যোগ দিলাম কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে।
মাস তিনেক যাওয়ার পর ভাবলাম, এই দিয়ে পোষাবে না। ধানবিজ্ঞানী হব—এটা আমার ভেতরের ইচ্ছা। আমরা যখন ১৯৭৪ সালে স্নাতক শেষ করি, তখন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। শিক্ষা সফর যাকে বলে। ওখানে সব দেখেশুনে আমার ভাবনায় ধানবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন জাগে।
একদিন বাড়ি থেকে কর্মস্থল নীলফামারী যাচ্ছি। পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে জানাল, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বিজ্ঞানী নিয়োগ দিচ্ছে। আমি দেখলাম, আবেদন করার সময় শেষ। অফিসের এক বড় ভাইকে জানালাম। তিনি বললেন, তুমি দরখাস্ত করে দাও।
সরকারি চাকরি করি একটা। আরেকটায় যেতে ছাড়পত্র লাগে। খালি দরখাস্ত পাঠালাম। ইন্টারভিউতে ডাকও পড়ল। ইন্টারভিউ বোর্ড বলল, তুমি যথাযথভাবে দরখাস্ত করোনি। পরেরবার ঠিকঠাকমতো কোরো। মন খারাপ করে বের হয়ে আসি। আমার পরেই ঢুকল আমার এক সহপাঠী। সে বিএডিসিতে কাজ করে। তাকে জিজ্ঞেস করল, চাকরি করো?
সে বলল, করি। সঙ্গে এটাও বলল, স্যার, পড়াশোনা করেছি জেনেটিকসে। আমি কি এই জ্ঞানটা কাজে লাগাতে পারব না? সারা জীবন সার বিক্রি করে যাব?
বোর্ডে একজন ছিলেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। তিনি অন্য সদস্যদের বললেন, ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছেন, সবার ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলেন। ব্রিলিয়ান্ট (মেধাবী) খুঁজে বের করি। তখন ওর ইন্টারভিউ হলো।
আপনি কী করলেন?
আমি বসে ছিলাম ওর জন্য। এমন সময় একজন কর্মকর্তা ছুটে এসে বললেন, আবদুস সালাম আছেন? আমি হাত তুললাম। তিনি বললেন, আপনাকে থাকতে বলেছে। আমার ইন্টারভিউ হলো সবার শেষে। কিছুক্ষণ পর ফলাফল দেওয়া হলো। আমাকে ডেকে বলা হলো, ইউ স্টুড ফার্স্ট (তুমি প্রথম হয়েছ)। আগামীকাল ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যাবে, নিয়োগপত্র নিয়ে আসবে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে গেলাম। প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগে যোগ দিলাম—মনের যেটা চাহিদা ছিল। এ-ই হচ্ছে আমার শুরু।
তারপর...
১৯৭৯ সালে আমাকে প্রশিক্ষণের জন্য ইরিতে (আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র) পাঠানো হলো। ধান উৎপাদন বিষয়ে প্রশিক্ষণ। আমার বিষয় ভিন্ন। আমাকে বলা হলো, জেনেটিকস অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং তুমি বোঝো। যেটা জানো না, সেটা হচ্ছে মডার্ন প্র্যাকটিস অব রাইস ব্রিডিং। এটা শিখে আসবে।
প্রশিক্ষণ শেষ করে আসার পর আমাকে বদলি করা হলো হবিগঞ্জে। শহর থেকে নৌকায় যেতে হতো অফিসে। আমি বিভাগীয় প্রধানকে বললাম, স্যার, আমার বাড়ি নওগাঁ। রাজশাহী অঞ্চলে দেন। বাবা মারা গেছেন। পরিবারের দেখভাল করতে পারব।
তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির নিচে হলে ধান চিটা হয়ে যায়। ১৫ ডিগ্রির নিচে হলে ধানে থোড়ই আসবে না। এটাই ধানের মর্মকথা। তিনি পাল্টা বললেন, আজ যদি তোমাকে স্কলারশিপ দিয়ে আমেরিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তোমার জন্য দূরে হবে না?
আমি থ মেরে গেলাম। বললাম, এটা তো ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের বিষয়, ইনস্টিটিউশনের স্বার্থে। তিনি বললেন, ঠিক এই কারণেই তোমাকে হবিগঞ্জে দেওয়া হয়েছে।
আসসালামু আলাইকুম বলে হবিগঞ্জে চলে গেলাম। ১৫ দিন পর ঢাকায় এলাম। বিভাগীয় প্রধানকে বললাম, আপনি কি আমার সঙ্গে হবিগঞ্জ যাবেন? বললেন, কেন? বললাম, ওখানে আমি ধানের যে জেনেটিক ভ্যারিয়েশন দেখেছি, তা আউটস্ট্যান্ডিং (অসামান্য)। আমাকে গাইড করেন। তিনি রাজি হলেন। একসঙ্গে গেলাম। আমার প্রস্তাবিত ভ্যারাইটি দেখে বললেন, রাইট সিলেকশন। পরের বছর আমরা ওই ধানগুলোর পরীক্ষামূলক উৎপাদন করলাম। সে বছর বড় বন্যা হলো। হাওরের সব ধান তলিয়ে গেল। শুধু আমার প্রপোজাল (প্রস্তাবিত ধান) তিনটা দাঁড়িয়ে আছে। এক মিটারের ওপর পানি, ধানের শিষটা মাথা তুলে আছে। স্যার বললেন, হয়ে গেছে। হাওর অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত ভ্যারাইটি (জাত) পাওয়া গেছে। সেই ভ্যারাইটি তিনটিরই পরে নাম হলো বিআর-১৭, বিআর-১৮, বিআর-১৯ বা হাসি, মঙ্গল, শাহজালাল।
আপনার প্রথম উদ্ভাবন! একসঙ্গে তিন ভ্যারাইটি! প্রতিক্রিয়া কী পেলেন?
ছয়জন সিনিয়র (জ্যেষ্ঠ) বিজ্ঞানীকে ডিঙিয়ে আমাকে পিএইচডি স্কলারশিপ দেওয়া হয়। ওই বছর আমাকে ব্রির বেস্ট ওয়ার্কিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হলো। চলে গেলাম পিএইচডি করতে।
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে?
ইউপি দিলিমান (ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইন)। আমার অভিসন্দর্ভ ছিল ‘ফটোপিরিয়ড সেনসিটিভিটি’ নিয়ে। ধারণাটা আমি পাই ড. ডেভিড ম্যাককিল নামের ইরির একজন আমেরিকান বিজ্ঞানীর কাছ থেকে। তিনি একটা সভায় বলেছিলেন, তোমরা ফটোপিরিয়ড সেনসিটিভিটি (আলোক সংবেদনশীলতা) থেকে বের হয়ে আসো।
এটা কী বিষয়?
লতিশাইল, নাজিরশাইল, কাজলশাইল—এই শাইল ধানগুলো আলোক সংবেদনশীল।
একটু ব্যাখ্যা করবেন?
ধান হলো শর্ট ডে প্ল্যান্ট (ছোট দিনের গাছ)। দিন ছোট হলে আলো কম হয়, তাতে ধানে দ্রুত থোড় আসে। উৎপাদনও বেশি হয়। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু দিন বড় হলেও যাতে একই রকম ফল পাওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করাই হলো ফটোপিরিয়ড সেনসিটিভিটি কমিয়ে ফেলা।
এই নিয়ে পিএইচডি শেষ করলেন...
পিএইচডি করে আসার পর আমার যোগ দেওয়ার কথা হবিগঞ্জে। কিন্তু প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগের প্রধান ড. নূর মোহাম্মদ মিঞা বললেন, তুমি এখানে জয়েন করো। আমি চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। প্রশাসন বিভাগ বলল, তোমাকে হবিগঞ্জে যোগ দিতে হবে। ড. নূর মোহাম্মদের তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ। তিনি বললেন, আমি একবার যা লিখেছি তা আর কাটা হবে না। আমি যা বলি তা-ই করি। ফলে কাজ শুরু করলাম প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগে। শুরুতেই আমরা রোপা আমনের গবেষণা জোরদার করি।
এটা কত সালের কথা?
১৯৮৮ সালের বন্যার পর। আমার ভাবনা হলো ধানের আলোক সংবেদনশীলতা কমিয়ে ফেলা। শাইল ধান পাকে ১৫০ দিনে। আমরা ব্রি-৩০ ধানের সময় ১৫০ দিনে নামিয়ে আনলাম। এরপরের ভ্যারাইটি ব্রি-৩১। এর সময় কমানো গেল আরও ১১ দিন। তাতে ধান পাকার সময় ১৩৫ দিনে নেমে এল। ব্রি-৩৩ মঙ্গা এলাকার জন্য। ১১২ দিনে পাকার ব্যবস্থা হলো। ব্রি-৩৯ পাওয়া যাবে ১২৫ দিনে। এভাবে দেখা যাবে ১১৫ থেকে ১৫০ দিন—আমনের একটা সেট তৈরি হয়েছে। আমার ভাবনাটা ছিল, যে কৃষকের যে রকম প্রয়োজন, সে কৃষক সে রকম ভ্যারাইটি ব্যবহার করবে।
মানুষ বেশি বলে আমাদের চাহিদাও বেশি। যদিও আমাদের ধান উৎপাদন বহুগুণ বেড়েছে। আবার ভারতে এক শ কোটি মানুষ। তারা কীভাবে চাল রপ্তানি করে?
কারণ হচ্ছে, আমাদের ভ্যারাইটি কম। আবার ভারতের রপ্তানির একটা বড় অংশ সুগন্ধি চাল। আমরাও অ্যারোমেটিক রাইসের দিকে নজর দিয়েছি। আমাদের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একবার বিজ্ঞানী নিলুফারকে নিয়ে ইরান গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পাঁচ-ছয়টি সুগন্ধি জাত নিয়ে এসেছিলেন। সেটা আমাকে আরও উদ্বুদ্ধ করে। এরপর আমরা ব্রি-৫০ তথা বাংলামতি উদ্ভাবন করলাম। বেশ সুগন্ধি এবং খুব সরু।
সব মিলে ধানের ২১টি জাত উদ্ভাবন হয়েছে আপনার নেতৃত্বে। এর মধ্যে আপনার সবচেয়ে প্রিয় জাত কোনটি।
দুটি। ব্রি-৩৭, ব্রি-৫০।
কেন?
৩৭ অবিকল কাটারিভোগের মতো। সুগন্ধি। ফলনও অনেক বেশি হয়। কিন্তু জনপ্রিয় হতে পারেনি ফটো সেনসিটিভিটির কারণে। কেবল দিনাজপুরে হয়। কারণ, ধান পাকার সময় আবহাওয়া এমন থাকে, যেটা দেশের অন্য কোথাও থাকে না। ব্রি-৫০ দারুণ সুগন্ধি। কিন্তু এটা যখন মিলে নেওয়া হলো, চালটা গুঁড়ো হয়ে গেল। এটা নিয়ে আরও কাজ করার আছে। আমি ২০১০ সালে অবসরে চলে আসি। এখন অন্যরা হয়তো করবে। আমার সবকিছু আমি তাদের দিয়ে এসেছি। তবে এখন মাঝেমধ্যে শুনি, দেশের এখানে-সেখানে বাংলামতি নামে ধানের চাষ হচ্ছে।
কিন্তু চাল যে ভেঙে যায়, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা আপনি করেননি?
এখন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এটা করার চেষ্টা করছে। ইরানের যে ভ্যারাইটি আনা হয়েছে—ইত্যাদি দিয়ে চেষ্টা হচ্ছে।
এই উদ্ভাবনের জীবনে কোন কাজটি আপনার করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু করতে পারেননি।
ইচ্ছা ছিল হাওর এলাকার জন্য এমন একটা ধান উদ্ভাবন করা, যা বন্যা বা ঢল আসার আগেই পাকবে। করতে পারিনি। কারণ, সারা পৃথিবীতে এখন আদি জাত সংরক্ষণ করা হচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে নানা আইন হচ্ছে। জিন সোর্স সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কেউ কারও ভ্যারাইটি হস্তান্তর করতে চায় না। সেখানে আমরা আটকে গেছি। তাই বিকল্প ভাবতে হবে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বোরো ধানের মৌসুম। তখন ঠান্ডা। তাই আমাদের ঠান্ডাসহিষ্ণু ধানের দিকে যেতে হবে। ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার নিচে ধানের থোড়ই আসবে না। ১৮ ডিগ্রির নিচে হলে ধান চিটা হয়ে যায়। এটাই ধানের মর্মকথা।
শীতকালের জন্য একটা জাতের ভাবনা আপনার আছে বোঝা যাচ্ছে। আমাদের তো এখন শীতের জন্য বোরো আছেই। শীতকালের জন্য যে ভ্যারাইটি চাইছেন, তাকে তাহলে কোন সময়ে ব্যবহার করা হবে?
চিন্তাটা হলো আমরা নভেম্বরে রোপণ করব এবং মার্চ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে কেটে ফেলব। তাহলে আমরা মোটামুটি হাওর এলাকার বন্যা থেকে বাইরে থাকতে পারব। আরেকটা বিষয় হলো, এর সঙ্গে যদি লবণসহনীয় মাত্রা যোগ করা যায়, তাহলে নদীর লবণাক্ত পানিও আপনি ব্যবহার করতে পারবেন। তাতে শ্যালো মেশিন, ডিপ টিউবওয়েল আর লাগবে না। খরচ কমে যাবে। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে নদী থেকে একটা সেচ দিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। ফুল এসে যাবে। তাহলে মার্চের ১৫ তারিখের মধ্যে আপনি ধান কাটতে পারবেন। মানে আমরা ‘ঠান্ডা লাভিং’ একটা ধান চাই, গমের মতো। এর জন্য আমাদের জিন সোর্স লাগবে। কিন্তু এটা কেউ আর দিতে চায় না।
ভ্যারাইটি কি এলাকা ধরে, নাকি জলবায়ুর ভিত্তিতে করা হয়। জাত উদ্ভাবনের সময় আপনাদের চিন্তাটা কী থাকে?
প্রথমত, আমরা দেখি মৌসুম। যেমন আউশ যখন চাষ হয়, তখন দিন সবচেয়ে বড় থাকে। উদাহরণ দিই। আপনি যদি হেঁটে যান, তাহলে বহুদূর যেতে পারবেন। কিন্তু দৌড়ালে যেতে পারবেন কম দূরত্ব। কারণ শক্তিক্ষয়। আউশের সময় যেহেতু তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে, গাছের শক্তিক্ষয় বেশি হয়। ফলে ফলন কমে যায়। আবার তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণে সেল ডিভিশন বেশি হয়। গাছের বৃদ্ধি হয় দ্রুত। তাতেও ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ জন্য দেখবেন আউশের ফলন কম হয়।
আমন শুরু হয় বড় দিন দিয়ে, শেষ হয় ছোট দিনে। গরম দিয়ে শুরু, ঠান্ডা দিয়ে শেষ। এই কারণে আমনের ফলন আউশের চেয়ে বেশি। আবার বোরো শুরু হয় ঠান্ডা দিয়ে (নভেম্বর-মার্চ), শেষ হয় গরমে। এর জীবনকাল বেশি; ফলনও বেশি।
এর মানে ঠান্ডাসহিষ্ণু জাতের ধান উৎপাদনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারবে। আচ্ছা, উদ্ভাবনের সময় আর কী কী বিষয় গুরুত্ব দিতে হয়?
কৃষকের জন্য বেশি ফলন, ভোক্তার জন্য গুণমান। চাল ভালো হলে ভোক্তার চাহিদা থাকবে, ভোক্তার চাহিদা থাকলে কৃষক উৎপাদন বাড়বে। যেমন: বোরো-২৮, ২৯। ২৮-এর গ্রেইনটা একটু ভালো। ২৯-এর গ্রেইন কোয়ালিটি ২৮-এর চেয়ে একটু কম। এ কারণে ২৮-এর চাহিদা বেশি, উৎপাদনও হয় বেশি।
স্বাস্থ্য সচেতনতা, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে কিছু মানুষের মধ্যে ভাত খাওয়ার প্রবণতা কমছে। একে কীভাবে দেখছেন?
এই জায়গা থেকে শুরু হয় প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট (পণ্যের উন্নয়ন)। কম খাবে, কিন্তু বেশি পুষ্টি থাকতে হবে। কেউ চাইবে চালে জিআই কম হোক, যাতে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমরা এদের বলছি হাইব্রিড কার্ব। এখন এ ধরনের প্রোডাক্টই আসছে; সুপার প্রোডাক্ট।
স্টিকি রাইসের (আঠালো ভাত) কোনো ভ্যারাইটি কি আমাদের আছে?
আমিও একসময় ভাবতাম, জাপান, কোরিয়া, চীন, রাশিয়ায় যে স্টিকি রাইস খায়, তার জাত আমাদের এখানে হবে কি? জানলাম, ওরা এ গ্রেডের জাপনিকা রাইস খায়। এই ধান অন্য দেশ আমদানি করতে পারে না। এ কারণে এটা গবেষণায় স্থিত হয়নি।
শুধু একটা কারণে হাইব্রিড ধান, যেটা চীন থেকে আসছে, বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে পারছে না। কারণটি হলো, এর জেনেটিক সোর্সে আছে লো অ্যামাইনোস।
অ্যামাইনোস কী?
অ্যামাইনোস হলো চালের একটা কেমিক্যাল কম্পাউন্ড। এটার পরিমাণ কম হলে ভাত আঠালো, ভেজা হয়। অ্যামাইনোসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ওয়াক্সি—এটা পুরো আঠালো। চীনারা খায়। ইন্টারমিডিয়েট—জাপানিরা খায়। এর অ্যামাইনোস হচ্ছে ২০ থেকে ২৪ ভাগ। আমরা যেটা খাই, সেটা হলো হার্ড রাইস। অ্যামাইনোসের পরিমাণ ২৪ শতাংশের বেশি। তাই ভাত ঝরঝরে হয়। পানি ছাড়ে না।
ছোটবেলায় আপনার প্রিয় ধান কী ছিল?
আমার বাড়ি নওগাঁ। খরাপ্রবণ এলাকা। আমার প্রিয় ছিল জিরাশাইল ও সোনাশাইল।
আপনি ২১টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। ১৫টির উদ্ভাবনী দলের সদস্য। আপনি ধান উৎপাদন করেন না। শহরে থাকেন। আপনার বাসায় কী চাল খান?
নাজিরশাইল, গ্রেট করা। প্রশ্নটা করায় কথাটা এল। আমরা বাজার থেকে যে নাজিরশাইল কিনি, তা চালকলে কেটে, পলিশ করে করা হয়। এটা নাজিরশাইল ধান থেকে হয় না। কারণ, এই ধান খুব কম উৎপাদিত হয়। এর বিকল্প হিসেবে আমরা উদ্ভাবন করেছি ব্রি-৪৯। এটা জনপ্রিয় হচ্ছিল। কিন্তু একটা পোকার আক্রমণে এটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। রোগটার নাম ‘লক্ষ্মীর গু’। ধানের মধ্য সবুজ একটা গোটার মতো হয়। গায়ে লাগলে লেপটে যায়।
নামটা ‘লক্ষ্মীর গু’ কেন?
আগে গ্রামে ধানে ‘লক্ষ্মীর গু’ দেখা দিলে বলা হতো, সে বছর ধান বেশি হবে। আসলে বৃষ্টি বেশি হলে এটা দেখা দেয়। বৃষ্টি হওয়া মানে শুষ্ক এলাকায় ধানের জন্য ভালো। মানে লক্ষ্মী এনেছে। আবার জিনিসটা গায়ে লাগলে ঘিনঘিন করে। তাই এমন নাম।
এটা তাহলে কোন ভ্যারাইটি?
স্বর্ণা। ইন্ডিয়ান স্বর্ণা থেকে এটা করা হয়।
এর মানে আপনার প্রিয় ধানটা আপনি খেতে পারছেন না।
হ্যাঁ, উৎপাদন কম হয়।
আপনার ছেলেমেয়ে কজন?
এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
তাঁরা কি জানেন, আপনি ধানের ২১টি জাত উদ্ভাবন করেছেন?
অত ভালোভাবে জানে না। তবে ধারণা আছে, বাবা অনেক কাজ করে।
তাহলে আপনার কাজকে ছেলেমেয়েরা কীভাবে দেখেন?
পছন্দ করে বলে মনে হয় না। করলে তো এই পেশায় আসত। পছন্দ করবে কেন? আমি তো সারা জীবন মাঠেঘাটে পড়ে ছিলাম।
আপনি প্রচারবিমুখ। গুগল করেও আমরা আপনার সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি। গণমাধ্যমে আসেন না। ছেলেমেয়েরাও বিশেষ জানেন না। আপনার স্ত্রী কি জানেন কিছু?
তিনি কিছু কিছু বোঝেন। পুরস্কার-টুরস্কার দেওয়া হলে সে অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়ে যাই। এই আরকি! ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল রাইস কংগ্রেস আমাকে একটা পুরস্কার দেয়। কিছুই না—আউটস্ট্যান্ডিং কন্ট্রিবিউশন অন রাইস রিসার্চ। সেই কংগ্রেসটা ভারতে হয়েছে। সেখানে তাঁকে নিয়ে গেছি। এই আরকি! তবে পুরস্কার যে পাব, তা আগে থেকে জানতাম না। এখনকার মতো তখন আগে পুরস্কারপ্রাপ্তকে জানানো হতো না।
এই খাতে আপনি কত বছর সময় দিলেন?
প্রায় ৪০ বছর। ২০১০ সালে অবসরে গেছি। এখন পর্যন্ত থাকলে আমার ঝুড়ি অনেক বড় হতো। তবে যা হয়েছে, তাতেই খুশি।
আচ্ছা, আতপ আর সেদ্ধ চালের মধ্যে খাদ্যমানের কোনো পার্থক্য আছে?
কোনো পার্থক্য নেই। এটা মানুষের পছন্দের বিষয়। হাওর অঞ্চলে জ্বালানির সমস্যা ছিল, আছে। হতে পারে তারা ধান সেদ্ধ করার সুযোগ কম পায়। ফলে সেখানে আতপ চালের প্রচলন হয়েছে। সেখান থেকে চাল যে এলাকায় যায়, সেসব এলাকা, তথা পুরো সিলেট অঞ্চলে এই অভ্যাস হয়েছে।
আপনি একজন বিজ্ঞানী। গবেষণা করেন, নিভৃতে থাকেন। আমি মানবিকের ছাত্র। বিজ্ঞান বুঝি না। আমি একটা উদ্ভট জিনিস চাইব আপনার কাছে। আমি অফিসে আসার সময় দুপুরের খাবার নিয়ে আসি। হাতে সময় কম থাকে। ভাত নেওয়া, ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করা। কোনটা নেব? চামচ, বাটি ধোয়া—একটা হুলুস্থুল লেগে যায়। সেখান থেকে আমার মধ্যে একটা আকাশকুসুম চাওয়ার জন্ম হয়েছে। এমন কি হতে পারে, চালের মধ্যেই মাছ, মাংস বা সবজি ইত্যাদি যুক্ত করা থাকবে, কেবল ভাতটা রান্না করলেই হয়ে যাবে—মাছভাত, মাংসভাত, সবজিভাত—এমন; কিন্তু মাছ, মাংস, সবজির সব গুণাগুণ অটুট থাকবে?
সম্ভব হতেও পারে। কিছুটা হচ্ছে। কার্বের মধ্যে বিভিন্ন পুষ্টিগুণ যোগ করা। ইন্টারন্যাশনাল রাইস কংগ্রেসে আমি এটা দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও হয়েছে। চালকে গুঁড়া করে তার মধ্যে জিংক, আয়রন, ক্যারোটিন ইত্যাদি রাসায়নিক উপাদান মিশিয়ে খামি তৈরি করা হয়। সেই খামি মেশিনে ঢুকিয়ে আবার চাল বানানো হচ্ছে। কিন্তু আপনি চেয়েছেন বায়োপ্রোডাক্ট (মাছ, মাংস, মুরগি)। এটা চালের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে আরও বহু সময় লাগবে। তবে শুরুতে হয়তো ঘ্রাণযুক্ত চাল পেতে পারেন। আবার ভবিষ্যতে কখনো যদি মাছ, মাংস ইত্যাদি চালের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভবও হয়, তখন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা খেয়ে ফেলতে হবে; নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে বা পচে যাবে।
শেষ প্রশ্ন। এই দুই ঘণ্টার আলোচনায় কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমি আপনাকে করতে পারিনি, কিন্তু আপনার ইচ্ছা আছে আমাকে বলার?
হা হা হা! একটা গল্প বলি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগে আলাদা পদোন্নতি হওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। কোনো বিভাগে প্রমোশন হচ্ছে, কোথাও হচ্ছে না। এক-এগারো সরকারের সময় একটা সভায় এ নিয়ে আলোচনা হলো। আমি ছিলাম সেখানে। সরকারের অনেক বিভাগের লোকজন ছিল। সভার শেষ দিকে একজন সেনা কর্মকর্তা—যিনি আলোচনা করছিলেন—বললেন, এখানে ব্রির কেউ আছেন? আমি বললাম আছি। তিনি বললেন, আপনাদের কোনো সমস্যা আছে? আমি বললাম, সেনাবাহিনীর ভাইদের প্রতি সমীহ রেখে আমি একটা কথা বলতে চাই। এটা আমার কথা বলব, ইনস্টিটিউশনের কথা নয়। ...সেনাবাহিনীতে একজন সেনাপ্রধান আছেন। আবার সেখানে তাঁর সমমর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা আছেন। সে সময় নৌবাহিনীর প্রধানের পদ খালি হয়েছে। এখন কি আপনারা সেনাবাহিনীর ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে নৌবাহিনীর প্রধান করে দেবেন? দেবেন না। যা-ই হোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমার কথা, বিজ্ঞানীদের জন্য একটা আলাদা বেতনকাঠামো থাকতে হবে। নিয়োগের সময়ও কিছু যোগ্যতা, শর্ত নির্দিষ্ট থাকতে হবে। এটা না থাকা মানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের যেকোনো একজন গ্র্যাজুয়েটকে নিয়োগ দিয়ে আপনি তাঁকে বিজ্ঞানী বানাবেন। এটা তো লম্বা সময়ের ব্যাপার। বিজ্ঞানী নিয়োগের যোগ্যতা, শর্ত—এগুলো আরও উন্নত করতে হবে, যাতে আমি যথা লোকটি যথা কাজ করতে পারি। আমাদের মেধাবী লোক নিয়োগ দিতে হবে। যথাসময়ে পদোন্নতি দিতে হবে। না হলে আমাদের এই মেধাগুলো বিদেশে চলে যাবে।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
আপনাকেও।
শাহেদ মুহাম্মদ আলী, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক।