>
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী। ২৫ বছর ধরে পরিবেশ রক্ষায় আইনি লড়াইয়ে যুক্ত। প্রায় তিন শ মামলায় রায় পেয়েছেন। কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
প্রথম আলো: পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমি এখন যে কাজটা করছি, তার পেছনে আমার শিক্ষা ও পারিবারিক জীবন ভূমিকা রেখেছে। পারিবারিকভাবে একটি রাজনৈতিক আবহে বড় হয়েছি। শহরে বড় হলেও গ্রাম কী, সংকট কী, সম্ভাবনা কী, তা আমার সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। জীবনে এটা হব, হতে চাই—এমন কোনো চিন্তা করে কখনো এগোইনি। তবে আমি নিজে যেটাকে সঠিক মনে করি, তা আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করি। আমি যখন কোনো মানুষের বিষয় নিয়ে কাজ করি, তখন তার জায়গা থেকে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। স্কুলে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, বই থেকে পড়াতেন না। ডি কস্তা নামের ওই শিক্ষক বলতেন, তোমরা দশটা গাছের পাতা নিয়ে এসো। পাতা দেখে গাছের নাম লিখতাম। পরিবেশ রক্ষার মনোজগৎ সেখান থেকে তৈরি হয়েছিল।
প্রথম আলো: যেকোনো দেশেই পরিবেশ রক্ষায় কাজ তো বেশ কঠিন।
রিজওয়ানা: হুমম, অনেকে বলে, আমি এত প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে পরিবেশ রক্ষার মামলায় কীভাবে জিতি? এর প্রধান কারণ হচ্ছে, আমি ভুক্তভোগীদের সমস্যাটাকে সামনে থেকে বোঝার চেষ্টা করি। আমি পত্রিকার পাতা থেকে ক্লু নিই। ঘটনাস্থলে নিজে যাই। শুধু আইনের বইয়ে উত্তর খুঁজি না। মানুষের জীবনের গল্পের সঙ্গে আইনটাকে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক সময় দেশের বড় বড় আইনজীবী আমার প্রতিপক্ষ থাকেন। কিন্তু আমি মামলা জিতে আসি। এর কারণে আমার কাছে যুক্তি বেশি থাকে। যারা আমার প্রতিপক্ষ, তারাও জানে, অন্যায়টা যে হচ্ছে, তা আমি নিশ্চিত না হয়ে মামলা লড়ি না। ফলে আমার প্রতিপক্ষ আমার বিরুদ্ধে যখন অপপ্রচার চালায়, তখন তারা আমাকে মোরালি ডাউন করার চেষ্টা করে। ব্যক্তিগত আক্রমণ করে। এসব বিপদের সময় আমি আমার পরিবার থেকে সবচেয়ে বড় সহায়তা পাই। যে কারণে অনেক বাধাবিপত্তি আসার পরও আমি এগিয়ে যেতে পারি।
প্রথম আলো: প্রভাবশালীদের কাছ থেকে চাপ আসে না?
রিজওয়ানা: আমি ব্যক্তিগত স্বার্থে কোনো আইনি লড়াইয়ে নামি না। জনস্বার্থ থাকলে তবেই তাতে আমি নামি। মামলা লড়তে থাকলে নানা জায়গা থেকে চাপ আসে। শুধু যে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ীরা চাপ দেন, তা নয়। আমরাও তো সমাজে চলাফেরা করি। মামলায় অনেক প্রতিপক্ষ আমাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে তদবির করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি ভুক্তভোগীদের বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিই। এটা সবাই জানে। যে কারণে আমার প্রতিপক্ষও আমার সঙ্গে আলোচনা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের কথা বলেন?
রিজওয়ানা: আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন এরশাদের শাসনামল। মিথ্যা প্রচার, হত্যা, দুর্নীতির বিষয়গুলো তখন থেকে প্রবলভাবে শুরু হয়। এরশাদের পতনের সময় আমরা সারা দিনরাত রাজপথে কাটিয়েছি। এসব করে বাসায় যখন ফিরেছি, মা বাসায় ঢুকতে দেননি। তখন বাবার প্রশ্রয় পেয়েছি।
প্রথম আলো: বেলার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন।
রিজওয়ানা: বিষয়টা একটু কাকতালীয়। ১৯৯৩ সালের কথা, তখন আমরা ধানমন্ডির বাসায় থাকি। বেলার প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন ফারুক একদিন আমাদের বাসায় এলেন বাসা ভাড়া নিতে। কোনো এক কারণে তিনি বাসাটা ভাড়া নিলেন না। কিন্তু আমার মাকে একদিন বললেন, ‘আপনার মেয়ে তো আইনে পড়েছে। ওকে বলবেন বেলায় চাকরির একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়েছে, তাতে আবেদন করতে।’ আমি সেখানে আবেদন করার পর চাকরি হয়ে গেল। আমার প্রথম কাজ দেওয়া হলো দেশের সব কটি পরিবেশ আইন একত্র করা। তা করলাম। এরপর আমাকে তিনি বলেন মৎস্য আইন পড়তে। আমি খুব বিরক্ত হলাম। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘যান, পত্রিকায় নিউজ হয়েছে, নোয়াখালীর সেনবাগে একটি গ্রামে ১৮টি ইটভাটা। দেখে আসেন।’ আমরা দলবলে তা দেখতে গেলাম। সেখানে যাওয়াটা আমাকে খুবই আন্দোলিত করল। সেই থেকে পরিবেশ রক্ষার আইনি লড়াইয়ে পথচলা শুরু হলো। এরপর নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে আমরা জনস্বার্থে মামলা করলাম। যখন-তখন, যেকোনোভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টির বিরুদ্ধে মামলা করে রায় পেলাম।
প্রথম আলো: বেলা ছাড়া আর কোনো পরিবেশবিষয়ক আইনি সংগঠন তো দাঁড়াচ্ছে না?
রিজওয়ানা: আমাদের এই কাজে অনেক অর্জন আছে। আবার অনেক ঝুঁকিও আছে। যেমন আমরা যাদের পক্ষে আইনি লড়াই চালাই, তাদের কাছ থেকে কোনো অর্থ নিই না। উন্নয়ন–সহযোগীদের কাছ থেকে সব সময় তহবিল পাওয়া যায় না। এসব কষ্ট ও ঝুঁকি বেশির ভাগ আইনজীবী নিতে চান না। কিন্তু আমরা কাজ বন্ধ করি না। দেশের অনেক বরেণ্য আইনজীবী আমাদের পক্ষে বিনা পারিশ্রমিকে মামলা লড়ে দেন। জনস্বার্থে কাজ করি বলেই তা সম্ভব হয়েছে।
ইফতেখার মাহমুদ, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক