জলসাঘরের আলো-আঁধার
ইন্দোর রাজ শিবাজি হোলকারের জলসাঘরে বীণা বাজিয়ে মুগ্ধতার ইন্দ্রজালে সবাইকে আচ্ছন্ন করেছিলেন বীণাকার বন্দে আলী খাঁ। শিবাজির খাস নর্তকী চুন্নি বাই তখন রাজার পাশে বসে শুনছিলেন বীণকারের বাদন। বন্দে আলী খাঁর বাদন শুনে খুশি হয়ে তাঁকে ইনাম দিতে চাইলেন রাজা। এ সময় একটি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। ইনাম হিসেবে চুন্নি বাইকেই চেয়ে বসলেন বন্দে আলী খাঁ।
চুন্নি বাই ছিলেন বাইজি। তাঁর ওপর যেন সবার অধিকার। তাই তাঁকেই হাতবদলের ঘুঁটি হতে হয়েছিল রাজরাজড়াদের ইচ্ছাখুশির খেলায়। চুন্নি বাইয়ের মনের কথাটি জলসাঘরের কেউই সেদিন জানতে চায়নি। এন্টনী ফিরিঙ্গী চলচ্চিত্রে মান্না দে গেয়েছিলেন:
আমি যে জলসা ঘরে বেলোয়ারি ঝাড়
নিশি ফুরালে কেহ চায় না আমায় জানি গো আর
আমি যে আতর ওগো, আতরদানে ভরা
আমারই কাজ হলো যে গন্ধে খুশি করা…
এখানে চুন্নি বাইয়ের মনের কথা যেমন লেখা আছে, তেমনি একই সঙ্গে এতে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের হাজারো বাইজির অন্তর-বেদনার কাব্য আর দুঃখ-বঞ্চনার সীমাহীন অনুরণন। কেবল বাইজি বলেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে চুন্নি বাইকে ইনাম হিসেবে হাতবদল করা সম্ভব হয়েছিল। একইভাবে জানকী বাই, গওহরজান, আখতারী বাই—সবার জীবনই কেউ না কেউ হাতবদল করেছেন তাঁদের ভালোবাসা, সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে। আবার বাইজিদের প্রতি সামাজিক বঞ্চনা ও অবজ্ঞার কারণেও তাঁরা ঠকেছেন পদে পদে। জীবনভর এই নৃত্যগীত পটীয়সীরা যেন ছুটেছেন ভুল গন্তব্যে, মিছে ঠিকানায়।
কে তারে রাখে মনে...
প্রাচীনকাল থেকেই রাজরাজড়া ও সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের আনন্দ-বিনোদনের প্রধান উৎস হয়ে আছে সংগীত ও নৃত্য। জলসাঘরের আলোকিত আভায় গান–নাচের মাধ্যমে শ্রোতার মনে রসের সঞ্চার করার প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন বাইজিরূপী নারীরা। আদতে এঁরা সাধারণ কোনো নারী নন, তাঁদের হতে হতো নানা কলায় উত্তীর্ণ। বাইজিদের হাত ধরে এককালে নৃত্য ও সংগীত গভীর উৎকর্ষ লাভ করেছিল।
সে যুগে বাইজিদের দাম নির্ধারিত হতো ধনী ও ক্ষমতাসীনদের খেয়ালিপনা আর কানাকড়ি দিয়ে। এসব শিল্পীর দক্ষতা ও নৈপুণ্যকে কেনা হতো সোনা-চাঁদির বিনিময়ে। কিন্তু শুধু নারী হওয়ার কারণে ততখানি সম্মান তাঁরা পেতেন না, যা তাঁদের প্রাপ্য ছিল। এমনকি নাচ–গান ও রূপের নেশায় উচ্চ মান অর্জনের ফলে সম্মানিতা বা দুর্লভা হলেও কোনো পুরুষ শিল্পী কখনো এসব বাইজির সঙ্গে গানের আসরে বসতে চাইতেন না। তবে উল্টোটিও ঘটেছে। একবার কলকাতার এক আসরে মুস্তারী বাই পূরবী রাগে খেয়াল গেয়ে সুরের মদিরায় শ্রোতাদের এমন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলেন যে ওই আসরের পরবর্তী শিল্পীরা—বিখ্যাত ফৈয়াজ খাঁ, এনায়েত খাঁ ও হাফেজ আলী খাঁ—মঞ্চে উঠতে রাজি হলেন না। কারণ, মুস্তারী বাইয়ের সুরে আচ্ছন্ন শ্রোতাদের মুগ্ধতা ছিন্ন করার মতো কঠিন ঝুঁকি সম্ভবত তাঁরা নিতে চাইছিলেন না।
সমাজের প্রয়োজনেই বাইজি-সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছিল। বহু বাইজিই ছিলেন উঁচু মানের শিল্পী। তাঁদের কণ্ঠমাধুর্য, মোহনীয় নাচের ঝংকার আর দেহভঙ্গিমা, অনুপম রূপসৌন্দর্য মুগ্ধ, আবিষ্ট ও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল খোদ মোগল সম্রাট থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত এ দেশের বাবু, জমিদার ও বিত্তশালীদের। এই শ্রেণির প্রতি মুগ্ধ হয়ে কত রাজা, যুবরাজ, জমিদার তাঁদের স্তবগান করেছেন, তাঁদের পদতলে ছুড়ে দিয়েছেন মোহর! কিন্তু তাঁদের মনের ভাষা তাঁরা কোনো দিন বুঝতে চাননি। তাই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই বাইজিরা হয়েছেন অন্ধকারের বাসিন্দা।
ভারতবর্ষের হাজার হাজার বাইজির মধ্যে বিভিন্ন শহরে শুধু কিছু বাইজি অর্থযশ ও খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অধিকাংশই বৃদ্ধ বয়সে চরম দারিদ্র্য ও অবহেলায় সবার অগোচরেই এই জগৎ ত্যাগ করেছেন। হয়েছেন সংগীতের ইতিহাসে বিস্মৃত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের কোনো কোনো বাইজি সম্পর্কে আমাদের কিছুটা জানা হলেও প্রায় সবাই আজ ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছেন। অথচ একটি সময়ে ভারতের মার্গ সংগীতের ধারা তাঁদের মাধ্যমেই ছিল চর্চিত ও বহমান।
বাইজিদের সবটাই যে ছলাকলায় পূর্ণ ছিল, তা নয়। তাঁদের ভেতরে যে মানুষটি বাস করত, সেখানে প্রবাহিত হতো ভালোবাসার ফল্গুধারাও। তাঁরাও চেয়েছিলেন প্রিয়তম পুরুষকে ভালোবেসে সুখের ঘর রচনা করতে। কিন্তু প্রায়ই তাঁদের সে স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেছে। কেননা স্বপ্নপূরণের পথে ছিল পাহাড়সমান সামাজিক বাধা। আবার কখনো বাইজিরা ভালোবাসায় নিজেদের সমর্পণ করে হয়েছেন প্রতারণার শিকার। বুঝেছেন, রূপমাধুর্য ও সম্পত্তির লোভেই কোনো কোনো পুরুষ তাঁদের জীবনে এসেছিল, স্বার্থ হাসিলের পর সরে পড়েছে।
এসব ডিঙিয়ে কেউ কেউ সমাজের উঁচুতে অবস্থানরত পুরুষের সঙ্গে ঘর বাঁধলেও তাতে ছিল নানা শর্তের প্রতিবন্ধকতা। এগুলোর মধ্যে বড় শর্তই ছিল মাহফিল বা কোনো অনুষ্ঠানে গান গাওয়া যাবে না।
প্রেমে শুধু প্রতারণা নয়, বিত্তশালীদের খেয়ালিপনায় অত্যাচারিতও হয়েছিলেন বাইজিরা। বিখ্যাত বাইজি মালকাজান ও তাঁর কন্যা ভারতের বাইজি মহলের সম্রাজ্ঞী গওহরজান থেকে শুরু করে মোতি বাই, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, রসুলান বাই, জানকী বাই এমনকি বিখ্যাত বেগম আখতার (আখতারী বাই)—কেউই এই বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাননি। ভারতীয় মার্গ সংগীতের খ্যাতিমান শিল্পী রেবা মুহুরীর ভাষায়, ‘অনেকের কাছেই আমি শুনতাম, রাতে বাইজিদের গান শুনে যাঁরা মুগ্ধ, তাঁরাই আবার দিনের বেলায় সেই বাইজিকেই নর্দমার পাঁক ভাবতেন। যেন তাঁদের নাম উচ্চারণেও পাপ। যখন-তখন বাইজিদের সম্পর্কে এই সব মন্তব্য শুনে আমার খুব দুঃখ হতো।’
একবার রেবা মুহুরী তাঁর বাবা অমিয়নাথ সান্যালকে—যিনি নিজেও ছিলেন উচ্চ মানের মার্গ সংগীতের সুগায়ক—প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি তো বাইজিদের সঙ্গে অনেক মেলামেশা করেছ। তাঁদের থেকে অনেক গান শিখেছ, দেখেছ তাঁদের খুব কাছ থেকে। তাঁরা কি আমাদের মতো স্বাভাবিক মানুষ নন? তাঁদের মানুষে এত ঘৃণা করে কেন?’
উত্তরে তাঁর বাবা অমিয়নাথ সান্যাল বলেছিলেন, ‘তাহলে একটা সত্যি কথা শোন। এই যে এত বড় বড় বাইজি, যাঁদের লোকে ঘৃণা করে, আমার মতে তাঁরা এক-একজনা গান্ধর্বী। আসলে এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে একজন গান্ধর্বীর যে সম্মান পাওয়া উচিত, সে সম্মান আমরা দিতে পারিনি।’
জানকী বাই
জীবন নিয়ে নানান ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হতো বাইজিদের। কোনো বাইজি গান গেয়ে নাম করলে তাঁকে নিয়ে, তাঁকে পাওয়ার জন্য রাজা-মহারাজা ও জমিদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। সবাই তাঁকে প্রচুর টাকা দিয়ে কিনে নিতেন, নিজের ইচ্ছেকে চাপিয়ে দিতেন বাইজিদের মনের বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই প্রতিযোগিতা কখনো কখনো সহিংস রূপ নিত। খুনখারাবিতেও জড়িয়ে পড়তেন কেউ কেউ। খুনের শিকার হতেন বাইজিরা। জানকী বাইয়ের জীবনেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।
এলাহাবাদের জানকী বাইকে সবাই ‘ছাপ্পান্ন ছুরি’ বলে ডাকত। সারা ভারতে তাঁর খ্যাতি ছিল। সত্যেন সেন তাঁর লেখায় এই জানকী বাইয়ের কথা লিখেছিলেন। জানকী বাই ঢাকায়ও ছিলেন কিছুদিন। ঢাকায় তিনিই সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেতেন। সে সময়ে এক দিনের মুজরার জন্য তাঁকে দিতে হতো দেড় হাজার টাকা। জানকী বাই দেখতে তেমন সুন্দরী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর গান শুনে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে যেত। তাঁর স্বামী ছিলেন সারেঙ্গিবাদক। তখনকার দিনে বাইজিদের সঙ্গে তাঁদের সারেঙ্গিবাদকদের খুব ভালো সম্পর্ক ও বোঝাপড়া ছিল। স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসতেন জানকী। সেই সময়ে একজন ধনী ভদ্রলোক গান শুনে জানকীর প্রেমে পড়ে যান। তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন তিনি। একসময় জানকীকে তিনি চাপ প্রয়োগ করেন, স্বামীকে ত্যাগ করে যেন শুধু তাঁর সঙ্গেই থাকেন। কিন্তু স্বামীকে ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান জানকী। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে ওই বিত্তবান লোকের গোলমাল বেড়েই চলছিল। একপর্যায়ে জানকীকে চোখে চোখে রাখার জন্য গোপনে লোক নিয়োগ করলেন তিনি।
এর মধ্যে নিজের বিপদ বুঝতে পেরে জানকী বাইও গোপনে স্বামীকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন—এমন মনস্থির করলেন। একদিন অন্ধকারে জানকী এলাহাবাদের গঙ্গার ঘাটে নৌকার কাছে পৌঁছালে অকস্মাৎ ওই লোকের ওঁত পেতে থাকা গুন্ডারা তাঁদের ওপরে হামলে পড়ে। আদতে জানকী বাইয়ের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আগেই ওই ব্যক্তি জেনে গিয়েছিলেন। ঘটনাস্থলেই গুন্ডারা জানকী বাই ও তাঁর স্বামীকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। সেই সন্ধ্যায় ওই স্থানেই জানকীর স্বামী মারা যান। আর অজ্ঞান হয়ে গঙ্গার ঘাটে পড়ে থাকেন জানকী। এ সময় দুজনই মারা গেছেন ভেবে গুন্ডারা ওই ঘাটেই ফেলে রেখে যায় তাঁদের। জানকীর দেহে ছাপ্পান্নটা আঘাতের চিহ্ন ছিল। মুখ ও গলা বাদে তাঁর শরীরের সর্বত্র গুন্ডারা ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিল।
জানকী ও তাঁর স্বামী ঘাটে যখন নিঃসাড় পড়ে ছিলেন, তখনই তাঁদের নৌকাওয়ালা পালিয়ে যান। পরে এই বাইজিকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরে এলে থানা থেকে পুলিশ এসে প্রশ্ন করলে জানকী বাই ওই ধনী ব্যক্তির নাম বলে দেন। গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। এ হত্যাযজ্ঞের পেছনে যে ওই ধনী লোকেরই ইন্ধন রয়েছে—জানকী এটি খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন। তখন হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন এক ব্রিটিশ ডাক্তার। জানকীকে তিনি ওই লোকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করার পরামর্শ দিলেন। পরে পুলিশ কমিশনার সেই দায়ী লোককে হাসপাতালে ধরে নিয়ে আসেন। এরপর জানকী বাইয়ের সামনে যখন তাঁকে উপস্থিত করা হলো, সে সময় কেঁদেকেটে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বললেন, জানকীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়েই এই খুনের ঘটনা তিনি ঘটিয়েছেন। কিন্তু ঈশ্বরের দয়ায় জানকী যে বেঁচে আছেন—এটি তাঁর জন্য বিরাট সৌভাগ্যের ঘটনা।
এ সময় জানকীর কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলেন তিনি। জানকী জানতেন, লোকটি রাগের মাথায় এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাই তিনি পুলিশ অফিসারকে তাঁকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ছেড়ে দিলে জানকীর ওপরে তিনি আবার আক্রমণ করতে পারেন—এই আশঙ্কায় পুলিশ অফিসার তাঁকে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তবে জানকীর পুনঃ পুনঃ অনুরোধে শর্ত সাপেক্ষে তিনি তাঁকে মুক্তি দেন। এই দুর্ঘটনায় জানকী বাইকে এক বছর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছিল।
গওহরজান
গওহরজান ছিলেন খুবই শৌখিন আর ফ্যাশনসচেতন। গান রেকর্ড করা কিংবা মুজরায় অংশ নেওয়ার আগে নিজেকে মোহনীয় করে সাজাতেন। ভালোবাসতেন রূপচর্চা করতে। অর্ডার দিয়ে নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করে নিতেন। আসরে যে গয়না পরতেন, তার দাম সে যুগেই ছিল ৫০-৬০ হাজার টাকা। তাঁর দুই হাতে বাঁধা থাকত দুটি সিল্কের রুমাল। ওই আমলে শুধু বাইজিরাই নন, বাবু-বিবিরাও নকল করতেন গওহরের পোশাক-পরিচ্ছদ। গওহরজানের গান শুনতে হলে রাজা, জমিদার ও বিত্তশালী বাবুদের অগ্রিম বুকিং করতে হতো। এই গওহরজানও একাধিকবার পুড়েছিলেন প্রেমের অনলে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সুখী ছিলেন না। তাই ভালোবাসার দহন আর প্রিয়তমেষুর বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণায় আজীবন পুড়েছেন তিনি।
১৮৮৭ সাল। এক সন্ধ্যায় দুজন সুদর্শন পুরুষ গওহরের মা মালকাজানের কলকাতার বাড়িতে এলেন। তাঁদের একজন বেনারসের বিখ্যাত রাই পরিবারের সন্তান রাই ছগন। সুদূর বেনারস থেকে তিনি কলকাতায় এসেছেন গওহরের গান শুনতে। সঙ্গে বন্ধু মনোহর। ছগনকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় গওহরের। কয়েক দিন গভীর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গওহরের গান শুনলেন ছগন। উপহার দিলেন মুক্তার মালা। ধীরে ধীরে গওহরও ছগনের প্রেমে পড়লেন। মালকাজানের অনুমতি নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় গওহরকে নিয়ে কলকাতা শহরে ঘুরতে বেরোলেন ছগন। ফেরার পর গওহরকে জানালেন, তিনি বেনারসে ফিরে যাচ্ছেন, আজই কলকাতায় তাঁর শেষ সন্ধ্যা। বিচ্ছেদবেদনায় কাতর হয়ে পড়ল গওহরের মন। অশ্রুসিক্ত হয়ে ছগনের হাত ধরে তিনি বললেন, ‘যদি তোমাকে যেতে না দিই? তুমি কি থেকে যাবে? আমি কি তোমার মাত্র কয়েক দিনের ভালোবাসা?’ এ সময় গওহরের সামনে সাহেবি কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসলেন ছগন। বললেন, ‘তুমি যদি আমার সঙ্গে চলে আসো, তবে বেনারসে তুমি রানির মতো থাকবে।’
প্রেমে উদ্গ্রীব মেয়েকে মালকাজান বাধা দিলেন না। কলকাতার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ উপেক্ষা করে ছগনের সঙ্গে বেনারসে পাড়ি জমালেন গওহরজান। বাগানঘেরা সুন্দর একটি কটেজে বসবাস শুরু করলেন তাঁরা। গভীর ভালোবাসায় যেন হারিয়ে যেতে থাকলেন দুজন। গওহর কবিতা লিখলেন, ‘ছগন প্রিয়া’ অথবা ‘গওহর প্রিয়া’ নামে। তবে এই মধুময় প্রেমও বেশি দীর্ঘায়িত হলো না।
একদিন শহরের বাইরে ছিলেন ছগন। এ সময় গওহরের বাড়িতে এলেন ছগনের ভাই লালন রাই। তাঁর নিরীহ ভালো মানুষ ভাইয়ের জীবন নষ্ট করে দেওয়ার জন্য দায়ী করলেন গওহরকে। প্রস্তাব দিলেন, গওহর যদি এই শহর ছেড়ে চলে যান, তবে তিনি যত টাকা চান, দেওয়া হবে। আসলে সে সময় ছগনের পরিবারে সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা চলছিল। পরিবারের অন্য সদস্যদের আশঙ্কা, ছগন হয়তো তাঁর অংশ গওহরকে লিখে দেবেন।
এদিকে পরিবারের সহায়তায় ছগন তখন আরেক সুন্দরী ও বিদুষী ব্রাহ্মণ মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হন, তাঁকে বিয়ে করতে মনস্থির করেন। ছগনের মধ্যে দ্রুত নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। গওহর বুঝতে পারলেন, তিনি তাঁর মনের মানুষকে হারাতে বসেছেন। তাই আর বেনারসে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না তিনি। ১৮৯১ সালের ৩০ জুলাই ছগনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন গওহর। আমার নাম গওহরজান (২০১০) বইয়ে বিক্রম সম্পত লিখেছেন, ‘উচ্চ শ্রেণির এসব মানুষ তাদের নিজেদের আনন্দের জন্য পুজো করে তাদের অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তারপর খুব সহজেই নিজেদের জীবন থেকে তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়। কেউ এদের আচার-আচরণ নিয়ে একটা প্রশ্নও তোলে না।’
গওহর যখন খ্যাতির শিখরে, সে সময় তাঁর জীবনে এলেন গোলাম আব্বাস নামের এক আফগান যুবক। আব্বাসের প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়ে করলেন গওহর। কিন্তু আসল ঘটনা হলো, গওহরের বিপুল অর্থ-সম্পত্তির লোভে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন আব্বাস। কপট ভালোবাসার অভিনয় করে গোলাম আব্বাস গওহরের তিনটি বাড়ি নিজের নামে লিখিয়ে নেন। এমনকি ব্যাংকে গচ্ছিত নিজের টাকাকড়ি শেয়ার কেনার জন্য আব্বাসের হাতে তুলে দেন গওহরজান। কিন্তু শেয়ারবাজারে এই আফগান যুবকের বিরাট লোকসান হলে দালালরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। ফলে গওহরকে স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু ছিল, তা বিক্রি করে দেউলিয়া হতে হয়। আব্বাসের কারসাজিতে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন তিনি। তখনই বেরিয়ে পড়ল আব্বাসের আসল রূপ। এ সময় বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে গওহরকে আদালতে মামলা করতে হয়। আব্বাসকে তিনি বেশ কয়েকটি বাড়ি দানপত্র করে দিয়েছিলেন। বিশ্বাসভঙ্গের কারণে সেই দানপত্র নাকচ করার জন্যই করতে হলো মামলা। এতে গওহরজান জিতলেও একটি বাড়ি আব্বাসকে দিয়ে তাঁর সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আর মামলা চালাতে দেনায়ও জড়িয়ে পড়েছিলেন গওহরজান। আসবাব, অলংকার ও বাড়ি বিক্রি করে দেউলিয়া হয়ে যান। সেই দুর্দিনে তাঁর কিছু ছাত্রছাত্রী তাঁকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছিল।
এরপর কলকাতা ছেড়ে মহিশুরের মহারাজ কৃষ্ণরাজ ওয়ারিয়াবের দরবারে সংগীতশিল্পী হিসেবে যোগ দেন গওহরজান। মহিশুরে যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে কোনো এক দিন মারা যান তিনি। এর কিছুদিন পরে ১৯৩০-এর ২৮ জানুয়ারি দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় গওহরজানের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। গওহরের সমাধি পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
বেগম আখতার
‘জোছনা করেছে আড়ি/ আসে না আমার বাড়ি/ গলি দিয়ে চলে যায়/ লুটিয়ে রুপোলি শাড়ি...’—সুপরিচিত ঠুমরি ঘরানার এই গানটির কথা মনে হলেই মনে পড়ে বেগম আখতারের কথা।
পরবর্তী জীবনে তিনি নিজের প্রতিভায় খ্যাতিমান হয়েছিলেন বটে, তবে প্রথম জীবনে তিনি বাইজি ছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল আখতারী বাই। মুস্তারী বাইয়ের মেয়ে আখতারী বাই। টিকে থাকার জন্য জীবনে তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। বাইজি-জীবনে তিনি ধর্ষণেরও শিকার হয়েছিলেন।
পরে এই কিংবদন্তি শিল্পী এক নবাবকে বিয়ে করেন। বেগম আখতার যখন নবাবকে বিয়ে করেন, তখন মাহফিলে বা সর্বত্র গান গাইতে পারবেন না, এমনটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। অনেক বছর গান করেননি। যদিও পরবর্তী সময়ে সংগীতের জগতে ফিরে এসেছিলেন তিনি । একদিন কা বাদশাহ ছবির সাতটি গানের সব কটিই গেয়েছিলেন তিনি। সেটি ছিল সিনেমায় তাঁর প্রথম গান গাওয়া।বেগম সাহেবা চলচ্চিত্রেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এভাবেই ঠুমরি, গজল ও দাদরার শিল্পী বেগম আখতার সাধারণ্যে পেয়েছিলেন বিপুল পরিচিত। তাঁর বেশ কিছু ঠুমরি ও গজলের রেকর্ড বেরিয়েছিল।
বেগম আখতার পরবর্তী জীবনে যেমন পেয়েছেন সুখ্যাতি-সম্মান, ঠিক তেমনি তিনি যখন আখতারী বাই ছিলেন, জীবনের সেই প্রথম অধ্যায়ে পেয়েছিলেন প্রচণ্ড এক আঘাত। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
বিহারের একটি স্টেট রাজের রাজার আমন্ত্রণে মা মুস্তারী বাই ও ওস্তাদ আঁতা খান সাহেবের সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করতে সেখানে গিয়েছিলেন আখতারী বাই। ছিলেন দুদিন। শেষের দিন অনুষ্ঠান শেষে তিনি যখন তাঁবুতে ফিরে এলেন, তখন তাঁর মা ছিলেন বাইরে। এমন সময় রাজার পক্ষের এক সংবাদবাহক বললেন যে মুস্তারী বাই রাজার কাছ থেকে উপহার ও ইনাম নেওয়ার জন্য আখতারী বাইকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আসলে এটা ছিল একটা জঘন্য ফাঁদ। রাজা স্বয়ং বেগম আখতারকে প্রসাদে বন্দী করে রেখে ধর্ষণ করেছিলেন। মুস্তারী বাই তাঁবুতে এসে যখন জানলেন, মিথ্যে বলে তাঁর মেয়েকে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তখন তিনি আর আঁতা খান ছুটে গেলেও রাজপ্রাসাদে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরের দিন তাঁদের ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। একই সঙ্গে এ কথাও জানা যায় যে স্টেটের রাজা ছাড়াও আরেকজনের কাছে ধর্ষিত হয়েছিলেন বেগম আখতার ওরফে আখতারী বাই। তিনি আর কেউ নন, ছিলেন তাঁর শিক্ষক।
প্রেমেও পড়ছিলেন বেগম আখতার। হায়দরাবাদের নিজামের ছোট ছেলে মোয়াজ্জেম ঝা। নিজামের প্রাসাদে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বেশ কিছুদিন গানের মাহফিলে যোগ দিয়েছিলেন বেগম আখতার। সেখানেই মোয়াজ্জেম ঝা তাঁকে ভালোবেসে ফেলেন। কিন্তু আইনসম্মতভাবে বিয়ে না করে তিনি তাঁকে রক্ষিতা বা মিস্ট্রেস হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী নিজামের ছোট ছেলেকে কোনো বনেদি বা ‘রয়্যাল ফ্যামিলি’র মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। তাই বাস্তবতা বুঝেই বেগম আখতার মোয়াজ্জেমকে আর বিয়ে করেননি।
ওস্তাদ আমির খানের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একটি অনুষ্ঠানে আমির খানের মৃত্যুসংবাদ শুনে তৎক্ষণাৎ নিজের হোস্টেলে চলে যান বেগম আখতার। এ ঘটনায় তিনি এতটাই মুষড়ে পড়েছিলেন যে প্রায় দুই দিন নিজের ঘরে উদ্ভ্রান্তের মতো কাটিয়েছেন। আসলে অন্য বাইজিদের মতো আখতারী বাইয়ের জীবনও ছিল না–পাওয়ার বেদনায় পরিপূর্ণ।
তুলসী বাই
শেষবেলায় বেনারসের ডালকামন্ডীর তুলসী বাইয়ের জীবনের চমকপ্রদ একটি গল্পও বলা দরকার। তুলসী বাই স্বভাবতই এখানে হাজির। আরও আছেন বাইজি রাধা বাই। এই কাহিনিতে সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের কারণে বাইজিদের ইচ্ছা–অনিচ্ছা জলাঞ্জলি দেওয়ার চিত্র যেমন হাজির, তেমনি সংগীত-অন্তঃপ্রাণ মানুষের প্রতি তাঁদের দরদের ছবিটিও ফুটে ওঠে।
সুন্দরী, শান্তশিষ্ট ও সভ্য ডালকামন্ডীর তুলসী বাই ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ বাইজি। ভালো ভজন, খেয়াল আর গজল গাইতেন, কিন্তু ঠুমরি গাইতেই ছিল তাঁর আপত্তি। ঠুমরি গাইতেন না, আবার ধর্মপ্রাণ বাইজি—এটি আবার হয় নাকি! কিন্তু তা–ই হয়েছিল। তবে তুলসী বাই কেন ঠুমরি গাইতেন না, তা কেউই জানত না। আর ঠুমরি না গাওয়ার ফলে তাঁর গান শোনার লোকও খুব বেশি হতো না সেকালে। ফলে খুব কষ্ট করে চললেও তাতেই খুশি ছিলেন তুলসী বাই। তাঁর বাড়ির সামনের সড়ক থেকে একটু দূরেই ছিল তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট পরমা সুন্দরী, নাচিয়ে ও ঠুমরি জানা রাধা বাইয়ের বাস। রাধার গীতমাধুর্যে সবাই তখন মাতোয়ারা। তাই রাতভর তাঁর বাড়িতে গান শুনতে আসে অনেক লোক। অনেক বিত্তশালীর কাছেও এই বাইজির বেশ কদর।
রাধা বাইয়ের কণ্ঠে ঠুমরি শোনার জন্য ঠুমরিপাগল এক ভদ্রলোক রোজই আসতেন তাঁর জলসায়। রাধার ঠুমরি ও রূপে মুগ্ধ এই ভদ্রলোক তাঁর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে গেলেন। বিয়ে করতে চাইলেন রাধাকে। কিন্তু এই গল্পে রাধা নামের ‘লাড়কি’র পাশে একজন ‘লাড়কা’ নয়, দুজন ছেলে উপস্থিত। ফলে এতে বাদ সাধলেন প্রভাবশালী এক বিত্তবান মানুষ। প্রায় একই সময়ে তিনিও মজেছিলেন রাধার প্রেমে। রাধাকে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে তাঁকে অধিকার করে নিতে চাইলেন তিনি। তবে ওই ঠুমরিপাগল লোকটি যে প্রতিদিনই রাধার ডেরায় আসেন এবং তিনি যে রাধার প্রেমে মত্ত—এসব জেনে যেতে বিত্তবান লোকটির সময় লাগল না। এ সময় রাধা বাইকে তিনি সাবধান করে দিয়ে বললেন, ওই লোক যেন আর না আসে। এবার রাধা পড়লেন বিপদে। তাঁর তখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। অবশেষে ঠুমরিপ্রেমীকে তিনি বোঝালেন যে তাঁকে বিয়ে করলে তাঁর সব হারাতে হবে। সমাজ তাঁকে গ্রহণ করবে না, তাই তিনি যেন এখানে আর না আসেন। এ সময় রাধা বাই বিত্তশালী ওই ব্যক্তির কথা জানিয়ে লোকটিকে এ-সংক্রান্ত বিপদের কথাও বললেন। কিন্তু ঠুমরিপাগল রাধাকে ছাড়া বাঁচবেন কীভাবে! হাঙ্গামা এড়াতে তাই দিনের বেলায় রাধার বাড়িতে পড়ে থাকতেন তিনি। এদিকে ধনী লোকটি এ বিষয়টিও জেনে গেলেন। ওই বেচারাকে এবার চিরতরে দুনিয়াছাড়া করার ব্যবস্থা নিলেন তিনি।
একদিন সকাল নয়টার সময় সেই ঠুমরিপাগল রইস ভদ্রলোক তুলসী বাইয়ের বাড়ি ছাড়িয়ে রাধা বাইয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় আড়াল থেকে কয়েকজন গুন্ডা ছুটে এসে তাঁকে ছোরা মারতে শুরু করে। রইসের চিৎকার–চেঁচামেচিতে তাঁকে উদ্ধার করা তো দূরের কথা, ভয়ে সবাই ঘরের মধ্যে পালিয়ে গেল। আর ঠুমরিপাগল মানুষটি আর কিছুক্ষণের ভেতরেই মারা যাবেন ভেবে তাঁকে শূন্য রাস্তায় ফেলে গেল গুন্ডারা। রক্তাক্ত অবস্থায় লোকটি পড়ে আছেন। মাঝেমধ্যে পানি পানি বলে আওয়াজ করছেন। ওই সময়ে তুলসী বাই গঙ্গায় স্নান করে মন্দিরে পুজো দিয়ে পাত্রে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। লোকটির ‘পানি পানি’ চিৎকার শুনে তাঁর কাছে গিয়ে বসলেন তুলসী। লোকটির জন্য খুব মায়া হলো তাঁর। পাত্র থেকে পানি ঢেলে দিলেন তাঁর মুখে। লোকটির মুখ মুছিয়ে তাঁর মাথাটা নিজের কোলের ওপর নিলেন। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে তুলসী বাই তখন কাঁদছেন এই ভেবে যে লোকটি গান এত ভালোবাসেন! লোকটার জন্য তুলসীর খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাঁর মনে তখন হয়তো ভেসে উঠছিল কোনো স্বজনের মুখ।
এমন সময় ওই লোক তুলসীর কাছে একটা আবদার করে বসেন, তিনি যেন তাঁকে একটা ঠুমরি গেয়ে শোনান। এখন তুলসী বাইয়ের বিস্ময়ের সীমা থাকল না। মৃত্যুপথযাত্রী রইস নামের লোকটি মৃত্যুর আগে তাঁর কাছে ঠুমরি শুনতে চাইছেন! কিন্তু তিনি তো কখনো ঠুমরি গান না। কিন্তু তিনি তিনি কী করবেন? অগত্যা মৃত্যুর মুখে বসে থাকা সেই গানপাগলকে সান্ত্বনা দিতেই একটি গান রচনা করলেন তিনি। গাইতে শুরু করলেন আস্তে আস্তে: ‘শো যাও করে জিয়া মে মেরে লাল...।’
পুরো গানটি অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় এমন:
ছেলে, তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শোও
আমার বুকের ওপর মাথা রেখে তুমি ঘুমোনোর চেষ্টা করো
আমার এই যে বুকখানা—
ওটা সুখশান্তি দিয়ে তৈরি করা একটা পালঙ্ক
তুমি তো আবার পালঙ্ক ছাড়া ঘুমাতে পারো না,
তুমি এটাকেই পালঙ্ক মনে করো
মৃত্যুর জন্য ভয় পেয়ো না।
একমনে গান গেয়ে যাচ্ছেন তুলসী বাই। চোখের পানিতে তাঁর মুখ ভিজে যাচ্ছে। পুরোপুরি বিভোর হয়ে গেছেন গানে। এদিকে সবাই একে একে বেরিয়ে আসছে। গানপাগল মানুষটি ততক্ষণে মারা গেছেন। তখনো গেয়ে চলছেন তুলসী বাই। লোকজন এসে মৃতদেহটি সরিয়ে নিয়ে গেল। তুলসী বাই চলে গেলেন নিজের ঘরে। এর পরদিন থেকে তাঁকে আর পাওয়া গেল না। তিনি যে কোথায় হারিয়ে গেলেন—কেউ তাঁর হদিস পেল না। পরে লোকজন বলছিল যে তুলসী বাইয়ের একটি ছোট ছেলে খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল। ছেলে, স্বামী ও সংসার হারানোর সঙ্গে ওই লোকের এমন মৃত্যু হয়তো তাঁকে এই সংসারের মায়া ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
পরবর্তীকালে অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠেই শোনা গেছে ‘শো যাও করে জিয়া মে মেরে লাল’ গানটি। এই গানের নেপথ্য কাহিনি অবশ্য বেশির ভাগই জানতেন না।
সেকালের বাইজিদের জীবন জলসাঘরের মতো বর্ণময় আর আলো-ঝলমলে ছিল না। শোষণ, পেষণ, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, প্রতিযোগিতা দারিদ্র্য, অবহেলা, অত্যাচার— আলোর নিচে আঁধারের মতো এগুলোই ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাইজিদের জীবনের মর্মকথা যেন মান্না দের গাওয়া সেই গানের মতোই: ‘আলেয়ার পিছে আমি মিছেই ছুটে যাই বারে বার…’।
...
দারিদ্র্য তাঁদের ‘মহান’ করেনি
জলসাঘরে বেলোয়ারি ঝাড়ের উজ্জ্বলতায় রাতে যেসব বাইজি ঝলমল করতেন, দিনের বেলায় তাঁদের অন্দরে দারিদ্র্য তাঁদের কখনো ‘মহান’ করেনি। একজীবনে বাইজিদের অনেককেই বারবার লড়তে হয়েছে দারিদ্র্যের সঙ্গে। এমনই একজন হলেন মোতি বাই। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী রেবা মুহুরী তাঁর বাইজি ও ঠুমরি বইতে মোতি বাইকে তুলনা করেছেন ‘বেনারসের প্রাণ বড়ী মোতি’ হিসেবে। তো দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত বিখ্যাত বেনারসের সেই বড়ী মোতি বাই শেষ বয়সে শহর থেকে দূরে এক শহরতলিতে এক গোয়ালঘরে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর এই দারিদ্র্যের পেছনেও রয়েছে নিষ্ঠুর এক গল্প।
বেনারসের এক সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তির বাগানবাড়িতে গানের জন্য আমন্ত্রণ জানালে মোতি বাই রাজি হননি। তাঁর স্পষ্ট কথা ছিল, বাড়িতে কোনো মাহফিল হলে তিনি যাবেন, কিন্তু বাগানবাড়িতে কদাচ নয়। ফলে মোতি বাইয়ের ওপর বেজায় খেপলেন সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি। মোতি বাই যেন কোনো অনুষ্ঠান বা মাহফিলে গান গাওয়ার সুযোগ না পান, সেই ব্যবস্থা তিনি পাকা করেছিলেন। এতে মোতি বাই খুব আর্থিক সংকটে পড়ে যান। এ সময় রেবা মুহুরীর একটি গানের অনুষ্ঠানে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শুধু একটি ভালো শাড়ি না থাকায় পিছিয়ে যান তিনি। পরে অবশ্য সে অনুষ্ঠানে তাঁর থাকা সম্ভব হয়েছিল রেবার দেওয়া শাড়ি উপহার পেয়ে।
শুধু মোতি বাই নন, আরও অনেকেরই এমন দীনহীন অবস্থা ছিল। তাঁদের দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রেডিওর অনুষ্ঠান বা মাহফিলে অংশগ্রহণের জন্য ভালো শাড়ি পর্যন্ত ছিল না। দারিদ্র্যের কথা এবং একই সঙ্গে আবার যখন রেবা মুহুরীর উল্লেখ পাওয়া গেল, তখন এখানে রাজস্থানের যোধপুরের বাইজি ফরহাদ-জিহান-বিব্বো এবং পাটনার বাইজি দুর্গেশনন্দিনীর কাহিনিটিও এই দফায় বলে ফেলা যাক। কারণ, মোতি বাইয়ের মতো বিব্বো ও দুর্গেশনন্দিনীর করুণ গল্পের সঙ্গেও রেবা মুহুরীর যোগ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই কাহিনিগুলো পাওয়া গেছে তাঁর বাইজি ও ঠুমরির সূত্রে। প্রথমে বলা যাক বিব্বোর গল্প।
ফরহাদ-জিহান-বিব্বোর তখন খুব নামডাক। তিনি গিয়েছিলেন যোধপুরের সংগীতকলা একাডেমির একটি অনুষ্ঠানে গান রেকর্ড করতে। ভেবেছিলেন, একটি ঘরেই তো গান রেকর্ড করা হবে। গিয়ে দেখলেন, তাঁকে মঞ্চে গাইতে হবে এবং সেই গানটি রেকর্ড করা হবে। কিন্তু বিব্বোর শাড়ি ও ব্লাউজের এতটাই জীর্ণ অবস্থা ছিল যে গানের আয়োজন শুরু হলেও গ্রিনরুমেই বসে ছিলেন তিনি। পরে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত রেবা মুহুরী দ্রুত তাঁর বাড়ি থেকে ভালো শাড়ি ও ব্লাউজ আনিয়ে বিব্বোকে মঞ্চে উঠিয়েছিলেন।
আরেকটি ঘটনায়ও বিব্বোর চরম দারিদ্র্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। যোধপুরের আর একটি অনুষ্ঠানে পাঁচ হাজার টাকার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গান রেকর্ড করার জন্য আনা হলো বিব্বোকে। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকেরা তাঁকে পাঁচ শ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলে তিনি কেঁদে ফেললেন। তখন আয়োজকেরা বিব্বোকে বলেছিলেন, টাকা দিলে তখনই সব টাকা আপনি খরচ করে ফেলবেন। তাই বাকি টাকাগুলো আমাদের কাছে থাকুক। পরে আস্তে আস্তে আপনাকে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
বলা বাহুল্য, সেই পরে আর কখনোই আসেনি। এর কিছুদিন পর মারা যান যোধপুরের এই বাইজি।
পাটনার বাইজি দুর্গেশনন্দিনীর কাহিনিটিও খুব মর্মন্তুদ। একবার দিল্লি রেডিও স্টেশনে গান রেকর্ডিং করতে গেলেন দুর্গেশনন্দিনী। পরনে জীর্ণ-পুরোনো শাড়ি। মুখাবয়বে আর্থিক কষ্ট আর মানসিক যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। সেখানেই এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে রেবা মুহুরীর পরিচয়। তখন দুর্গেশনন্দিনীকে রেবা বললেন যে তাঁর গান তিনি শুনেছেন বটে, কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে গাইতে দেখেননি। এতে দুর্গেশনন্দিনী দুঃখ করে বললেন, ‘আমার ভালো কাপড়চোপড় নেই। লোকের সঙ্গে ভালো করে মিশতেও পারি না। আমি অনেক দিন প্রায় গানবাজনা ছেড়ে দিয়েছি। এই রেডিও স্টেশনের বাবুরা দয়া করে যখন ব্যবস্থা করেন, তখনই মাঝেমধ্যে এসে গানটান করি।’
নিজের পেশা ছেড়ে দুর্গেশনন্দিনী এক শরিফ লোককে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের পাঁচটি সন্তান ছিল। কিন্তু একজন বাইজিকে বিয়ে করার জন্য সমাজ ওই শরিফ আদমিকে ত্যাগ করেছিল। তার পরও তীব্র দারিদ্র্যের ভেতরেও যদিও তাঁরা জীবনটি কোনোরকমে চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একদিন পরিবারসহ মথুরায় যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় দুর্গেশনন্দিনী ছাড়া পরিবারের সবাই প্রাণ হারান। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কেবল বেঁচে থাকার জন্য আবার গান গাইতে শুরু করেন হতভাগ্য এই বাইজি। প্রতারণা ও ভালোবাসাহীনতা ছাড়াও সমাজের নির্মম বৈষম্য, অবিচার আর চরম দারিদ্র্যও যে ছিল বাইজিদের সঙ্গী, এ ঘটনাগুলোই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।