জব্বারের বলী
ধানকাটা শেষে চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে চট্টগ্রামের নগর ও গ্রামে ধুম পড়ত বলীখেলার। ফসলের শুকনো মাঠের একাংশ থেকে নাড়া তুলে পরিষ্কার করা হতো কুস্তির জায়গা। দিঘির পাড়, পুরাতন বটগাছের তলা বা খোলা মাঠও ব্যবহার করা হতো এই লোকজ অনুষ্ঠানে। খেলার দিন সকাল হলেই বাঁশদণ্ডের ওপর রংবেরঙের পতাকাগুলো নৃত্যছন্দে পতপত করে উড়তে থাকত আকাশে। সঙ্গে ঢোল, কাড়া, সানাই আর করতালের সম্মেলক বাদ্যে সাড়া জাগত জনপদে, বলীখেলার সুরেলা আহ্বানে। শিশু-কিশোরেরা বায়না ধরত বলীখেলার মেলা থেকে খেলনা কেনার ও এটা-ওটা খাওয়ার টাকার। ছুটে যেত বলীখেলার আসরে। গৃহকর্ত্রীরা বছরের ব্যবহার্য অনেক গেরস্তালি দ্রব্য ও রকমারি খাবার সংগ্রহ করতেন এই মেলা থেকে। অনেক খাবার আছে, যা কেবল মেলাতেই পাওয়া যেত। পাড়াগাঁয়ের বিবাহিত মেয়েরা বাপের বাড়িতে নাইয়র আসতেন মেলার অছিলায়, মেলার খাবারদাবার যেত বেয়াইবাড়ি। অন্য স্বজনেরাও বাদ পড়তেন না। বলীখেলার সেই রমরমা অবস্থা গ্রামগঞ্জে এখন আর নেই। কোথাও কোথাও রূপবিকৃতিও ঘটেছে।
শহর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বলীখেলা হয় লালদীঘির পাড়ে বাংলা সনের ১২ বৈশাখ। বলীখেলা মানে কুস্তির লড়াই। বলীদের পেটানো তাগড়া শরীর—ঘুষাঘুষি, রক্তারক্তির পাশবিকতা তাঁদের পরিহার্য। হাত-পায়ের পেঁচ বা কসরত আর শক্তি দিয়ে অপরজনকে মাটিতে ফেলে পিঠ ঠেকাতে পারলেই জিতে যান একজন বলী। এই কুস্তির আসর বসে দিঘিসংলগ্ন মাঠে। কুস্তিগিরদের চট্টগ্রামের ভাষায় ডাকা হয় ‘বলী’।
কুস্তি উপলক্ষে লালদীঘিকে ঘিরে সব রাস্তাজুড়ে বসে চার-পাঁচ দিনের জমজমাট মেলা। সামান্য আচ্ছাদন বা একদম খোলা আকাশের নিচে পসার সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা সার বেঁধে। লোহা, কাঠ, বাঁশ-বেত এবং মাটির তৈরি নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্র, বিশেষ ধরনের জলখাবার ও মৌসুমি ফলফলারি কিনতে পাওয়া যায় মেলায়। লোহার তৈরি দা, ধামা, ছুরি, বঁটি, কোদাল, ফঁরা, হামানদিস্তা, ইস্, তাওয়া ও খুন্তি নিয়ে কামারেরা নিজেই বসেন রাস্তার পাশে। কাঠমিস্ত্রিরা আসেন কারুকাজ করা পিঠার ছাঁচ, রুটি বেলার ‘পিঁড়া’ ও বেলুনি, রেহেল, আসন ইত্যাদি নিয়ে। কুমোরদের তৈরি পোড়ামাটির তৈজসপত্রের স্তূপ ও খেলনা পুতুলগুলো চোখে পড়ে বেশি।
১৯০৯ সালে লালদীঘির বলীখেলার প্রতিষ্ঠা করেন ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী আবদুল জব্বার সওদাগর। তাই জব্বর্যার বলীখেলা নামেও অভিহিত হয় এই কুস্তি ও লোকমেলা। বঙ্গভঙ্গ রদের পর সাধারণ মানুষের মনে তীব্র জাতীয়তাবোধ জন্ম নেয়, যাঁরা ছিলেন এত দিন রাজনীতির নীরব দর্শক। সে সময় বিলেতি দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশি জিনিসের ব্যবহার, গ্রামগঞ্জে স্বদেশি মেলার অনুষ্ঠান, বিদ্রোহী সাহিত্য রচনা ও প্রকাশ সমাজে জাগায় বিশেষ আলোড়ন। এই প্রেক্ষাপটে লোকজ মেলার আড়ালে শরীরচর্চার মাধ্যমে যুবশক্তিকে সংগঠিত করে বিদেশি ব্রিটিশ অপশক্তিকে তাড়িয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে জব্বার সওদাগরের স্বপ্ন ও অবদান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে একটি বলীখেলার স্মারকে বার্ষিক সমারোহে শত বছর ধরে, বীর চট্টগ্রামের প্রতিভূ হয়ে।
‘শতবর্ষী লালদীঘির বলীখেলা’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৯