ছেলেদের পোশাকে ক্যাটস আইয়ের ৩৫ বছর
কানাডার দীর্ঘ প্রবাসজীবন ছেড়ে দেশে ফেরেন সাঈদ সিদ্দিকী ও তাঁর স্ত্রী আশরাফুন সিদ্দিকী। ১৯৮০ সালে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় গ্রিন সুপার মার্কেটে ছোট্ট একটি রকমারি পণ্যের দোকান খোলেন তাঁরা। নাম দেন ক্যাটস আই। সেখানে ছেলেদের শার্টের পাশাপাশি গয়না, খাবারদাবার ও ক্যাসেট বিক্রি হতো।
সেই দোকানে ছেলেদের শার্ট বিক্রিতে ভালো সাড়া পাওয়ায় একটি ব্র্যান্ড করার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন আশরাফুন সিদ্দিকী। সেই ভাবনা থেকে ১৯৮৩ সালে এলিফ্যান্ট রোডের মনসুর ভবনের একটি তলা ভাড়া নেন সিদ্দিকী দম্পতি। সেখানে একটি দোকানে ছেলেদের পোশাকের ব্র্যান্ড ক্যাটস আইয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ব্র্যান্ডটির পোশাক তৈরি করার জন্য ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসার গ্যারেজটিকে ঠিকঠাক করে ছোট্ট কারখানা করেন তাঁরা।
বাংলাদেশে ছেলেদের পোশাকের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ক্যাটস আইয়ের শুরুর গল্পটা এমনই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পোশাকের নকশায় নতুনত্ব এনেছে ব্র্যান্ডটি। ছেলেদের পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে মেয়েদের পোশাক নিয়ে এসেছে। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের যাত্রায় ব্র্যান্ডটির ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, খুলনা, কক্সবাজার ও বরিশালে ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে। ক্যাটস আইয়ের বিক্রয়কেন্দ্র বর্তমানে ৩৪।
নব্বইয়ের দশকে চাকরিজীবীদের জন্য ফরমাল পোশাক জোগান দেওয়ার জন্য তেমন কোনো দেশি ব্র্যান্ড ছিল না। সেই শূন্যতা পূরণে ১৯৯৩ সালে মনসুন রেইন নামে নতুন ব্র্যান্ড করেন সাঈদ সিদ্দিকী ও আশরাফুন সিদ্দিকী। সেটির বিক্রয়কেন্দ্র এখন তিনটি। ১৯৯৮ সালে খেলাধুলার পোশাক বিক্রির জন্য ক্যাটস আই আনলিমিটেড নামে নতুন ব্র্যান্ড করেন এই উদ্যোক্তা দম্পতি। বর্তমানে অবশ্য এই ব্র্যান্ডের পোশাক উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের পোশাক বিক্রি শুরু করে ক্যাটস আই। ব্র্যান্ডটির তিনটি বিক্রয়কেন্দ্রে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের পোশাক কিনতে পারেন ক্রেতারা।
গত ৩৬ বছরে ক্যাটস আইয়ের ব্যবসা বেড়েছে বহুগুণ। সব মিলিয়ে বিক্রয়কেন্দ্র দাঁড়িয়েছে ৩৭–এ। গ্যারেজে শুরু করা কারখানাটি এলিফ্যান্ট রোডের মিনিটি প্লাজার তৃতীয় থেকে দশম তলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্র মিলে ক্যাটস আইয়ে কাজ করেন ৪০০ জন। প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ মিলে ব্র্যান্ডটির মোট কর্মসংস্থান ৫০০ জনের। ক্যাজুয়াল ও ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, টাই ছাড়া ব্র্যান্ডটি বর্তমানে পাঞ্জাবি, কটি, টি–শার্ট, পলো শার্ট, জিনস, মানিব্যাগ, বেল্ট, ক্যাপ, মেয়েদের টপস, জুয়েলারি ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে।
৩৬ বছরে ক্যাটস আইয়ের ব্যবসা বেড়েছে বহুগুণ। সব মিলিয়ে বিক্রয়কেন্দ্র দাঁড়িয়েছে ৩৭–এ। গ্যারেজে শুরু করা কারখানাটি এলিফ্যান্ট রোডের মিনিটি প্লাজার তৃতীয় থেকে দশম তলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।ক্যাটস আইয়ের শুরুর গল্পটি প্রথম আলোকে শোনালেন ব্র্যান্ডটির পরিচালক মো. আশরাফউদ্দীন শিবলী। তিনি বলেন, সাঈদ সিদ্দিকী কানাডার একটি চেইনশপে কাজ করতেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই দেশে তিনি ক্যাটস আই করেন।
মো. আশরাফউদ্দীন বলেন, ‘ব্র্যান্ডের পোশাক কী, একসময় সেটি মানুষকে বোঝাতে হয়েছে আমাদের। দিন বদলেছে। মানুষ এখন বেশ ফ্যাশন–সচেতন। ফলে ব্র্যান্ডের পোশাকের ক্রেতা গত এক দশকে বেড়েছে। প্রতিবছর পোশাক বিক্রি ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত বছর আমাদের লেনদেন ছিল ৭০ কোটি টাকার মতো।’
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আমরা যখন ক্যাটস আইয়ের সঙ্গে কথা বলি, তখন ব্র্যান্ডটির চেয়ারম্যান সাঈদ সিদ্দিকী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুন সিদ্দিকী বিদেশে ছিলেন। সে জন্য তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তবে তাঁরা এখনো ব্যবসা পরিচালনা করেন। ব্যবসায় তাঁদের সঙ্গে দুই মেয়ে ও জামাতা যুক্ত হয়েছেন।
ক্যাটস আইয়ের নকশার বিষয়টি দেখেন পরিচালক সাদেক কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মেয়েদের পাশাপাশি পুরুষেরা এখন ফ্যাশন–সচেতন হয়ে উঠেছেন। তাঁরাও ফ্যাশনধারা অনুসরণ করেন। তা ছাড়া নিজেকে কোন পোশাকে মানাবে, সে বিষয়ে বেশ সতর্ক আমাদের ভোক্তারা। সে জন্য ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশীয় কাপড়ের পাশাপাশি আমরা আমদানি করা কাপড় ব্যবহার করি। তবে কখনোই কাপড়ের মানের সঙ্গে আপস করি না। তা ছাড়া আমাদের পোশাকের নকশায় ভিন্নতা থাকে সব সময়। সেটিই ক্রেতাদের কাছে অন্য ব্র্যান্ডের চেয়ে ক্যাটস আইকে আলাদা জায়গায় নিয়ে গেছে।’
ক্যাটস আইয়ের পরিচালক মো. আশরাফউদ্দীন বলেন, ব্র্যান্ডের পোশাকের ক্রেতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্র্যান্ডের সংখ্যাও বাজারে এসেছে। ফলে পণ্যের মূল্য নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। অন্যদিকে দোকানভাড়া থেকে শুরু করে কাপড়ের দাম, শ্রমিকের মজুরি সবই বেড়েছে। সে জন্য ব্যবসাটি চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে। মুনাফা কমে গেছে।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি দিতে চায় ক্যাটস আই। আশরাফউদ্দীন বললেন, শিগগরি মালয়েশিয়া ও দুবাইতে ক্যাটস আইয়ের পোশাক পাওয়া যাবে।
শুভংকর কর্মকার : প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক