ছেলেটির বয়স ছাব্বিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘ওই লেংড়ু, এক কাপ চা দে।’ হুকুম দিয়ে ছেলেটি দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে। গোফরান মিয়ার পাশে রাখা ক্রাচটা দেখে বলে, ‘কবে পা-টা গেল? মাস্তান ছিলি বুঝি? নাকি অ্যাকসিডেন্ট?’
কথা বলে না গোফরান মিয়া। কেরোসিনের স্টোভ বাড়িয়ে দেয়। ধপ করে জ্বলে ওঠে আগুন। তার মনে হয়, আগুনই এই মুহূর্তে তার চোখের সামনে একমাত্র দৃশ্য। একটি ছেলে মানুষের চেহারা নিয়ে ওর সামনে আস্তাকুঁড়। মাথা নিচু করে বয়ামের ঢাকনা খোলে গোফরান মিয়া। চায়ের পাতা আর চিনির বয়াম। কাপ-পিরিচ গোছায়। টেবিল-চামচটা রাখে কনডেন্সড মিল্কের পটের ওপর। টুং করে শব্দ করে—ইচ্ছে করেই করে, যেন বুকের ভেতরটা জাগিয়ে তুলতে চায়। ছেলেটির কানে সেই শব্দ অন্য রকম লাগে। শৈশবের স্মৃতির একটা কিছু ভেসে আসে সেই শব্দে। ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয় ছেলেটি। সেই সময়ে পাতিলের ফুটন্ত পানিতে চায়ের পাতা দেয় গোফরান মিয়া। ভাবে, তার প্রিয় দৃশ্য তো শত্রুর মুখ এবং গোলবারুদের রণক্ষেত্র। কখনো চারপাশের মানুষের আচরণ সেই দৃশ্যটিকে আড়াল করে ফেলে। তখন সে নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সাহস অর্জন করে। ভাবে, নদী কোনো জলের ধারা নয়, যেখানে পা ফেলা যায় না। নদীও অখণ্ড ভূমি, যেখানে শস্য এবং মানুষের সহ-অবস্থান। এভাবে নিজের স্মৃতির মধ্যে গোফরান মিয়া বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা খুঁজে পায়।
ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এক কাপ চা দিতে এত সময় লাগে? ক্রাচটা তো পাশেই রাখা আছে। আরও বেশি দেরি করলে দেব মাথা ফাটিয়ে। ওই ক্রাচ দিয়েই ফাটাব।’
গোফরান মিয়া এবারও কোনো কথা বলে না। ছাঁকনিতে চা ছাঁকে। ছেলেটি চিৎকার করে বলে, ‘আমি পানি খাব। আমার বুক পুড়ছে।’
গোফরান মিয়া এবারও কথা না বলে কলসি থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে দেয়। ও একটানে গ্লাসের পানি শেষ করে বলে, ‘এক কাপ চা দিতে এত সময় লাগে কেন? কেমন চাওয়ালা তুই?’
গোফরান মিয়া চা বানিয়ে কাপটা টেবিলের অপর পাশে ঠেলে দেয়। একদম ছেলেটির ডান হাতের কাছে। মুহূর্তে কাপ হাতে উঠিয়ে চুমুক দেয় ও। বেশ বড় এক চুমুক চা ওর গলা দিয়ে নেমে যায়। এত গরম চা ছেলেটি কী করে গলা দিয়ে নামাল! গোফরান মিয়া ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে। বাইরে তাকায়। বেড়িবাঁধের ওপর রোদ বিছিয়েছে। লোকজনের চলাচল তেমনভাবে শুরু হয়নি। দু-চারজন বেরিয়েছে মাত্র।
গোফরান মিয়া সকালে ঘুম থেকে উঠেই দোকানে আসে। পান্তাও খেয়ে আসে না। দোকানের সব কাজ নিজেই করে। আজ এমন একটি খদ্দের পাবে ভাবতেই পারছে না। দুমাস ধরে দোকানটি চালাচ্ছে। সম্মানের চেয়ে অসম্মানই বেশি। ছোকরারা আসে। এখানে বসে আড্ডা দেয়। কখনো পয়সা দেয়, কখনো দেয় না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে ছাড়ে না। ওরা এখানে বসে গুলতানি মেরে ওকে ধন্য করে দিচ্ছে, এমন ভাব। নিরুপায় মানুষটি সয়ে যায়। অনবরত বেঁচে থাকার সান্ত্বনা খুঁজতে থাকে।
চা শেষ করে ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘যাই। তুই তো আমার সঙ্গে কোনো কথাই বললি না। আজ না বললে কী হবে, আর একদিন বলবি। খাসজমিতে চায়ের দোকান খুলে বসেছিস। ভালো থাকিস। গেলাম।’
ও পা ওপরে তুলে বেঞ্চি টপকায়।
গোফরান মিয়া ধমক দিয়ে বলে, ‘দাঁড়া।’
‘আমি চা খেয়ে কাউকে দাম মেটাই না। আমি হুকুমের বাদশা।’—হো-হো হাসিতে চারপাশ তোলপাড় করে ও, ‘বেড়িবাঁধের এই রাস্তায় কত হেঁটে গেছি। দোকানটা দেখিনি। দোকানটা করে ভালোই করেছিস। রোজ মাগনা চা খেতে পারব।’
খনখন করে ওঠে গোফরান মিয়ার কণ্ঠস্বর, ‘মাগনা!’
‘মাগনাই তো। তুই আমার বাবার বয়সী। আমি আমার বাবার বয়সী সবাইকে তুই করেই বলি। তুই করে বললে গায়ে জোর বাড়ে। মাস্তানির জোর।’
‘মাস্তানি!’ গোফরান মিয়া চোখ বড় করে তাকায়।
ছেলেটি গোফরান মিয়ার মুখের ওপর বুড়ো আঙুল নাড়িয়ে বলে, ‘মাস্তানি চিনিস না? কেমন বুড়ো তুই? তুই কি বুড়ো না ছাগলের বাচ্চা? মনে হচ্ছে জন্মেই হাঁটতে শিখলি মাত্র!’
গোফরান মিয়া ক্রাচটা সোজা করে ওঠালে ও বলে, ‘লাভ নাই। আমার সঙ্গে পারবি নাকি তুই? হাঃ।’ ছেলেটি ধীর পায়ে হেঁটে চলে যায়। বেড়িবাঁধের ভেতরের দিকে নামে। ও কোথায় যাবে? নদীর কাছে নাকি সমুদ্রের কাছে? গোফরান মিয়া তার জন্য রাখা টুলটায় ধপ করে বসে পড়ে, যেন শক্তি ফুরিয়ে আসছে। বুকের ভেতরে হাজার বছরের স্তব্ধতা। যেন সে কোনো দিন কোনো যুদ্ধ দেখেনি। যেন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ কী, তা-ও জানে না। প্রবল বিষণ্নতা তার শরীরজুড়ে বিছিয়ে থাকে। ভাবে, দিতে হয়েছে এক কাপ চা-ই তো মাত্র, কিন্তু মূল্য অনেক। আজকের আয়টুকু সমুদ্রের সমান—দুই টাকা দিয়ে হিসাব মাত্র নয়, জীবনের খেরোখাতা ভরে রাখার জন্য সঞ্চয়ের বড় হিসাব। স্টোভের আগুন নিভে যায়। শূন্য চায়ের কাপটি পড়ে থাকে সামনে। মনে হয় এগুলো তার সামনে কোনো দৃশ্যই নয়। ছেলেটি কোথায় চলে গেছে গোফরান মিয়া আর খেয়াল করতে পারে না। তখন দু-হাতে শক্ত করে ক্রাচ আঁকড়ে ধরে নিজেকে থিতু করে। কতক্ষণ কেটে যায় সে হিসাব তার মাথায় আসে না।
দোকানে নতুন খদ্দের আসে। বেলা হয়েছে। চড়চড়িয়ে রোদ বাড়ছে। রোদ বাড়লে গোফরান মিয়া দুচোখ ভরে বেড়িবাঁধের অপর পারের জমিনটুকু উজ্জ্বল চোখে দেখে। ভাবে, এভাবেই স্বদেশ দেখা। আজ সে সেভাবে দেখতে পারছে না। বুঝতে পারে চোখ ঘোলাটে হয়ে আছে। দৃষ্টি অনেক দূরে পৌঁছায় না। দেখতে পায় পাশের ঘরের মেয়ে দুটো ছুটে আসছে। কাঁধে স্কুলের ব্যাগ। ওরা রোজই দোকানের সামনে দাঁড়ায়। আজও দাঁড়িয়ে বলে, ‘কয় কাপ চা বিক্রি হয়েছে দাদু?’
‘এক কাপও না।’
‘হায়, হায় দিনটা এত খারাপ?’
‘খুব খারাপ দিন দাদুরা।’ খুব খারাপ বলতে বলতে দৃষ্টি উদাস হয়ে যায় গোফরান মিয়ার। মেয়েরা বলে, ‘আজ আপনার মন খারাপ দাদু। আমরা যাই। যেদিন বাবার কাছ থেকে টাকা পাব, সেদিন আপনার দোকানের চা আমরা কিনে খাব। অন্য লোকদের মতো ফাঁকি দেব না।’ কথা বলে ওরা দৌড়ে চলে যায়। হায়, মায়াবী পাখিরা।
দোকানে আসে দুজন লোক। সে স্টোভের আগুন উসকে দেয়। দুজনে বেঞ্চে বসে। একজন বলে, ‘দোকানটা করে ভালোই করেছেন। আমরা একটা বসার জায়গা পেয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে পা ধরে গেলে দুদণ্ড জিরোতে হয়।’
ততক্ষণে চা বানায় গোফরান মিয়া। কাপ ঠেলে দেয় ওদের সামনে। চায়ে চুমুক দিয়ে একজন বলে, ‘কেমন আছেন মিয়া?’
‘বেচাবিক্রি কম। দিন কাটে তো কাটে না।’ তার মুখজুড়ে বিষণ্নতা গাঢ় হয়। ওরা চা খেয়ে টাকা দিয়ে চলে যায়। গোফরান মিয়া দেখতে পায় কুদ্দুস দফাদার আসছে। দোকান খোলার দুই মাসের মধ্যে এক দিনও কিনে চা খায়নি। না দিলে হুমকি-ধমকি দেয়। বলে, ‘চোর বানিয়ে থানায় ঢুকিয়ে দেব। বুঝবি ঠেলা।’ তাই তো, ঠেলা বোঝা তো খুব বেশি কঠিন কাজ। গোফরান মিয়া আবার ক্রাচের ওপর হাত রাখে, যেন ক্রাচটি কোনো আগ্নেয়াস্ত্র, যেটি ওর সাহসের জায়গা। পরক্ষণে ঝিমিয়ে যায়। যুদ্ধ করার দিনগুলো একদিন শুরু হয়েছিল, শেষও হয়েছিল একদিন। তার পরের হিসাবনিকাশ অনেক লম্বা। জীবনটা টানতে টানতে এ পর্যন্ত এসেছে। কুদ্দুস দফাদার বেঞ্চের ওপর পা উঠিয়ে বসে বলে, ‘আজ এক কাপে হবে না। দুই কাপ লাগবে।’
‘একবারে দেব, না দুইবারে দেব?’
‘দুইবারে। জানোই তো আমি একটু দম নিয়ে চা খাই। দোকানে একটা খবরের কাগজ রাখো না কেন? চা খেতে খেতে কাগজ পড়তে ভালোই লাগে। বেশি ভালো লাগে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দেখতে।’
বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসে দফাদার। কথা শুনে রাগে হাত কাঁপে গোফরান মিয়ার। চায়ে ঠিকমতো চিনি মেশানো হয় না।
‘তোমার হাত কাঁপে কেন মিয়া? রোগে ধরেছে নাকি?’
‘খবর কাগজটা আপনি কিনে আনেন না কেন?’
‘কী বললি? আমি কাগজ কিনব? তোর সাহস তো কম না। এবার থানা না, জেলে ভরে ছাড়ব। চিনিস আমাকে?’
‘চিনব না কেন? আপনি ওই অফিসের পাহারার কাজ করেন। মেলা ক্ষমতা আপনার।’
মনে রাখিস। আর হিসাব করে কথা বলিস।’
‘নেন চা খান।’
‘বাবা-মা তোকে আদবকায়দা শেখায় নাই। বানচোত।’
গোফরান মিয়া এবারও ঠান্ডা মাথায় বলে, ‘নেন চা খান। আর এক কাপ বানানোর সময় হয়েছে।’
কুদ্দুস দফাদার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলে, ‘বেড়ার গায়ে মাইয়াগো ছবি টাঙাবি। এর পরে যেন ছবি দেখি।’
গোফরান মিয়া দাঁত কিড়মিড় করে। শূন্য দৃষ্টিতে বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে দূরে তাকায়। দুজন খদ্দের এসে বসে।
‘চা দিয়ো মিয়া। তুমি কেমন আছ?’
‘বসেন।’—গোফরান মিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে যায় বাতাসে।
‘তোমার কি মন খারাপ?’
গোফরান মিয়া চায়ের কাপ ঠেলে দিয়ে বলে, ‘চা নেন।’


দুজনে চায়ের কাপ টেনে নেয়। বুঝতে পারে গোফরান মিয়া আজ আর কথা বলবে না। মাঝে মাঝে লোকটা এমনই করে। একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। দুজনেরই মনে হয়, মাস দুয়েক হলো দোকান করেছে লোকটা। সরকারি খাসজমি। কে কখন ঠেলা মেরে উঠিয়ে দেবে! সে জন্য হয়তো মন খারাপ থাকে। এ সময় কুদ্দুস দফাদার চেঁচিয়ে বলে, ‘আমার চা কই? জানিস না বসে থাকার টাইম আমার নাই!’
লোক দুজন চমকে উঠে তার দিকে তাকায়। ইউনিফর্ম দেখে অন্যদিকে মুখ ফেরায়। গোফরান মিয়া তার দিকে চায়ের কাপ ঠেলে দেয়। অন্য দুজন খদ্দের দাম মিটিয়ে চলে যায়। কুদ্দুস চায়ের কাপ টেনে চুমুক দিয়ে বলে, ‘এরপর সারা দিন কত রোজগার হলো তার হিসাব দিবি। আমাকে বখরা দিতে হবে।’
‘বখরা!’—শব্দটি শুনে আঁতকে ওঠে গোফরান মিয়া।
‘বখরা বোঝো না চান্দু? বখরা না দিলে এখানে দোকানই চালাতে পারবে না। বোঝই তো সব।’
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ঠক করে টেবিলের ওপর কাপটা রেখে কোমরের বেল্ট ঠিক করতে করতে বেরিয়ে যায় কুদ্দুস দফাদার। বেড়িবাঁধের রাস্তাটা আবার দেখে গোফরান মিয়া। মনে হয় রাস্তায় লোক নেই। এমন প্রবল জনশূন্য পথ তার কোনো দিন দেখা হয়নি। বিষণ্ন হতে হতে ভাবে, একটু পরে নাতিটা আসবে দুপুরের ভাত নিয়ে। এসেই নানা বায়না ধরবে। ওর বায়না মেটানোর সাধ্যি গোফরান মিয়ার থাকে না। নিজেকে খুব হতভাগ্য মানুষ মনে হয় তখন। একটু পরে চারটে ছেলে আসে। বেঞ্চে বসে হাসাহাসি করে। আজেবাজে কথা বলে। সে ওদেরকে বলতে পারে না যে এখান থেকে উঠে যাও বাবারা। ওরা ইটের ভাটায় কাজ করে। একসময় ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘কেমন বেচাবিক্রি হলো চাচা?’
‘চিনি কেনার পয়সাই হয়নি।’
আপনি তো বুড়ো হাবড়া হয়ে গেছেন। গায়ের জোর কমে গেছে। এই চল যাই।’
যে উদ্যমে এসেছিল, সেই উদ্যমে চলে যায় ওরা। ওরা মাঝে মাঝে আসে। গুলতানি করে। চা খেলে দাম মেটায়। ওদের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল বোধ করে গোফরান মিয়া। যুদ্ধের সময় তার বয়স তো এদের মতোই ছিল। সাহস ছিল, শক্তি ছিল। তাহলে এখন থাকবে না কেন? সকাল থেকে যা ঘটেছে, সেই বিষণ্নতা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়ায় সে। দ্রুত হাতে চায়ের কাপ-পিরিচ-কেটলি-চামচ ধুয়ে গুছিয়ে রেখে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার জন্য। নাতির সঙ্গে দেখা হয় পথে। বড় মেয়ের বড় ছেলে মাসুম নানাকে পথে দেখে থমকে দাঁড়ায়।
‘কী হয়েছে নানাভাই?’
‘আজ বাড়িতে ভাত খাব।’
‘মা খুব খুশি হবে। মা বলে, বাজান বাড়িতে না থাকলে ভালো লাগে না। ভাত খেয়ে মজা পাই না।’
হা-হা করে হাসতে হাসতে গোফরান মিয়া বলে, ‘ছোটবেলায়ও তোর মা এমন কথা বলত। মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে।’
‘এখন আরও বেশি ভালোবাসে। আপনি যে সাহসী যোদ্ধা।’
দুপুরে খেয়েদেয়ে গোফরান মিয়া বাজার থেকে একটা প্লাস্টিকের বোর্ড আর রং কিনে আনে। মেয়ে-নাতিসহ বড় বড় করে লেখে, ‘মুক্তিযোদ্ধা গোফরান মিয়ার চায়ের দোকান’।
বিকেলে মেয়ে ও নাতিসহ সেই বোর্ড নিয়ে দোকানে যায়। দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটা আটকে দেয় দোকানের সামনে। তারপর ক্রাচটা পাশে রেখে বেঞ্চের ওপর বসে। প্রবল ফুর্তিতে তার চারপাশের বাতাস শোঁ-শোঁ বয়। পেছন থেকে হাসিতুন বলে, ‘বাজান আজকে আমি আপনাকে চা বানিয়ে দি?’
‘দাও মা।’—খুশিতে-আনন্দে ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে গোফরান মিয়া বলে, ‘আজকে আমি আমার দোকানে চা কিনে খাব। আজকে আমার মা চাবিক্রেতা।’
‘আমিও চা কিনে খাব। আপনাকে ঠকাব না।’
‘আমি কারও কাছে ঠকি না নানাভাই।’ নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে। ওর মাথার ওপর থুতনি রেখে বলে, ‘বল তোর কী চাই?’
‘একটা লাল রঙের ঘুড়ি চাই। ওই ঘুড়িটাকে আমি আকাশে পাঠাব।’
‘ঠিক আছে দেব।’ নাতিকে ছেড়ে দিয়ে হাসিতুনকে সে বলে, ‘তোর জন্যও চা বানাস মা। আজ আমাদের চায়ের খুশি।’ তিনজনে চা খাওয়ার সময় দেখতে পায় কুদ্দুস দফাদার আসছে। মাসুম চেঁচিয়ে বলে, ‘নানাভাই, ওই শয়তান লোকটা আসছে। ও কেমন পাহারাদার নানাভাই?’
‘থাক, অমন করে বলে না সোনামানিক।’
অল্পক্ষণে কুদ্দুস দফাদার দোকানের সামনে এসে সাইনবোর্ডের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। গোফরান মিয়ার মনে হয়, দফাদারের চোখের পলক বুঝি পড়ছে না। পরক্ষণে সে গোফরানের পাশে এসে বসে বলে, ‘আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা? আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি জানতাম না। আপনার কাছ থেকে যত চা খেয়েছি, তার দাম কড়ায়-গণ্ডায় দিয়ে যাব। সেলাম!’
দফাদার চলে যায়। হাততালি দেয় মাসুম। হাসতে হাসতে বলে, ‘লোকটা টাকা দিয়ে গেলে আপনি আম্মাকে একটা লাল শাড়ি কিনে দেবেন নানাভাই।’
গোফরান মিয়া নাতিকে বুকের মধ্যে টেনে ধরলে ওর চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। একসময় বুকের ভেতর থেকে কান্নার ফোঁপানি উঠে আসে। মেয়ে এসে আঁচল দিয়ে বাবার চোখ মুছিয়ে দেয়। সবাই দেখতে পায় দিনের আলো কমে আসছে। একটু পরে হারিকেন জ্বালাতে হবে। নইলে ঝাঁপ বন্ধ করতে হবে। তখন গোফরান মিয়া খেয়াল করে বেড়িবাঁধের সোজা রাস্তা দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে ছেলেটি। দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। চোখ বড় করে সাইনবোর্ডটি পড়ে। মুহূর্ত সময় মাত্র। তিন লাফে ছুটে এসে চেপে ধরে গোফরান মিয়ার ডান পা।
‘আপনি মুক্তিযোদ্ধা! আমাকে মাফ করে দেন। আমি নষ্ট ছেলে।’
ছেলেটিকে টেনে পাশে বসায় গোফরান মিয়া। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কেউ কেউ আমাকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে। তাদের হুকুম পালন করেছি। ডাকাতি-রাহাজানি-খুন—কিছুই তো বাদ রাখিনি। কেউ আমাকে ভালো থাকতে দেয়নি। বলেনি, এই টাকা নিয়ে তুই একটা চায়ের দোকান কর।’
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ছেলেটি। কিছুক্ষণ কেঁদে চুপ করে থাকে। তারপর গোফরান মিয়ার ক্রাচটি বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা শহীদ হয়েছিলেন। আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম।’
হাসিতুন পেছন থেকে বলে, ‘তুমি শহীদের ছেলে?’
ছেলেটির কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। শূন্যে তাকিয়ে থাকে গোফরান মিয়া। তার মনে হয়, মাসুমের নাটাই ছেড়ে লাল ঘুড়িটা আকাশে উঠে গেছে।
কান্না থামিয়ে ছেলেটি এ সময় বলে, ‘পুলিশ আমাকে খুঁজছে। আমি দুদিনের জন্য এই এলাকায় লুকিয়ে থাকতে এসেছি। আবার অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকতে যাব। এভাবে লুকিয়ে থাকার জন্য আমার বাবা কি শহীদ হয়েছিলেন?’
সূর্য তখনো ডোবেনি। আকাশটা লাল হয়ে আছে। হাসিতুনের চোখের সামনে একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য। সে বুঝতে পারে, তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার বুক তোলপাড় করছে। ছেলেটির মাথা বুকে জড়িয়ে ধরেছে ওর বাবা। তার দুগাল বেয়ে নামছে চোখের জল।
সেলিনা হোসেন: কথাশিল্পী।