যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিরা সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তাদের সেই প্রত্যাশিত রাষ্ট্র ছিল না। শুরুতেই তাদের ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ, আঞ্চলিক বৈষম্য ও জাতি নিপীড়ন। পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’ বলে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায় ‘এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে পড়া’র মতো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র উন্মোচিত হয়। জাতীয় মুক্তি অর্জন ব্যতীত এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের যে কোনো উপায় নেই, বঙ্গবন্ধু দ্রুত তা উপলব্ধি করলেন। আর আন্দোলন-সংগ্রামের এই নবতর পর্যায়ে বেশি আবশ্যক দৃঢ়ভিত্তিসম্পন্ন সংগঠনের, এ কথাও তিনি সহজে উপলব্ধি করতে পারলেন। অধিকন্তু, বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সাংগঠনিক শক্তিতে গভীর আস্থা। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর প্রথমে ছাত্রলীগ এবং আরও কিছু পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাস ১৯ দিন পর এর প্রতিষ্ঠা (৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮)। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল–এর ছাত্র। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তিনিই যে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, পূর্বাপর ঘটনা তার প্রমাণ বহন করে।
বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানেরা ক্রমান্বয়ে পাশ্চাত্যের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলে তাঁদের ভেতর দেশ, সমাজ, আপন সম্প্রদায় সম্বন্ধে সচেতনতাও সৃষ্টি হতে থাকে। বিভিন্ন জেলা শহরে মুসলমান ছাত্রদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেক এসব সংগঠন বা সমিতিকে প্রাদেশিক পর্যায়ে একই পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সমন্বিত রূপ দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেভাবে একই বছর কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধি সম্মেলনে খান বাহাদুর আসাদুজ্জামানকে সভাপতি এবং আবদুল ওয়াসেককে সাধারণ সম্পদক করে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি’ গঠিত হয়। এই ছাত্রসংগঠন ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারকার্যে অংশ নেয়। এরপর ১৯৩৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সমগ্র বাংলার মুসলিম ছাত্র প্রতিনিধিদের এক সম্মেলনে আবদুল ওয়াসেককে সভাপতি ও শামসুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সহযোগী সংগঠন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনসহ পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রদের এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যাহোক, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মতো ছাত্রলীগও অভ্যন্তরীণভাবে সোহরাওয়ার্দী–আবুল হাশিম বনাম নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত এটি ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত ও ভূমি-স্বার্থনির্ভর রক্ষণশীল শ্রেণির মধ্যকার একধরনের মেরুকরণ। আনোয়ার হোসেন, নূরুদ্দিন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শাহ আজিজুর রহমান তখনকার দিনে প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত ছাত্রলীগের সর্বশেষ কাউন্সিল ১৯৪৪ সালে শাহ আজিজুর রহমানের নিজ জেলা কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। সে কাউন্সিলে নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপ–সমর্থক শামসুল হুদা চৌধুরী সভাপতি এবং শাহ আজিজুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যদিকে প্যানেল নির্বাচন নিয়ে বিভক্তি দেখা দেওয়ায় বঙ্গবন্ধু ও নূরুদ্দিন আহমেদ তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে কাউন্সিল অধিবেশন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁদের সাংগঠনিক প্রাধান্য অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ইসলামিয়া কলেজকেন্দ্রিক ছাত্ররাই ছিলেন কলকাতায় মুসলিম ছাত্রলীগের মূল শক্তি এবং তাঁরা সবাই ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও কিছুকাল শাহ আজিজ-শামসুল হুদার নেতৃত্ব অক্ষুণ্ন থাকে, শুধু সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ রাখা হয়। তাঁরা নাজিমুদ্দীন ও নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকারের কাছ থেকে সর্বপ্রকার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে থাকেন। পক্ষান্তরে, সোহরাওয়ার্দী–সমর্থক ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের ওপর চালানো হয় জেল-জুলুম-গ্রেপ্তারসহ নানা নির্যাতন।
এ রকম এক রাজনৈতিক পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু সমমনা আগের ছাত্রনেতা-কর্মীদের নিয়ে নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এভাবে সবিস্তার বর্ণনা দেন:
নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগে’র নাম বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ করা হয়েছে। শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই জেনারেল সেক্রেটারি রইলেন। ঢাকায় কাউন্সিল সভা না করে অন্য কোথাও তাঁরা করলেন গোপনে। কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশই ছাত্র নয়, ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালে সংগঠনে নির্বাচন হয়েছিল, আর হয় নাই। আমরা ঐ কমিটি মানতে চাইলাম না। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নয়। আমি ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমউদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন, আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান করা দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হলে, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হলো।...প্রতিষ্ঠানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মোগলটুলী (পৃ. ৮৮-৮৯)।
>ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথেই বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।
নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হলেও বঙ্গবন্ধুই ছিলেন নতুন এ ছাত্রসংগঠনের প্রাণশক্তি। সমসাময়িক ছাত্রনেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের চেয়ে তিনি ছিলেন বয়সে জ্যেষ্ঠ। তিনি তখনই মনে মনে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার পক্ষে মন স্থির করে ফেলেছিলেন। হয়তো সে কারণে তিনি নিজেকে ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেননি। উপরন্তু, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে জরিমানা এবং জরিমানার টাকা দিতে অসম্মতি জানালে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। অতএব এরপর ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আর যুক্ত থাকা তাঁর চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। তবে যাহোক, নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নতুন এ ছাত্রসংগঠন গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। অন্যদিকে, ছাত্রনেতা নইমউদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া শাস্তি মেনে নিয়ে জরিমানার টাকা পরিশোধ ও ভবিষ্যতের জন্য বন্ডসই দিয়ে ছাত্রত্ব বজায় রেখে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী এ কাজের জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে তাঁকে ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় (আত্মজীবনী, পৃ. ১১৬)। শুরু থেকেই একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সঙ্গে নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু লেখেন:
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথেই বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী (আত্মজীবনী, পৃ. ৮৯)।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক ও তা থেকে উদ্ভূত ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা। ভাষা আন্দোলনের উভয় পর্বে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ভাষা-সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছাত্রলীগ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। ছাত্রলীগের উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ পালন করা হয়। এ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতা–কর্মী গ্রেপ্তার হন; অনেকে গুরুতরভাবে আহত হন। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও এ পর্বেও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের ভূমিকা ছিল খুবই বলিষ্ঠ। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে তাঁদের ছিল কার্যকর প্রতিনিধিত্ব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় চিকিৎসাধীন বঙ্গবন্ধু কীভাবে বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ কর্মীদের দিয়েছিলেন, আগের অধ্যায়ে তা বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শহরে আন্দোলন-বিক্ষোভ করেন।
ছাত্রলীগ হচ্ছে আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর আগে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা সে স্থান পূরণ করেন। শুধু ভাষা-আন্দোলন বা মুসলিম লীগ সরকারের প্রাথমিক জেল-জুলুম-নির্যাতন মোকাবিলায় নয়, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় ও এর সংগঠন গড়ে তুলতেও ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়:
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়বার কাজে সাহায্য করছিল…আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরত (আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৬)।
১৯৪৯ সালে ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর সভাপতির ভাষণ থেকে ওই সময়ে ছাত্রলীগের ভূমিকা, ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক–সম্বন্ধ–অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তৃত জানা যায়। বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে লেখেন:
আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নাই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই। তবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পূর্ব বাংলার লোক কোনোদিন তা ভুলতে পারবে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার আপনারা করেছেন এদেশের মানুষ চিরজীবন তা ভুলতে পারবে না। আপনারাই এদেশে বিরোধী দল সৃষ্টি করেছেন। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না...(আত্মজীবনী, পৃ. ১২৬)।
ছাত্রলীগ–সম্পর্কিত আরও কিছু স্মৃতিচারণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যদিও আমি সদস্য ছিলাম না, তবুও ছাত্রনেতারা আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন মত বুদ্ধি পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করি নাই। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে’ (পৃ. ১২৭)।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসমাজের ঐতিহ্যবাহী ও সবচেয়ে পুরোনো সংগঠন ছাত্রলীগ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয় মুক্তি, তথা স্বাধীনতার আন্দোলনে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করে।
আওয়ামী লীগ
বলা যায়, একই রাজনৈতিক পটভূমিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর দশ মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দেশের প্রথম বিরোধী দল—পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। তবে ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ছাত্রনেতৃবৃন্দের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং একই মাসে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে ১৫০ নম্বর মোগলটুলী পার্টি হাউসের প্রগতিশীল লীগের কর্মীদের প্রধান সংগঠক শামসুল হকের বিজয়—এ উভয় ঘটনা নতুন এ দল প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করে (দ্রষ্টব্য, আত্মজীবনী, পৃ. ১১৪, ১১৯)। ‘নিরাপত্তা বন্দী’ হিসেবে জেলে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন।
বিরুদ্ধবাদীদের ওপর মুসলিম লীগ সরকারের জুলুম-নির্যাতন এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে তখন বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন সহজ ব্যাপার ছিল না। নতুন দল গঠনের জন্য কোথাও হল বা জায়গা না পাওয়া যাওয়ায় পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে (প্রাইভেট বাড়ি) এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নিজের সম্পৃক্ততাসহ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার কাহিনি বঙ্গবন্ধু এভাবে বর্ণনা করেন:
...পুরানা লীগ কর্মীরা মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকল ঢাকায়—ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সে সভা আহ্বান করা হয়েছিল...আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই...আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, ‘আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের...নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।’ আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে...সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী [মুসলিম] লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে, ‘নিরাপত্তা বন্দি’ (আত্মজীবনী, পৃ. ১১৯-২১)।
পার্টির সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বাংলা ও পাকিস্তানের অন্যান্য ইউনিটকে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার’ প্রদানের দাবিসহ আওয়ামী লীগের জন্য একটি ড্রাফট বা খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করেছিলেন। নবপ্রতিষ্ঠিত দলের লক্ষ্য-আদর্শ তুলে ধরতে ঢাকায় দু–একটা জনসভাও করেন। কিন্তু বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি তিনি ও দলের সভাপতি মাওলানা ভাসানী কিছুদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে যান। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মুক্তিলাভের পর থেকে ১৯৫৪ সালের মে মাসের শেষে পুনরায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগপর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারাগারের বাইরে ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এটিই ছিল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিস্তারকাল। আর এর প্রাণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে কারামুক্তির পর আওয়ামী লীগের অবস্থা তিনি যেভাবে দেখেছেন, তার বর্ণনা এরূপ:
শামসুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের অফিস নবাবপুরে নিয়ে এসেছেন...যেয়ে দেখি একখানা টেবিল, দুই তিনখানা চেয়ার, একটা লম্বা টুল...একটা ছেলে রাখা হয়েছে, যাকে আফস পিয়ন বলা যেতে পারে। শামসুল হক সাহেব জেলে...ঢাকায় তখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে। ভয়ে মানুষ কোনো কথা বলে না। কথা বললেই গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে একই অবস্থা। আওয়ামী লীগ অফিসে কেউই আসে না ভয়ে। আমি ও কামরুজ্জামান সাহেব বিকালে বসে থাকি। অনেক চেনা লোক দেখলাম, নবাবপুর দিয়ে যাবার সময় আমাদের অফিসের দিকে আসলেই মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। দু’একজন আমাদের দলের সদস্যও ছিল। আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসলে আমি বলতাম, অফিসে...দেখা করবেন, সেখানেই আলাপ করব। শহীদ সাহেব [সোহরাওয়ার্দী] যখন এসেছিলেন, তাঁর এক ভক্তের কাছ থেকে একটা টাইপ রাইটিং মেশিন নিয়ে অফিসের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার একজন ছাত্র সিরাজ, এক হাত দিয়ে আস্তে আস্তে টাইপ করতে পারত। তাকে বললাম, অফিসে কাজ করতে। সে রাজি হলো...একজন পিয়ন রাখলাম, প্রফেসার কামরুজ্জামান সাহেবের বাসায় থাকত (আত্মজীবনী, পৃ. ২১০-২১১)।
পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি শামসুল হক কারাগারে বন্দী থাকায় ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুকে ভারপ্রাপ্ত জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রচেষ্টা-পরিশ্রমের অন্ত ছিল না। মুসলিম লীগ সরকারের অবর্ণনীয় জেল–জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন। সরকারের লেলিয়ে দেওয়া ভাড়াটে গুন্ডাদের মোকাবিলা করেছেন। ঢাকা শহরের মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে আওয়ামী লীগের পক্ষে একদল যুবকর্মী সৃষ্টি করেছেন। শোভাযাত্রা-মিছিল-পিকেটিং করতে গিয়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও গোয়েন্দাদের কড়া নজর এড়িয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়েছেন। সাংগঠনিক ও অন্যান্য বিষয়ে বুদ্ধি–পরামর্শের জন্য করাচি এবং লাহোরে সোহরাওয়ার্দীর কাছে ছুটে গিয়েছেন। কখনো সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী; কখনো অন্য নেতাদের নিয়ে এবং কখনো একাই জেলার পর জেলা, এমনকি মহাকুমা পর্যায়েও ব্যাপক সফর করে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এর মধ্যেই তার ব্যবস্থা করেছেন। দলের নেতা, বিশেষ করে সিনিয়র নেতাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং কারও কারও সুবিধাবাদী প্রবণতা সামাল দিয়েছেন (বিস্তারিত, আত্মজীবনী, পৃ. ১৩০-১৩৪, ২১১-২২১, ২৩৬-২৩৯, ২৪৩)।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে বাংলায় মুসলিম লীগের মধ্যে যে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ, প্রগতিশীল অংশের নেতা–কর্মীরা জেলায় জেলায় এ সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে সংগঠিত হতে থাকেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে দেশজুড়ে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিশেষ অবস্থা খুবই সহায়ক হয়েছিল (আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৫-২৩৬)।যাহোক, অবশেষে বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে চার বছর পর ১৯৫৩ সালের ১৪-১৬ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় পর্যন্ত দেশের শতকরা প্রায় ৭০টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হন বলে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন (পৃ. ২৩৭)। সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক ও ইয়ার মোহাম্মদ খান কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
সংক্ষেপিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত
সূত্র: বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পুনঃপাঠ, ইউপিএল, ২০১৮
হারুন-অর-রশিদ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ‘ঐ মহামানব আসে’ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। ক্রোড়পত্রের সেই লেখাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।