স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। দেশটিকে উন্নয়ন-যোগ্যতা পরীক্ষার একটি উদাহরণ বা ‘টেস্ট কেইস’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল; অর্থাৎ, বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করতে পারে, তবে যেকোনো দেশই তা পারবে। প্রায় সাড়ে চার দশক পর আর্থসামাজিক নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্জনকে এখন ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তবে কী করে এ অর্জন সম্ভব হলো, তা খতিয়ে দেখা দরকার; তা না হলে ভবিষ্যতের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলোও বোঝা যাবে না। এ চ্যালেঞ্জগুলোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা ব্যতিক্রমধর্মী। এ কারণে ভিন্ন অর্থে হলেও বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের নতুন পরীক্ষাগার হতে যাচ্ছে, যা অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের এযাবৎকালের অর্জনগুলো এখন সুবিদিত। নব্বইয়ের দশক থেকে জাতীয় ও মাথাপিছু আয়ের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির হারের বিচারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে প্রথম সারিতে। সে সঙ্গে দারিদ্রের হার দ্রুত কমেছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর ক্ষেত্রেও চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতে, বিশেষত শিশুমৃত্যু হার, মেয়েশিশুদের স্কুলে ভর্তির হার, জনসংখ্যার গড় আয়ু, আধুনিক জন্মনিরোধ পদ্ধতি গ্রহণ ইত্যাদিতে বাংলাদেশে যত দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত মেলা কঠিন।
দুটি বিবেচনায় এ অর্জনগুলোকে উন্নয়নের বিস্ময় বা ধাঁধা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রথমত, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতা, মাথাপিছু জমির চরম স্বল্পতা এবং সর্বোপরি ব্যাপক দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের দেশগুলোর মধ্যে একসময় পিছিয়ে থেকেও এখন স্পষ্টতই অগ্রবর্তী অবস্থানে চলে এসেছে; অথচ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম, তা সে জিডিপির অনুপাতেই হোক বা মাথাপিছু ব্যয়ের হিসাবেই হোক।
কীভাবে এটা সম্ভব হলো? এ প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। তবে লক্ষণীয় যে এ অর্জনগুলো কোনো পূর্বনির্ধারিত সমন্বিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটেনি; বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা অনুঘটক কাজ করেছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে নেওয়া কিছু কার্যকর কর্মসূচি, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু সরকারি সংস্থার উদ্যোগী ভূমিকা, একটি শক্তিশালী এনজিও সেক্টরের উপস্থিতি ও সর্বোপরি ব্যক্তি উদ্যোগের সমন্বয়ে সুশাসনের ঘাটতি অনেকটা কাটিয়ে ওঠা গেছে। যেমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সার্বিক দুর্বলতা সত্ত্বেও তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ বা বিদেশের শ্রমবাজারের সুযোগ গ্রহণের জন্য সহায়ক নীতিকাঠামো তৈরি করা গেছে।
বাংলাদেশের একটা সামাজিক বৈশিষ্ট্য হলো যে বর্ণ-গোত্র-শ্রেণি বিভাজন এত প্রকট নয় যে তা কারও জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ গ্রহণে বড় বাধা সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে এ দেশের নিম্নবিত্তের মানুষও অনেক উন্নয়ন-সচেতন এবং যেকোনো নতুন প্রযুক্তি বা সুযোগ তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকলে তা তারা দ্রুত গ্রহণ করে; সেটা উফশী ধান উৎপাদনের প্রযুক্তি, ক্ষুদ্রঋণ, খাওয়ার স্যালাইন বা আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন। ঘন জনবসতি, গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটের ব্যাপক প্রসার এবং এনজিওদের নিবিড় কার্যক্রমের ফলে উন্নয়নের ধ্যানধারণা অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক দ্রুত বিস্তার লাভ করে। শিশুদের টিকাদান বা জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সামাজিক বাজারজাতকরণের মতো সফল কর্মসূচিগুলো অনেকাংশেই সরকারি সেবাদানের অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে পাশ কাটিয়ে বাস্তবায়ন করা গেছে।
এবার আসা যাক ভবিষ্যতের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে। এ যাবৎকালের অর্জনগুলোর যে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো তা থেকেই এ চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে অনেকটা ধারণা মেলে। যেমন সামাজিক খাতের সূচকগুলোর ক্ষেত্রে স্বল্প খরচের সুযোগগুলো কমে আসার ফলে এ খাতের অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ যেমন অনেক বাড়াতে হবে, তেমনি সেবার মানও উন্নত করতে হবে। ডায়রিয়া বা সংক্রামক ব্যাধিজনিত শিশুমৃত্যুর হার ইতিমধ্যে কমে গেছে; এ হার আরও কমাতে হলে এখন দরকার হবে প্রসবকালীন জটিলতা বা অন্যান্য কারণে শিশুমৃত্যু রোধ করতে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে উন্নত সেবা নিশ্চিত করা। আবার স্কুলের শিক্ষার মান উন্নত করা না গেলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বাড়বে।
এ ছাড়া উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ যদি পারিবারিক আয় থেকে মেটাতে হয়, তবে ভবিষ্যতে এ-সংক্রান্ত সূচকগুলোতে ধনী-গরিবের বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আগেভাগেই সাফল্য আসায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জনসংখ্যায় বয়সকাঠামোর সুবিধা পেতে শুরু করেছে, যার ফলে শ্রমশক্তির আকার জনসংখ্যার তুলনায় দ্রুততর হারে বাড়ছে। কিন্তু এ সুবিধা পুরো কাজে লাগানোর জন্য শ্রমশক্তির প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর যে প্রস্ততি দরকার তা এখনো নেই। এখন পর্যন্ত কৃষির বাইরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে প্রধানত কাজ করেছে স্বল্প দক্ষ শ্রমিকের বিদেশে কর্মসংস্থান, স্বল্প মজুরির নারী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল তৈরি পোশাকশিল্প এবং নিম্ন প্রযুক্তির ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পোদ্যোগ। প্রবৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে যেতে হলে উৎপাদনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং শ্রমশক্তির প্রশিক্ষণের মান ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। নারী শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির ওপর নির্ভর করেই যদি বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতা শক্তি ধরে রাখতে হয়, তাহলে তো এ ধরনের শিল্প বিকাশ দিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণে অগ্রগতি আসবে না। যে দারিদ্র্যসীমার আয়ের ওপর ভিত্তি করে এখন দেশের দারিদ্রের হার মাপা হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তা-ও পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন হবে; তা না হলে দারিদ্রের বাস্তবসম্মত চিত্র পাওয়া যাবে না।
আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভবিষ্যতে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য কী করে রক্ষা করা যাবে। মাথাপিছু জমির চরম স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে এ সমস্যা ক্রমে যত প্রকট আকার ধারণ করছে, তার দৃষ্টান্ত আর কোথাও নেই। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের সম্ভাব্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকাতেও আছে বাংলাদেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, এত বড় সমস্যার মোকাবিলা করার মতো পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা অর্জন কতখানি সম্ভব হবে, যেখানে এখনই পরিবেশের নানা ধরনের দূষণ রোধ এবং নদী-বন-পাহাড়ের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা রক্ষা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবশেষে সুশাসনের বিষয়ে ফিরে আসা যাক। এযাবৎকালের অর্জনগুলোর পেছনে সরকারসমূহের একটা কল্যাণমুখী ভূমিকা ছিল, এটা অস্বীকার করা যায় না। সরকারের জবাবদিহির কার্যকর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এটা সম্ভব হয়েছে। অন্যায় সুযোগ-সুবিধা বিতরণের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি পরিচালিত হলেও জনগণের দৃষ্টিতে বৈধতা অর্জনের তাগিদেই ক্ষমতাসীনদের কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ধারণা বাহ্যত গ্রহণ করতে হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। এ অঙ্গীকার আদায় করার পেছনে কাজ করেছে জনগণের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা, সম্ভবত যার সূত্রপাত হয়ে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।
প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট হবে। অর্থনীতির সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা ও জবাবদিহির কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির প্রয়োজনীয়তা ক্রমে বাড়ছে। অন্যদিকে মৌলিক চাহিদা পূরণের বাইরে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের নতুন প্রত্যাশাও তৈরি হচ্ছে। অর্থনীতিতে কম খরচে বেশি সুফল পাওয়ার সুযোগ এখন কমে আসছে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ ও সামাজিক খাতের বিনিয়োগের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থের সংকুলান করতে হবে। সে অবস্থায় কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা না গেলে দুর্নীতি ও অন্যায়-অনিয়মের আর্থিক বোঝা অর্থনীতির পক্ষে বহন করা ক্রমে বেশি দুরূহ হবে। এত দিন সুশাসনের ঘাটতি সত্ত্বেও দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে সুশাসন ও উন্নয়নের কী সমীকরণ তৈরি হয়, তা নিয়ে বাংলাদেশ হয়তো আবারও ভিন্নধর্মী দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা