ঈদের প্রতীক্ষা
চারদিকে মানুষ করছে ছোটাছুটি। ঈদে কেউ কিনবে একটি গেঞ্জি, একটি লুঙ্গি, এক জোড়া জুতো। অভাবের সংসারে এগুলো জোগান দেওয়াই মুশকিল। অভাবের সংসারে ঈদের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যেন অলীক স্বপ্ন।
তবে বড়লোকদের কথা আলাদা। তাদের কেউ ভাবছে এই বাজে শহর থেকে মুক্তি পেতে কোনখানে গিয়ে ঈদটা কাটানো যায়। থিম্পু থেকে কাঠমান্ডু, কুয়ালালামপুর থেকে দার্জিলিং, দিল্লি থেকে মুম্বাই, সব হাতছানি দিয়ে ডাকছে এমন সব জায়গায় যেখানে ফকির নেই, প্রার্থী নেই। চারদিকে ফুর্তি আর ফুর্তির ফোয়ারা। টেলিভিশনে চলছে প্রতিযোগিতা নতুন দিনের, নতুন আমোদের, নতুন ফুর্তির। বিভিন্ন দোকান থেকে প্রতিদিন শত শত অফার আসছে মোবাইলে। তাদের প্রতিযোগিতা হলো লেটেস্ট ফার্নিচার, লেটেস্ট কাপড়চোপড়, ঘর সাজানোর সামগ্রীর জন্য। আরও আছে ডায়মন্ড ও গোল্ডের সুসমাচার।
যখন ছোট, দুটো ঈদ কেমন করে এত তাড়াতাড়ি আসছে বুঝতে পারতাম না। প্রথমটি সেমাই, পরেরটি গরুর। সত্তর বছর আগের কথা। কোচবিহারে গরু কোরবানি দেওয়া নিষিদ্ধ। গোপনে যা হেতা, সেই মাংস খেতাম।
ঈদের মাঠ দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত, কারণ তারা দেখতে পেত মুসলমানরা কী সুন্দর একটি দিনে সবাই বিভেদ ভুলে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা এসে ঈদের নামাজের পরে মুসলমানদের সঙ্গে কোলাকুলি করত। সেই পুলিশ লাইনের মাঠটি এখন দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হেয়ছে। হয়তো ঈদের নামাজে আর তেমন লোক হয় না।
ঈদুজ্জোহা উপলক্ষে আব্বার রেকর্ডকৃত গানটি গাইতাম। আজও যখন সেই গান গাই, ফিরে আসে স্মৃতির সুরভি, কোচবিহারের ঈদের মাঠে নামাজ পড়ার অনুষঙ্গ। আল্লাহর জন্য সব বিসর্জন দেওয়ার জন্য আহ্বান। নজরুলের সেই আহ্বান কি মনে রেখেছি? গানটি:
যে আপন পুত্র আল্লারে দেয় শহীদ হওয়ার তরে
কাবাতে সে যায় নারে ভাই নিজেই কাবা গড়ে
সে যেখানে যায় জাগে সেথা কাবার উম্মিদ
ঈদ মোবারক হো।
ঈদের গানে
এই গান নিয়ে মানুষের উৎসাহ যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে লেখকেরা নতুন নতুন লেখা লিখেছেন, আমরাও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণটি আব্বাসউদ্দীনের নিজ জবানিতে, যা ছাপা হয়েছে তঁার লেখা দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথার ১৩৩ নম্বর পৃষ্ঠায়।
এ গান নিয়ে হয়তো আরও লেখা হবে কোনো দিন, গল্পে, উপন্যাসে, আজ নয় অন্য কোনো দিন, এই কারণে যে এই গানটি মুসলমানদের জাগিয়ে তুলেছিল। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমাদের রয়েছে একটি জাতিসত্তা, যাতে মূর্ত স্বতন্ত্র বীণার তারে গুঞ্জরিত কাব্যসুধা ও সংগীত। আমরা যে সেদিন জেগেছিলাম তারই ফলশ্রুতি: পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) ও পরে বাংলাদেশ। নজরুল ও আব্বাসউদ্দীন আমাদের জাগিয়ে তুলেছিলেন।
‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটি জন্মের পর থেকেই গেয়ে এসেছি। আব্বা শিখিয়েছেন আমাদের, সেই ছোটবেলায় বলরামপুরে, কোচবিহারে, কলকাতায়, ঢাকা শহরে এবং এরপরে বাংলাদেশের আনাচে–কানাচে।
কারণটি গানের গভীরে। কী বলতে চেয়েছেন কবি তঁার মাত্র দশ লাইনের গানে। কেউ কেউ গান শুনে যাই, গানের ভেতরে ঢুকি না। টেলিভিশনে গান দেখি, শিল্পীর পরেন কী, যন্ত্রীরা কারা, সুরটি কেমনভাবে আলোড়িত, সেদিকেই দৃষ্টিপাত।
শোন আসমানি তাগিদ
অর্থ: আল্লাহ্ তাঅালার বয়ান, অর্থাৎ কোরআন শরিফে কী রয়েছে। মানবতার স্বার্থে আপনি নিেজকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত কি না, এটাই আসমানি তাগিদ। পুঞ্জিভূত সম্পদের ভার, দিন দিন যা বেড়েই চলেছে, তাতে বাঙালি মুসলমানদের নিদ্রাভঙ্গ হবে কি? নিদ্রা থেকে জাগরিত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লে, কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে কি? জাকাত না দিলে মুসলমানদের এই মুর্দাবেশ ঘুচবে না। বলছেন, ‘দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ’।
জাকাত নিয়ে ভাবনা
জাকাত নিয়েই নজরুলের একাধিক গান। তবে এবার আসুন আমার স্বপ্নে। তখন পোলাও খেতে আপত্তি কী? বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলাম। প্রথমে কী করব? ঈদের মাঠে অনেকের সঙ্গে প্রথম সারিতে আমিও। মনে পড়বে কাজী নজরুল ইসলাম ঈদগাহ নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা ও গান। ঈদগাহ নিয়ে স্বপ্নের এ বিস্তার। এটি শাহাদাতের ঈদগাহ, যেখানে মুসলমান প্রস্তুত শাহাদাতের জন্য।
যে ময়দানে সব গাজি মুসলিম হয়েছে শহীদ।
এটিই বক্তব্য। আমার নয়, নজরুলের।
এগুলো বাস্তবায়িত হলে অসুবিধা কী? শহীদ হতে চাইবেন না যঁারা, ঈদগাহ তঁাদের জন্য নয়। কারণ, এই পৃথিবীর সম্পদ আহরণ ও ভোগ নিয়েই তঁারা ব্যস্ত।
ঈদগাহের মাঠে ঢুকতেই কয়েক হাজার প্রার্থী, বেশির ভাগ অন্ধ, লাচার, তারপরও হাজারো দুঃখী মানুষের মিছিল। এই কয়েক হাজার মানুষকে সম্পদ বিলানো কোনো ব্যাপারই না। বাংলাদেশের প্রতি শহরে–গ্রামে প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জাকাত দিতে প্রস্তুত সব মুসলমান, এমনকি গরিবেরাও। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। যারা নামে মুসলমান, কর্মে নই, আকিদায় নই, তাদের দেশে ফি বছর প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন হবে যে, ঈদের মাঠ হবে প্রার্থীদের দখলে।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন, হাত মিলাও হাতে
শাহি মঞ্জিলে থাকব না। রাসুল (সা.) ছিলেন না। গরিবদের মেতা থাকব। জীবনের প্রতি মুহূর্ত নিয়োজিত হবে গরিবের জন্য, চিন্তা হবে কীভাবে আগামী ঈদে তাদের মুখে হাসি ফুটবে। যারা তাদের অন্ন কেড়ে খায়, তাদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই। সর্বাবস্থায় বড়মানুষি ও বড়লোকি পরিহার করে চলব। সাধারণ মানুষের জন্য সব রকম বিলাসিতা থেকে নিজকে মুক্ত করব। ভেবে দেখলাম এই কাজগুলো তো আমরা এখনই করতে পারি, রাষ্ট্রপতি না হলেও চলবে। দোস্ত–দুশমন কি ভুলে গিয়েছি, ঈদের দিন কি ভুলে যাই? দোস্ত ও দুশমনের ফারাক দিন দিন বেড়েই চলেছে।
রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হেলা, তুমি কি আরও কিছুদিন রাষ্ট্রপতি থাকতে চাও? তাহলে তাও সম্ভব। ফেরত নিয়ে আসতে চাই তোমাকে। বিদায় হজের পর উনি মুহূর্তে বুঝতে পারলেন তঁাকে চলে যেতে হবে আল্লাহর কাছে। জানালেন, ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, হে প্রভু। রেখে যাচ্ছি কোরআন ও সুন্নাহকে। শাহাদাতের মর্যাদা জানে যারা, তারাই তোমার দ্বীন টিকিয়ে রাখবে।
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ
অর্থাৎ, চাই ইসলামের মুরিদ হতে। কোনো রাজনৈতিক দলের বা পীর সাহেবানের মুরিদ হওয়া নয়। শক্ত করে ধরতে হবে আল্লাহর রজ্জু। মুর্শিদ ও পীর: হজরত মুহাম্মদ (সা.)। কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামেই মুরিদ থাকব আমরা। ‘মুরিদ’ শব্দটির ব্যাখ্যা সা’ল তাফসির আল্ কুরআনুল করিম গ্রন্থটির অনুবাদকর্মে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে ‘শিরনি তৌহিদে’র
‘তৌহিদ’ আল্লাহর একত্ববাদ, তঁার ‘ওয়াহ্দানিয়াত’। আল্লাহর সৃষ্টির সঙ্গে একাত্মবোধ, মমত্ববোধ, প্রগাঢ় ভালোবাসা, বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ কারও প্রতি নয়, এই হেলা তৌহিদের শিরনি। ঈদের মাঠে যখন কোলাকুলি করি, নিজকে বিলিয়ে দি সম্পূর্ণভাবে এর চেয়ে আর কোনো আনন্দ জীবনে খুঁজে পাইনি, ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত। পাঞ্জাবিটি ময়লা হয়ে যায়। আমি তখন তৌহিদের শিরনিতে পরিপূর্ণ প্রস্তুত, এখনই পাব আমার প্রিয় হজরতের দাওয়াত।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য–সংগীত ব্যক্তিত্ব।