২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আশা করি, নতুন বছরে কোভিড বিদায় হবে

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

কোভিড একটি জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি। এর আগে নিপাহ, সোয়াইন ফ্লুর মতো স্থানীয় পর্যায়ের যেসব প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, সেগুলো সফলভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এ অভিজ্ঞতা থেকে আইইডিসিআরের আস্থা জন্মে যে তারা বিশ্ব মহামারি কোভিডও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। ২০২০ সালের মার্চে দেশে প্রথম কোভিড আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর প্রথম দিকের পরিস্থিতি আইইডিসিআর ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিল। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছিল, পরিস্থিতি তত নতুন মাত্রা পাচ্ছিল। কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে কোভিড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রথমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যায়। মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে গাইডলাইন, সেখানে পরিস্থিতি অনুযায়ী নেতৃত্ব ধাপে ধাপে ওপরের স্তরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ীই বর্তমানে কোভিড নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হাতে রয়েছে।

আমার কাছে মনে হয়, কোভিড মহামারি নিয়ন্ত্রণে আইইডিসিআরকে কেন্দ্রে রাখা দরকার। এ ধরনের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় প্রতিষ্ঠানটির ২১ বছরের বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসিসহ নানা জায়গায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের হাতে দায়িত্ব থাকলে সর্বোচ্চ পেশাদারি বজায় রাখা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো।

দৃষ্টান্ত হিসেবে ২০২০ সালের মার্চে জন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা বলা যায়। ২৬ মার্চ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। সে সময়ে সংক্রমণ ক্লাস্টার থেকে কমিউনিটি পর্যায়ে যাচ্ছিল। সিদ্ধান্ত আগেভাগে নিতে পারায় সংক্রমণের সুনামি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা গেছে। ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হয়নি।

বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারায় দেশে কোভিড সংক্রমণ বিলম্বিত করা গেছে। এতে অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যেমন শিখতে পেরেছি, আবার জনপ্রস্তুতি বা জনগণকে ধাতস্থ করারও সময় পেয়েছি। সংক্রমণের ঢেউ দেরিতে আসায় আমরা অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পেরেছি। তবে একটা ঘাটতি প্রথম থেকেই আমাদের ছিল, সেটা হলো জনযোগাযোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে একধরনের বার্তাই জনগণের সামনে নিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সেটা হস্তক্ষেপ হবে কি না। কিন্তু মহামারিকালে এ ধরনের মতপ্রকাশ স্থগিত থাকতে হবে। কোভিড মহামারি নিয়ে নানা ধরনের ভুল তথ্য আমরা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি। এখন টিকা নিয়েও নানা ভুল তথ্য দেখতে পাচ্ছি। এ ধরনের ভুল তথ্য মহামারি নিয়ন্ত্রণ কঠিন করে তোলে।

কোভিড নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের যে সফল্য, সেটাকে মধ্যম পর্যায়ের বলব। মহামারি নিয়ন্ত্রণে দুই ধরনের দেশ ভালো করেছে। প্রথমত, যারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, মানুষের জীবনকে কেন্দ্রে রেখে নীতি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশে আগে থেকেই তৃণমূল পর্যায় থেকে অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো শক্তিশালী ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি স্বাধীন প্যানেল কোভিড মোকাবিলায় কোন দেশের সাফল্য কতটুকু, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি নিরপেক্ষ গবেষণা করেছে। সেখানে কোভিড মোকাবিলার প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের স্কোর ১০-এর মধ্যে ৫ দশমিক ৫। যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্ট ৯ দশমিক ৫। জনসংখ্যার অনুপাতে মৃত্যু বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্ট ১০–এর মধ্যে ১ দশমিক ৫। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ দশমিক ৫। এ গবেষণা থেকেই স্পষ্ট যে মহামারি নিয়ন্ত্রণে সম্পদই সবকিছু নয়, নীতিই মূল কথা।

কোভিড মহামারির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের মহামারিগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনীন ও বিনা মূল্যে হতে হবে। স্বাস্থ্যসেবাকে কেন্দ্রে রেখে আর সব উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। কোভিড আমাদের এ শিক্ষা দিয়েছে যে জনস্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে অর্থনীতি, শিক্ষা—কোনোটাই চালু রাখা যায় না। বাংলাদেশের কমিউনিটি পর্যায়ের যে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে হবে।

অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো নগরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো একেবারেই অপ্রতুল। জরুরি ভিত্তিতে ঢাকাসহ অন্য নগরগুলোতে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

আশা করি, নতুন বছরে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা কোভিড মহামারিকে বিদায় জানাতে পারব। তবে এ ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য কাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি ও টিকার প্রাপ্যতা ও সমতা নিশ্চিত করতে হবে। টিকার প্রাপ্যতা ও সমতা নিশ্চিতের জন্য বৈশ্বিক উদ্যোগ থাকতে হবে। বিশ্বের সব অঞ্চলে জনগণের বড় অংশকে যদি টিকা নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে আপাত নিরাপদ দেশও নিরাপদ নয়।

মুশতাক হোসেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ