২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আলপথে হেঁটে বাংলাদেশের হৃদয়ে : মাহবুব হোসেন

মাহবুব হোসেন। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
মাহবুব হোসেন। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার পর ড. মাহবুব হোসেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গ্রামের আলপথ ধরে হাঁটবেন। প্রয়োজনে সেচ দেওয়া কৃষকের চষা খেতে পা নামাবেন। এই ছিল তাঁর নিরন্তর প্রচেষ্টা যে এশীয় অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে কাছ থেকে জানবেন।

ছেলেবেলায় মাহবুব হোসেন বিজ্ঞান পড়তে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন চিকিৎসক হয়ে রোগীদের সেবা করতে। পশ্চিমবঙ্গের নানাবাড়ির যে অঞ্চলে তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষা নেন, সেখানে সে সময় বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। উত্তরকালে সেটিই শাপে বর হলো। বিশ্বের ধাননির্ভর কৃষি অর্থনীতির বিস্তীর্ণ এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল মাহবুব হোসেনের মধ্যেই পেয়ে গেল এমন একজন সমাজবিজ্ঞানীকে, যিনি কৃষি অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। জীবনব্যাপী তিনি বোঝার চেষ্টা করে গেলেন কৃষিনির্ভর এশীয় অর্থনীতিগুলোর দারিদ্র্যের স্বরূপ। একটি সফল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর ক্লিভলেন ক্লিনিকে মাহবুব হোসেন যখন দেহত্যাগ করেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ তখন যথার্থই বলেছিলেন, দুনিয়ায় এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা, যাঁরা ড. হোসেনের মতো উন্নয়ননীতি ইস্যুগুলোর বিষয়ে এত গভীর জ্ঞান রাখতেন।

প্রায় ১৭ বছর ফিলিপাইনের লস বানিওসে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইরি) কাজ করে অবসর নেওয়ার কয়েক বছর বাকি থাকতেই ২০০৯ সালে তিনি যখন দেশে ফিরে আসতে মনস্থির করেন, ইরি কর্তৃপক্ষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। মাহবুব হোসেনের জবাব ছিল, তিনি বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষি অর্থনীতির জন্য এবং বহুবিধ সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশে থেকে কাজ করতে চান।

ইরির সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব ছাড়াও মাহবুব হোসেন এর উপমহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দেশে ফিরে আসেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে। ১৯৮০–র দশকের শেষের দিকে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পলিসি থিঙ্কট্যাংক বিআইডিএস যখন খ্যাতির তুঙ্গে, তৎকালীন ইরি মহাপরিচালক ক্লাউস লাম্পেকে তিন বছর অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল মাহবুব হোসেনকে ইরিতে যোগ দেওয়ানোর জন্য। ১৯৯১ সালে লাম্পে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে চিঠি লিখে এ অনুরোধ করেন, যাতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বিআইডিএসের মহাপরিচালক পদে দ্বিতীয় মেয়াদে না রেখে ইরিকে তাঁর সেবা নেওয়ার সুযোগ করে দেন। সরকার তাঁদের অনুরোধ রেখেছিল।

মাহবুব হোসেনের ইরির দিনগুলো এখন ইতিহাসের অংশ। বেশ কিছুদিন ইরিতে কাছ থেকে তাঁর কর্মযজ্ঞ দেখার আমার সুযোগ হয়েছিল। ইরির দিনগুলোয় তিনি এমনভাবে গবেষণার তত্ত্বকাঠামো ও একটি যোগ্য গবেষণা বাহিনী তৈরি করে দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি এখনো তাঁর গড়ে দিয়ে আসা বনিয়াদের সুফল পাচ্ছে।

১৯৮৫-৮৭ সময়ে মাহবুব হোসেন যখন ওয়াশিংটনভিত্তিক খাদ্যনীতিবিষয়ক থিঙ্কট্যাংক ইফ্রির (ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট) হয়ে কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন, তখনই তিনি ইরির চোখে পড়েন। তিনি ইরি ছেড়ে চলে আসার সময় তারা ব্যথিত হয়েছিল বটে, কিন্তু কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছিল কৃষি অর্থনীতি গবেষণার শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যাওয়ার জন্য।

২০১৩ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বিবেচনায় বিশ্বের ৫০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন নির্বাচিত হন মাহবুব হোসেন। এরই তিন বছর পর, ৭১ বছর বয়সে, তিনি হৃদ্​রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। গ্রামীণ ব্যাংক যখন সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠেনি, তখন এই ব্যাংকের ঋণদান মডেল নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করেছিলেন মাহবুব হোসেন।

মাহবুব হোসেন বাংলাদেশ রাইস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার নেওয়ার পর এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি হিসেবে একই বোর্ডে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়। সে সূত্রে বলতে পারি, মাহবুব হোসেনের জীবনের অন্যতম সেরা কাজ দেশের প্রতিনিধিত্বশীল ৬২টি গ্রাম নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে তাঁর গবেষণাটি। আমি তেমন দুয়েকটি গ্রামে গিয়েছি। কৃষক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কীভাবে দশকের পর দশক ধরে মাহবুব হোসেন ও তাঁর দল সেসব নির্দিষ্ট গ্রামীণ জনপদের এবং কৃষি খামারগুলোর তথ্য সংগ্রহ করেছে। ১৯৮৮ সাল থেকে শুরু করে তিনি ও তাঁর দল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা সেসব গ্রামে ফিরে ফিরে গেছেন ২০০০, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে। এই গবেষণা মাহবুব হোসেনকে বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপট বুঝতে সহায়তা করেছে।

মাহবুব হোসেন তাঁর বিভিন্ন গবেষণালব্ধ উপলব্ধির কথা নিবন্ধ, বক্তৃতা ও গ্রন্থে লিখে গেছেন। লিখে গেছেন গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা, নতুন উদ্ভাবনার কথা, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নন-ফার্ম (অকৃষি) অর্থনীতির ক্ষেত্র প্রসারিত করতে কৃষি অর্থনীতি কীভাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, সেসব কথা।

বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নের মধ্যে মাহবুব হোসেন বেঁচে থাকবেন।

রিয়াজ আহমদ ঢাকা ট্রিবিউন–এর িনর্বাহী সম্পাদক