আমাদের জন্য আমাদের টি-শার্ট
এই শতাব্দীর প্রথম বাংলা নববর্ষ বেশ আলাদা হয়েই রইল। সকালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হলো, ফলে থমথমে উত্তেজনা। আর এদিকে চারুকলার সামনে ৮-১০ জনের ছোট্ট বিক্ষিপ্ত দল—অনুপম চক্রবর্তী, তনুজা ভট্টাচার্য, আমীরুল রাজিব, মুনেম ওয়াসিফ, নিজার আলম, নিলিম, টুটুলসহ আমাদের কজনের একটু ভিন্ন রকম এক আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি চলছে। টি-শার্টে ‘ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ব্যক্তিত্ব ধারাবাহিক’–এর প্রথম দৃশ্যরূপ উপস্থাপন আলোর মুখ দেখবে। দুই তরুণ শিল্পীর অঙ্কন দিয়েই এই দৃশ্যরূপ রচিত হয়েছে। শিল্পী ধ্রুব এষ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে, উপন্যাস, গল্প ও ছড়া লিখে সুপরিচিত ও জনপ্রিয় এবং সব্যসাচী হাজরা পেইন্টিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মোট সাতটি টি-শার্টের অনাড়ম্বর মোড়ক উন্মোচন, দিনব্যাপী পথ-প্রদর্শনী ও বিক্রির আয়োজন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনের রাস্তা ওবং ওপারে মোল্লার চায়ের দোকানের সামনের সড়কে ডেকোরেটরের বানানো স্টলে। প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন কার্টুনিস্ট ও চারুকলার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য, ইজেলের ওপর রাখা কার্ট্রিজ পেপারে আঁকলেন টি-শার্ট পরা এক যুবকের ছবি, যার গায়ের টি-শার্টে আঁকা ওই যুবকেরই ছবি। কেন এ রকম আঁকলেন! এর মানে দাঁড়াল আমাদের স্বকীয়তা, নিজস্ব ভাবনা ও আত্মপরিচয় আমাদের পোশাকেও। আধুনিক বিশ্ব এই টি-শার্টের ক্যানভাস কত বৈচিত্র্যপূর্ণ, কত যে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে! টি-শার্ট নিয়ে, এর কাপড়, এর ডিজাইন নিয়ে হয়ে চলেছে কত যে নিরীক্ষা, বিষয় ও ডিজাইনে কত যে বৈচিত্র্য! উপরিতল অলংকরণে মুদ্রণশিল্পের পরিশীলিত ব্যবহার–কৌশল কত চিত্তাকর্ষক হতে পারে, তা আজ আশপাশে তাকালেই দেখা যায়। এক সময় ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটের আর গার্মেন্টসের বাতিল টি-শার্টের ছড়াছড়ি। কে জানত, পরবর্তী সময়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পথে-প্রান্তরে ‘নব–আনন্দে জাগো’, ‘জয়নুল’, ‘সুরঞ্জনা’, ‘তাদের খাড়া দুটো শিং’, ‘বাউল’ বা ‘পাখি’—এ রকম টি-শার্ট নতুন মাত্রা যোগ করবে, আমাদের নব–আনন্দে জাগাবে!
টি–শার্ট কখনো শিল্পীর ক্যানভাস, কখনো হয়ে ওঠে স্মারক, স্যুভেনির বা মোমেনটাম—আবার কখনো গর্বের ও প্রেরণার প্রতীক। স্মারক এমন এক ধারণা, যা আমদানি বা রপ্তানি করার মতো নয়, কিন্তু বিনিময় ও সংগ্রহ করা যায়। সময়টা যে আরও নতুন কিছু সূচনার, কে জানত!
ছয়–সাত বছরে যাকে বলে বাজার জরিপ, সেটা হয়ে গেল। যোগ হলো স্ক্রিনপ্রিন্টে মুদ্রণদক্ষতা আর টি-শার্টে সবচেয়ে দরকারি শিল্পী ও শিল্পভাষা শেখা। বাকি থাকল ক্যানভাস—মানে টি-শার্ট; দরকার টাকা। তারও সমাধান হয়ে গেল।এমনই একটা বিমূর্ত সময়ে আমাদের বাংলা বা বাংলাদেশের টি-শার্টের স্বপ্নযাত্রা শুরু। ঢাকার আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিছু করার চেষ্টার সময়ে এমনই কিছু ভাবনা দানা বাঁধতে থাকে। তিনতলার সামনের দিকে নিত্য উপহারে বসে মিনিটে কটা রিকশা, স্কুটার বা বাস রাস্তা দিয়ে যায়—গুনতে গুনতে, শিখতে শিখতে শতাব্দীর শেষ কটা দিন পার করা। তত দিনে স্ক্রিনপ্রিন্ট মাধ্যমে হাতে তৈরি কাগজ দিয়ে সাত-আট শ নবদম্পতির জন্য বিয়ের কার্ড করা হয়ে গেছে। চলছে এসব দম্পতির বিবাহ-বার্ষিকীতে শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানোর ডাক ঠিকানার তালিকা নবায়ন, সংশোধন ও কার্ড পাঠানো। নববর্ষ, জন্মদিন বা নানা রকম অনুষ্ঠানের দাওয়াতের কার্ড ছাপায় একটু সুনামও হলো। আর এসবের অলংকরণ, গ্রাফিক ডিজাইন সব্যসাচী হাজরা অনেক যত্নসহকারে ও সাবলীলভাবে করে দিতেন। বিকেল ও সন্ধ্যায় প্রায় নিয়মিত সব্যসাচী হাজরা, তনুজা ভট্টাচার্য ও অনুপম চক্রবর্তী, মাঝেমধ্যে আরও তরুণতর সব্যসাচী মিস্ত্রি, রাজিব, ওয়াসিফ, নিজার, মাসুম, নিলিম, তানভির, টুটুল, ফাইজা, গোরা, উজ্জ্বল, শিবু, সুমনসহ আরও অনেকে আমাদের সঙ্গে অংশ নিতেন।
ছয়–সাত বছরে যাকে বলে বাজার জরিপ, সেটা হয়ে গেল। যোগ হলো স্ক্রিনপ্রিন্টে মুদ্রণদক্ষতা আর টি-শার্টে সবচেয়ে দরকারি শিল্পী ও শিল্পভাষা শেখা। বাকি থাকল ক্যানভাস—মানে টি-শার্ট; দরকার টাকা। তারও সমাধান হয়ে গেল। বন্ধু আলমগীর হোসেন আর মো. আজিজুর রহমান এগিয়ে এলেন। এই হলো আমাদের স্বপ্নযাত্রার প্রস্তুতিপর্ব।
ধ্রুব, সব্য, অনুপম ও আমি অনেক আলোচনা করেছি, কেন হ্যারি পটার, স্পাইডারম্যান বা এ রকম টি-শার্ট আমরা করব না। ওসব করার জন্য যোগ্য, সক্ষম মানুষের অভাব নেই পশ্চিমে। একটা লাইন মাথায় ঘুরছিল, ঠিক করতে পারছিলাম না। এক সন্ধ্যায় তনুজা ও অনুপম সমাধান করলেন, এটা হবে ‘সিরিজ অব হেরিটেজ অ্যান্ড অ্যাপোসল’, বাংলায় যাকে বলি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব ধারাবাহিক। অনুপম একটা বাক্য বললেন, ‘এটা সব সময় ট্যাগে লিখবেন, “উই আর ওল্ডার দ্যান দ্য রকস অ্যামং হুইচ উই সিট”—এটা কিন্তু রাখতেই হবে! এ–ই ছিল আমাদের সৃজন দল। এ দলই টি-শার্টের লেখার কপি নিয়ে কোনো সংশয় হলে ঠিক করে দিত।
শুরুটা মোটামুটি সহজ। অনেকটা সার্কাস খেলায় দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার মতো—রুদ্ধশ্বাস, রোমাঞ্চকর! এমন আবহ—যেকোনো মুহূর্তে পতন! কিন্তু সচরাচর পড়েন না দড়াবাজ। সার্কাস খেলায় সম্ভাব্য পতনজনিত বিপদ থেকে রক্ষায় নিরাপত্তাজাল থাকে, যা দর্শক দেখতে পান না। খেলোয়াড় নিশ্চিন্ত–নির্ভার দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটেন। অবশ্য বাস্তব জীবনের খেলায় একটু সমস্যা আছে—পড়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, খেলাটা অনেক বছর ধরে চলতে পারে এবং কোনো নিরাপত্তাব্যূহ নেই। পড়ে হাত–পা ভাঙা তো কোনো ব্যাপারই নয়, উদ্যোগটারই মৃত্যু হতে পারে এবং হয়ও।
দ্বিতীয় বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি, সব্যসাচী হাজরার দুটি টি-শার্ট—ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর এবং ঢাকা সিটি অব কনট্রাস্ট (তাঁতীবাজারে ভোররাতে গিয়ে মোনেম ওয়াসিফ আলোকচিত্র তুলেছিলেন)—দেশীয় চেতনার এই টি-শার্ট এতটাই উদ্বুদ্ধ করেছিল যে রাজিব, ওয়াসিফ, নিজার, মাসুম, নিলিম, তানভির ২০০২–০৩ সালের ভাষাদিবস ও পয়লা বৈশাখে টিএসসি ও চারুকলার সামনে দাঁড়িয়ে বিক্রি করেছেন।
এরপর যুক্ত হন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল। রাত জেগে হাতে, ট্রেসিং পেপারে পাঁচ রঙে কালার সেপারেশনে করেন গাজীর পট, ডাকসু ভবন খুঁজে চার ভাষাশহীদের ছবি নিয়ে একুশের টি-শার্ট। যুক্ত হন শিল্পী নাজিব তারিক ও কনক আদিত্য—তাঁরাও বেশ কিছু ভালো টি-শার্ট করেন।
২০০৪ সালে স্লোভাকিয়ার তরুণ টম বরিস তাঁর স্নাতক শেষে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে টি-শার্ট পরিহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শরিফকে দেখে জানতে চান, ‘কোথায় পাব?’ শরিফ বলেন, ‘আজিজ মার্কেটে পাবেন। চলুন, আমিও যাব ওদিকে।’
টম বরিস আমার এখানে আসেন। নানা কথাবার্তার পর বলেন, ‘তোমাদের পতাকা ফুটে ওঠে, এ রকম কোনো স্যুভেনির, টি-শার্ট নেই?’ আমি বললাম, ‘তুমি কদিন থাকবে? দেখি পারি কি না!’ কিন্তু হলো না। দুটি টি-শার্ট নিয়ে গেলেন বরিস। আরও একটির দাম অগ্রিম দিয়ে গেলেন, ‘যদি করতে পারো, পাঠিয়ে দিও আমার ঠিকানায়।’ মে অথবা জুনে পাঠানো গেল শেষমেশ। টম বরিস মেইল করলেন, ‘তুমি ঠিক আছ তো! তোমার দেশে বন্যা হয়েছে, টেলিভিশনে দেখলাম। তোমার এই পতাকার প্রতীক টি-শার্টটি একদিন খুব জনপ্রিয় হবে, দেখে নিয়ো। আর এবার বেশি টি-শার্ট নিতে পারিনি। আবার বাংলাদেশে এলে তোমার অনেক টি-শার্ট কিনব। গুড লাক।’
শুরু হলো নতুন যুগের সুচনা। ২০০৫ সালে তরুণদের এই প্রচেষ্টায় যোগ দিয়ে উদ্দীপ্ত করলেন কিংবদন্তিতুল্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আরেক দিকপাল শিল্পী হাশেম খান, আবুল বারক আলভি, শেখ আফজাল ও চন্দ্রশেখর সাহার মতো বড় শিল্পীদের যুক্ততার মধ্য দিয়ে। তাঁদের কাজ পোশাকে স্বকীয়তা ও নিজস্বতার চর্চাকে অনন্য এক মর্যাদাপূর্ণ মাত্রা যোগ করে।
এভাবেই বাংলা বা বাংলাদেশের টি-শার্টে নিজস্বতার এক নতুন ধারার অবয়ব তৈরি হয়। এই অসামান্য সব সৃষ্টিশীল মানুষেরাই আমাদের নিজস্ব ভাষায় টি-শার্টের ধারণার পরিচর্যা ও সমৃদ্ধ করেছেন ও করে চলেছেন। তাঁদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আর কৃতজ্ঞতা অগণিত ভোক্তা ও শুভানুধ্যায়ীর প্রতি, যাঁদের অবিরাম ভালোবাসা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। এটি অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বদেশি পোশাক চর্চায় অনুপ্রাণিত করে, যার ফলে পরবর্তীকালে টি-শার্ট ফেস্টিভ্যাল আয়োজনের মতো কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয় তাঁরা।
আজও সেই দড়ির ওপর দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি কোনো নিরাপত্তাব্যূহ ছাড়াই। পোশাকে স্বদেশি চেতনার নবজাগরণের স্বপ্ন শেষ হয়নি আজও।
বাহার রহমান : ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী