অর্জন উদ্যাপন করতে যেন কুণ্ঠিত না হই

িশক্ষায় েময়েদের অন্তর্ভুক্তির হার ছেলেদের চেয়ে বেশি
িশক্ষায় েময়েদের অন্তর্ভুক্তির হার ছেলেদের চেয়ে বেশি

সময়টা ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে এসেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। সে উপলক্ষে একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার ঘটল। পৃথিবীর ১৮৯টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান স্বাক্ষর করলেন ‘সহস্রক ঘোষণাপত্রে’। জন্ম নিল ‘সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্য’। বিশ্বের মৌলিক বঞ্চনাগুলোকে কমানোর লক্ষ্যে এ একটি মহতী উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হলো বিশ্বসভায়।

সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য শুরুতেই জেনে নিই;

প্রথমত, সব রকমের মানববঞ্চনা নয়, বরং বিশ্বের মৌলিক বঞ্চনা হ্রাস করাই সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং বৈশ্বিক লক্ষ্য হলেও সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু উন্নয়নশীল দেশগুলো।

দ্বিতীয়ত, মোট আটটি লক্ষ্যকে সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের আওতায় আনা হয়েছিল এবং এগুলো অর্জনের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ২০১৫।

তৃতীয়ত, সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্য প্রোথিত মানব উন্নয়নের ধ্যানধারণা ও মানবাধিকারের মধ্যে। তাই মানববঞ্চনা দূরীকরণই ছিল সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু।

চতুর্থত, সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের ভিত্তি হচ্ছে সহস্রক ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্র সহস্রক লক্ষ্যের তুলনায় অনেক ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত। যেমন সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যে সুশাসনবিষয়ক কোনো লক্ষ্য নেই, কিন্তু ঘোষণাপত্রে এর স্বীকৃতি আছে।

পঞ্চমত, সহস্রক ঘোষণাপত্র মানববঞ্চনা হ্রাসে সারা বিশ্বের যৌথ অঙ্গীকার। তাই উন্নয়নশীল দেশের বঞ্চনা হ্রাসে উন্নত বিশ্বের দায়িত্বও এখানে স্বীকৃত।

সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ এ বৈশ্বিক অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের পক্ষে সে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। যদিও বহু উন্নয়নশীল দেশ এ উদ্যোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব অবস্থান নিয়েছিল এবং উন্নত বিশ্বের অভিপ্রায় সম্পর্কে সন্দিহান ছিল।

বাংলাদেশ কিন্তু প্রথম থেকেই সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্য সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেছে এবং গঠনমূলকভাবে এগুলো অর্জনে ব্রতী হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক হচ্ছে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহকে বাংলাদেশ কখনো সমান্তরাল উদ্যোগ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবেনি। বরং দুটির মধ্যেই একটি সামঞ্জস্য বিধান করতে চেয়েছে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যকেই গ্রহণ করেছে পরিকল্পনার লক্ষ্য হিসেবে। একই সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়নকৌশল এবং সম্পদলভ্যতার মধ্যে একটি সযত্ন সামঞ্জস্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পেরেছে। অন্যদিকে সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের পরিমাপ, প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিত করা এবং এগুলোর যথাযথ মূল্যায়নে বাংলাদেশ সব সময় সচেষ্ট থেকেছে।

এবার দেখা যাক সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের চালচিত্র। চরম দারিদ্র্যের হ্রাস দিয়েই শুরু করা যাক। ২০১৫ নয়, ২০১০ নাগাদই চরম দারিদ্র্যের হার বাংলাদেশে আর্ধেকের বেশি কমে নেমে এসেছে ১৯৯১ সালের ৪১ শতাংশ থেকে ২০১০–এ ১৩ শতাংশে। সার্বিক দারিদ্র্যও আর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য বাংলাদেশ অর্জন করেছে ২০১৩ সাল নাগাদ—২০১৫ সালের সময়সীমার আগেই।

সমীক্ষা অনুযায়ী গত আট বছরে এক কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। ২০১০ সালে যারা সার্বিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, তার এক-তৃতীয়াংশ আর দরিদ্র নয়। ২০১০ ও ২০১৮ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৩১ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের এ সাফল্য অনেকটাই অর্জিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে দেশে আয় প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বজায় রেখে। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি ছিল। জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার উপাত্ত অনুসারে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সময়কালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল তিন গুণ—ভারতের ১৩ শতাংশ বনাম বাংলাদেশের ৩৯ শতাংশ। এ হারে যদি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আগামী বছরগুলোতে বজায় থাকে, তাহলে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের মাথাপিছু আয়কে ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ আর ভারতের একদা পরিচিত দরিদ্র পশ্চাৎপদ প্রতিবেশী নয়।

তবে এ আয় বৃদ্ধির যাত্রায় ধনীদের ভাগে যা পড়েছে অনেক বেশি দরিদ্রদের তুলনায়। ফলে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান দপ্তরের মতে, দেশের ৩৮ শতাংশ সম্পদের মালিক দেশের ১০ শতাংশ সর্বোচ্চ ধনিকশ্রেণি এবং দেশের সবচেয়ে দরিদ্রশ্রেণির কাছে আছে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ।

সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের অন্য সূচকগুলোতেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু যেখানে ৭৩ বছর, ভারতের সেখানে ৬৯ বছর, পাকিস্তানের ৬৭ বছর। শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে যেখানে প্রতি হাজারে ২৮, ভারতে ৩৫, পাকিস্তানে ৬৪। মাতৃমৃত্যুর হার কিংবা শিশু অপুষ্টির হারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অর্জন ভারত কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো।

শিক্ষার দিকে চোখ ফেরানো যাক। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশ, ভারতে ৬৯ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ। যুব সাক্ষরতার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তির অঙ্গনেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।

নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সাক্ষরতার হার বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে যেখানে ৯০ শতাংশ, তরুণীদের মধ্যে তা ৯৩ শতাংশ। কি প্রাথমিক, কি মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর, মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর প্রতি ১০০ হাজার জনে যেখানে ১৭৬, উন্নয়নশীল দেশে তা ২৩২। বাংলাদেশে যেখানে ৬২ শতাংশ নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পন্থাগুলো অবলম্বন করেন, উন্নয়নশীল দেশে তা মাত্র ৫৩ শতাংশ।

এসব উপাত্তভিত্তিক চিত্র থেকে একটি সুদৃঢ় উপসংহার বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ও জাতীয় আয়কে যত দক্ষভাবে সামাজিক অগ্রগতিতে রূপান্তর করতে পেরেছে, অনেক দেশ পারেনি। তবে এসব সাফল্যের মানে এই নয় যে বাংলাদেশ সব মানববঞ্চনা মিটিয়ে দিয়েছে এবং আমরা করণীয়, সবকিছু করে ফেলেছি।

বাংলাদেশে সামাজিক বিনিয়োগ আরও বেশি বাড়ানো দরকার। ভৌত অবকাঠামোই শুধু মূলধন নয়, মানব মূলধনও একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ মূলধন। আর্থসামাজিক বলয়ের বাইরে এখনো বহু বাধার দিকে আমাদের তাকাতে হবে সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের অর্জনকে বজায়ক্ষম করতে হলে। নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। আজকের বিশ্বে উন্নয়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া, যাকে দক্ষভাবে মোকাবিলা করতে হলে উন্নয়ন–সহযোগীদের মধ্যে একটি গঠনমূলক আঁতাত দরকার। নতুন উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতা যেমন, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে নতুন চিন্তাচেতনার প্রয়োজন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে।

উন্নয়ন প্রেক্ষাপটে আমাদের যথেষ্ট সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা থাকলেও আমাদের অর্জনের আলো দেখতে আমরা যেন ভুল না করি এবং তাকে উদ্যাপন করতে যেন কুণ্ঠিত না হই। সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের অঙ্গনে বাংলাদেশ যে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে একটি নতুন গতিময়তা দান করবে।

আর শুধু সমস্যার কথা বলে আমরা যেন থেমে না থাকি। সমাধান কী হতে পারে, সেদিকে যেন দৃষ্টিটা ঘোরাই। আর মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন ব্যাপারটি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের দৌড় নয়, একটি দীর্ঘ পথযাত্রা, একটি আলোর ঝলকানি নয়, একটি ধারাবাহিকতা। সুতরাং সহস্রক উন্নয়ন লক্ষ্যের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে দৃপ্ত পদক্ষেপে বজায়ক্ষম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে।

সেলিম জাহান, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক