অবিস্মরণীয় কয়েকটি দিন
>বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে, কিন্তু বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে বন্দী। তাঁর মুক্তি হলো আকস্মিকভাবে। মুক্ত বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লি হয়ে পা রাখলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। এই পুরো সময়টা তিনি ছিলেন বিশ্বগণমাধ্যমের দৃষ্টির কেন্দ্রে। দেশ-বিদেশের পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে সে কয়েকটি দিনের ছবি।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২, রোববার
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, যুক্তরাষ্ট্র
মুক্ত শেখ মুজিবের যুক্তরাজ্যে পদার্পণ, ইয়াহিয়া গ্রেপ্তার
পাকিস্তানের কারাগারে ৯ মাস বন্দী থাকার পর মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আজ যুক্তরাজ্যে উড়ে গেছেন। মুক্ত হওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি পুরো বিশ্বের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ যেন মারা না যায়, সে জন্য বাইরের দেশগুলোর কাছে সহায়তাও চেয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য আজ ভীষণ এক আবেগময় দিন। তাঁর যুক্তরাজ্যে আগমন ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এ কারণে তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বাসও ছিল বাঁধনহারা।
গতকাল শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে নিজের কথা রেখেছেন পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। মুক্তি দেওয়ার পর শেখ মুজিবকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়। ভোর ৬টা ৩৬ মিনিটে তিনি যুক্তরাজ্যে এসে নামেন।
এদিকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার পর সাবেক পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অব স্টাফ আবদুল হামিদ খানকে গৃহবন্দী করা হয়েছে।
হিথ-মুজিব সাক্ষাৎ
শেখ মুজিবের লন্ডনে পদার্পণের বিষয়টি জানতে পেরে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিমানবন্দরে ছুটে যান। এরপর যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে তাঁকে ক্ল্যারিজ’স হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা তাঁর জন্য একটি স্যুট বুকিং দিয়ে ফেলেছেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ দেশের বাইরে ছিলেন। শেখ মুজিবের আগমনের খবর শুনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হিথ দ্রুত ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে আসেন। সন্ধ্যায় প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন তাঁরা। হিথ মুজিবকে কথা দেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটাতে যা যা করা সম্ভব, ব্রিটেন তা করবে। কিন্তু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে হিথ বলেন, ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত ও দেশের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশিদের হাতে না আসা পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হতে পারে।
শেখ মুজিব কবে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন, সেটি এখনো জানা যায়নি। তবে নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত বাংলাদেশের একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, শেখ মুজিব আগামীকাল সোমবার সকাল সাতটায় দিল্লি পৌঁছাবেন।
শেখ মুজিব কেন লন্ডনে এসেছেন, সেটি এখনো এক রকমের রহস্য হয়ে আছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, মুক্ত হওয়ার পর তিনি কোথায় যাবেন, সেটি পাকিস্তানিরাই ঠিক করে দিয়েছে। তবে ভুট্টো বলেছেন, শেখ মুজিব নিজেই লন্ডনে আসতে চেয়েছেন।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সরাসরি ঢাকা বা ভারতের কোথাও যান, পাকিস্তানিরা তা চায়নি। খুব সম্ভবত এটিকে তারা নিজেদের জন্য অপমানজনক বলে বিবেচনা করেছে। ভুট্টো ইরান বা তুরস্কের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তবে শেখ মুজিব চেয়েছিলেন, সরাসরি দেশে ফিরতে না দেওয়া হলে তিনি আগে লন্ডনেই যেতে চান।
কনডেম সেলে বন্দী ফাঁসির আসামি
সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেছেন, তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কনডেম সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ওই সেলে গরম ছিল অসহনীয়। নির্জন একাকিত্ব তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। শেখ মুজিব এমনকি এটাও বলেছেন, ভুট্টো না জানানো পর্যন্ত তিনি যুদ্ধের ফলাফলও জানতেন না।
শেখ মুজিব বলেন, ‘আজ আমি আমার দেশবাসীর সঙ্গে স্বাধীনতার অবাধ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারি। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করে নিয়েছি। এই সংগ্রামের চূড়ান্ত ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কনডেম সেলে বন্দী অবস্থায় যখন ফাঁসির অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম, আমার দেশের মানুষ তখন আমাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।’
শেখ মুজিব বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ রাখতে ভুট্টো তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছেন, দেশে ফেরা না পর্যন্ত এ ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলতে পারেন না।
যুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশিদের ওপর কেমন অত্যাচার চালিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিব বলেন, ‘ওরা আমার দেশের ছেলেমেয়েদের নির্যাতন করেছে, নিষ্ঠুরভাবে মানুষ হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার ভবন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আজ যদি হিটলার বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনিও পাকিস্তানিদের এই বর্বরতা দেখে লজ্জা পেতেন।’
শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সঙ্গে যে রকম আচরণ করেছিল, তাতে একসঙ্গে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভুট্টো সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করবে।
যুদ্ধের সময় যেসব দেশ বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে, সংবাদ সম্মেলনে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শেখ মুজিব। ভারত, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর নাম উল্লেখ করেন তিনি।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকেও ধন্যবাদ জানান শেখ মুজিব। নিক্সন সরকার পাকিস্তানের পক্ষে থাকার পরেও কেন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি ধন্যবাদ জানালেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের ব্যাপারে জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষেই ছিল।’
যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে চাইলে তা গ্রহণ করবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, যেকোনো দেশের সহায়তাই তিনি সাদরে গ্রহণ করবেন, তবে কোনো দেশ বাংলাদেশের জনগণের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে সেটা তিনি হতে দেবেন না।
অংশবিশেষ
৯ জানুয়ারি ১৯৭২, রোববার
দ্য সানডে টেলিগ্রাফ, লন্ডন
শেখ মুজিবের আগমন ও হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সাহায্যের অনুরোধ
রোনাল্ড পাইন, কূটনৈতিক প্রতিবেদক
শেখ মুজিবুর রহমান, ৫১ বছর বয়সী ‘বাংলাদেশের জনক’ গতকাল ভোরে সবাইকে চমকে দিয়ে লন্ডনে পৌঁছান। গত রাতে (ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড) হিথের সঙ্গে আন্তরিক আলাপচারিতায় তিনি এক ঘণ্টা সময় কাটান।
প্রধানমন্ত্রী হিথ প্রথম কোনো সরকারপ্রধান, যিনি সরাসরি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বললেন। শেখ মুজিব এসেছেন নব্য স্বাধীন দেশটির স্বীকৃতি ও লাখো পাউন্ড সাহায্যের আবেদন জানাতে।
নতুন প্রজাতন্ত্রের শরণার্থীসংকট মোকাবিলা ও রাষ্ট্রের আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় সাহায্যের বিষয়ে বেশ লম্বা সময় ধরে আলোচনা হয়। মাত্রই কিছুদিন আগে পাকিস্তানের কারাগারে থাকা বাংলাদেশের নেতাকে হিথ বলেন, তাঁর সরকার সম্ভাব্য সব সহযোগিতা দিতে উদ্গ্রীব। আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী (হিথ) এই মত ব্যক্ত করেন যে জাতিসংঘই সর্বোত্তম সংস্থা, যার মাধ্যমে মানুষের দুর্দশা লাঘবে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়া সম্ভব। তবে কমনওয়েলথের বিশেষ বন্ধনের আওতায় সরাসরি কিংবা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও ব্রিটেন সহযোগিতা করতে পারে বলেও তিনি একমত হন।
এ সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর সাবেক সংবিধানবিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। আর প্রধানমন্ত্রীর (এডওয়ার্ড হিথ) সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র দপ্তরের ইয়ান সাদারল্যান্ড। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এর আগে তিনি বেশ দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন।
নতুন রাষ্ট্রকে ব্রিটেনের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রসঙ্গটি উঠে আসে আলোচনায়। এ সময় স্বীকৃতির জন্য সাধারণভাবে অনুসৃত ব্রিটিশ মানদণ্ডের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেন। দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় এলে (ব্রিটিশ) প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে বলেন, খুব শিগগির কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার ইচ্ছে ব্রিটেনের নেই। তবে হিথের দেওয়া উষ্ণ অভ্যর্থনা রাষ্ট্রপতির (মুজিব) হতাশা কিছুটা লাঘব করেছে।
রাষ্ট্রপতি মুজিব (১৯৭১ সালে) গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলি সম্পর্কে হিথকে বিস্তারিত ধারণা দেন। তিনি এমনকি গত সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট (জুলফিকার আলী) ভুট্টোর সঙ্গে হওয়া তাঁর আলাপের বর্ণনাও দেন। গৃহবন্দিত্ব ও কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিব কেন লন্ডন আসতে মনস্থির করলেন, সে বিষয়ে জানতে অন্য সবার মতো হিথও উদ্গ্রীব ছিলেন। শেখ মুজিব হিথকে বলেন, কোথায় যাওয়া উচিত, তা নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন এবং উভয়ের দৃষ্টিতেই লন্ডনই ছিল সেরা জায়গা।
বিরোধীদলীয় নেতা মি. উইলসন গত রাতে বাংলাদেশের নেতার সঙ্গে আলোচনার জন্য ক্ল্যারিজ’স হোটেলে যান। শেখ মুজিব সেখানে সংবাদ সম্মেলন করেন। উইলসনের অনুরোধেই বৈঠকটির আয়োজন হয়।
তিনি হোটেলে পৌঁছালে বাংলাদেশের সমর্থকেরা উল্লাসধ্বনি করে। বিরোধীদলীয় এই নেতা শেখ মুজিবকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ব্রিটেনের অনুসৃত নীতি ব্যাখ্যা করে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে এ ক্ষেত্রে কনজারভেটিভরা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে লেবার পার্টি তাতে সমর্থন দেবে।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২, রোববার
দৈনিক ইত্তেফাক, এনা, ইউএনআই, লক্ষ্ণৌ‘
আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ’
—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
‘আসলে আমরাই—’
—ইন্দিরা গান্ধী
অদ্য সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আলোচনা করেন। কথা বলার সময়ে শ্রীমতী গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জ্ঞাপন করেন।
ভারতীয় নেত্রী বাংলাদেশের নেতার শারীরিক কুশলাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। তিনি শেখ সাহেবকে বলেন, তিনি (শেখ সাহেব) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তাঁহার জনগণকে অনুপ্রাণিত করেন।
দুই নেতার মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ হইলে শ্রীমতী গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কেমন আছেন?’ উত্তরে বাংলার নেতা বলেন,
‘আমি ভালোই আছি। আমি আপনার নিকট একান্ত কৃতজ্ঞ।’ উত্তরে ভারতীয় নেত্রী বলেন, ‘কিন্তু আসলে আমরাই আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কারণ, আপনিই আপনার দেশবাসীকে স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রেরণা দিয়াছেন।’
১০ জানুয়ারি ১৯৭২, সোমবার
দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা
দিল্লিতে নেতার রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা
নয়াদিল্লি হইতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানাইয়াছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ (সোমবার) স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় ভারতের রাজধানীতে আসিয়া পৌঁছিলে তাঁহাকে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হইবে। এখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর একখানি বিশেষ বিমানযোগে তিনি সরাসরি ঢাকা গমন করিবেন।
গতকাল বিকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আজাদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর নয়াদিল্লি আগমনের সময়সূচি ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লি আসিয়া পৌঁছিলে তাঁহাকে রাষ্ট্রপ্রধানের যথোচিত মর্যাদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হইবে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পালাম বিমানবন্দরে তাঁহাকে স্বাগত জানাইবেন। নয়াদিল্লিতে শেখ সাহেবের অবস্থানকাল হইবে প্রায় তিন ঘণ্টা।
ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র বঙ্গবন্ধুর নয়াদিল্লিতে অবস্থানের সূচি বর্ণনা করিতে গিয়া বলিয়াছেন, পালাম বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল এরিয়ায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রধানের বিমানখানি অবতরণ করিবে এবং তিনি বিমানবন্দরে সমাগত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিবেন। ইহার পর শেখ সাহেব ক্যান্টনমেন্ট প্যারেড গ্রাউন্ডে যাইবেন এবং সেখানে এক জনসভায় বক্তৃতা করিবেন। এই সভার পর তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে ভি ভি গিরির সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। এখানে উভয় রাষ্ট্রপ্রধানের সহিত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীরও সাক্ষাৎকার ঘটিবে।
১১ জানুয়ারি ১৯৭২, মঙ্গলবার
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নয়াদিল্লি
শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাতে দিল্লিতে আয়োজিত জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সেটা এনেও দিয়েছেন। বাংলাদেশকে মুক্ত করা ভারতেরও অঙ্গীকার ছিল, সঙ্গে ছিল মুজিবকে মুক্ত করা। ‘শেষত আমরা লাখ লাখ শরণার্থীকে তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠাতে চেয়েছি। আমরা সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছি।’ তিনি বলেন।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বঙ্গবন্ধু এখন দেশে ফেরত যাচ্ছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিকশিত হবে। তিনি আরও বলেন, মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, তখনো তিনি পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত বাংলাদেশি তরুণদের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের মানুষ এ রকম বীরের মতো লড়াই করতে পেরেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেখ মুজিব এখন নিজ দেশ, জনগণ ও পরিবারের কাছে ফিরছেন। তবে নিজ দেশে তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে, সেটা আর কিছু নয়, বাংলাদেশের পুনর্গঠন।
তবে দিল্লির প্যারেড গ্রাউন্ডে সমবেত বিপুল জনতা শেখ মুজিবের বক্তৃতা শোনার জন্যই এসেছিলেন। সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী সংক্ষেপেই বক্তৃতা সারেন।
১১ জানুয়ারি ১৯৭২, মঙ্গলবার
সংবাদ, ঢাকা
জনতা সাগরে জেগেছে ঊর্মি
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (সোমবার) দুপুরে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিলে বিমানবন্দরে তাঁহাকে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করামাত্র সেখানে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার জনতা উল্লাসে ফাটিয়া পড়ে।
বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি বিমানবন্দরের ওপরে দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতার মুহুর্মুহু করতালি ও আনন্দধ্বনিতে সমগ্র তেজগাঁও এলাকা প্রকম্পিত হইয়া ওঠে। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিশালকায় কমেট-৫ বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু ঢাকা আগমন করেন। রানওয়েতে বিমানটিকে অবতরণের পূর্বে বেশ কয়েকবার বিমানবন্দরের চারিদিকে পরিক্রমণ করিতে হয়। এই সময় অপেক্ষমাণ বিশাল জনতা আনন্দ উল্লাসে লাফাইতে থাকে। দুপুর ১টা ৪২ মিনিটের সময় বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করে। বঙ্গবন্ধু বিমান হইতে বাহির হইয়া ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস’ ফলক আঁকা গ্যাংওয়েতে (সিঁড়ি) দাঁড়াইবার সঙ্গে সঙ্গে জনতা বাঁধভাঙা জোয়ারের ন্যায় সকল রকম নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উপেক্ষা করিয়া তাঁহার দিকে ছুটিয়া যায়। বঙ্গবন্ধুও সর্বপ্রথম তাঁহার জন্য প্রতীক্ষমাণ জনতার উদ্দেশে হস্ত উত্তোলিত করেন। গ্যাংওয়ে হইতে ফুলহাতা কালো ‘মুজিব কোর্ট’ পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন চারিদিকে ফিরিয়া হাত উঁচাইয়া জনতার অভিনন্দনের জবাব প্রদান করিতেছিলেন, ওই সময় হইতে জনতা ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি স্লোগান প্রদান করিতে থাকে।
এই দিকে বিমানবন্দর চত্বরে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষমাণ বিদেশি কূটনীতিক, পদস্থ কর্মচারী, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিপ্রধান শ্রী মণি সিংহ, সম্পাদক জনাব আবদুস সালাম, শ্রী খোকা রায়, শ্রী অনিল মুখার্জি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বেগম মতিয়া চৌধুরী, আবদুল হালিম, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দকে পুষ্পস্তবক ও মালাসহ দেখা যায়। তাঁহাদের অনতিদূরেই ছিল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদানের জন্য দণ্ডায়মান বাংলাদেশ স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর জওয়ানেরা।
বিমানের গ্যাংওয়েতে সর্বপ্রথমে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এরপর প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন। বঙ্গবন্ধু বিমান হইতে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের ন্যায় জনতা সকল কর্ডন ভেদ করিয়া চারিদিক হইতে তাঁহাকে এমনভাবে ঘিরিয়া ফেলেন যে তিনি যে স্থানে দণ্ডায়মান ছিলেন, সেখান হইতে এক পাও পর্যন্ত আগানো অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়। জনতার ভিড়ের চাপে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য আগত বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, পদস্থ সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিদের কাতারগুলিও ভাঙ্গিয়া একাকার হইয়া যায়। তখন সমগ্র বিমানবন্দর চত্বরে শুধু পুষ্পমাল্য আর স্তবকের বৃষ্টি পরিলক্ষিত হয়।
এই ভিড়ের মধ্যেই কোনোরকমে বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ ডায়াসে লইয়া যাওয়া হয়। ঠিক এই সময় বঙ্গবন্ধুর সহিত তাঁহার বৃদ্ধ পিতার সাক্ষাৎ ঘটে। বঙ্গবন্ধুর পিতা পূর্ব হইতেই সেখানেই পুত্রের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন। বাংলাদেশ বাহিনীপ্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সাথে বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চে উপস্থিত হন। বাংলাদেশ বাহিনীর মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন প্রদানকারী সম্মিলিত তিন বাহিনীর নেতৃত্ব করেন।
সামরিক অভিবাদন শেষে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্যদের সমভিব্যাহারে অপেক্ষমাণ বিদেশি কূটনীতিকদের দিকে আগাইয়া যান। কিন্তু এই দিকে জনতার ভিড় এতই প্রচণ্ড আকার ধারণ করে যে বিদেশি কূটনীতিকদের ব্যতীত অপেক্ষমাণ আর সকলের সাথে তাঁহার দেখা করা সম্ভব হইয়া ওঠে নাই।
এই ভিড়ের মাঝেই একপর্যায়ে বাংলাদেশ ন্যাপের পক্ষে ন্যাপ নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ জন নেতা, কর্নেল ওসমানী, জনাব তোফায়েল আহমেদ এমএনএ প্রমুখ রাষ্ট্রপ্রধানকে কোনোরকমে জনতার মধ্য হইতে উদ্ধার করিয়া তাঁহার জন্য অপেক্ষমাণ সুসজ্জিত একটি খোলা গাড়িতে আনিয়া তোলেন। তখন বেলা আড়াইটা। শুরু হইল বিমানবন্দর হইতে রেসকোর্স যাত্রা। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়িটি ধীরে ধীরে আগাইতে থাকে। রাস্তার দুই পার্শ্বে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার নারী-পুরুষের প্রাণঢালা সংবর্ধনা মাথায় করিয়া বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তাঁহার বহুপ্রতীক্ষিত ভাষণ প্রদানের জন্য যাত্রা করেন। সমগ্র রাস্তায় তিলধারণের জায়গা নাই। বাড়িঘরের ছাদ লোকে ভরপুর। তেজগাঁও বিমানবন্দর হইতে রেসকোর্স—এই পথটুকু অতিক্রম করিতে বঙ্গবন্ধুর গাড়িটির দীর্ঘ সোয়া ২ ঘণ্টা সময় লাগে। বিকাল পৌনে ৫টায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে আসিয়া পৌঁছেন।
বঙ্গবন্ধুর মোটর-মিছিলটি বিমানবন্দর হইতে রেসকোর্সে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বঙ্গবন্ধুর মোটর–মিছিলটি সারাক্ষণ অনুসরণ করে।