২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

প্রবাসে জনসংযোগ

কোটি মানুষের স্বপ্নে, ত্যাগে, বীরত্বে রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মহা ইতিহাস। আজ প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সে সময়ের তৎপরতার বর্ণনা দিচ্ছেন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।

রেহমান সোবহান

নিউইয়র্ক থেকে হারুন-উর রশিদের সঙ্গে আমি ওয়াশিংটনের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। ওয়াশিংটনে এ এম এ মুহিত আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করলেন। তিনি তখন ছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক মিনিস্টার, সে দিনই সন্ধ্যায় আমি ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মচারীদের সঙ্গে মিলিত হলাম। তাঁরা সবাই অভিজাত গোষ্ঠীর, যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন এনায়েত করিম, শামসুল কিবরিয়া—যাঁরা পরে পররাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন, ছিলেন অধ্যাপক আবু রুশদ মতীনউদ্দিন—তিনি তখন সেখানে শিক্ষাবিষয়ক অ্যাটাশে, ছিলেন মোয়াজ্জেম আলী, সম্ভবত তখন তিনি থার্ড সেক্রেটারি।

এ ছাড়া ছিলেন বেশ কয়েকজন নন-পিএফএস অফিসার, যেমন রুস্তম আলী, রাজ্জাক খান, শরিফুল আলম প্রমুখ। সে সময় তাঁদের কেউই বিদ্রোহ করেননি। তাঁরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি তাঁদের পরিপূর্ণ সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। বলা দরকার, তাঁদের অনেকেই তখন গোপনে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার জন্য। আমি তাঁদের কাছে দল ত্যাগ করার তাজউদ্দীন আহমদের মেসেজ পৌঁছে দিলাম। তাঁরা সবাই পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার জন্য তখন প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তাঁরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জনগণের ত্যাগ সম্পর্কে তার আগে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন।

যাহোক, তাঁরা সে অবস্থায় বিদ্রোহ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের পক্ষে গোপনে প্রচার চালাতে রাজি হলেন। এই সময়েই রাজ্জাক খান ও শরিফুল আলম বাংলাদেশের ছাত্র মোহসীন সিদ্দিকীকে নিয়ে প্রকাশ্যেই আমাকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এলেন। প্রেস, টিভি ও কংগ্রেসিদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্যই তাঁরা মূলত এগিয়ে এলেন। প্রেস বা টিভির সাহায্য আমাদের প্রয়োজন ছিল এ জন্য, যাতে আমি পাকিস্তানের প্রতি সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য দাতাদের কাছে আমার মেসেজ পৌঁছাতে পারি।

আমাকে বাংলাদেশ বিষয়ে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার টিভিতে সুযোগ দেওয়া হলো। এর ফলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ব্যাপক প্রচার পেল। এ কাজে আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করলেন খ্যাতনামা সাংবাদিক ও টিভি ভাষ্যকার ওয়ারেন ইউনা। তখন পর্যন্ত রাজ্জাক ও আলম পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মী থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অনেকটা আমার সচিবালয়ের মতো কাজ করছিলেন।

পত্রিকাজগতের বিশিষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে আমি দেখা করলাম। আমি বিশেষভাবে দেখা করলাম ওয়াশিংটন স্টার-এর হেনরি ব্রাডশার, ওয়াশিংটন পোস্ট-এর লুইস সাইমন, বাল্টিমোর পোস্ট-এর অ্যাডাম কাইমার, নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেন ওয়েলস ও অভিজাত সাপ্তাহিক নিউ রিপাবলিক-এর সম্পাদক গিলবার্ট হ্যারিসনের সঙ্গে। ওয়াশিংটনে এগুলোই তখন উল্লেখযোগ্য কাগজ। এসব কাগজের কলাম লেখকেরা এবং এই কাগজগুলোর নেতৃস্থানীয় লেখকেরাই কংগ্রেসিদের মতামতকে যথাসম্ভব প্রভাবিত করতে পারেন। কাজেই এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বড় রকমের অভ্যুত্থান।

কংগ্রেসেও আমি একইভাবে কাজ চালিয়ে গেলাম। এখানে আমি বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি দুজন কার্যকর সমর্থকের সংস্পর্শে এলাম, তাঁদের একজন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং অপরজন ফ্রাংক চার্চ। তাঁরা দুজনই সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির মর্যাদাসম্পন্ন সদস্য। অল্প সময়ের মধ্যেই সিনেটর চার্চের সহকারী টম ডাউন এবং সিনেটর কেনেডির সহকারী গেরি টিংকার ও ডেল ডেইহান আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সক্রিয় মুখপাত্রে পরিণত হলেন। তাঁদের মাধ্যমে আমি বেশ কয়েকজন সিনেট সদস্যের সঙ্গে দেখা করলাম।

সে সময় কেনেডি, চার্চ ও গ্যালাগারের নেতৃত্বে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে কংগ্রেসম্যান ও সিনেটররা বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে কথা বলতে শুরু করলেন এবং সরকারের কাছে দাবি জানালেন বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা জানানোর জন্য। তাঁরা পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্যও অনুরোধ করলেন। ২৬ মার্চের পর বাংলাদেশ থেকে যেসব মার্কিন নাগরিক দেশে চলে এসেছিলেন, তাঁদের প্রেরিত অনেক চিঠিপত্র, দলিল ও কাগজপত্র ও কংগ্রেসনাল নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।

ঠিক সে সময়েই আমি জানতে পারলাম যে পাকিস্তানের কিছু পুরোনো বন্ধু সিনেটর সিমিংটনের নেতৃত্বে এম এম আহমেদের সম্মানে এক চা-চক্রের আয়োজন করছেন, যাতে তিনি সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে তাঁর বক্তব্য সিনেটরদের উদ্দেশে পেশ করতে পারেন। এম এম আহমেদ বেশ একটা সুযোগ পেলেও আমাদের বন্ধুদের ধারণা ছিল যে এটা সামলানো যাবে। যেহেতু চার্চ ও কেনেডি উভয়েই ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, কাজেই ঠিক করা হলো যে একজন নির্দলীয় সিনেট সদস্যকে উদ্বুদ্ধ করা হবে আমাকে উদ্দেশ করে একটি লাঞ্চের আয়োজন করার জন্য।

আমাদের ধারণা, এটা হলে তা রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক—উভয় পার্টির লোকদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে। ওহাইওর সিনেটর স্যাক্সবি এ ধরনের একটি লাঞ্চের আয়োজন করতে রাজি হলেন। এবং সত্যি সত্যিই এটি শেষ পর্যন্ত একটি বিশাল অনুষ্ঠানে পরিণত হলো এবং এম এম আহমেদের অনুষ্ঠানটির চেয়েও অনেক বেশিসংখ্যক মর্যাদাসম্পন্ন সিনেটর এ অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে অন্যদের ছাড়াও আমি পেলাম সিনেটর ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর চার্চ ফুলব্রাইট এবং রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যালঘুদের নেতা সিনেটর স্কটকে।

মার্কিন রাজনীতির এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিস্তারিত ঘটনা গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনলেন। অনুষ্ঠানে এ-ও বলা হলো যে যত দিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধান দাতাদেশের ভূমিকায় থাকবে, তত দিন পর্যন্তই পাকিস্তানিদের দুষ্কর্মে সাহায্য করা হবে। সিনেটে অবিলম্বে এসব পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে স্যাক্সবি-চার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য বিল সংশোধনের উদ্যোগ নিলেন এবং পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য বন্ধের উপক্রম হলো। যদিও শেষাবধি বাংলাদেশে যত দিন গণহত্যা চলেছিল, মার্কিন সাহায্য তত দিন অব্যাহত ছিল।

প্রথমা প্রকাশনপ্রকাশিত বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য (২০১৯) থেকে সংক্ষেপিত