>পয়লা বৈশাখ আমাদের অন্যতম প্রধান উৎসব। বাংলার অগ্রযাত্রায় নববর্ষ বড় প্রেরণা। জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে যাঁরা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার পাঠ যেন িনজেদের ঐতিহ্যের দিকেই ফিরে তাকানো। সে বিবেচনায় আমাদের অগ্রগণ্য কয়েকজন সংস্কৃতিসেবীর পূর্বপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার নতুন প্রজন্মের পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২য় বর্ষ, ৩৯ সংখ্যা, ১৫ মার্চ ১৯৭৪
নজরুল ইসলাম: আমরা শুনেছি এবং জানি যে আপনি ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসতেন এবং শিল্পী হবার দুর্বার প্রেরণা আপনাকে ঘরছাড়া করে, কিন্তু ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রতীরের ছেলে আপনি স্কুলের পাঠ শেষ না করেই সুদূর কলকাতার পথে পাড়ি জমালেন শিল্পী হবেন বলে।আপনার আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত কেমন করে সম্ভব হলো?
জয়নুল আবেদিন: তখন তো জানো, ময়মনসিংহ-কলকাতা কত দূর। সেই ১৯৩২-৩৩ সালে। আমি স্কুলে পড়ি, কিন্তু ছবিও আঁকি। নিজে নিজেই। ময়মনসিংহের ছেলেরা তখন কলকাতায় থাকত, পড়ত, এর মাঝে কেউ কেউ আর্ট স্কুলেও পড়ত, তারা যখন দেশে আসত আমার সঙ্গেও আলাপ হতো। আমার কলকাতায় যাবার জন্য তখনকার যুগে বাংলার একমাত্র আর্ট স্কুলে পড়বার জন্য ভীষণ ইচ্ছা করত। কিন্তু কাজটি অসম্ভব। বাড়িতে ঘুমানো দায়। আমার স্কুলের অনেক শিক্ষকও আমার হয়ে অভিভাবকের কাছে সুপারিশ করলেন। তবু হয় না। ময়মনসিংহে আমাদের তখন একটা গ্রুপ ছিল যারা শিল্পী হতে চাইতাম। এ রকম কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরেফিরে একেবারে কলকাতা। কিন্তু খরচা জোগাবে কে? তখনকার দিনে যারা নিজের পয়সায় পড়তে পারত না, তাদের অনেকেই জেলা বোর্ডের বৃত্তি পেত। আমিও আমাদের জেলা বোর্ডের দু-একজনকে ধরলাম, কিন্তু নিয়ম ছিল আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষের সার্টিফিকেট ছাড়া কিছুই হবে না। আবার এই সার্টিফিকেটও এক বছর পড়ার পর পরীক্ষা হলে তার ফলের ভিত্তিতে হবে। কিন্তু আমার চলবে কেমন করে?
কলকাতায় গেলাম। এখানে-সেখানে থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। প্রথম হলাম। মুকুল দে তখন প্রিন্সিপাল। ভর্তি পরীক্ষাতেই আমার আঁকার হাত দেখে তিনি এবং সব শিক্ষক খুশি হলেন। ভর্তি হব কিন্তু চলবে কী করে? প্রিন্সিপালকে বললাম, জেলা বোর্ডের বৃত্তি পাব, যদি তিনি একটা সার্টিফিকেট আগেই দেন এই বলে যে আমি বৃত্তির যোগ্য। কিন্তু তাই–বা কেমন করে হয়? আর্ট স্কুলে কখনো এমন হয়নি যে প্রথম বর্ষের পরীক্ষার আগেই বৃত্তির জন্য অধ্যক্ষ অনুমোদন দেবেন। মুকুল দে ছিলেন কড়া মানুষ। বললেন, হবে না। এক বছর দেখব তারপর। কেঁদে ফেললাম। ধমকে বললেন, কী হে তোমার চোখটোখ খারাপ নাকি? জল পড়ছে যে চোখ থেকে? আচ্ছা, দাঁড়াও, এই প্রথম আমার নিয়ম ভাঙছি। তোমার জন্য অনুমোদন লিখছি। হয়ে গেল আমার বৃত্তি। সেই যুগে ১৫ টাকা। মোটামুটি চলে যেত।
ন. ই.: তাহলে সে যুগে, ব্রিটিশ আমলেও, প্রতিভার স্বীকৃতিতে একজন ভারতীয়ও নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়ম গড়তে পারতেন।লাল ফিতার ভয় পেতেন না?
জ. আ.: মুকুল দে তো তাই দেখালেন।
ন. ই.: আমরা শুনেছি আপনি নাকি ছাত্র থাকতেই কলকাতা আর্ট কলেজের শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জ. আ.: হ্যাঁ, আমাদের কলেজের কোর্স ছিল ছয় বছরের, তবে ফিফথ ইয়ারে থাকতেই আমাকে কলেজের একটা খালি পোস্টের জন্য নিয়ে নেওয়া হয়। আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়তাম। সফিউদ্দীন সাহেব আমার বন্ধু, আবার ছাত্রও (শিল্পী সফিউদ্দীন আহমদ) ওর সঙ্গে ওই ক্লাসে ছিল রাজেন তরফদার আর কলকাতা আর্ট কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ সত্যেন ঘোষাল। আমি পাস করে বেরোই ১৯৩৭-৩৮ সেশনে। মুকুল দে অবশ্য আমি ফিফথ ইয়ারে থাকতেই বলতেন, চাও তো তোমাকে আগেই ডিগ্রি দিয়ে দিতে পারি, এমনকি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হিসেবে। আমি অবশ্য সাধারণ নিয়মেই কোর্স শেষ করেছি।
ন. ই.: আপনি যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, তখন তো বাংলাদেশের চিত্রকলায় অবনীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারতীয় তথা ওরিয়েন্টাল আর্টকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার একটা আন্দোলন চলছিল।কিন্তু আপনি ইউরোপীয় চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন? কারণ কী?
জ. আ.: আসলে মুকুল দেও আমাকে ওরিয়েন্টাল আর্টেই যেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। আমার মারাত্মক দুর্বলতা ছিল ইউরোপীয় চিত্রাঙ্কন রীতির প্রতি। আমি ছোটবেলা থেকে নিসর্গ থেকে ছবি এঁকেছি। সেই আঁকার রীতি আমার নিজস্ব এবং বস্তুত ইউরোপিয়ান একাডেমিক পদ্ধতির। মনে হতো ওভাবেই প্রকৃতির দৃশ্যাবলি, গাছপালা, নদী ইত্যাদি আমি ঠিকভাবে দেখাতে পারব। ওরিয়েন্টাল রীতি তো বেশ স্টাইলাইজড, তাতে যেন তৃপ্তি পেতাম না।
ন. ই.: আপনি কি তখন ইউরোপীয় শিল্পীদের ছবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।থাকলে বিশেষ করে কাদের ছবি ভালো লাগত?
জ. আ.: আমার সবচেয়ে ভালো লাগত ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি। এবং তাদের কিছু প্রভাব আমার মধ্যে তখন পড়েছিল। আমি দিল্লিতে [কলকাতা] ১৯৩৮ সালে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত চিত্র প্রদর্শনীতে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলাম, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর আঁকা কয়েকটি ছবির জন্য, সেগুলো ইম্প্রেশনিস্ট রীতির ছবি। আমার কাছে অন্যান্য ইউরোপিয়ান শিল্পী যাঁদের কাজ খুব ভালো লাগত তাঁরা ছিলেন ভেলাজকয়েজ, রেমব্রান্ট ও সেজান।
ন. ই.: আমি নিজে আপনার চিত্রকলা দেখে যা বুঝতে পারি, তা হলো আপনার চিত্রকলায় চারটি প্রধান ধারা পাওয়া যায়।প্রথমত ১৯৩৩ থেকে ৪২ পর্যন্ত একাডেমিক বা ইম্প্রেশনিস্ট, দ্বিতীয়ত ১৯৪২-৪৩-এর দুর্ভিক্ষের ওপর আঁকা স্কেচ, যেগুলো খুব প্রকাশবাদী বা এক্সপ্রেশনিস্ট, তৃতীয়ত ১৯৪৭-এর উত্তর বাংলার লোকজ শিল্পধারাভিত্তিক চিত্রকলা এবং বিগত দশকে অঙ্কিত বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্ররীতি।আপনি নিজে এ ধারা বিবর্তনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে কি কোনো ব্যাখ্যা করতে আমরা উৎসাহিত হতে পারি?
জ. আ.: ব্যাখ্যা আছে। আমার মনে হয়, প্রথম দিকে আমি যখন তরুণ ছাত্র, তখন ইউরোপীয় চিত্রকলার প্রচণ্ড শক্তি আমাকে আকর্ষণ করে এবং আমি তাদের শিল্পরীতির অনুকরণে ছবি আঁকতে চেষ্টা করি। তখন সামাজিক চেতনা ততটা হয় নাই। আমি ইম্প্রেশনিস্ট বা একাডেমিক পদ্ধতিতেই আঁকতাম, তারপর এল সেই ভয়াল দুর্ভিক্ষ, আমি কলকাতার সেই ভয়াবহ দৃশ্যাবলি ধরে রাখতে চাইলাম। চটপট কাজ করতে হয়, তা ছাড়া সব জিনিসের দাম চড়া, আমি সস্তা কাগজে, দ্রুত হাতে, কঠিনের আঁচড়ে অবিরাম এঁকে চললাম, শত শত স্কেচ, দুর্ভিক্ষের বিভিন্ন দৃশ্যের প্রয়োজনের তাগিদে নেহাত অবস্থার প্রয়োজনে আমার স্টাইল বদলে গেল, এক্সপ্রেশনিস্ট হতে বাধ্য হলাম, খুব সহজ অথচ শক্ত রেখায়, কিছুটা জ্যামিতিক আকৃতির মধ্যে সেই সব দৃশ্য ধরে রাখতে চাইলাম। তারপর ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হলো। পাকিস্তান এলাম, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায়। বাঙালির ভাষা, বাঙালির সংস্কৃতির জন্য সবার যে আন্দোলন, সম্ভবত তারই প্রভাব পড়ল অবচেতনভাবে আমারও মনে, বাঙালির লোকজ শিল্পরীতিকে তুলে ধরতে হবে, পাশ্চাত্য প্রভাব দেখে মুক্ত থাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্যকে অস্বীকার করার একটা বিদ্রোহ হিসেবেই রচিত হলো আমার একটি চিত্রপর্যায় এবং সম্ভবত নিজেরই অজ্ঞাতে এইসব শক্তি কাজ করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিগত দশকে যখন মনে হতো যে ওরা আর আমাদের সংস্কৃতিকে চেপে রাখতে পারবে না, তখন যেন কিছুটা মুক্ত হয়েই কিছু কিছু বিমূর্ত প্রকাশবাদী ছবি আমিও এঁকেছি, অন্যরা বিশেষ করে তরুণেরা যেমন এঁকেছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই রীতি আমার জন্য নয়। আমার চিত্র প্রকৃতি ও মানবনির্ভর, বিষয়নির্ভর এবং আমার ছবির উৎপত্তি ও রঙের পেছনে বাংলার ঐতিহ্যবাহী অঙ্কনধারা, লোকজ রীতিগুলো বেশি উৎসাহ জোগায়।
ন. ই.: আপনি চারুকলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।খুব ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে পঁচিশ বছরে এই কলেজ আজ সুন্দর ও বৃহৎ এক প্রতিষ্ঠান।একই সঙ্গে আপনি বহুদিন ধরে লোকশিল্পের জাদুঘর এবং জাতীয় চিত্রশালা তথা জাতীয় মিউজিয়ামের জন্য অবিরাম দাবি জানাচ্ছেন, আপনার কি মনে হয় না যে এই ধরনের দাবিদাওয়ায় সময় ব্যয় না করে আপনি শুধু শিল্প নির্মাণেই নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে পারেন এবং তাতে শিল্পকলার সেবা হবে বৃহত্তর।
জ. আ.: না, আমি নিজে শিল্পকর্ম করে যত আনন্দ পাই, তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাই শিল্পকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে, আমার নিজের শিল্পকে জীবনে প্রবিষ্ট হতে দেখলে। ছবি আঁকার সাফল্যের চেয়ে আমি তৃপ্তি পাই আরও অনেকে ছবি আঁকতে পারবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করবার প্রচেষ্টায়। কেননা এখান থেকেই জন্ম দেবে সুন্দরের নির্মাতারা, এখান থেকেই জন্ম নেবে সুন্দরের চিন্তা এবং সুন্দর। আমি একটি সুন্দর বা মহৎ ছবি এঁকে আর কত দূর কী করতে পারি। শিল্পকলা শুধু শিল্পকলার জন্য এ ধরনের বিশ্বাস আমার নয়। আমি বিশ্বাস করি, শিল্পকলা মানুষের জন্য, তার জীবনকে সুন্দর করার জন্য।...