
উনিশ শতকের শুরুতে বাঙালি সমাজে যে নবচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তার চালক ও বাহক ছিলেন মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকিত কলকাতার মধ্যবিত্ত যুবকেরা। এ দেশে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় উৎসাহদাতা ইংরেজরাই; তাদের উদ্দেশ্য ছিল লর্ড মেকলে কথিত ‘রক্তে ভারতীয় চিন্তায় ইউরোপীয় মানুষ’ তৈরি করা। কিন্তু হিন্দু কলেজের (প্রতিষ্ঠা ১৮১৭) যুগ পার হতেই ইউরোপীয় চিন্তা ভারতে জাতীয়তাবাদী ও স্বশাসনের চেতনার বিকাশ ঘটায়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র—সবাই ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করেছিলেন; তাঁরাই আবার প্রাচ্য ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার দিশারি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ বিদ্বৎসমাজকে ঐতিহ্যসচেতন করে তুলেছিল। এর একটি ধারা সুরাতত্ত্বের সন্ধান, নানা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনা ও স্থানের বিবরণী প্রকাশ প্রভৃতির মধ্যে দেখা যায়। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এর প্রকাশ দেখা গিয়েছিল বাঙালির উৎসব পালা-পার্বণের ঠিকুজি-সন্ধানে, লোকসাহিত্যের উপকরণ প্রকাশে ও পুঁথির অবিষ্কারে। এর একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল বাংলা চতুর্দশ শতকের শুরুতে স্থাপিত বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ। কলকাতার রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটিও তখন বৃহৎ পুঁথির ভান্ডার গড়ে তুলেছিল।
কলকাতায় পুঁথি সংগ্রহের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। কলকাতার বাইরে দীনেশ চন্দ্র সেন ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মধ্যে এ সময়েই নানা কারণে ‘বাঙ্গালা পুঁথি খোঁজার জন্য একটা উৎকট আগ্রহ জন্মিল’। ঘটনাক্রমে এর মধ্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যু হয় এবং ‘বাঙ্গালা, বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার পুঁথি খোঁজার ভার’ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ওপর অর্পিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে শাস্ত্রী বাংলা পুঁথি সন্ধানের স্থানিক পরিধিকে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। সম্ভবত বিএইচ হজসন ও অন্যদের নেপালভিত্তিক অনুসন্ধান তাঁকে এ ক্ষেত্রে উৎসাহী করেছিল।
শাস্ত্রী ১৮৯৭-৯৮ সালে দুবার নেপাল যান। সেবার তিনি ‘সুভাষিত-সংগ্রহ’, ‘দোহাকোষ পঞ্জিকা’সহ কয়েকটি সংস্কৃত পুঁথির সন্ধান পান। ১০ বছর পর (১৯০৭) নেপাল গিয়ে খুঁজে পান চর্যার পুঁথি। এরও ১০ বছর পরে ক্যালকাটা রিভিউতে (১৯১৭) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘...the delight of the Brahmin knew no bounds when he laid his hondes, one fine morning. on a palm leas manuscript in the early 12 century Bengali script, of a collection of Bengali songs with sanskrit commentary attached.... . it was Bengali on the face of it.’
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার মূল পুঁথিটি কলকাতায় নিয়ে আসেন; সঙ্গে নেপাল দরবার গ্রন্থাগারের লিপিকরদের দিয়ে একটি অনুলিপিও তৈরি করিয়ে নেন। নয় বছর পর হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা (১৯১৬) গ্রন্থে অন্য তিনটি পুঁথির সঙ্গে চর্য্যাচর্য্য-বিনিশ্চয় প্রকাশিত হয়। চর্য্যাচর্য্য-বিনিশ্চয় অংশের নামপৃষ্ঠায় লেখা ছিল ‘প্রাচীন বঙ্গ-বৌদ্ধ কবিগণের পদ-সংগ্রহ ও তাহার সংস্কৃত টীকা’। চর্য্যাচর্য্য প্রকাশের আগেও এর কিছু বিবরণ নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে গ্রন্থাকারে এর প্রকাশ আমাদের সামনে একটি প্রাচীন নিদর্শনকে পূর্ণরূপে তুলে ধরল।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পুঁথিটি প্রকাশ করেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তা ছিল চর্যার টীকার পুঁথি। মুনিদত্ত নামে একজন ভাষ্যকার সেই সময়ের রীতিতে ১০০ চর্যা থেকে বাছাই করে অর্ধেকের টীকা তৈরি করেছিলেন। পরে পণ্ডিতদের গবেষণায় জানা গেল যে পুঁথিটি মুনিদত্তের নিজের হাতের লেখা নয়। অর্থাৎ মুনিদত্তের পুঁথিটির নকল তৈরি হচ্ছিল। মুদ্রণযন্ত্রের পূর্ববর্তী যুগে এটাই ছিল প্রচলিত রীতি। শাস্ত্রী যে পুঁথিটি পেয়েছিলেন, তার লিপিকর মুনিদত্তের টীকার সঙ্গে মূল চর্যাগুলোও যুক্ত করে দিয়েছিলেন; নইলে এ পদগুলো আমরা পেতাম কি না সন্দেহ! লিপিকর হয়তো তখন মুখে মুখে প্রচলিত এ পদগুলো জানতেন অথবা চর্যার কোনো পুঁথি ছিল, যেখান থেকে তিনি এগুলো নকল করেছিলেন।
বৌদ্ধগান ও দোহার একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাতে তিনি পাল রাজত্বের সময়কালে এ অঞ্চলে রচিত সাহিত্য সম্পর্কে নানা অনুমানের কথা বলেছেন। চর্যার পদগুলোকে তিনি হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষা অর্থাৎ নবম শতক ও তার কাছাকাছি সময়ের বাংলা নিদর্শন বলে দাবি করেন। চর্যার অকারাদিক্রমে শব্দতালিকা তৈরি করে এবং এর ব্যাকরণ অনুসন্ধান করেই শাস্ত্রী এ দাবি করেছিলেন। ভূমিকাতে তিনি চর্যাকারদের জীবন সম্পর্কেও বিস্তৃত আলোচনা করেন। তাতে দেখা যায় যে তাঁদের অধিকাংশই বঙ্গবাসী; তবে দুয়েকজন যে উড়িয়া কিংবা বিহারি ছিলেন, সেটাও তিনি উল্লেখ করেছেন।
শাস্ত্রীয় সংকলন প্রকাশের পর বাংলার পণ্ডিতমহল এর ভাষা নিয়ে তর্কে অবতীর্ণ হয়। বিজয়চন্দ্র মজুমদারসহ একদল দাবি করে যে এর ভাষা আদৌ বাংলা নয়। পাশাপাশি উড়িয়া, অসমিয়া, মৈথিলী ও হিন্দি ভাষাভাষীর পণ্ডিতেরা চর্যার ভাষাকে নিজ নিজ ভাষা বলে দাবি করেন। আবার ‘সন্ধ্যাভাষা’র উল্লেখ-সূত্রে কয়েকজন একে সন্ধ্যাদেশের ভাষা বলে মনে করেন এবং সন্ধ্যাদেশের একটি ভূগোলও তৈরি করে ফেলেন। তবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ গবেষণার ফল The origin and development of the Bengali language (১৯২৬) প্রকাশিত হলে পণ্ডিতেরা এর বাংলাত্ব মেনে নেন। পরে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার সেন প্রমুখের গবেষণায় এই মত আরও দৃঢ় হয়। তবে কয়েকটি চর্যার রচয়িতা যে মূল বঙ্গ অঞ্চলের বাইরে, তা-ও সবাই স্বীকার করেছেন। এর থেকে বোঝা যায় যে এই পুরো অঞ্চলজুড়েই চর্যা তৈরি হচ্ছিল। অনেকে আবার এই পুরো অঞ্চলকেই পাল আমলের বৃহত্তর বঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
চর্যা-রচয়িতাদের কাল নিয়ে শাস্ত্রীর অনুমান অনেকে গ্রহণ করেননি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ এনামুল হক প্রমুখ ভাষাবিদ মনে করেন যে দশম শতকের আগে চর্যা রচনা সম্ভব ছিল না এবং এ পদগুলো মূলত দশম থেকে দ্বাদশ শতকের রচনা। এ যুক্তি অবশ্য এখন প্রশ্নসাপেক্ষ: কেননা নবম-দশম শতকের ‘হেবজ্রতন্ত্র’-এর চীনা অনুবাদে চর্যা পাওয়া গেছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অবশ্য অনেক আগেই দাবি করেছিলেন যে এসব চর্যা অষ্টম শতক থেকেই লেখা হয়েছে।
শাস্ত্রী মনে করেছিলেন, চর্যার পুঁথির হস্তাক্ষর দ্বাদশ শতকের। সেটা অনেকে মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন, মূল টীকাটি পুরোনো হলেও যে অনুলিপিটি পাওয়া গেছে তা অনেক পরের। লিপিবিশারদ রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে মনে করেন, চর্যাগুলো পুরোনো হলেও পুঁথিটি অত পুরোনো নয়। কেউ কেউ আবার এটিকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের লেখা বলে মানেন। এর লিপি বঙ্গলিপি: তবে তৎকালে বঙ্গলিপির সঙ্গে মৈথিলী বা নেওয়ারির তেমন পার্থক্য ছিল না।
এই পুঁথিতে মোট ৫০ বা ৫১টি পদ থাকার কথা। কিন্তু কয়েকটি তালপাতার পৃষ্ঠা ছিন্ন থাকার ফলে সাড়ে ৩টি পদ পাওয়া যায়নি। পরে তিব্বতের মহাগ্রন্থ তন্জুর-এ এগুলোর অনুবাদ পাওয়া গেছে। প্রথিতযশা পণ্ডিতেরা চর্যার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ তৈরি করেছেন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে পাঠান্তর। চর্যার এই পাঠভেদের প্রধান কারণ দীর্ঘকাল মুখে মুখে প্রচলিত থাকার পর লিপিবদ্ধ হওয়ায় এর পাঠবিকৃতি ঘটেছিল। তার সঙ্গে ছিল লিপিকর-প্রমাদ এবং অপরিচিত-অস্পষ্ট অক্ষর। এর ফলে চর্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি শব্দের পাঠান্তর পাওয়া যায়।
চর্যা-রচয়িতাদের পরিচয় নিয়েও নানা রকম তর্ক আছে। তবে এঁদের সবাই তন্ত্রযানী সিদ্ধ এবং প্রসিদ্ধ ৮৪ সিদ্ধর তালিকায় এঁদের অনেকের নাম আছে। চর্যা ছাড়াও এঁদের নানা রচনার অনুবাদ তিব্বতি তন্জুর-এ রয়েছে। কালানুক্রমে ২৪ জন চর্যাকার হচ্ছেন সরহ, আর্যদেব, শবর, লুই, কুক্কুরী, দারিক, গুন্ডুরী, বিরূপ, ডোম্বী, কম্বল, কঙ্কন, কাহ্ন (জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ), তন্ত্রী, মহী, ভদ্র, বীনা, ধাম, শান্তি, ভুসুকু, জয়ানন্দ, চাটিল, ঢেন্টণ ও তাড়ক। তাঁদের অধিকাংশই সে সময়ের বৃহত্তর বঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছেন অথবা বাস করেছেন অথবা ধ্যান করেছেন। তবে কয়েকজন চর্যাকার উড়িষ্যা ও মগধবাসী ছিলেন। উল্লেখ্য, পাল রাজত্বকালে ত্রিপুরা থেকে মগধ পর্যন্ত একধরনের রাজনৈতিক-ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক ঐক্য ছিল।
আবহমান বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে চর্যাপদ-এর গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন-এর পূর্ববর্তী আর কোনো বাংলা কাব্য বা কবিতা আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। মাত্র সাড়ে ৪৬টি বা ৫০-৫১টি পদই প্রাচীন বাংলা কবিতার একমাত্র উদাহরণ। চর্যাপদ পাওয়া না গেলে বাংলা কাব্য-সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হতো ত্রয়োদশ শতক থেকে; আমাদের কৌলীন্য কমে যেত অনেকটা।
চর্যার পদগুলোতেই বাংলা কবিতার প্রাচীন রূপটি রক্ষিত আছে। এর দ্বিপদী মিত্রাক্ষর চরণের মধ্যে বাংলা ছন্দের প্রাচীনতম উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই। প্রায় দেড় শ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘জয়দেব ও বিদ্যাপটি’ (১৮৮০) প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে ‘গীতিকাব্যই বাংলার চরিত্রধাতুর সঙ্গে সুসংবদ্ধ’। বস্তুত চর্যাপদেই বাঙালির গীতিকাব্যের সূচনা। মধ্যযুগে এর পরম বিকাশ ঘটেছিল বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে। আরও পরে বিহারীলাল চক্রবর্তী হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গীতিকবিতাকেই অবলম্বন করে বাংলা কবিতার পরম বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। বস্তুত চর্যার পদগুলো প্রাচীন বাংলা গানের নমুনা হিসেবেও মূল্যবান, যাতে রাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে।
চর্যার ভাষাই বাংলা ভাষার একমাত্র প্রাচীন উপকরণ। এর প্রায় ২ হাজার ৪০০ শব্দ দিয়েই আমরা বাংলা ভাষার পুরোনো চেহারাকে চেনার চেষ্টা করি। পদ্য হলেও এর শব্দগঠন ও চরণবিন্যাস থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের ব্যাকরণ তৈরির উদ্যোগ নিই। এই উপকরণ না হলে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষা পর্যন্ত বিকাশের স্তর ব্যাখ্যা করা দুরূহ হতো। সর্বানন্দের অমরকেষের টীকা এবং মানসোন্নাসই বাংলা শব্দের একমাত্র উৎস হতো। একই সঙ্গে অসমিয়া, উড়িয়া, মৈথিলী ও ভোজপুরীর সঙ্গে বাংলা ভাষার আত্মীয়তাও অস্পষ্ট হয়ে যেত। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে চর্যার পুঁথিটিও অত্যন্ত মূল্যবান। এটি সাড়ে বারো ইঞ্চি বাই দেড় ইঞ্চি আকারের পাকানো তালপাতার ওপর কালো কালিতে লেখা। এর ৬৯টি পাতার দুই পাশে প্রতিটিতে পাঁচ লাইন লেখা। এর প্রথম ও শেষ দিকের পাতা না থাকায় পুঁথির লিপিকাল, লিপিকর ও লিপিস্থান জানা যায়নি। এটি নেপালে লিখিত না বৃহত্তর বঙ্গের কোন স্থান থেকে নেপালে আনীত, তা জানা যায়নি। অনুমান করা যায়, এটি একসময় বজ্রজানীদের মহাতীর্থ স্বয়ম্ভূতে ছিল; কেননা তন্জুর-এ তিব্বতি অনুবাদের স্থান হিসেবে স্বয়ম্ভূর নাম আছে। প্রথম মলাটের কোণে ভাদ্র ৭৪১ নেপালি সম্বৎ-এর উল্লেখ আছে। পণ্ডিতদের অনুমান, এ সময়ে অর্থাৎ ১৬২০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পুঁথিটি নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগারে নীত হয়। দরবার গ্রন্থাগারের পুস্তক তালিকায় চর্যার নাম উঠেছিল ১৮১০ সালে। ১৯৬৪ সালে পুঁথিটি নেপালের জাতীয় অভিলেখালয়ে স্থানান্তরিত হয়। দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এর তিন-চার পাতা মাত্র ওই অভিলেখালয়ে খুঁজে পাওয়া যায়। অন্য পাতাগুলোর কোনো হদিস ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দিতে পারেননি। তবে পুঁথির অন্য কয়েকটি নকলও তাঁদের সংগ্রহে আছে।
বৃহত্তর বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের উপকরণ হিসেবেও চর্যার পদে বিধৃত সমাজ ও মানুষের ছবির গুরুত্ব অতুলনীয়। নৃতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্বের সঙ্গে চর্যার জীবনচিত্রকে মিলিয়েই বাঙালির ফেলে আসা দিনকে জানা যায়। প্রাচীন কৃষিকাজের নানা স্মৃতি, ফসল ও ফুল, গৃহ-আসবাব, সামাজিক আচার, খাদ্য, অলংকার, ক্রীড়া, নদী-নগর, যানবাহন; এমনকি চুরি বা পরকীয়া প্রণয়ের কথাও রয়েছে এই পদগুলোতে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কারের পরবর্তী সময়ে পুঁথি সন্ধানীদের প্রয়াসে আরও বেশ কিছু চর্যা খুঁজে পাওয়া গেছে। এর ফলে মধ্যযুগের কাহিনিকাব্যের পাশাপাশি চর্যাভিত্তিক গীতিকবিতার ধারার সম্পর্কও ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেখা যাচ্ছে যে অষ্টম থেকে বিশ শতক পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবেই চর্যা রচিত হয়েছে; যদিও ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের পর এটিকে নেপালের নেওয়ারি বজ্রাচার্য ও শাক্যমুনিরাই মূলত লালন করে চলেছেন। তিব্বত অঞ্চলে এর তিব্বতি ধারাবাহিকতার নানা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এভাবে বাঙালির প্রাচীনতম সাহিত্য-ঐতিহ্য এখনো জীবন্ত।