কী ঘর বানাইমু আমি

ঘরবাড়ি বিষয়ে বাঙালির দার্শনিক অবস্থান অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে যুক্ত। লালন ফকির, হাসন রাজা, আবদুল লতিফ প্রমুখ বাঙালি মনীষী মানবদেহকে ঘরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাঙালি মরমিবাদ নাকি বাস্তুবিজ্ঞানের সুদীর্ঘ এবং সংঘবদ্ধ জ্ঞান—বাস্তবে কে কাকে অনুপ্রাণিত করেছে, এই একুশ শতকে এসে সেটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন। সে যা–ই হোক, বাস্তুবিজ্ঞানে বাঙালির যে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও পরম্পরা রয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য।

‘আমাদের একটা দক্ষিণের বারান্দা হবে’ স্কয়ার ফুটের হিসাবে বসবাস করা নাগরিক বাঙালির এই আকাঙ্ক্ষা মূলত তার ঐতিহ্যগত পরম্পরারই অংশ। শুধু দক্ষিণমুখী বাড়িটা ছোট হতে হতে দক্ষিণমুখী বারান্দায় রূপ পেয়েছে, এখানেই যা বেদনা। বায়ুর প্রবাহ এবং রোদের প্রাচুর্যের কথা মনে রেখে আমাদের আদি বাস্তুবিজ্ঞানে দক্ষিণমুখী বাড়িকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নিদেন পক্ষে ‘বড় ঘর’ বা আধুনিক ধারণার ‘মাস্টার বেড’ দক্ষিণমুখী হতেই হবে। নইলে দমকা হাওয়ায় ‘মাঘের এ অন্তরঙ্গ দুপুরবেলায়’ না শোনা পুরোনো গল্প মনে পড়ে না। বাঙালি যেহেতু গপ্পবাজ, তাই তার একটা কাছারিঘর দরকার ছিল, অবসরে আড্ডা দেওয়ার জন্য। এই কাছারিঘর ছিল মূল বাড়ির বাইরে, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূল বাড়ি গড়ে উঠত শোবার ঘর (১–২টি), রান্নাঘর, গোয়াল এবং গোলাঘরের সমন্বয়ে। আগেই বলেছি, শোবার ঘর সাধারণত দক্ষিণমুখী হতো, তারপরে রান্নাঘর, তার পাশে গোলাঘর বা ভাঁড়ারঘর, তার পাশে গোয়ালঘর। রান্নাঘর বাঙালি জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বাড়ির উত্তর–পশ্চিম কোণে কিংবা উত্তরমুখী করে দক্ষিণ দিকে রান্নাঘর বানানো হয়। এর বড় কারণ বায়ুপ্রবাহ। রান্নার ঝাঁজালো গন্ধ যেন বায়ুপ্রবাহে দূর হয়ে যায়, সে কারণে এই ব্যবস্থা। বাঙালি ঐতিহ্যবাহী বাস্তুবিজ্ঞানে খাবার ঘরের অস্তিত্ব নেই। রান্নাঘরের খোলা মেঝে কিংবা বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসেই বাঙালি চিরকাল খেয়ে এসেছে তার যাবতীয় উপাদেয় খানাখাদ্য। খুব বেশি হলে বয়স্কদের জন্য অনুচ্চ জলচৌকি ব্যবহার করা হতো। চেয়ার-টেবিলে সজ্জিত পৃথক খাবার ঘর নিতান্তই অর্বাচীন এবং শহুরে ব্যাপার। বারান্দা বাঙালি বাড়ির বৈশিষ্ট্য। পুরো বাড়ির প্রতিটি ঘরের সামনে বারান্দা না থাকলেও শোবার ঘর এবং রান্নাঘরের সামনে বারান্দা থাকতে হবে। অর্থনৈতিক ‘অনটন হেতু’ এ নিয়ম অবশ্য শিথিলযোগ্য।

ঘর বসানোর পর যে ফাঁকা জায়গাগুলো থাকত, সেগুলো কুয়োতলা (পরবর্তী সময়ে কলতলা) হিসেবে, বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এক বা দুটি শোবার ঘর, রান্নাঘর, গোয়াল ও গোলাঘর—এই মূল ধারণাকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর বাড়ির গঠন নির্ভর করত। সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি বা জমিদারবাড়ি ছিল কিছুটা ভিন্ন। যেমন কোনো জমিদারবাড়িতে গোয়ালঘর পাওয়া যায় না—অন্তত আমি দেখিনি! এটা বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার। আবার হতে পারে যে গোয়ালঘর ছিল মূল বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা বাইরে, সময়ের প্রবাহে বিলীন হয়ে গেছে এবং অপ্রয়োজনীয় ভেবে কেউ তার খোঁজ রাখেনি।

বাঙালি বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উপাসনালয়। এ ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বাড়ির বাইরে বা গ্রামের নির্দিষ্ট জায়গায় সর্বজনীন মন্দির থাকলেও প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটি করে পারিবারিক মন্দির বা প্রার্থনার জায়গা আছে এবং এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি পরিবারে। সম্পন্নদের পারিবারিক মন্দির থাকে বাড়ির নির্দিষ্ট জায়গায়। এই জায়গা সাধারণত বাড়ির পূর্ব দিকে হয়ে থাকে। খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের উপাসনালয়ও তাই, অর্থাৎ গ্রামের একটি নির্দিষ্ট জায়গাতেই সেগুলো স্থাপন করা হয়।

বাঙালি তার বাস্তুবিজ্ঞানে পশ্চিমি জ্ঞান গ্রহণ করেছে মূলত শহরের অবকাঠামো, বড় স্থাপনা, যেমন রাজপ্রাসাদ, জমিদারবাড়ি, ধর্মীয় স্থাপনা ইত্যাদি তৈরির ক্ষেত্রে। সাধারণ বাঙালির সে ‘সাহেবি কেতায়’ বানানো বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য (!) হয়নি কোনো দিনই। পশ্চিমি জ্ঞান তো বটেই, যদি ‘আর্য-অনার্য’ ধারণাপ্রসূত ঐতিহাসিক সূত্র ধরে কথা বলি, তাহলেও দেখা যায়, এই ভূ–ভারতের বাস্তুবিজ্ঞানে অনার্যদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্কুল অব থট’ প্রচলিত ছিল ময়, নগ্নজিৎ প্রমুখ অনার্য বিশেষজ্ঞের হাত ধরে। সেই চিন্তাধারার প্রণেতারা পাথরের চেয়ে ইট ও কাঠের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন হাজার হাজার বছর আগে এবং সেটা আর্যদের হেড ইঞ্জিনিয়ার ‘বিশ্বকর্মা’র ধারণা তৈরিরও বহু বছর আগে। এর বড় প্রমাণ সিন্ধু সভ্যতার বাস্তুবিজ্ঞানে মেলে। আর্যদের আগমনের পর অনার্য ভারতের বাস্তুবিজ্ঞানে আর্যদের চিন্তাচেতনার প্রলেপ পড়ে। আর্যদের হেড ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রম্ নামের বইয়ে আজ থেকে আনুমানিক দুই হাজার বছর আগে বাড়ি বানানোর আগে ‘ভূমি পরীক্ষা’র কথা বলা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন ভারতীয় বাস্তুবিজ্ঞান আদৌ পিছিয়ে ছিল না। এ ছাড়া সে বইয়ের লেখক সাধারণ বাড়ি বানানোর জন্য ‘ত্রয়োবিংশতি পর্যায়ের’ কাঠ অনুমোদন করেছেন, যেটা আমরা এখনো মোটামুটি অনুসরণ করে চলি।

আর্য, অনার্য, ইউরোপীয় সব বাদ দিয়ে ফিরে আসি বাঙালির নিজস্ব বাস্তুবিজ্ঞানে। বরিশালের কবি বিজয় গুপ্ত রচিত পদ্মাপুরাণ–এর একটি অধ্যায় আছে মনসার জন্য জয়ন্তী নগরে বিশ্বকর্মার প্রাসাদ নির্মাণ প্রসঙ্গে। সেই প্রাসাদ নির্মিত হলে তার চারদিকে বহুতর ফুল-ফল-ঔষধি গাছ রোপণ করা হয়েছিল। একুশ শতকের এই বন ধ্বংসের কালে মনে করিয়ে দেওয়া যেতেই পারে, আমাদের বাস্তুবিজ্ঞানে উদ্ভিদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বাড়ির দক্ষিণ দিকে নিমগাছ রোপণের নির্দেশনা, উঠানের প্রান্তজুড়ে শতমূল-পারিজাতের লতা রোপণের প্রাচীন প্রথা আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। বিজয় গুপ্ত লিখেছেন, মনসা তার স্বপ্নের পুরির সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য কৃষ্ণচূড়া, আমলকী, বট, তাল, সুপারি, নারকেল ইত্যাদি গাছের সঙ্গে সেখানে রোপণ করেছিল কমলা, লেবু, পাতিলেবু, কাগজি লেবু, এলাচির মতো ঔষধি গাছও। সেখানে ছিল জবা, মালতী, টগরসহ প্রায় সব ফুল। আজ থেকে আনুমানিক চার শ বছর আগে বিজয় গুপ্ত লিখেছেন,

মলয়া শীতল বায় কোকিলা পঞ্চম গায়

 ভ্রমরের শব্দ বহুতর।

এসব অপূর্ব রীত, শোভা করে চারিভিত,

           দিব্যপুরী জয়ন্তী নগর…

গাছ-পাখি-ফুল-ফল নিয়ে এক শোভাময় বৈজ্ঞানিক বাস্তুতন্ত্রের চর্চা করেছিল বলেই হয়তো বাঙালির দার্শনিক চিন্তায় ঘরবাড়ির প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। সে জন্যই হাসন রাজা বলেছিলেন, ‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার…’। মর্ত্য থেকে অমৃতলোক—এর মধ্যে যে অসীম শূন্যতা, সেই শূন্যতার মধ্যে বাঙালির দার্শনিক চিন্তায় ঘরের কথাই এসেছে।

রজত কান্তি রায় সাংবাদিক