এ সময়ের বাহন-সংস্কৃতি
রাইড শেয়ারিংয়ের ধারণা বিদেশে প্রথম শুরু হয়েছিল কার-পুলিং থেকে। কয়েকজন সহকর্মী এক গাড়িতে একসঙ্গে অফিসে যাওয়া বা ফিরে আসার প্রথা অনেক আগে থেকেই সেখানে চালু ছিল। যানজট কমাতে এবং তেলের খরচ বাঁচাতে সরকারিভাবেও এটাকে উৎসাহিত করা হতো। বিদেশের অনেক শহরে একাধিক যাত্রীওয়ালা গাড়ির জন্য আলাদা এইচওভি (হাই অকুপেন্সি ভেহিকল) লেনও আছে। নিজের গাড়িতে নিজের সহকর্মী বা বন্ধুর বদলে যখন অচেনা লোককে নেওয়া শুরু হলো, তখনই এ রাইড শেয়ারিং ধারণার জন্ম। শুরুটা হয়েছিল কিন্তু গাড়ির মালিকের পার্শ্বব্যবসা (সাইড বিজনেস) হিসেবে, অনেকটা ফ্রিল্যান্স কাজের মতো। পরবর্তী সময়ে সেটাই পূর্ণকালীন কাজে পরিণত হয়েছে। অনেকে এখন নিজে না চালিয়ে চালক রেখে একাধিক গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে এই পরিষেবা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশে সম্ভবত ২০১৫ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রাইড শেয়ারিং শুরু হয়। প্রথম দিকে এটা অনেকটাই অনলাইনে গাড়িভাড়া বা ট্যাক্সি ডাকা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১৬-তে উবার এসে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল। ঢাকার ১৮ লাখ অধিবাসীর জন্য দিনে কেবল ৫ হাজার বাস, ৪০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশ এবং ৪ লাখ রিকশা চলাচল করে, যা দৈনন্দিন যাত্রী পরিবহনে বড়ই অপ্রতুল। এ ছাড়া ট্যাক্সি আর সিএনজিচালকদের দৌরাত্ম্যে যাত্রীরা যথেষ্ট অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় উবার এসে তাদের পেশাদারত্ব, সহজলভ্যতা ও ভালো গাড়ি দিয়ে সবার মন জয় করে নিল। দেশীয় উদ্যোগ পাঠাও বেশ কিছুদিন ধরেই সাইকেল ও মোটরসাইকেল দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করে আসছিল। উবারের সাফল্য অনুসরণ করে তারা রাইড শেয়ারিং পরিষেবায় আরেকটি বিপ্লব ঘটাল।
রাইড শেয়ারিংয়ের উপকারিতা যাত্রীরা যেমন পাচ্ছেন, তেমনিভাবে এতে প্রচুর তরুণ উদ্যোক্তার জন্যও উপার্জনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। অনেক শিক্ষিত বেকার ব্যাংকঋণ নিয়ে মোটরসাইকেল বা গাড়ি কিনে এই রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন এবং মাসে ভালো টাকা রোজগার করছেন। সরকার প্রথম দিকে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও পরে নীতিমালা তৈরি করে এই নতুন শিল্পকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই খাতে ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বুঝতে পেরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কয়েকটি কোম্পানিতে অর্থলগ্নিও করেছেন। কিছু নীতিগত সমস্যা দূর করতে পারলে এই শিল্পখাতের আরও দ্রুত বিকাশ লাভ সম্ভব।
রাইড শেয়ারিংয়ের উপকারিতা যাত্রীরা যেমন পাচ্ছেন, তেমনিভাবে এতে প্রচুর তরুণ উদ্যোক্তার জন্যও উপার্জনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। অনেক শিক্ষিত বেকার ব্যাংকঋণ নিয়ে মোটরসাইকেল বা গাড়ি কিনে এই রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন এবং মাসে ভালো টাকা রোজগার করছেন।রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। এ কারণে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় সাধন অতি জরুরি। মোবাইল অ্যাপে এবং গাড়িতে যদি একটি আপৎকালীন বোতামের ব্যবস্থা রাখা যায়, যা চাপলে পুলিশের ৯৯৯-এ কল চলে যাবে লোকেশনসহ, তাহলে এই ঝুঁকি অনেকটা প্রশমিত হতে পারে। নীতিমালায় বলা আছে, যেকোনো রাইড পুলিশ যেন প্রয়োজনে পর্যবেক্ষণ করতে পারে, তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা দরকার।
শুধু নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে লিলি ও পিঙ্ক-স্যাম যাত্রা শুরু করেছে। নারী চালিত স্কুটার বা মোটরবাইকের মাধ্যমে এই পরিষেবার কারণে নারীরাও এখন স্বাচ্ছন্দ্যে রাইড শেয়ারিং করতে পারছেন। রাইড শেয়ারিংয়ের দেশীয় পথিকৃৎ পাঠাও যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি অন্যান্য পরিষেবাও দেওয়া শুরু করেছে। একই মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে যেকোনো রেস্তোরাঁ থেকে খাবারের অর্ডার করা যাচ্ছে। আরেক বড় রাইড শেয়ারিং কোম্পানি সহজ, যারা অনেক আগে থেকেই বাস ও ট্রেনের টিকিট অনলাইনে বিক্রি করত, তারাও এই খাবার ডেলিভারি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। এই দুই কোম্পানিই ডিজিটাল ওয়ালেট সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলছে।
তবে রাইড শেয়ারিংকে যানজট নিরসনের জাদুর কাঠি মনে করলে চলবে না! যানজটের প্রধান কারণগুলোর একটা হলো রাস্তার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যাধিক্য। বাস, মেট্রোরেল ইত্যাদি অধিক যাত্রী বহনসম্পন্ন গণপরিবহন ছাড়া যানজট কমানো সম্ভব নয়। একটি বাসে যেখানে ২৫ থেকে ৫০ জন যাত্রী অনায়াসে যেতে পারেন, সেখানে একটি গাড়ি চার–পাঁচজনের বেশি বহন করতে পারে না। এ অবস্থায় রাইড শেয়ারিং ব্যবসার কারণে যদি কয়েক হাজার গাড়ি/মোটরসাইকেল রাস্তায় নামে, তাহলে যানজট বাড়বে বই কমবে না। যেহেতু যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যই বেশির ভাগ যাত্রী এই পরিষেবাটি নেন, সেহেতু ভিড়ের মধ্যে পাশ কাটিয়ে, কখনো বা ফুটপাতের ওপর উঠে মোটরসাইকেলচালকেরা যাত্রীকে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে চান। তাই অনেক সময়ই তাঁদের ট্রাফিক আইন ভাঙতে হয় এবং ফলে এরা প্রায়ই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ান। এ বিষয়ে সচেতনতা থাকতে হবে।
যেকোনো নতুন ব্যবসা খাতে ভোক্তার আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে প্রথম দিকে কিছুটা বাড়তি পদক্ষেপ ও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে তাদের পরিষেবায় অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। শুধু ডিসকাউন্ট–সুবিধা দিলেই চলবে না, খেয়াল রাখতে হবে যে যেন কোনো অঘটন না ঘটে; বিশেষ করে ছিনতাই বা দুর্ঘটনা না ঘটে। যাত্রীদের সঙ্গে চালকদের ভালো ব্যবহারের ব্যাপারেও মনোযোগী হতে হবে। কারণ, দুর্ভাগ্যবশত যদি এ ধরনের কোনো অযাচিত ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে গ্রাহক-অসন্তুষ্টির খারাপ প্রভাব পুরো রাইড শেয়ারিং ব্যবসার ওপর এসে পড়বে এবং তা এই উদীয়মান ব্যবসা খাতের জন্য মোটেও ভালো হবে না।
মোবাইল অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং পরিষেবা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং কোম্পানির গড় মাসিক আয় এবং বর্তমানে এই ব্যবসায় যুক্ত যানবাহনের সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে এ খাতে এখন বছরে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এর আকার অদূর ভবিষ্যতে যে আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সৈয়দ আলমাস কবীর : বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)–এর সভাপতি