বাংলাদেশে মাদক ও এইচআইভি: কাঠামোগত বাধা অপসারণে করণীয়
এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায়, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ এবং প্রথম আলোর আয়োজনে ১২ এপ্রিল ২০২২ এই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
অংশগ্রহণকারী
মো. আজিজুল ইসলাম
অতিরিক্ত মহাপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির
অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
ডা. মো. খুরশীদ আলম
লাইন ডিরেক্টর (টিবিএল অ্যান্ড এএসপি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
হাবিবুর রহমান
উপমহাপরিদর্শক, ঢাকা রেঞ্জ, বাংলাদেশ পুলিশ
শোয়েবুর রেজা চৌধুরী
চিফ কনসালট্যান্ট, কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
ডা. রাহানুল ইসলাম
আবাসিক মনোরোগ চিকিৎসক, কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র
ডা. লিমা রহমান
পরিচালক, স্বাস্থ্য পুষ্টি ও এইচআইভি/এইডস সেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
ড. তাসনীম আজিম
সাবেক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও প্রধান, এইচআইভি প্রোগ্রাম, আইসিডিডিআরবি
ডা. সায়মা খান
কান্ট্রি ম্যানেজার, ইউএন এইডস বাংলাদেশ
মো. আবু তাহের
ন্যাশনাল প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (ড্রাগস অ্যান্ড এইচআইভি/এইডস), ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অব ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম, বাংলাদেশ
ডা. ইখতিয়ার উদ্দীন খন্দকার
পরিচালক, হেলথ প্রোগ্রাম, কেয়ার বাংলাদেশ
মোহাম্মাদ নিয়াজ মোরশেদ খান
সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, আইসিডিডিআরবি
মনোজ কুমার বিশ্বাস
বিসিসিএম কো-অর্ডিনেটর, দ্য গ্লোবাল ফান্ড বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
সাহেদ ইবনে ওবায়েদ
প্রেসিডেন্ট, নেটওয়ার্ক ফর পিপল হু ইউজ ড্রাগ (এনপুড)
এজাজুল ইসলাম চৌধুরী
টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রাম, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
সুপারিশ
■ এইচআইভি প্রতিরোধ একটা জাতীয় ইস্যু। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০-এর মধ্যে এইচআইভি নির্মূল করতে হলে স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
■ মাদকসেবীরা যেন এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচিতে সহজে অংশ নিতে পারে, সে জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সহজ ও পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
■ মাদক গ্রহণকারীদের গুণগত চিকিৎসা প্রদান করে তাদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে হবে।
■ গৃহহীন, নারী ও ভাসমান মাদকসেবীরা এইচআইভি ছড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।
■ পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সদস্যদের এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
■ মাদকদ্রব্য ব্যবহারকে ডিক্রিমিনালাইজ করা বা অপরাধ হিসেবে না দেখে পাবলিক হেলথ ইস্যু হিসেবে দেখা যায় কি না ভাবতে হবে।
■ মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য জেলখানায়ও এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচি বিস্তৃত করা দরকার।
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
এইচআইভি এমন একটি ভাইরাস, যেটা শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ফলে বিভিন্ন রোগে ওই ব্যক্তি সহজেই আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে যেন এটা নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যাপারে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আজকের আলোচনায় আশা করি এইচআইভি প্রতিরোধে কাঠামোগত সমস্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসবে। প্রথম আলোর মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠী এ সম্পর্কে জানবে এবং নীতিনির্ধারকেরা নতুন করে বিষয়টি ভাববেন।
লিমা রহমান
একজন মাদক গ্রহণকারী কীভাবে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয় এবং সেখান থেকে উত্তরণের উপায় কী, তা জানতে হলে মাদক ও মাদক গ্রহণকারীর সঙ্গে এইচআইভির কী সম্পর্ক, তা জানা দরকার। একসময় আমরা লক্ষ করলাম, ঢাকায় সুইয়ের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে হঠাৎ এইচআইভি সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ হলো। সে সময় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোলের তত্ত্বাবধানে আমরা কাজ শুরু করলাম। বুঝতে চাইলাম কেন এইচআইভি সংক্রমণের হার বাড়ছে। আমরা দেখলাম যে তাদের মধ্যে সুই/সিরিঞ্জ ভাগাভাগির (শেয়ারিং) হার কোনোভাবেই কমছে না। এখানে আরও কিছু কারণ ছিল, যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব ছিল না।
মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একজন মাদক ব্যবহারকারী ও মাদক বিক্রেতাকে একই দৃষ্টিতে দেখা হয়। ফলে যেসব মাদক ব্যবহারকারী এইচআইভি কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে, তাদের ড্রপ ইন সেন্টার (ডিআইসি) এলাকায় অবস্থান করা বা তাদের জন্য নির্দিষ্ট সেবা যথাযথভাবে গ্রহণ করা প্রায়ই সমস্যা হয়ে দঁাড়ায়। তা ছাড়া সুইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারী যারা এইচআইভিতে আক্রান্ত, তাদেরকে সরকারের সহায়তায় আমরা অ্যান্টি–রেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেবা দিচ্ছি। কিন্তু এখনো একটা ভালো অংশ শনাক্তের বাইরে। তাদেরকে খুঁজে বের করা এবং যারা ইতিমধ্যে শনাক্ত হয়েছে, তাদের নিরবচ্ছিন্ন এরআরটি সেবা প্রদান করার জন্যও একটা ভালো পরিবেশ দরকার।
এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঢাকা শহরে এইচআইভি বাড়ার পর একটা ব্যাপক পরিকল্পনার মাধ্যমে এইডস এসটিডি কন্ট্রোল, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ, কেয়ার বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ করেছি, যার ফলস্বরূপ ২০২০ সালে সরকার পরিচালিত জরিপে আমরা দেখেছি যে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে কমেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সবার সহযোগিতায় এই সফলতা আনতে পেরেছি কিন্তু এটাকে ধরে রাখতে হলে আমাদের আইনগতসহ অন্যান্য কাঠামোগত সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
এজাজুল ইসলাম চৌধুরী
সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম (এএসপি), মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, দেশি-বিদেশি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা এইচআইভি কর্মসূচি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ের সহায়তা সত্ত্বেও দেখা যায় কিছু কাঠামোগত সমস্যার কারণে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমস্যা হয়, যা এইচআইভি ও রক্তবাহিত অন্যান্য রোগ ছড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা সৃষ্টি করে। কাঠামোগত সমস্যার মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অন্যতম সমস্যা হলেও মাদক ব্যবহারকারীদের মবিলিটি, বসবাসের স্থান, চিকিত্সা ও পুনর্বাসন এবং জেলখানায় গমনসহ বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব সমস্যার সমাধান একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে না হলে, শুধু চিকিৎসাসামগ্রী বিতরণ করে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সম্পর্কিত সরকারি বিভাগগুলোর উচ্চপদস্থ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা, বাস্তবায়নকারী সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, কমিউনিটি নেটওয়ার্কসহ সবাই আলোচনা করে একটা কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। এরপর কীভাবে এসব কাঠামোগত সমস্যা থেকে বের হওয়া যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশে মাদক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। তবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত একটা জরিপে দেখানো হয়েছে, ১৮ বছরের ওপরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। অবশ্য এটি প্রকৃত সংখ্যা থেকে অনেক কম বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। সুইয়ের মাধ্যমে যারা মাদক নেয়, তাদের অনুমিত সংখ্যা ৩৩ হাজার। ১৯৯৮ সাল থেকেই বাংলাদেশে এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ হচ্ছে। বর্তমানে গ্লোবাল ফান্ডের আর্থিক সহায়তায়, সেভ দ্য চিলড্রেন প্রিন্সিপাল রিসিপিয়েন্ট (পিআর) হিসেবে কাজ করছে। তাদের সহায়তায় কেয়ার বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম সুইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারী ১৪ হাজার জনের মধ্যে ১৩টি জেলায় ৩৫টি সেবাকেন্দ্র থেকে এইচআইভি নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি চতুর্থ স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচির আওতায়ও সুইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের নিয়ে কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট ২০২১ থেকে উল্লেখ করা হয় যে মাদকের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ সত্ত্বেও বিগত ১০ বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মাদক ব্যবহারকারী বেড়েছে। একইভাবে মাদক ব্যবহারসংক্রান্ত কারণে অসুস্থতা (ড্রাগ ইউজ ডিজঅর্ডার) ও মৃত্যু বেড়েছে বহুগুণ। যে কারণে মাদক সমস্যা সমাধানের জন্য সারা বিশ্বে দৃষ্টিভঙ্গিগত একটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৪৯টি দেশে মাদক ব্যবহারকে কোনো না কোনো প্রকারে ডিক্রিমিনালাইজ বা অপরাধহীন করার প্রয়াস নিয়েছে। তবে, এটি কোনোভাবেই মাদককে আইনগত বৈধতা দেওয়া না। এই ব্যবস্থায় সরবরাহ এবং বিক্রয় ঠিকই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে থাকে, শুধু ব্যবহারের জন্য তার যতটুকু প্রয়োজন, তা নিজের কাছে রাখা ও ব্যবহারকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, অপরাধ হিসাবে নয়। গবেষণা উপাত্তে দেখা গেছে, এতে মাদক ব্যবহার কমে যায়, অপরাধমূলক কাজ কম সংঘটিত হয়, এইচআইভি কমে যায় এবং মাদক উদ্ধারের ঘটনাও বেড়ে যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় মাদক চিকিৎসা অপ্রতুল। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। ফলে রিলাপসের (পুনরায় মাদকে ফিরে যাওয়া) পরিমাণ খুব বেশি। এখানে যথাযথ দিকনির্দেশনা ও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। চিকিৎসা গ্রহণের পরে মানসিক পুনর্বাসনের সঙ্গে তাদের আর্থিক পুনর্বাসনও প্রয়োজন। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মাদক ব্যবহারকারী রাস্তায় থাকে, তাদের এইচআইভিতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। তাই গৃহহীন যারা আছে, যারা রাস্তায় থাকে, তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশেষত, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আওতায় সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর বা যুব মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যদি সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে পরিবার ও সমাজে তারা বেশি অবদান রাখতে পারবে এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে।
এইচআইভি কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশগ্রহণ যে দেশে বেশি, সে দেশের কর্মসূচিও তত বেশি সফল। যে জন্য প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কর্মসূচি সম্পর্কে নিয়মিত অবহিত করা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
ইখতিয়ার উদ্দীন খন্দকার
কেয়ার বাংলাদেশ ১৯৯৮ সাল থেকে এইচআইভি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখন সেভ দ্য চিলড্রেনের নেতৃত্বে কাজ করছি। এইচআইভি প্রতিরোধ শুধু এনজিওগুলোর ইস্যু নয়। এটা একটা জাতীয় ইস্যু। এ ইস্যু বাস্তবায়নে সবাইকে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। মাদক ব্যবহারকারীরা অসুস্থ, পারিবারিক, সামাজিক সবভাবে তারা অবহেলিত। এরা সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় চলে আসছে।
চিকিৎসা প্রদানের সঙ্গে তাদের জীবন ও জীবিকার সংযোগ ঘটাতে হবে। সে যদি তার জীবনে কোনো আশা না দেখে, তাহলে কোনোভাবেই সে তার জীবন নিয়ে ভাববে না। এ জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে এদের যুক্ত করতে হবে। এইচআইভি আক্রান্ত রোগীরা একটা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। তাদের দক্ষতার ভিত্তিতে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা গ্লোবাল ফান্ডের সহায়তায় কিছু সহায়তা তাদের দিচ্ছি। এটা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। সবাই চেষ্টা করে তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে।
মোহাম্মাদ নিয়াজ মোরশেদ খান
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ এবং পরবর্তী সময়ে ২০১৮ অনুযায়ী কেউ যদি মাদক গ্রহণের জন্য মাদক সংগ্রহ করে এবং তার কাছে যদি মাদক গ্রহণের কোনো উপকরণ (সুই বা সিরিঞ্জ ইত্যাদি) পাওয়া যায়, তাহলে তাকে জেলে দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ জন্য অনেক সময় তারা এইচআইভি সেবাকেন্দ্রের কর্ম এলাকা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটা একধরনের কাঠামোগত বাধা।
২০১৯ সালে এইচআইভিতে বিরাজমান মানবাধিকার ও জেন্ডার বেইজড ভায়োলেন্স সমস্যা সমাধানে একটি টাস্কফোর্স (এনটিএফ) গঠন করা হয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে। কাঠামোগত বাধাগুলো নিয়ে সেই কমিটিও কাজ করতে পারে। বাসস্থান নেই, এমন মাদকসেবীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এদের পুনর্বাসনের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
সাহেদ ইবনে ওবায়েদ
বাাংলাদেশে কত মানুষ মাদক গ্রহণ করে, এর পরিসংখ্যান খুব জরুরি। কারণ, সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া সম্ভব নয়। একবার প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। কিন্তু আমাদের প্রকৃত সংখ্যাটা জানা প্রয়োজন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অনেক কাজ করছে। যেসব মাদক গ্রহণকারী পথে থাকে, তাদের নিজেদের চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য নেই। এদের দেখলে মানুষ মনে হয় না। ভীষণ খারাপ অবস্থায় ডাস্টবিনের কাছে থাকে। তাদের পেটে ক্ষুধা, বাসস্থান নেই, শিক্ষা, চিকিৎসা—প্রায় কিছুই নেই। তার কাছে এইচআইভি বড় না ক্ষুধা বড়? এসব বাদ দিয়ে শুধু এইচআইভি রোধ করলে কি হবে?
আমরা প্রায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছি। তাই মাদক গ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর কথাও আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
মো. আবু তাহের
আমাদের প্রথমে ভাবতে হবে কীভাবে মাদকের সরবরাহ বন্ধ করা যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একার পক্ষে কোনোভাবেই এটা সম্ভব নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যে পরিমাণ মাদক আসে, সেটা যদি বন্ধ না করতে পারি, তাহলে যত চেষ্টাই করি না কেন, সেটা ফলপ্রসূ হবে না। দেশের সীমান্ত এলাকা কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। চিকিৎসায় কিছু ড্রাগ লাগে। কোন ড্রাগ চিকিৎসায় কী পরিমাণ লাগে, সেটা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। ইয়াবার কোনো মেডিকেল উদ্দেশ্য নেই। তাহলে কেন বিপুল পরিমাণ ইয়াবা আসছে? মাদকের বর্তমান আইনটা রিভিউ করা উচিত, যেন এইচআইভি কর্মসূচি পরিচালনায় বিদ্যমান বাধাগুলো অপসারণ করা যায়।
যারা মাদকের ব্যবসা করে, তারা যত বড় ক্ষমতার চর্চা করুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের ধরতে হবে। এই জায়গায় কাজ করতে পারলে ঢাকা শহরে অনেক মাদক ব্যবহার কমে যাবে। স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
রাহানুল ইসলাম
মাদক ব্যবহার ও আত্মহত্যা—এ দুটি হলো আমাদের দেশে ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু সমস্যা সমাধানে এগুলো কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা প্রয়োজন। এটি একটি কাঠামোগত বাধা। ১৯৯০ সাল থেকেই নিরাময় শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে ট্রিটম্যান্টের বিপরীতে। এটি একটি ভুল তথ্য। ট্রিটমেন্টের বাংলা কখনো নিরাময় নয় বরং চিকিত্সা। নিরাময় মানে কিউর।
একজন মাদক গ্রহণকারী যে পুনরায় মাদক গ্রহণ শুরু করে, এটা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই। পুনরায় মাদক গ্রহণের অর্থ চিকিৎসা ব্যর্থ হয়েছে এটা নয়। মাদকের ওভারডোজ ব্যবস্থাপনায় ন্যালাক্সজন সহজলভ্য করতে হবে।
ডোপ টেস্ট নিয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। পুনর্বাসন নিয়েও ভুল ধারণা আছে। পুনর্বাসন মানে হাঁস–মুরগি পালন নয়। পুনর্বাসন হলো তার মনোযোগ বাড়ানোর সক্ষমতা অর্জন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ। এটি তাকে এমনভাবে পরিবর্তিত করে যেন সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবে, পরিবারে তাকে গ্রহণ করবে, এটাই তার পুনর্বাসন। চিকিৎসার একটি সামগ্রিক জাতীয় গাইডলাইন দরকার। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমাদের দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিকিৎসার একটা বাস্তব কাঠামো দরকার, যেটা সারা দেশে সমানভাবে কাজ করবে।
তাসনীম আজিম
আলোচনায় এসেছে, প্রচলিত ধারণার বাইরে কাজ করতে হবে। এটা বলা সহজ। কিন্তু কাজটা কঠিন। আমরা বারবার এসব আলোচনা করছি। কিন্তু খুব বেশি কাজ হচ্ছে না। কাঠামোগত বাধা অপসারণে আইন একটা বড় ইস্যু। আইনের কিছু ধারা মাদক ব্যবহারকারীদের সেবাদানে বাধা সৃষ্টি করে। যারা মাদক গ্রহণ করে, তারা অপরাধী নয়। এরা মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ নির্ভরশীলতা তাদের বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
কেউ ওদের বুঝতে পারে না। চিনতে পারে না। একবার এক নারী মাদকসেবীকে বললাম আপনার ঠিকানা বলেন। সে বলল পার্ক। বুঝতে পারছি না পার্ক কেন বলছে। পরে বুঝলাম ওর তো ঠিকানা নেই। ও পার্কের এক কোনায় থাকে। ওদের অনেকে বলছে ওরা দিনে একবারও পেট ভরে খেতে পায় না। ওরা ওষুধ দিয়ে কী করবে? যারা খাবার পায় না, সারাক্ষণ ক্ষুধার যন্ত্রণায় থাকে, তাদের আগে খাবার দিতে হবে, নাকি ওষুধ দিতে হবে—এটা ঠিক করতে হবে। একটা জনগোষ্ঠী সারা দিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় থাকে, এটা একটা মানবিক ইস্যু। নারী মাদকসেবীদের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
মনোজ কুমার বিশ্বাস
এইচআইভি ও মাদক মাল্টিডাইমেনশনাল বিষয়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুলিশ ও র্যাব, যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করে, তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। কুসংস্কার দূর করতে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিভিন্ন দেশের এ ব্যাপারে ভালো কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে হবে। তা হলেই সুফল পাব। মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট যারা কাজ করে, তারা কীভাবে মাদকসেবীদের সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে পারে, সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে।
সায়মা খান
২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত একটা বৈশ্বিক কৌশলপত্র (গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি) তৈরি করা হয়েছে। এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে চিকিৎসা, এইচআইভি প্রতিরোধ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধাপে মানবাধিকার, জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স। শেষ পর্যায়ে রয়েছে সম্পদ সংগ্রহ ও বণ্টন। ক্রস কাটিং ইস্যুর মধ্যে রয়েছে সামাজিক সুরক্ষা ও তথ্য। ইউএন এইডস স্পষ্টভাবে চিন্তা করছে যে যদি মাদকসেবীদের মানবাধিকার দেখা না হয়, সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া না হয়, আইনের সুবিধা যদি সে না পায়, তাহলে তাকে তার সমস্যা থেকে সুরক্ষা দেওয়া যাবে না।
কোনো রোগীকে শুধু রোগ বহনকারী হিসেবে দেখলে হবে না। আমি একজন নারী ইনজেকটিং ড্রাগ ইউজারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, সে একজন যৌনকর্মী। তার কিছু ছিল না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে কিন্তু নিডল সিরিঞ্জ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামকে পাবলিক হেলথ অ্যাপ্রোচ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। নিডল সিরিঞ্জ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম মাদকদ্রব্য ব্যবহারকে উৎসাহিত করে না। সর্বোপরি যে কারণগুলো মানুষকে মাদকদ্রব্য গ্রহণের দিকে নিয়ে যায়, সেটা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।
শোয়েবুর রেজা চৌধুরী
যারা সুইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহার করে, পৃথিবীজুড়ে তাদের এইচআইভি বেশি। ২০১৭ সালে ঢাকায় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ২২ শতাংশ হলো। তবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক কমেছে। এ ক্ষেত্রে অপিওয়েড সাবস্টিটিউশন থেরাপি বা ওএসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডিটক্সিফিকেশন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও আমরা ওএসটি ব্যবহার করতে পারি। এ ছাড়া ওএসটি অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।
সবাইকে মাদকমুক্ত করতে পারব না। অনেকে ভালো হওয়ার পর আবার মাদকে আসক্ত হবে। এটাই হচ্ছে মাদকাসক্ত রোগীর ধরন। অধিকাংশ মাদকাসক্ত রোগীর চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য থাকে না। আমরা কাউকেই বিনা চিকিৎসায় রাখব না। সরকার এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের অনেক মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন। জেলা পর্যায়ে তঁাদের নিয়োগ দেওয়া যায়। ঢাকা থেকে আমরা যেতে পারি। টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমেও চিকিৎসা করতে পারি। মাদকাসক্ত রোগীদের জন্য মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা তাদের খুব সাহায্য করে। তাদেরকে অপরাধী হিসেবে দেখাটা ঠিক নয়। এইচআইভি ও মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ সবাই যেন স্বাস্থ্য খাত থেকে সঠিক সেবা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
হাবিবুর রহমান
আলোচনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা বারবার এসেছে। হয়তো এর যুক্তিসংগত কারণও আছে। তবে, মাদকের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। পুলিশ তাদের সহযোগিতা করে।
মাদক ও এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে যেকোনো মূল্যে মাদকের অপব্যবহার কমাতে হবে। একজন ব্যক্তি যে মাদক গ্রহণ করে, সে হঠাৎ করে ইনজেকশন নেয় না। প্রথমে সে সিগারেট খায়, তারপর গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন—শেষ পর্যায় সে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক নেয়। শুরুতেই যদি মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারের হার অনেক কমাতে পারি।
আমাদের মধ্যে সমন্বয়টা খুব দরকার বলে মনে করি। যেমন মাদক হলো সুরক্ষাসেবার অধীনে। পুলিশ আছে জননিরাপত্তার অধীনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে এইডসের কাজ হয়। আইন প্রয়োগ করতে গেলে সেটা যায় আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আমাদের সবার মধ্যে একটা অর্থবহ সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।
বর্তমান কাঠামোয় যে কাজের সুযোগ রয়েছে, সেটা কি ঠিকমতো হচ্ছে? পুলিশ এখন বহুমুখী কাজের সঙ্গে যুক্ত। ওয়েসিস নামে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র করেছি। এটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।
মাদক ও এইচআইভি প্রতিরোধে যেকোনো রোডম্যাপের সঙ্গে পুলিশকে যুক্ত করতে হবে। সবার মধ্যে একটা কার্যকর সমন্বয় করা দরকার। এইচআইভি কর্মসূচির যথাযথ সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেতৃত্বে যদি নিয়মিত সভা করা যায়, তাহলে সমস্যা সমাধান হবে। পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টি নিয়ে আন্তরিক।
মো. খুরশীদ আলম
বাংলাদেশে ও বিশ্বের জন্য আজকের আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এইডস বিশ্বের জন্য একটা বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। ইনজেকটেবল ড্রাগ ইউজার এইচআইভি ছড়ানোর একটা বাহন হিসেবে কাজ করছে। এখন এদের সংখ্যাও অনেক বেশি। এইডসের পাশাপাশি হেপাটাইটিস বি ও সির মতো মারাত্মক রোগের উপস্থিতি তাদের মধ্যে ব্যাপক হারে লক্ষ করা গেছে। এভাবে চলতে থাকলে এটা আমাদের জন্য বিপর্যয় নিয়ে আসবে। আমরা দেখেছি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এইচআইভি কর্মসূচি নিয়ে খুবই আন্তরিক। আমরা চাইব আইনগত বাধার বিষয়টি তারা বিবেচনা করবে।
এ রোগ যেমন ধ্বংসাত্মক, তেমনি এর চিকিৎসার খরচও অনেক বেশি। এর মৃত্যুহারও অনেক বেশি। এ জন্য যেকোনো মূল্যে মাদকের সরবরাহ কমাতে হবে। যেসব মাদক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেটার সরবরাহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। কোনো কোনো মাদক নিরাময় কেন্দ্রে অপচিকিৎসা হয়। সর্বোপরি সমন্বিতভাবে কাজ করতে না পারলে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবে না।
আহমেদুল কবির
মাদক ব্যবহারকারীদের ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি মনে করি, এটা একটা বড় কাজ। ব্যক্তি থেকে শুরু করে কমিউনিটি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ও এই ঝুঁকি হ্রাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ইনজেকশন ব্যবহার করে। বাংলাদেশেও এ সংখ্যা অনেক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে ড্রপ ইন সেন্টারসহ যেসব সংগঠন মাদকসেবীকে সেবা দেয়, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিলে ভালো হয়। আমরাও চেষ্টা করছি হাসপাতালগুলোতে হেল্প ডেস্ক চালু করতে। বাংলাদেশে পুলিশ ও চিকিৎসক মানুষকে সরাসরি সেবা দেন। তাঁদের মধ্যে ভালো সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।
অনেক ধরনের ক্ষতিকর ড্রাগ ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়। এর বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ভাসমান ড্রাগ ইউজারদের এখনই পুনর্বাসন করতে হবে। এর ব্যাপক বিস্তার হলে সমাধান করা কঠিন হয়ে যাবে। আইনগত বিষয়গুলো সমাধানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বর্তমান ডিজি মহোদয়ের একটা কমিটি করার কথা শুনেছি, যেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমরা আন্তরিকভাবে সহায়তা করতে প্রস্তুত। কারণ, এইচআইভি প্রতিরোধে সরকারের যে প্রতিশ্রুতি, তা রক্ষা করতে হলে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
এ ছাড়া এইচআইভি ও মাদক নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থার মধ্যেও নিয়মিত সভা আয়োজন করা উচিত। তাহলে সমস্যা সমাধান ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করি। যারা ইনজেকটেবল ড্রাগ ইউস করে, তাদের নিরাপদ নিডল সিরিঞ্জ দেওয়া, মানসিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা, ওএসটি, ঝুঁকি হ্রাস—এ কাজগুলোও যদি সমন্বিতভাবে করতে পারি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। আমি মনে করি, আজকের আলোচনার পর একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করাই হবে এ অনুষ্ঠানের সফলতা।
মো. আজিজুল ইসলাম
অত্যন্ত ভালো আলোচনা হয়েছে। আজকের আলোচনার সব দিক বাস্তবায়ন করতে পারলে মাদক নিরাময়ের ক্ষেত্রে একটা নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হবে। আমরা ভালো থাকব এবং আমাদের দায়িত্ব রয়েছে অন্যকে ভালো রাখা। অন্যকে ভালো রাখতে হলে আমাদের কাজগুলো আন্তরিকতা দিয়ে করতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদক চিকিৎসার গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে চিকিৎসা গাইডলাইন প্রণয়নের কাজ চলছে। ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সেবা প্রদানকারীদের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তা ছাড়া মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলো নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে। যারা অপচিকিৎসায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আজকের আলোচনায় যে বিষয়গুলো এসেছে, আমি এর নোট নিয়েছি। সবাই মিলে একসঙ্গে এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করব। মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে ওএসটি সেবাকেন্দ্র স্থাপনের আমরা অনুমতি দিয়েছি এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করছি এই সেবার সম্প্রসারণে। বাকি যেসব সমস্যার কথা বলা হলো, সেগুলো সমাধানেও আমরা আন্তরিক। এ জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
সমাজ ও দেশের জন্য মাদক একটি ভয়াবহ সমস্যা। আজকের গোলটেবিল বৈঠকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছে। আশা করা যায়, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।