২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বন্ধ হোক পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বন্ধ হোক পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৭ জানুযারি ২০২২। গোলটেবিল আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

সাবের হোসেন চৌধুরী, এমপি

সভাপতি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

সোলায়মান হায়দার

পরিচালক (পরিকল্পনা), পরিবেশ অধিদপ্তর

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)

শামসুল হুদা

নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)

মোবারক আহমেদ খান

বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন; সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, ঢাকা

শাহরিয়ার হোসেন

সেক্রেটারি জেনারেল, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)

ইকবাল আহমেদ

সিনিয়র এনভায়রনমেন্ট স্পেশালিস্ট, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক

নারায়ণ চন্দ্র দে

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি

কামরুজ্জামান কামাল

পরিচালক (মার্কেটিং), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ

মো. খোরশেদ আলম

পরিবেশ গবেষক

আবু হাসনাত মো. মাকসুদ সিনহা

নির্বাহী পরিচালক, ওয়েস্ট কনসার্ন

মাকছুদুল ইসলাম

পরিচালক, করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ফুডপান্ডা

ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ

প্রধান নির্বাহী, ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস)

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

পলিথিন অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকও জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পলিথিন বা প্লাস্টিক পোড়ালে বায়ুদূষণ হয়। আর কোথাও ফেলে দিলে এটা কয়েক শ বছর পর্যন্ত থাকে। এর মধ্যে বিষাক্ত সিসাসহ বিভিন্ন দূষিত উপাদান থাকে। কিছু খাবার এমনভাবে পলিথিনে প্যাঁচানো থাকে, যা খাওয়ার সময় এর টুকরা আমাদের পেটে চলে যেতে পারে। এ জন্য আমরা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারি। নদী বা সমুদ্রে অনেক পলিথিন জমা হচ্ছে। অনেক মাছ এ পলিথিন খায়। মানুষ ওই মাছ খেলে তার সমস্যা হবে।

মোটা প্লাস্টিক যা অনেকবার ব্যবহার করা যায়, সেটা বন্ধ করতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক এখনই বন্ধ না করলে মানুষের জন্য মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হবে। আমাদের এখনই মাটি, পাট ও গাছের বিভিন্ন বিকল্প বস্তু ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে। আজকের আলোচনায় এসব বিষয় আসবে বলে আশা করি।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

আইনে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকার পরও পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকা কতটা জররি, সবার সেটা বুঝতে হবে। কিছু প্লাস্টিক আমরা একবার ব্যবহার করে ফেলে দিই। যেমন কাপ, বোতল, প্লেট, চামচ, কটনবাড ইত্যাদি। আজকের আলোচনার বিষয় হলো এগুলোর ব্যবহার বন্ধ করা, এর বিকল্প আছে কি না সেটা দেখা। আজ আমরা শুধু পরিবেশবাদী সংগঠন আলোচনা করছি তা নয়, আমাদের সঙ্গে ব্যক্তি খাতের আলোচকবৃন্দও রয়েছেন। তাঁদের একটি বিশাল ভূমিকা আছে। আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা, ভারতের কেরালা যদি এসব বন্ধ করতে পারে, তবে আমাদেরও খারাপকে ‘না’ বলতেই হবে।

আমরা প্লাস্টিক বন্ধ করতে বলছি না। কিন্তু একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধ করার মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতকে ভূমিকা নিতে হবে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে মুনাফা করা কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজ হতে পারে না। এটা উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদকদের এর বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের সনাতনী পণ্যে ফিরতে হবে, যখন পলিথিন বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ছিল না, তখন আমরা টেকসই পণ্য ব্যবহার করেই সবকিছু সম্পাদন করেছি। অর্থাৎ পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্প সমাজে আছে। মাটি, বাতাস, খাদ্য উৎপাদনসহ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

শাহরিয়ার হোসেন

সবাই জানি প্লাস্টিক ক্ষতিকর। কতটা ক্ষতিকর, কেন বা কীভাবে ক্ষতিকর, সেটি আজকের আলোচনার বিষয়। পেট্রোলিয়াম–জাতীয় পদার্থ থেকে এটি তৈরি হয়। প্লাস্টিক তার লাইফ সাইকেলে বিভিন্ন ধাপে মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। গ্রিনহাউস গ্যাসের একটি কারণ হলো প্লাস্টিক। প্লাস্টিক তৈরিতে প্রায় ৩৮ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৮টি অত্যন্ত ক্ষতিকর। পলিথিনও একবার ব্যবহার্য পণ্যের মধ্যে পড়ে। এটা কোনোভাবে রিসাইকেল হয় না। এটা বর্জ্য উৎপন্ন করে। এটা ভেঙে যায় ও কণায় পরিণত হয়। পরিবেশ থেকে কখনো বিলীন হয়ে যায় না। একসময় আমাদের খাদ্যের সঙ্গে মিশে যায়।

গত ১০ থেকে ১৫ বছরে প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। আবার যে প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহার করা যায়, সেটিও পরিবেশে থেকে যাচ্ছে। এখন সবকিছুর রংবেরঙের মিনি প্যাক তৈরি হচ্ছে। যত বেশি রং, তত বেশি কেমিক্যাল। এতে প্রায় ১৮টি কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মিনি প্যাক কোনোভাবেই পুনরায় ব্যবহার করা যায় না। এসব পরিবেশে থেকে কোনো না কোনোভাবে মানবদেহে ফিরে আসে। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ, যে দেশে ২০০২ সালে আইনের মাধ্যমে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ২০০৬ সালের পর এর আর কোনো কার্যকারিতা নেই।

২০২০ সালে আমাদের এক গবেষণায় দেখলাম, হঠাৎ করে পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে। সেটি এখনো চলমান। আইনের ফাঁক ও বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে এই পলিথিন আমাদের মানবদেহে প্রবেশ করছে। দেশে ‘প্লাস্টিক দুর্যোগ’ ক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। প্রতিবছর এটি বাড়ছে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। প্রতিবছর ৯ লাখ টন প্লাস্টিক আমাদের সাগর–মহাসাগরে যাচ্ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ২০২৬ সালে এটা হবে ১ কোটি ১৮ লাখ টন হবে। বৃদ্ধির এ প্রবণতা হলো প্রতি ১১ বছরে প্রায় দ্বিগুণ।

এটা করোনাভাইরাস থেকেও ভয়ংকর হতে পারে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য নয়। তাই আইন অনুযায়ী পলিথিনের ব্যবহার যদি নিষিদ্ধ থাকে আর একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে অনেকটা পরিবর্তন আনতে পারব। বিকল্প ব্যবহারের ফলে অন্য আরেকটি শিল্প গড়ে উঠবে। অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। অনেক ক্ষেত্রে ভাতের সঙ্গে মাইক্রো প্লাস্টিক খাওয়া হচ্ছে। আবার প্লাস্টিক রিসাইকেল করার সময় অব্যবস্থাপনার জন্য প্লাস্টিকের প্রচুর কণা আমাদের মাটি, পানি, পরিবেশ ও দিন শেষে খাদ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, এতে তেমন কিছু হচ্ছে না। কিন্তু গত ১৫ বছরে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৫ গুণ বেড়েছে। এখন শিশুরাও ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। আসলে প্লাস্টিকের রিসাইকেলও কোনো সমাধান নয়। প্লাস্টিক ঘুরেফিরে পরিবেশে থেকে যায়। তাই ধীরে ধীরে একবার ব্যবহারযোগ্য এবং শেষ পর্যন্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সোলায়মান হায়দার

পলিথিন ও প্লাস্টিক আমাদের শুধু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে না, মানবস্বাস্থ্যের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর শুরু থেকেই এ বিষয়ে সচেতন। আমাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছি। এখানে যারা এসব পণ্য উৎপাদন করে, তাদের চিহ্নিত করেছি। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সমাধান হবে বলে আশা করি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ১০ বছরব্যাপী একটি ‘প্লাস্টিক পরিকল্পনা’ তৈরি করেছি।

পরিবেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিনিয়োগ হচ্ছে। এখানে বায়ুদূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। আমরা প্লাস্টিক, মেডিকেল ওয়েস্ট, সলিড ওয়েস্টসহ বিভিন্ন ওয়েস্টের গাইডলাইন তৈরি করব। বড় উৎপাদনকারীদের ওই গাইডলাইনের আওতায় আনা হয়েছে। যাঁরা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁরা বলবেন কীভাবে উৎপাদনকারীদের দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা যায়। প্লাস্টিকের একবার ব্যবহার–প্রক্রিয়া থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের একবার ব্যবহারের অনুমতি দিতে হচ্ছে। তবে আমরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি।

২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ৩ হাজার অভিযান চালিয়ে ৬ হাজার মামলা দিয়েছে। আমরা প্রায় ২১ কোটি টাকা জরিমানা করে ১৮ কোটি টাকা আদায় করেছি। আমরা যে সফল হয়েছি, তা বলছি না। তবে আমাদের প্রত্যেকের সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে আইনেরও প্রয়োগ করতে হবে। আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে করছি। নিশ্চয়ই একটি পরিবর্তন আসবে।

মো. খোরশেদ আলম

আইনে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার একবার ব্যবহারযোগ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর বিকল্প কী হতে পারে, এ বিষয় আজকের আলোচনা। একটা সময় দেশে মাটির তৈরি পাত্র, কাঁসার পাত্র, সিরামিক ও কাচের পাত্রের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। এখন কমে গেছে। প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে হয়তো কিছু কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু এই সুবিধা থেকে প্লাস্টিক ব্যবহারের যে ভয়াবহ ক্ষতি, সেটা কয়েক গুণ বেশি, যা আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

বাঁশের তৈরি পানির বোতল খুবই চমৎকার। আমাদের অফিসে আমরা বাঁশ, কাঠ ও পাটের তৈরি স্টেশনারি ব্যবহার করতে পারি। আমরা আমাদের অনুষ্ঠানগুলোতে পানাপ্লেক্সে ব্যানার একবার ব্যবহার করে ফেলে দিই। প্লাস্টিকের ফোল্ডারসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করি। প্লাস্টিকের টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার আনি। আমরা নিজেরা অনুষ্ঠানগুলোতে মাটির পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করতে পারি। তাহলেও একটা উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারে।

দেশে কুমারের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মানুষ এখন মাটির তৈরি জিনিস শৌখিন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় এটি নিয়ে আসতে হবে। একইভাবে আমরা যদি পাট, কাঠ, বাঁশ, বেত ইত্যাদির তৈরি পণ্য ব্যবহার কারতে পারি, তাহলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। আবার এসব পণ্য পরিবেশবান্ধবও। এসব পণ্য আমরা আমাদের অফিস, বাসা, বাড়ি—সর্বত্র ব্যবহার করতে পারি। পানির বোতল, কাপ, প্লেট, চামচ ইত্যাদি অনেক পণ্যের বিকল্প কাগজের তৈরি পণ্য রয়েছে। হরহামেশা, ছোটখাটো সব কাজে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করছি। পাটের তৈরি ব্যাগ পলিথিনের বিকল্প হতে পারে। বিকল্প পণ্যের কথা বললে এর পর্যাপ্ততা ও মূল্য লাভজনক হতে হবে। বিশেষ কোথাও পাওয়া গেলে বা উৎপন্ন হলে হবে না। সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্লাস্টিকের বোতল বাদ দিয়ে কাচের বোতল ব্যবহার করতে হবে। বাসাবাড়ি থেকে চটের ব্যাগ বাজারে নিয়ে যেতে পারি। তাহলে পলিথিন ব্যবহৃত হবে না। এভাবে সব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ইকবাল আহমেদ

আমরা দুই বছর এটা নিয়ে কাজ করেছি। ৯ বছরের একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছি। এখানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর উন্মেষ হলো কীভাবে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে সরে আসতে পারি। ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের আইন হয়েছিল। আজ এত বছর পরও পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে। তেমন উন্নতি হয়নি। পরিবেশ ঠিক রাখতে প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। এটা শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। এখানে সিটি করপোরেশন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাইরের দেশে নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া কোথাও এসব ফেলা যায় না। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, সেটাও ভেবে দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুরা ছোটবেলা থেকে সচেতন হতে পারবে। এখানে প্যাকেজশিল্পের ভূমিকা আছে। তাদের কীভাবে দায়বদ্ধতার জায়গায় আনা যায়, সেটাও ভাবতে হবে।

মোবারক আহমেদ খান

২০০২ সালে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হলো। সেই মিটিংয়ে আমি ছিলাম। নিষিদ্ধ করতে না করেছিলাম। কারণ, যত দিন পর্যন্ত আমরা এর বিকল্প না দিতে পারব, তত দিন নিষিদ্ধ করলে এটা কার্যকর হবে না। পৃথিবীর ১৩৪টি দেশে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এদের মধ্যে প্রথম নিষিদ্ধ করেছে। ২০০২ সালে নিষিদ্ধ করার পরও আমরা এর কার্যকারিতা পাইনি। যাঁরা এটা নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের বলতে চাই, সব প্লাস্টিক পলিমার। কিন্তু সব পলিমার প্লাস্টিক নয়। প্লাস্টিক ও পলিথিন যে কত ভয়ানক ক্ষতিকর, সেটা আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। আমরা পাটের কথা ভাবতে শুরু করলাম। পাটে ৭০ শতাংশ সেলোলুজ থাকে। বাংলাদেশেই পাট উৎপন্ন হয়। ৭০ শতাংশ সেলোলুজ পৃথিবীর আর কোনো গাছে নেই। একটা গাছ পূর্ণবয়স্ক হতে ১৫ থেকে ২০ বছর লাগে। এরপর সেখান থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সেলোলুজ পাওয়া যাবে। অথচ পাটে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ৭০ শতাংশ সেলোলুজ পাওয়া যায়।

এক হেক্টর জায়গায় যে পাট উৎপাদিত হয়, প্রতিদিন এ পাট ১০ থেকে ১২ টন কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্রহণ করে। সমপরিমাণ অক্সিজেন আমাদের দেয়। পলি বা প্লাস্টিক থেকে পণ্য উৎপাদনের সময় মিলিয়ন টন কার্বন ডাই–অক্সাইড বাতাসে আসে। পাট থেকে আমরা পরিবেশবান্ধব অর্গানিক ব্যাগ তৈরি করেছি। এ ব্যাগের গুণ হলো একটা পলিব্যাগে যদি ১০ কেজি নেওয়া যায়, তখন তাহলে এ ব্যাগে ১৬ কেজি নেওয়া যাবে। এটা কাগজের মতো আগুনে পুড়ে ছাই হয়। মাটিতে মিশে সার হয়। নদী–সাগরে গেলে গলে মাছের খাবার হয়। পাট থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় দৈনিক এক টন ব্যাগ উৎপাদন করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর নামকরণ করেছেন ‘সোনালি’ ব্যাগ। এখন এটা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করতে হবে। দেশে-বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা।

বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহৃত হয়। এই বাজারে আমরা প্রবেশ করতে চাই। অনেক সস্তায় এর চেয়ে ভালো বিকল্প পৃথিবীর কেউ তৈরি করতে পারেনি। আমরা এটা দিয়ে সুন্দর মাস্ক তৈরি করেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। এ সংস্থার কাছ (পিপি) পার্সোন্যাল ইকুইপমেন্ট তৈরির অনুমতির অপেক্ষায় আছি। যাঁরা নীতি নির্ধারণ করবেন, তাঁদের সঙ্গে একজন বিজ্ঞানী থাকলে ভালো হয়। তিনি অনেক প্রযুক্তিগত বিষয় সহযোগিতা করতে পারবেন। এ বিষয়টিকে সবার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।

কামরুজ্জামান কামাল

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ক্ষতি আমরা জানলাম। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্লাস্টিক রিসাইকেল প্ল্যান্ট রয়েছে আমাদের। রিসাইকেলিং প্লাস্টিক দিয়ে আমরা যেসব প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করি, এসব পণ্য সাধারণত খাদ্য চেইনে আসে না। আমরা ফুলের টব, বাগানে ব্যবহারযোগ্য পণ্য, ময়লার ঝুড়ি, পরিচ্ছন্নতার উপকরণ, ফ্লাওয়ার টব ইত্যাদি তৈরি করে থাকি। জনাব মোবারকের আলোচনা থেকে একটা ভালো বিকল্পের কথা শুনলাম। যতক্ষণ না পর্যন্ত ভালো বিকল্প ব্যবহারকারীদের দিতে পারব, ততক্ষণ হয়তো একবার ব্যবহার করা প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা কঠিন হবে। তবে নিশ্চয়ই একটি ভালো বিকল্প বাজারে আসবে বলে আশা করি।

নারায়ণ চন্দ্র দে

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার সঙ্গে আমাদের প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। আমরা কোনো কিছু রপ্তানি করার সময় প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। ওষুধ ও ফুড চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে। কোভিডের সময় প্লাস্টিকের পিপি ব্যবহার করা হয়েছে। প্যাকেজিংয়ে প্লাস্টিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ জিরো ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনায় গেছে।

সবচেয়ে ভালো দিক হলো একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের অনেক বিকল্প আমাদের রয়েছে। কাপ, প্লেট, চামচ, স্ট্রসহ বিভিন্ন প্লাস্টিকের উপকরণ সহজে বন্ধ করা যেতে পারে। পাতলা প্লাস্টিক সরিয়ে ফেলতে হবে। এর কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। প্লাস্টিক ছয়বার পর্যন্ত রিসাইকেল করা যায়। শেষ ব্যবহার হিসেবে রাস্তায় ব্যবহার করা যায়। সম্প্রতি রাস্তায় ব্যবহার করতে দেখেছি। যত দিন না পর্যন্ত প্লাস্টিকের বিকল্প আসছে, তত দিন পর্যন্ত ভালো ব্যবস্থাপনা করে যেন রিসাইকেল করা যায়। সে ক্ষেত্রে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে হয়তো বন্ধ করা যাবে না। গাড়ি, বিমানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। তবে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে এর বিকল্প বাজারে আনতে হবে। যত দিন পর্যন্ত বাজারে বিকল্প না আসছে, তত দিন হয়তো একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক চলতে থাকবে। বড় প্রতিষ্ঠান এখন রিসাইকেল ইউনিট করছে। বিদেশ থেকে যেন প্লাস্টিক ওয়েস্ট না আসে, সে ব্যাপারে আমরা সবাইকে বলেছি।

আবু হাসনাত মো. মাকসুদ সিনহা

অত্যন্ত সময় উপযোগী আলোচনা। বিশ্বব্যাংক একটা রোডম্যাপ করেছে। আরেকটা হলো আরবান ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট হ্যান্ডলিং রুল। আরবান ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুলের গেজেট হয়েছে। এখন উৎসে বর্জ্য পৃথক করা যাবে। বড় প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্ধারণ করা যাবে। জিডিপির সঙ্গে দেশে বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। গবেষণা করে রোডম্যাপ করা হয়েছিল। এটা অনুসরণ করলে অনেক উপকার হবে। ঢাকা শহরের কোথায় কোথায় প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে থাকে, সেটা আমরা বের করেছি। ১ হাজার ২০০টির বেশি জায়গা পেয়েছি, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য থাকে। ঢাকা শহরের আশপাশ, চিটাগাং, কক্সবাজারে কী ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়, সেটা নির্ণয় করেছি। হঠাৎ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধ করতে পারব না।

বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তি খাতকে প্রণোদনা দিয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে হবে। শুধু প্লাস্টিক বর্জ্য হলে আমরা ব্যবস্থাপনা করব এমন নয়। এগুলো যারা উৎপাদন করে, বিলি–বণ্টন করে, তাদেরও কাজে লাগাতে হবে। সচেতনতা, উৎপাদন, ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং—এ বিষয়গুলো নিয়ে যদি পাইলটিং করা যায়, তাহলে ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করি।

মাকছুদুল ইসলাম

আমরা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক একেবারেই ব্যবহার করি না। এ বিষয়কে প্রচণ্ডভাবে নিরুৎসাহিত করে থাকি। ফুডপান্ডা একটা জার্মান টেকনোলজি কোম্পানি। প্রায় ৫০টি দেশে ফুডপান্ডা কাজ করছে। রেস্টুরেন্টে টেকসই প্যাকেজিং প্রোগ্রাম নিয়ে সিঙ্গাপুর, হংকং, আইইএ—এমন তিনটি দেশে পাইলট প্রোগ্রাম করেছে। সে প্রোগ্রামটা বাংলাদেশে নিয়ে আসব। এটি হবে সিটি করপোরেশন এলাকায়। এর মধ্যে থাকবে প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা, বর্জা সংগ্রহ ও সচেতনতা তৈরি করা। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে এটা করা হবে। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকটা বহুমুখী প্রতিষ্ঠান থাকবে। এটা সফল হলে আমরা সব সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কাজ করব। আজকের এই আলোচনা আমাদের ‍অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করি।

ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ

কক্সবাজারে প্লাস্টিকে অনেক দূষণ হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর বা অন্য কোনো পর্যায় থেকে কোনো অভিযান দেখিনি। আমরা যদি সমুদ্রসৈকতকে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকমুক্ত করতে চাই, তাহলে আমাদের বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটিকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি ডিসি। ওনার অনেক কাজ থাকে। তিনি শতাধিক কমিটির সভাপতি।

এই কমিটি যদি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে কাজ করতে সুবিধা হতো। সপ্তাহে অনন্ত দুই দিন যদি আমরা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে অভিযান পরিচালনা করতে পারি, তাহলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার একাধিক পথ নেই। জাহাজ থেকে নামার সময় যদি প্রত্যেককে চেক করা হয়, তাহলে একটা পলিথিনও যাবে না সেন্ট মার্টিনে। শিপ কর্তৃপক্ষ, সেন্ট মার্টিনের দোকান মালিক সমিতি সবাইকে নিয়ে আলোচনা করলে খুব সহজে সেন্ট মার্টিনকে পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকমুক্ত করা যাবে।

সাবের হোসেন চৌধুরী

এ বিষয়টি নিয়ে এতক্ষণ গভীরভাবে আলোচনা হয়েছে। ‍প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার, এর বৈজ্ঞানিক দিক, রিসাইক্লিং—প্রায় সব বিষয় আলোচনায় এসেছে। ৫০ বছর পর কী রকম বাংলাদেশ দেখতে চাই। জিডিপির প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন—এসবই একটি আদর্শ দেশের একমাত্র মাপকাঠি নয়। আইনে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের সংবিধানের ১৮ নম্বর ধারায় জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের কথা বলা আছে। মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমাদের এটা করতে হবে। বিশ্বের ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম, যারা ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টোব্যাকো কন্ট্রোল চুক্তিতে প্রথম দেশে হিসেবে বাংলাদেশ সই করেছিল। এখন আমাদের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। এখনো যদি সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ না করি, তাহলে এটা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কোনো পরিকল্পনা নেওয়ার আগে অতীতে কেন এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে, সেটা পর্যালোচনা করতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনে যারা পরিবেশদূষণ করে, তাদের দায়ী করা হয়। আমাদের এখানে সে ব্যবস্থা নেই। সাভারে যারা ট্যানারি কারখানা দিয়েছে, তারা অধিকাংশই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পর্যন্ত নেয়নি। পরিবেশ সম্পর্কে যদি এভাবে উদাসীন থাকি, তাহলে কী হবে? রুয়ান্ডা, ভারতের কেরালা, জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া—এরা যদি পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না। বাংলাদেশের তুলনায় তারা প্রায় ১০ গুণ বেশি পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার করত। তারা যদি পারে, আমরা কেন পারব না।

আইন, নীতি হয় কিন্তু কার্যকর হয় না। পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার কমানোর জন্য আগামী বাজেটেই সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। প্রথমে পরিবেশ অধিদপ্তরে একবার ব্যবহার পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারমুক্ত করতে হবে। এরপর মন্ত্রণালয়গুলো ও জাতীয় সংসদে এ উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে। একসময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারি তাঁর কার্যালয়েও যেন এটা ব্যবহৃত না হয়।

মানুষকে সচেতন করতে না পারলে যত ভালো আইন থাকুক, কাজ হবে না। আমার নির্বাচনী এলাকায় একটা ওয়ার্ড নিয়ে এটা শুরু করতে পারি। সারা দেশের তুলনায় ঢাকায় অনেক বেশি একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। এখানে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য জমে। এর ১০ শতাংশ প্লাস্টিক। এটা জমিতে যাচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে।

আমাদের নিজেদের একটা অ্যাকশন প্ল্যান থাকতে হবে। এটাকে আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আনতে হবে। আগামী দিনের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে কাজ করলে অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব। নাগরিক সমাজ, এনজিও, স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি সবার সমন্বয়ে কাজটি করতে হবে।

আগামী এক বছরে কী করব, সেটা আগে ঠিক করতে হবে। ভবিষ্যতে আমরা কী ধরনের বাংলাদেশ দেখতে চাই, সেটা নির্ভর করবে এ বিষয়ে আমরা কতটা পদক্ষেপ নিলাম এর ওপর। এ ক্ষেত্রে একটা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারব।

শামসুল হুদা

সবাই খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে মোবারক আহমেদ খান চাপা পড়া স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলেছেন। পাট নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। অনেক আশা। পাটের বিকল্প ব্যবহার তিনি সামনে এনেছেন। করোনা বিপর্যয়, জলবায়ু বিপর্যয়ের পর এবার আমরা পলিথিন প্লাস্টিক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি। এ বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর দেরি করার সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৯ মাসে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আমরা যখন চ্যালেঞ্জ নিই, সেটাতে জয়ী হই। প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। আমরা এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হব। এটা একটা সুযোগও। জনাব মোবারক পাইলট প্রকল্প হিসেবে যে বিকল্প পাটের পণ্য তৈরি করেছেন, সেটা যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এর জন্য একটা ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে। এখানে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবাইকে যদি এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারি, তাহলে পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকমুক্ত সমাজ গড়তে পারব। আমাদের দেশের পাট পৃথিবীর সেরা। এমনভাবে পাটের বিকল্প পণ্য উৎপাদন করতে হবে, যেন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। এটা কঠিন কিছু নয়। শুধু আমরা কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে চাই, সেটাই বিষয়। আমাদের এই চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রোডম্যাপ করে যেকোনো মূল্যে পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

এখানে মূল ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে। যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, আমরা সরকারকে করব। এখন যাঁরা প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবসা করছেন, তখন তাঁরা এর বিকল্পের ব্যবসা করবেন। পাট হবে সবচেয়ে ভালো বিকল্প। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবসায়ীরা তখন পাট নিয়ে কাজ করবেন। প্রয়োজনে সরকার তাঁদের প্রণোদনা দেবে। এ কাজের জন্য ঋণের সুবিধা থাকবে। দেশে–বিদেশে এর বিশাল বাজার রয়েছে। এত সুযোগ থাকার পরও তঁারা কেন এটা গ্রহণ করবেন না? সরকার সব সময় জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে বলে আশা করি। আজকের গোলটেবিলে উপস্থিত সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী এ বিষয়ে খুবই সচেতন। তিনি সংসদের স্থায়ী কমিটিতে তোলাসহ এ ক্ষেত্রে যা করণীয়, সেসব করবেন বলে আশা করি। এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ না নিতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে।

ফিরোজ চৌধুরী

পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সরকার এগুলোর ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলে আশা করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

সুপারিশ

  • মাটি, পানি, বাতাস ও খাদ্য উৎপাদনসহ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি।

  • পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর পলিথিন এবং প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যেন বিদ্যালয় থেকেই শিশুরা সচেতন হতে পারে।

  • পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ এবং এর বিকল্প প্রচলনে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ খাতে বাজেট বরাদ্দের বিষয় ভাবতে হবে।

  • প্রথমে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে অন্যান্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, জাতীয় সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

  • সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, অধিকারভিত্তিক সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে সোনালি প্রকল্পের মাধ্যমে পাট থেকে উৎপাদিত অর্গানিক ব্যাগের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটানোর জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে।

  • ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিক্রয়, মজুত, বাজারজাতকরণ, বিতরণ, আমদানি ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু অবাধে এর ব্যবহার চলছে। এ ক্ষেত্রে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।