ভার্চু্যয়াল গোলটেবিল
আইনের শাসন জোরদারকরণে জনস্বার্থ মামলার ভূমিকা
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) আয়োজনে ‘আইনের শাসন জোরদারকরণে জনস্বার্থ মামলার ভূমিকা’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৯ জুন ২০২১। এ আয়োজনে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
সুলতানা কামাল
মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
নিজামুল হক নাসিম
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ
রাজা দেবাশীষ রায়
চাকমা সার্কেল প্রধান
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
প্রধান নির্বাহী, বেলা
শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি
জেড আই খান পান্না
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মনজিল মোরসেদ
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ
আবু ওবায়দুর রহমান
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
জনস্বার্থের মামলার বিষয়টি বেশি আগের না। গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে জনস্বার্থে মামলা হচ্ছে। আমাদের সংবিধানে আছে আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের অধিকার সমান। সবার আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার আছে। অনেক সময় আইনের কোনো ব্যত্যয়ের জন্য জনসাধারণের অসুবিধা হতে পারে। নিজের অসুবিধা না হলেও নাগরিকের অসুবিধার জন্য অনেকে স্বেচ্ছায় মামলা করতে পারেন।
আইনের শাসনকে আরও জোরদার করার জন্যই জনস্বার্থে মামলা গুরুত্বপূর্ণ। আজ এ বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে।
সুলতানা কামাল
জনস্বার্থ রক্ষার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করা, আইন প্রণয়ন ও বিধিবিধান তৈরি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ জন্য যখন কোনো আইন জনস্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তখন রাষ্ট্রকেই দায়ী করা হয়। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দাবি থাকে, আইনের শাসন যেন জোরদার হয়। রাষ্ট্রের বাইরে কোনো পক্ষ বা গোষ্ঠীর কারণেও জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জনস্বার্থে কোনো মামলা হলে মূলত রাষ্ট্রের কাছেই আমাদের আবেদন থাকে। তাই রাষ্ট্রের নাগরিকের কল্যাণে জনস্বার্থে মামলাগুলো হয়ে থাকে। জনস্বার্থের কোনো মামলায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে অনেক মানুষের কল্যাণ হয়। জনস্বার্থে মামলা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মামলার জট কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
আবু ওবায়দুর রহমান
আইনের শাসন গতিশীল করতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। দায়িত্ব পালনে কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যত্যয় ঘটলে জনস্বার্থে মামলা হয়। এ মামলার মাধ্যমে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। জনস্বার্থের মামলা সরকারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে। এটা এমন ধরনের বিচার ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি জনস্বার্থ মামলায় আইনি সুরক্ষা পেলে অন্য ব্যক্তিরাও একই ধরনের ঘটনার শিকার হলে একই রকম আইনি সুরক্ষা পাবেন। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে তাদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া যায়।
বাংলাদেশে জনস্বার্থ মামলার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ১৯৯৭ সালে মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ মামলা থেকে জনস্বার্থ মামলার আইনগত ভিত্তি তৈরি হয়। এই মামলার রায়ে বলা হয়, জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো ঘটনায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনি প্রতিকার চেয়ে জনস্বার্থে মামলা করতে পারেন। এই মামলা মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ মামলার ঘটনা ছিল, সরকার টাঙ্গাইল জেলায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে। ফলে বনভূমি ধ্বংস, স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি ও বিপুল জনগোষ্ঠী ভূমিহীন হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে জলাবদ্ধতার কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পক্ষে মহিউদ্দিন ফারুক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের আদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। এই মামলার পর বাংলাদেশে জনস্বার্থ মামলার দ্বার উন্মোচিত হয়।
বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও নির্যাতনে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র রুবেলের পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হলে ব্লাস্টসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে মামলা করে। এই মামলার রায়ে নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
২০০৪ সালে বিরোধী দলের ডাকা সমাবেশের আগে তিন দিনে ঢাকায় ৭ হাজারের বেশি মানুষকে ডিএমপি অর্ডিন্যান্স ৮৬ ও ১০০ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত চলাফেরা ও আবাসস্থলে অবস্থানের সন্তোষজনক উত্তর না দিতে পারা। এ ধরনের গ্রেপ্তারকে চ্যালেঞ্জ করে দায়েরকৃত জনস্বার্থে মামলায়। হাইকোর্ট বিভাগ কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া এ ধরনের গ্রেপ্তার না
করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন। বর্তমানে ডিএমপি অর্ডিন্যান্সের অধীনে গ্রেপ্তার কমে গেছে।
২০০৫ সালে বাংলাদেশের কারগারে বিচারাধীন মামলায় ১০১৩ জন আসামির সন্ধান পাওয়া যায়। ৫ বছরে একবারের জন্যও তঁাদের আদালতে হাজির করা হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশে তঁাদের আদালতে হাজির করে বিচার শুরু হয়। বাংলাদেশের কারাগারগুলোর বিচারাধীন মামলায় ৮১০ জন বিদেশি বন্দীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। হাইকোর্টের
নির্দেশে তাঁদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
এ ছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গুলিবর্ষণ, গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল উচ্ছেদ ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে জনস্বার্থে মামলা হয়। এসব মামলার রায়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিতে আদালতের নির্দেশনা পাওয়া যায়।
জনস্বার্থ মামলার রায়ে আইনের শাসন আরও জোরদার করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন দেখা যায় না। রায় বাস্তবায়নে অবহেলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে যত্রতত্র নীতিগত সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়। অনেক সময় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অযথা সময়ক্ষেপণ ও কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। দক্ষ জনবল ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাব এর অন্যতম কারণ।
জনস্বার্থ মামলার রায় বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা, দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, নিম্ন আদালতের মামলায় বিচারকদের জনস্বার্থ মামলার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সম্প্রতি
সরকার জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেছে। এটা জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখবে।
জনস্বার্থের মামলায় রায় পাওয়ার পরই বলার সুযোগ নেই সফল হয়েছি। রায়/নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য এর সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। জনস্বার্থের মামলা একটা বটগাছের মতো। খুব ছোট থেকে শুরু হয়। কিন্তু বাড়তে বাড়তে একসময় বটগাছের মতো হয়। খুব ধৈর্যের মানসিকতা নিয়ে জনস্বার্থের মামলার ব্যাপারে কাজ করতে হবে।
জনস্বার্থের মামলার জন্য আমরা উচ্চ আদালতে যাই। এটা যদি নিম্ন আদালতে করা যায়, তাহলে উচ্চ আদালতের ওপর চাপ কমবে। আবার স্থানীয়ভাবে জনস্বার্থের মামলা করে অনেক সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে।
জনস্বার্থের মামলা সব সময় জনকল্যাণে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ, জনস্বার্থের মামলায় দিন শেষে সরকারই উপকৃত হয়। জনস্বার্থের মামলা যাঁরা করেন, তাঁরা নিজের স্বার্থের জন্য করেন না। এর মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। দিন শেষে সরকারেরই কল্যাণ হয়। খুব সাধারণ বিষয়ে জনস্বার্থে মামলা করলে এর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। এ মামলা করতে হলে হাতে পর্যাপ্ত তথ্য থাকতে হবে।
মনজিল মোরসেদ
জনস্বার্থের মামলা ব্যাপকতা লাভ করেছে। এ মামলার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। কিন্তু জনস্বার্থে যেসব মামলা হয়েছে, এর অধিকাংশই বাস্তাবায়িত হয়নি। জনস্বার্থ মামলার অনেক বিষয় আছে। আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য কী অগ্রগতি হয়েছে, সেটা আলোচনায় আসা প্রয়োজন। বিচার বিভাগ আইনের শাসন নিশ্চিত করবে। ষোড়শ সংশোধনী হলো আইনের শাসন নিশ্চিত করার প্রধান হাতিয়ার। বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকলে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারবে। আদালতের রায় না মানলে আদালত অবমাননা হয়। আদালত অবমাননার শাস্তি না হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি সেটা চ্যালেঞ্জে করে মামলা করেছি। আইনটি আগের জায়গায় ফিরে গেছে।
ইদানীং আমাদের সমাজের বড় একটি সমস্যা হলো দুর্নীতি। স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কিন্তু জনগণের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে করা হয়েছিল। এই দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য আইন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমি আদালতে মামলা করেছি। এখন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করতে পারছে।
২০০৬ সালের আগে জনস্বার্থ মামলা খুব বেশি হয়নি, তবে পরে এর ব্যাপকতা অনেক বেড়েছে। আমরা হিউম্যান রাইটস, নারী অধিকার, পুলিশি নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয় মামলা করেছি। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ অনেকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন।
বিচার পাওয়া মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে কোর্ট বন্ধ থাকায় আপনি বিচার পাবেন না। ৬৭ বছর আমাদের এমন ছিল। আমি এটাকে চ্যালেঞ্জে করেছি। আদালতে এখন সিভিল ভ্যাকেশন কোর্ট চালু আছে।
২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর যে সহিংসতা হয়েছিল, এর কোনো বিচার হয়নি। এর ব্যাপারে আদালতে গিয়েছি। ২৭ হাজার মামলা হয়েছিল। রাস্তায় গরুর হাট বসে না, ২৪ ঘণ্টায় বর্জ্য অপসারণ হয় কিসের জন্য? হাজারীবাগের মামলা ১০ বছর পড়ে ছিল। আদালত যখন ট্যানারি ব্যবসায়ীদের প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করলেন, তখন ব্যবসায়ীরা যেতে শুরু করলেন। জনস্বার্থের মামলার জন্যই এসব হয়েছে। জনস্বার্থে অনেক মামলা হয়েছে। অনেক ইতিবাচক রায় হয়েছে। অনেক মামলার রায় হয়নি। শেষ পর্যন্ত মামলার সঙ্গে লেগে না থাকতে পারলে কোনো ফল আসবে না।
আমাদের গোড়ায় যেতে হবে। জনস্বার্থ মামলার উৎস হলো সংবিধান। আমাদের সংবিধানে আছে, জনগণ সব ক্ষমতার উৎস। আইন কে তৈরি করে? জনগণ যাঁদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন, তাঁরা জনপ্রতিনিধি। তাঁরা আইন তৈরি করেন। এসব আইন যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে আমরা আদালতে যাই। আমার শেষ কথা হলো, যত বাধাই আসুক, জনস্বার্থের মামলায় সব সময় লেগে থাকতে হবে। আজ সমাধান হলেও পাঁচ বছর পর পুনরায় সমস্যা হতে পারে।
রাজা দেবাশীষ রায়
২০০৮ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি কমিশনাসহ যাঁরা শাসনব্যবস্থায় ছিলেন, তাঁরা আদালত পরিচালনা করতেন। পরে সারা দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসে। কিন্তু এর জন্য বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) অন্য আইনজীবীদের মামলা করতে হয়েছে। তখন আমি ছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ সহকারী। সে সময় পার্বত্য অঞ্চলে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমার একটা ভূমিকা ছিল।
আরেকবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের আদালতে ব্লাস্টের সঙ্গে একটা মামলা করেছিলাম। এই মামলায় মারমা জনগোষ্ঠীকে হিন্দু আইনের অধীনে আনার বিষয় এসেছিল। হিন্দু আইনের আসলে মারমা নারীরা কোনো সম্পত্তি পান না। এই মামলা জনস্বার্থে মামলা ছিল। বিচারকগণ এই রায় দিয়েছেন যে মারমা জনগোষ্ঠী তাদের প্রচলিত আইন দ্বারা পরিচালিত হবে এবং সম্পত্তি পাবেন।
বেলা, এএলআরডি ও আদিবাসী ফোরাম মিলে পাথর উত্তোলন বিষয়ে মামলা করে। পাথর উত্তোলন নিয়ে হাইকোর্ট একটি ভালো রায় দিয়েছিলেন, কিন্তু এটা কার্যকর হচ্ছে না। আদিবাসী (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী), দলিতসহ সমাজের অনগ্রসর অংশের কথা বলার জন্য জনস্বার্থ মামলা একধরনের সুযোগ করে দিয়েছে। ব্রিটিশের কিছু কট্টর আইন এখনো আছে। যেগুলো মানতে আমরা বাধ্য নয়। কেন ভূমির মামলা অ্যাসিস্ট্যান্ট জজের আদালত থেকে অ্যাপিলেট ডিভিশনে গিয়ে ২৫ বছর পর আবার ফিরে আসবে। পার্বত্য অঞ্চলের মতো ভূমি কমিশন কেন সমতলে হবে না? ভূমির বিরোধের জন্য কেন আমরা বিশেষ আদালত করতে পারব না, যেখানে আপিলের স্তরগুলো কম হবে। পার্বত্য অঞ্চলে এখন পর্যন্ত দেওয়ানি কার্যবিধি নেই। কেন রাষ্ট্রপতির অনুমতিক্রমে হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চ ঢাকার বাইরে আনতে পারব না? সেটা হলে আমাদের নাগরিকদের জন্য ভালো হতো। আদিবাসী (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী), দলিত, চা–শ্রমিকসহ অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য জনস্বার্থের মামলা অত্যন্ত কার্যকর। এ জন্য যেখানে যেখানে সংস্কার করা প্রয়োজন, সেখানে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
সারা দেশে কৃষিজমি অনূর্ধ্ব ২৫ বিঘার একটি সীমা রেখে দিয়ে এ–সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জেলা পর্যায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা যেতে পারে। এর জন্য নতুন এজলাস লাগবে না। যে বিচারিক কর্মকর্তা জেলা পর্যায়ে আছেন, তাঁদের কাছে বিশেষ ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়ে বিশেষ ভূমি ট্রাইব্যুনাল করা যায় বলে মনে করি। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, দুটি ধাপের বেশি যেন আপিলের স্তর না থাকে। বিশেষ সাংবিধানিক ইস্যু থাকলে সেটা উচ্চ আদালতে যেতে পারে। এ ছাড়া যেন জেলা পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়। অনেক জায়গায় বিরোধের জন্য উন্নয়ন হচ্ছে না। এখানে আমাদের কোটি কোটি টাকা বেঁচে যাবে। এখান থেকে পাইলটিং করে যদি আমরা ভালো ফল পাই, তাহলে সমতলের আদিবাসী (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর) মানুষদের একটি দাবি আছে যে সমতলেও যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো ভূমি কমিশন করা হয়। ভালো ফল পেলে কৃষিজমি ছাড়া অন্য ক্ষেত্রেও এটা কার্যকর করা যাবে। জনস্বার্থে মামলার সঙ্গে এটা সম্পূর্ণ মিলে যায়।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
জনস্বার্থে মামলা আইনজীবী, এনজিও ও ব্যক্তিপর্যায়—যে কেউ করতে পারে। মানুষ কোনো বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করে। জনস্বার্থে সরকারের যে কাজ করা উচিত, সেটা না করলে আমরা মামলা করি। এখন দেখা যাচ্ছে বিদেশি অর্থায়নে সরকার যে কাজ করছে, কখনো কখনো সেটাও জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আমরা মামলা করছি। এসব করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়। এ মামলা করতে গিয়ে যারা ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তাদের রক্ষায় হেভিয়াস কর্পাস মামলা করতে হয়।
যারা জনস্বার্থে মামলা করে, তাদের দেখতে হয় পাবলিক স্পিরিট ঠিক আছে কি না। অনেক মামলা করতে হলে যথেষ্ট গবেষণা করতে হয়। এই গবেষণার জন্য বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরাও অর্থায়ন করে। নারী অধিকার, পাহাড় রক্ষা, পাথর উত্তোলন, বন্য প্রাণী রক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, ভূমি অধিকার, শিশু অধিকারসহ অনেক বিষয় নিয়ে মামলা হচ্ছে। আমরা বেলা থেকে একটা মামলা করেছিলাম, যে মামলায় নির্দেশ দেওয়া হলো ট্যানারিকে হাজারীবাগ থেকে ধলেশ্বরীতে সরিয়ে নেওয়া হবে। ওই মামলার পর অনেকগুলো আদেশ হয়েছে। কারণ, ধলেশ্বরীতে গিয়েও ওরা একই কাজ করছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য সংশোধনাগার (সিইটিপি) প্রস্তুত না থাকার জন্য ২০০৯ সালে রায় পাওয়ার পরও আমাদের ২০১৬–১৭ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে। আজ সিইটিপি প্রস্তুত, কিন্তু সেটা চালু হচ্ছে না।
জনস্বার্থে মামলা করতে আমরা সর্বোচ্চ আদালতে যাই। আদালতের ভূমিকায় আমরা খুশি। উচ্চ আদালতই আমাদের শেষ ভরসা। আনোয়ারাতে একটা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হলো অথচ রামপালের বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা যায়নি। জনস্বার্থে মামলা সব সমস্যার সমাধান করে না। একটা আবাসন প্রকল্প, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ থেকে রিভিউ খারিজ হয়েছে। এরপরও সে প্রকল্প বন্ধ হয়নি। এ জন্য সবভাবে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। আর এসব করতে গিয়ে আমাদের হেভিয়াস কর্পাসের মতো অবস্থা হচ্ছে।
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সোনারগাঁয়ের কৃষকদের বাঁচাতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। শুধু মামলা করলেই হবে না। এর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে। জাহাজ ভাঙা নিয়ে রুল হয়েছে। রুলটা হতোই না যদি আমরা একাধারে লেগে না থাকতাম। রুল হওয়ার পর ১৮০ জন মানুষ মারা গেছেন।
জনস্বার্থের একটা কাজ যখন দীর্ঘদিন থেমে থাকে, তখনই আমাদের আদালতে যেতে হয়। কিন্তু আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত অন্যায় যেন না হয়, সে জন্য কাজ করা। এখন তথ্য অধিকার আইন আছে। কিন্তু যখন তথ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যাই, তাদের কাছ থেকে সব সময় সঠিকভাবে তথ্য পাই না। এ নিয়ে আমি আদালতে মামলা করেছি। এ মামলায় যদি আদেশ পাই, তাহলে শুধু পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করে, তারা নয়, অন্য যাদের তথ্যের প্রয়োজন, তাদের সবারই সুবিধা হবে।
কোনো ছোট বিষয় নয়, জনস্বার্থে এমনভাবে মামলা করতে হবে, যেন সারা দেশের জনগণ উপকৃত হয়। শুধু মধুমতির বিরুদ্ধে আমার মামলা করার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল মধুমতির মতো যারাই অন্যায় করছে, তারা সবাই যেন ফিরে আসে। আবাসন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেন একটা সিস্টেম তৈরি হয়। জনস্বার্থে মামলা খুব সংগঠিত হয়ে করতে হবে। সরেজমিনে যাচাই-বাছাই করে করতে হবে। এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেন কোনো কারণে যদি আমি না–ও থাকি, অন্যরা যেন মামলাটি চালিয়ে নিতে পারেন।
অনেক বিষয় নিয়ে আমরা আদালতে যাই। শেষ পর্যন্ত আদালতই ভরসা। আদালত আমাদের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখে।
শামসুল হুদা
আইনের শাসন ও জনস্বার্থে মামলা—এ দুটির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জনস্বার্থে মামলা জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেটা বিভিন্ন সময় জনস্বার্থে মামলার রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিপর্যায়েও জনস্বার্থে মামলা আমরা করতে পারি। সারা দেশে এ পর্যন্ত জনস্বার্থে হয়তো ২০০টি মামলা হয়েছে। আমাদের ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ। এখানে প্রতিদিন কিছু না কিছু আইনের ব্যত্যয় ঘটছে। নারী নির্যাতন, পরিবেশ নষ্ট, নাদীভাঙনে প্রতিকার, জলা দখল, আদিবাসী (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী) মানুষদের উচ্ছেদ, খাসজমি থেকে দরিদ্রদের উচ্ছেদ—এসব বিষয় অসংখ্য মামলা হচ্ছে। খুব অল্পসংখ্যক মামলার কথা আমরা জানতে পারি।
একটা মামলা করার আগে অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়। গবেষণা করতে হয়। তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। আদালত তো কথার ওপর রায় দেবেন না। জনস্বার্থে মামলা তো সরকারের কাজ। সরকার তার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এটা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, সরকার যেসব সংস্থার মাধ্যমে কাজ করবে, তাদের মধ্যে ঝামেলা রয়েছে। একজন ভূমিহীন নারী যখন নির্যাতিত হয়ে আমাদের কাছে আসেন, তখন সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের সেটা জানাতে হয়। তখন হয়তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে। তাঁকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। আসামি ধরা পড়ে। এরপর তদন্ত হলো কি না, চার্জশিট হলো কি না, মামলার প্রতিটি স্তরে লেগে থাকতে হয়। এই লেগে থাকার মানুষের খুব অভাব।
একটা কথা আছে যে ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’। এ জন্য হাজার হাজার মামলার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে কয়েক দশক সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চলেছে। আইন করার জন্য আমরা অনেক দেনদরবার করেছি। তারপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আইন করতে পেরেছি। দেখলাম, শুধু আইনে হচ্ছে না। আমরা আদালতে গেলাম। কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলো। এখন দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আবার আদালতে যেতে হবে। রিজওয়ানা হাসান বলে গেছেন, ন্যায়বিচার পেতে প্রতিটি স্তরে আমাদের লেগে থাকতে হয়।
আইনশৃঙ্খলা দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, তাদের মধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে গাফিলতি লক্ষ করা যায়। এটা দূর করতে না পারলে আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে থাকব।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমরা অনেক অনুষ্ঠান করছি। এসব অনুষ্ঠানের আলোচনায় এসব বিষয় আসা উচিত। আজ হাজার হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। কীভাবে এসব মামলা নিষ্পত্তি হবে, জানি না। একটা মামলা নিষ্পত্তি করতে যদি ২০–৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে একটা–দুটি জেনারেশন শেষ হয়ে যায়। অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তাই আমাদের বিচারব্যবস্থাকে জনমুখী ও জনবান্ধব করতে হবে।
জেলা ভূমি আদালত অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। এটা আমাদের অনেক দিনের দাবি। রাজা দেবাশীষ রায় এটা আলোচনায় এনেছেন। বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। আমরা সরকারকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে চাই। ফৌজদারি ও দেওয়ানি মিলিয়ে জমির মামলাই প্রায় ৮০ শতাংশ। যদি জেলা পর্যায়ে ভূমি আদালত করা যায়, তাহলে উচ্চ আদালতে মামলার চাপ অনেক কমে যাবে। সাধারণ মানুষের বিচারপ্রাপ্তি সহজ হবে।
নিম্ন আদালতে জনস্বার্থের মামলা নেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে যদি কোনো নির্দেশনা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের কল্যাণ হতে পারে। অন্তত কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে নিম্ন আদালতে মামলা করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
আইনের শাসন ও জনস্বার্থে মামলা পরস্পর পরিপূরক। জনস্বার্থ মামলা আইনের শাসনকে জোরদার করে। সভ্যতার ইতিহাস হলো শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের ইতিহাস। আমরা দেখতে পাই, নানা কৌশলে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। আবার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পুঁজির মালিক শক্তিশালী গোষ্ঠী, কালোটাকার মালিক শ্রেণি নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়।
আমরা দেখি, মাঝেমধ্যে বস্তি পুড়ে যায়। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। তাতে কার কী হয়েছে? কিন্তু যদি গুলশানের একটি বাড়িতে ঢিল পড়ত, তাহলে ১০ জন গ্রেপ্তার হতো। এ দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এদের তালিকা বের করে শাস্তি দেওয়া হয় না। আমি মনে করি, আইনের শাসনের পরিপূরক হলো জনস্বার্থের মামলা। জনস্বার্থের মামলা করতে হলে নিজস্ব ভালো যাচাই–বাছাই পদ্ধতি থাকতে হবে। যথেষ্ট তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে মামলা না হলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না।
নিজামুল হক নাসিম
নব্বইয়ের আগের জনস্বার্থে মামলার বিষয়টি আমাদের সামনে আসেনি। সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন একটি জনপ্রিয় শব্দ। শুরুতে এটা তেমন কর্যকর ছিল না। বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে মহিউদ্দিন ফারুকের মামলা থেকে জনস্বার্থে মামলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরে বস্তি উচ্ছেদের নামে মানুষকে ঝড়–বৃষ্টির মধ্যে গৃহহারা করা হয়। বলা হয়, যেসব বস্তিবাসী ওই জায়গায় থাকেন, তঁারা ওই জায়গার মালিক নন। তঁারা দখলকারী। কোনোভাবেই এঁরা এখানে থাকতে পারেন না। মাত্র দু–তিন দিনের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। এর বিরুদ্ধে আমরা মামলা করি। এ মামলাটির নাম ‘বস্তি উচ্ছেদের মামলা’। অনেক দিন পর আমরা রায় পাই। এই রায় জনস্বার্থে মামলায় একটি মাইলফলক তৈরি করে। রায়ে বলা হয়, যথেষ্টে সময় দিয়ে শোকজ না করে কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না। কাউকে উচ্ছেদ করলে তাকে অন্য একটি জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে উচ্ছেদ করতে হবে। এর ফলে বস্তি উচ্ছেদের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় এসেছে। এই মামলায় আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশের সবাই জমির মালিক না। নদীভাঙন, খাদ্যের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে তারা শহরে এসে বাস করছে। দেশের হাজার হাজার ভূমিহীন মানুষ কোথায় যাবে?
আমরা পোশাকশিল্পে আগুন লাগা, গণগ্রেপ্তারসহ আরও কিছু মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষে রায় পেয়েছি। ১৯৯৪/৯৫ সালে জনস্বার্থে মামলা নিয়ে ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে একটি আলোচনা হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি, ভারত ও নেপালের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এসেছিলেন। আমাদের বিচারপতিসহ সবাই মিলে একটি প্রাণবন্ত মামলা হয়েছিল। এ আলোচনা থেকে জনস্বার্থে মামলা সম্পর্কে সবাই একটা ভালো ধারণা পাই। এরপর থেকে জনস্বার্থে মামলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
আজ আমরা খুব আনন্দিত যে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন জনস্বার্থে মামলা করছে। এর মধ্যে রয়েছে, বেলা, ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। শুধু মনজিল মোরসেদের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ থেকেই দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। জনস্বার্থের মামলার মাধ্যমে ঢাকা শহর পরিচ্ছন্ন হচ্ছে। চামড়ার কারখানা ঢাকা শহর থেকে সরে গেছে। বুড়িগঙ্গা নদী ধীরে ধীরে দূষণমুক্ত হচ্ছে। এর ফলে অনেক মানুষে উপকার হয়েছে। সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনস্বার্থ মামলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমি বিশ্বাস করি, আগামী দিনে জনস্বার্থে মামলার মাধ্যমে জনগণ আরও উপকৃত হবে। আইন এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। [বি.দ্র: বক্তব্যটি ভিডিও বার্তা থেকে সংকলিত। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বক্তব্যটি সম্প্রচার করা সম্ভব হয়নি।]
সুলতানা কামাল
আইন, বিচারক, বিচার বিভাগ, বিচারপ্রার্থী—কোনো কিছুই মানুষের জীবন বাদ দিয়ে নয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশকে যেভাবে দেখতে চেয়েছি, বাংলাদেশের মানুষ এ দেশকে যেভাবে দেখতে চেয়েছে, সেই ইচ্ছার প্রতিফলন আছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে, যেটি দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের অংশ। সেখানে বলা আছে, রাষ্ট্র এ দেশের মানুষের জন্য সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা করবে, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে। এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, জনস্বার্থ রক্ষার জন্যই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে। মানুষ যেন আইনের চোখে সমান থাকে, ন্যায়বিচার পায়, রাষ্ট্র সেটা নিশ্চিত করবে।
রাষ্ট্রের কতকগুলো অঙ্গ রয়েছে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে। অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনপ্রণেতারা আইন প্রণয়ন করবেন। ভুক্তভোগীরা যেন বিচার বিভাগ থেকে ন্যায়বিচার পান, নির্বাহী বিভাগ সেটা বাস্তবায়ন করবে। একটা বস্তি উচ্ছেদ হলে হাজার মানুষ গৃহহারা হয়। খোলা আকাশের নিচে বাস করে। এটা দেখে যঁাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, যঁারা এটা নিয়ে গবেষণা করেন, ঘরহারা মানুষের কাছে গিয়ে তাদের কষ্টের কথা শোনেন, তঁারা জনস্বার্থে মামলা করতে পারেন।
প্রত্যেক মানুষের নাগরিক, মানবিক ও সাংবিধানিক দায় রয়েছে। সেটা হলো কোথাও যদি কেউ অধিকারবঞ্চিত হয়, অপমানিত হয়, নির্যাতিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে দেখিয়ে দেওয়া যে এখানে এই অন্যায় হচ্ছে। জনগণের একটি অংশকে তখন এগিয়ে আসতে হয়, এটার প্রতিকার যাতে হয় তার ব্যবস্থার জন্য। জনস্বার্থ মামলা তারই অংশমাত্র।
আজকের আয়োজনের প্রত্যেক আলোচক তঁাদের দিক থেকে অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে জনস্বার্থে মামলার বিষয়টি আলোচনা করেছেন। যেখানে সুষ্ঠু গণতন্ত্র থাকে না, সেখানে জনস্বার্থে মামলা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এটা নিয়ে যঁারা কাজ করেন, তঁাদের অনেক ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়।
জনস্বার্থ মামলা জেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আমি মনে করি, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা যদি কোনো জায়গায় বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
আইনের শাসন জোরদার করার জন্য জনস্বার্থ মামলার গুরুত্ব নিয়ে আজ অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হলো। আলোচনা থেকে অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা এসেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সুপারিশ
জনস্বার্থ মামলার রায় বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা, দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
জনস্বার্থের মামলা জনকল্যাণে। এ মামলায় দিন শেষে সরকারই উপকৃত হয়। কোনো ব্যক্তিস্বার্থে এ মামলা
হয় না।জনস্বার্থ মামলার রায় বাস্তবায়নে অবহেলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে যত্রতত্র নীতিগত সিদ্ধান্তের বদল হয়। এ অবস্থা পরিবর্তনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
জনস্বার্থ মামলার রায়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অযথা সময়ক্ষেপণ ও কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অমনোযোগিতা দেখা যায়। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
জনস্বার্থ মামলায় সব সময় লেগে থাকতে হয়। কারণ আজকে সমাধান হলেও পঁাচ বছর পর পুনরায় সমস্যা হতে পারে। তাই লেগে না থাকলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
জনস্বার্থের মামলা নিয়ে আমরা উচ্চ আদালতে যাই। তবে কিছু বিষয় বিষয় নিয়ে যদি নিম্ন আদালতে যাওয়া যেত, তাহলে উচ্চ আদালতের ওপর চাপ কমবে এবং স্থানীয়ভাবে অনেক জনস্বার্থ মামলার সমাধান হবে।
জেলা ভূমি আদালত অত্যন্ত জরুরি। এটা আমাদের অনেক দিনের দাবি। মামলার জট ও উচ্চ আদালতের চাপ কমাতে এটা ভূমিকা রাখবে। এ বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে।
জনস্বার্থের মামলা সংগঠিত হয়ে যাচাই-বাছাই করে করতে হবে। এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেন কারও অনুপস্থিতিতেও মামলাটি চলমান থাকে।
শুধু সংবাদমাধ্যমের ওপর ভিত্তি না করে সরেজমিনে যথাযথ তথ্যানুসন্ধান করে জনস্বার্থে মামলা করা প্রয়োজন।