নারীর পক্ষে শুরু হোক জাগরণ 

‘নারীর এগিয়ে চলা: বাধা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ ও প্রথম আলো

পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নারীর সমতা প্রতিষ্ঠায় পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নারীর পক্ষে পরিবর্তনে জাগরণ সৃষ্টিতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। একই ভাবে মনোযোগ দিতে হবে অন্য লিঙ্গ পরিচয়ের (জেন্ডার) মানুষের প্রতিও। পরিবর্তনের জন্য দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লড়াই শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই।

গতকাল মঙ্গলবার বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এমন অভিমত উঠে আসে।

‘নারীর এগিয়ে চলা: বাধা ও উত্তরণের উপায়’ শিরোনামে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে ‘নারীর এগিয়ে চলা’ প্রকল্পের একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে এর কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। প্রকল্পটি ২০২২ সালে রাজধানীর কালশী, জামালপুর সদর, পিরোজপুরের কাউখালী, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে শুরু হয়।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নারীপক্ষের সভানেত্রী গীতা দাস। তিনি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, নারীর স্বাস্থ্য, নারীর ওপর সহিংসতা রোধে তৃণমূল পর্যায়ে জবাবদিহি, নারীর স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ও জনগণের যৌথ উদ্যোগ জানা এবং সবক্ষেত্রে সরকারি সেবার তথ্য প্রচারের মাধ্যমে নারীবান্ধব সেবা প্রচার করা এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। 

বৈঠকে সরকারের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক বলেন, দশকের পর দশক লড়াই করেও দেশে নারীর জন্য খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করা যায়নি। কারণ, নারীর প্রতি একধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা মানুষের মস্তিষ্কে গ্রোথিত রয়েছে। এই মজ্জাগত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। নারীর পক্ষে জাগরণ ও পরিবর্তনের জন্য মনোযোগ দিতে হবে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা নারী শিক্ষার্থীরা কেন ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেল, সেটা নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানা দরকার।

শিরীন হক জানান, কমিশনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমতার জন্য তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ করবে কমিশন।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য লিঙ্গ (সেক্স) ও লিঙ্গ পরিচয় (জেন্ডার) নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতে হবে। পরিবার থেকেই ভিন্ন চিন্তাভাবনা শুরু হলে পরিবর্তন সম্ভব হবে। নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ও মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মাধ্যমে। পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে ও পরিবারে। পরিবর্তনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। এক পক্ষের সঙ্গে আরেক পক্ষের আলোচনা হতে হবে।

পারিবারিক নির্যাতন, ধর্ষণ, উত্ত্যক্তকরণ ও পাচারের মতো নির্যাতনের কথা তুলে ধরে আইন প্রয়োগের ওপর জোর দেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী। তিনি বলেন, পারিবারিক নির্যাতনকে সমস্যা হিসেবে শনাক্ত করে সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন প্রয়োগের জন্য মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরকে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে এবং জনবল নিয়োগ করতে হবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য হালিদা হানুম আখতার নারীর স্বাস্থ্যে নজর দেওয়ার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে কিশোরীদের লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন কার্যক্রম নিতে হবে। 

নারীকে ‘কর্মঠ’ মেয়ে হিসেবে চিত্রিত করার আহ্বান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, নারীর বিরুদ্ধে কোনো প্রচারে চুপ থাকা যাবে না। তিনি নির্বাচনে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ মনোনয়ন নারীদের দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পদক্ষেপ নেওয়া এবং কর্মক্ষেত্র থেকে নারীর ঝরে পড়া বন্ধে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের আহ্বান জানান।

উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ডব্লিউডিডিএফ) চেয়ারম্যান শিরীন আক্তার বলেন, প্রতিবন্ধী নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি নেই। বিচারপ্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত ঘাটতি থাকার কারণে নির্যাতনের শিকার হলেও বিচার পান না প্রতিবন্ধী নারীরা।

নারীপক্ষের নির্বাহী সদস্য তাসনীম আজীম বলেন, নারীর শরীর নিয়ে নারী যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটা ক্ষমতায়নের একটি প্রক্রিয়া।

বেসরকারি সংগঠন বহ্নিশিখার ব্যবস্থাপনা অংশীদার তাসাফ্ফী হোসেন বলেন, নারীদের পোশাক, রাতে চলাফেরা নিয়ে আগের চেয়ে নারীবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ আরও বেড়েছে। জেন্ডার সমতা বলতে গেলে শুধু নারীর বিষয় আসে না, এখানে ট্রান্সলিঙ্গ, আন্তলিঙ্গের অধিকারের বিষয়ও তুলে ধরা উচিত।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার, সাংবাদিক রীতা ভৌমিক, জামালপুরের টিএমকেএসের নির্বাহী পরিচালক শামিমা খান, তরুণ দলনেতা সুনামগঞ্জের মালবিকা আজিম, পিরোজপুরের শারমিন সুলতানা, জামালপুরের খুরশেদ জাহান খুশবু প্রমুখ।

গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।