গোলটেবিল বৈঠক
ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতা প্রতিষ্ঠা জরুরি
‘সামাজিক পরিচয় নির্বিশেষে সকল নারীর ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক বৈঠকটি হয় প্রথম আলো কার্যালয়ে।
সমতার পথে সবার প্রয়োজন এক নয়। তাই ন্যায্যতাভিত্তিক সমতা প্রতিষ্ঠায় যার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু নিশ্চিত করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের আলোচনায় পুরুষতন্ত্রের পাশাপাশি অপর অসমতার বিষয়গুলোকেও সামনে আনতে হবে। ক্ষমতায়ন ও সমতা প্রতিষ্ঠার যাত্রায় সব প্রান্তের নারী, অন্য লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ের মানুষ ও সংবেদনশীল পুরুষদের এক কণ্ঠে সোচ্চার হতে হবে। গতকাল বুধবার সকালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নাগরিক উদ্যোগ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
‘সামাজিক পরিচয় নির্বিশেষে সকল নারীর ক্ষমতায়ন’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে অধ্যাপক ও অধিকারকর্মী আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ কীভাবে হবে, সে আলোচনা এখন করা দরকার। এখন সেই আলোচনার সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। কারণ, এই সময়ে দুঃখজনক হলেও ‘বৈষম্যবাদী’ মতাদর্শেরও উত্থান ঘটেছে। তিনি বলেন, নারী–পুরুষের বাইরে অন্য লিঙ্গ–পরিচয়ের মানুষ যে রয়েছে, তা এত দিন আলোচনার বাইরে ছিল। শ্রেণিগত বৈষম্যের কারণে মানুষ স্বৈরতন্ত্রের ব্যাপকতা দেখেছে। বৈচিত্র্য ও বৈষম্যের যে পার্থক্য আছে, সেটাও আলোচনায় আনা উচিত। আমাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং বৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হবে।’
নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য সুমাইয়া ইসলাম বলেন, নারীসহ অন্য লিঙ্গ–পরিচয়ের মানুষকে হাল ছেড়ে না দিয়ে শক্ত হাতে সমতার জন্য লড়াই করতে হবে। নিজের অধিকারের পাশাপাশি অন্যের অধিকারের কথাও বলতে হবে। কমিশন জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা ও সীমাবদ্ধতাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এগোচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিউএফ) সভাপতি ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য কল্পনা আক্তার বলেন, সমতার অধিকার চাওয়াকে সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে ধরতে হবে। একজন অপরজনের কথা না বললে সমস্যার সমাধান হবে না। বৈষম্যের প্রথা ভাঙতে হবে ঘর থেকেই। ক্ষমতায়নের বীজ বপন করতে হবে পরিবার থেকে।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, পুরুষতন্ত্র, ধর্মীয় বাড়াবাড়ি, বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈচিত্র্যকে অগ্রাহ্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আধিপত্যসহ অন্যান্য বৈষম্য ও নিপীড়ন সৃষ্টিকারী বিষয়গুলোকে একসঙ্গে মোকাবিলা করেই নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। যার প্রান্তিকতা যত বেশি, তার জন্য ক্ষমতায়নের চ্যালেঞ্জও বেশি। তিনি আরও বলেন, পরস্পরের প্রতি মমতা না থাকলে সমতা দূরেই রয়ে যাবে। পুরুষও পুরুষতন্ত্রের শিকার। তাই পুরুষকেও দাঁড়াতে হবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে।
প্রাগ্রসরের প্রতিষ্ঠাতা ও মানবাধিকারকর্মী ফওজিয়া খোন্দকার ইভা বলেন, সমতা নির্ভর করে ন্যায্যতার ওপর। আগে সমতার আন্দোলনে সব নারীর জন্য একই কৌশল নেওয়া হয়েছিল। এখন সময় এসেছে যার যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু নিশ্চিত করার। ন্যায্যতার সঙ্গে চাহিদা বা প্রয়োজন নিশ্চিত করতে হবে।
জেন্ডার সমতায় নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন। তিনি বলেন, সামাজিক বিভিন্ন প্রথায় পুরুষতন্ত্রের প্রতিফলন দেখা যায়, নারীর নেতৃত্ব বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বৈষম্য নিরসন করতে হলে নারীর নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় কমিটিগুলোতে নারীর জন্য ৩৩ শতাংশ স্থান রাখার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি।
দলিত নারী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনি রানী দাস তাঁর সম্প্রদায়ে নারীর প্রতি বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘সেখানে পঞ্চায়েত কমিটির ভোটে নারীরা ভোট দিতে পারে না। পুরুষেরা চায় না, সালিসে নারীরা তাদের পাশে বসে বিচারকার্যে অংশ নিক।’
রূপান্তরিত নারী আভা মুসকান তিথি বলেন, রূপান্তরিত নারীরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নয়, তাদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। তাদের মানবাধিকার উপেক্ষিত হচ্ছে। তাদের প্রতি মানুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা সমাজের প্রচলিত গভীর বৈষম্যের ফল।
সাপোর্টিং পিপল অ্যান্ড রিবিল্ডিং কমিউনিটির জেন্ডার ও ইন্টারসেকশনালিটি (আন্তসংযুক্ততা) বিভাগের লিড ডালিয়া চাকমা বলেন, মূলধারায় পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সবার প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। প্রতিনিধিত্ব না থাকার ফলে বাদ পড়ে যাওয়া জাতিগোষ্ঠীগুলোর পরিচয় সংকট তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর পাহাড়ে স্থিতিশীলতা আনতে সেখানকার মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
চা–শ্রমিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি তামান্না সিং বারইক বলেন, কম মজুরি ও পরিবেশ চা–বাগানে এখনো সংকট তৈরি করছে। চা–বাগানের নারীরা কম মজুরির কারণে পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতায় ভুগছেন। সারা দিন দাঁড়িয়ে কাজ করেন, কিন্তু চা–বাগানে শ্রমিকদের জন্য শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক সাইমি ওয়াদুদ, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, উইমেন আই ২৪–এর সাংবাদিক রীতা ভৌমিক, দৈনিক ইত্তেফাক–এর প্রতিবেদক রাবেয়া বেবী, কল্যাণময়ী নারী সংঘের সভাপতি রিনা আক্তার, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রভাত টুডু, উর্দুভাষী কমিউনিটির প্রতিনিধি কাজল রেখা এবং গ্রিন বাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি সুলতানা বেগম।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।