গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব

দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় রামরু ও রাজনীতি চর্চা কেন্দ্রের আয়োজনে ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩ সেপ্টেম্বর। আলোচকদের বক্তব্যের সারমর্ম এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় রামরু ও রাজনীতি চর্চা কেন্দ্র আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ছবি: প্রথম আলো

অংশগ্রহণকারী

 অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

অধ্যাপক নিজাম আহমেদ

সাবেক অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী

চেয়ারম্যান, সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ এবং সাবেক মহাহিসাবনিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক

ড. তোফায়েল আহমেদ

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ

অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন

অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. মোহাম্মদ রাশেদ আলম ভূঁইয়া

সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হারুন রশিদ

পিএচডি গবেষক ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, ক্যান্ট স্টেট ইউনিভারসিটি

মোহাম্মদ জাকারিয়া

প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, দি এশিয়া ফাউন্ডেশন

সঞ্চালনা:

ফিরোজ চৌধুরী,

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

 অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে যাওয়ার চেষ্টা ও চেতনা সবার মধ্যে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু মূল সমস্যাটা রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারের কোন মন্ত্রণালয় কীভাবে নিচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দায়িত্বের জায়গা থেকে রাজনৈতিক সংস্কারে কিছু প্রস্তাব রাখছি।

প্রথমত, আমাদের ৫৩ বছরের ইতিহাসে রাজনৈতিক কাঠামো অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। পাঁচ দশকে আমরা ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করেছি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বাধীনতার দীর্ঘ আড়াই শ বছরের ইতিহাসে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো একবারও পরিবর্তন হয়নি। তাদের ১৪ পৃষ্ঠার পুরোনো সংবিধানও খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তাই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় করার পথ খুঁজে বের করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণে ও প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সংসদের দুটি কক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে অনেক দেশ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের দিকে যাচ্ছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে।

তৃতীয়ত, ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বাদশ সংসদে এসে দাঁড়ায় ৬৭ শতাংশে। গত ১৫ বছররে দেশের ব্যাংকিং খাত, পোশাকশিল্প, বিদ্যুৎ, ঋণখেলাপির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যবসায়ীরা নীতিকাঠামো ঠিক করছেন। ফলে জাতীয় স্বার্থ ও জনকল্যাণের প্রশ্নে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট দেখা দিয়েছে। তাই ব্যবসায়ীদের আধিপত্য কমিয়ে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের অবস্থান নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রয়োজন। এর একটি হবে জনপ্রতিনিধিদের জন্য। অপর কক্ষে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব পেশার প্রতিনিধি থাকবে। সংবিধান পরিবর্তনে দুটি কক্ষের অনুমোদন লাগবে।

চতুর্থত, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ১৯৭২-৭৩ সালের প্রেক্ষাপটে যুক্তিসংগত ও সময়োপযোগী ছিল। সে সময় নারীরা তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিল। নারীদের নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সামাজিক প্রেক্ষাপটও ছিল না। কিন্তু ২০২৪ সালের ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। নারী কোটার বিরুদ্ধেও তাঁদের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল। উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রজন্মের নারীরা অনেক বেশি আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। নাগরিক হিসেবে নারীরা নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করা ও নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী প্রার্থী বাছাইয়ে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে।

পঞ্চমত, স্থানীয় পর্যায়ে সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয়  সরকারব্যবস্থা প্রণয়ন করা যেতে পারে। বড় ভুখণ্ডের দেশগুলোয় ফেডারেল সরকার দেখা যায়। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ছোট হলেও জনসংখ্যায় অনেক বড় দেশ, প্রায় ১৭ কোটি। নেপালকে আমরা ফেডারেল শাসনব্যবস্থার সুফল পেতে দেখেছি। ২০১৫ সালের সংবিধানে নেপাল ফেডারেল শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে ফেডারেল শাসনব্যবস্থার কারণে ছোট গোষ্ঠীগুলোর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকারের কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেছে। ফলে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতার সংখ্যা কমে এসেছে।

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী

চেয়ারম্যান, সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ এবং

সাবেক মহাহিসাবনিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক

আমাদের বর্তমান সংবিধানে স্বৈরাচারী হওয়ার অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। ১৯৭২–এর সংবিধানেও তা ছিল। পরবর্তী সময়ে সংশোধনীগুলোর মাধ্যমে এ ধরনের আরও কিছু উপাদান যুক্ত করা হয়েছে। নব্বইয়ের অভ্যুত্থান ছিল রাজনৈতিক দলের। ১৯৯০ সালে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবার সেটা হতে দেওয়া যাবে না। এবারের অভ্যুত্থান ছাত্র–জনতার। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে আসা সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

অনেকগুলো বিষয় সংস্কারের প্রয়োজন হলেও সর্বপ্রথম সংবিধান সংস্কার করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংশোধন করতে পারে কি না, তার বৈধতা আছে কি না—এ বিষয়ে যাওয়া অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অনেকটা সাংঘর্ষিক। সংবিধান জনগণের জন্য। সরকার জনকল্যাণের জন্য। তাই ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র আওতায় সংবিধান সংশোধনে যাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে:

প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারকে পৃথক করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করবে না। কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসন পৃথক হবে।

দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক আইন, পুলিশ অ্যাক্ট ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে এনফোর্সিং অথরিটি হিসেবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে পুলিশকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হয়। স্বাধীন দেশে জনবান্ধব পুলিশ কমিশন তৈরি করতে ব্রিটিশ আমলের আইন সংশোধন করতে হবে।

তৃতীয়ত, প্রসিকিউশন সার্ভিস বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারে নিযুক্ত সরকারি আইনি পক্ষসমূহ স্বাধীন করা প্রয়োজন। দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনকে সাংবিধানিক সংস্থায় রূপান্তর করা যেতে পারে। তথ্য কমিশনকে গণমাধ্যমের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

চতুর্থত, সংখ্যানুপাতিক জনপ্রতিনিধিপদ্ধতি প্রচলন করা প্রয়োজন। সংসদে দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী আসন পাবে। এর ফলে ছোট দলগুলোও সংসদে আসন পাবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ রাখা যাবে না।

পঞ্চমত, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটির আইনটি দুর্বল। এখানে সার্চ কমিটিতে বিভিন্ন অংশীজন যুক্ত করতে হবে।

ষষ্ঠত, স্থানীয় সরকারে কাউন্সিলর নির্বাচন হবে। কাউন্সিলররা পালাক্রমে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচন করবেন। কাউন্সিলররা অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারবেন। এতে চেয়ারম্যান বা মেয়রের একনায়কতন্ত্র কমে যাবে। ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হবে।

এ ছাড়া সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলো যতটা সম্ভব শর্তহীন করা দরকার। বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন ও সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে আনা, সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে করা যাবে না। এটাকে সংবিধানের প্রভিশনে নিয়ে আসতে হবে। না হলে পরবর্তী সময়ে যে কেউ এসে পরিবর্তন করে ফেলবে।

নতুন সাংবিধানিক কাঠামো লাগবে। তাহলেই এই গণ–অভ্যুত্থান টেকসই হবে। সংস্কার ছাড়া এক দল থেকে আরেক দলে ক্ষমতা গেলে জনমানুষের আশার প্রতিফলন হবে না।

অধ্যাপক নিজাম আহমেদ

সাবেক অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের (নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ) মধ্যে ভারসাম্যের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষমতার স্বতন্ত্রিকীকরণ নীতি স্বীকৃত। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিমাত্রায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে, যা রাষ্ট্রশাসনের সংকটের মূল কারণ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

অনেকে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। বাস্তবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। পৃথিবীর যেসব দেশে ‘টুইন-হেডেড এক্সিকিউটিভ সিস্টেম’ আছে, সেসব দেশে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন।

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি সংশোধন করা দরকার। বর্তমানে প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থা সংশোধন করে সমানুপাতিক ব্যবস্থা চালু করা দরকার। সমানুপাতিক ব্যবস্থায় কোনো দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সুযোগ সীমিত। এ ব্যবস্থায় বিরোধী দলের উপস্থিতি নিশ্চিতের ফলে গঠিত সংসদ অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে থাকে। বিরোধীদের শাসনপ্রক্রিয়ায় অংশীদার করার জন্য সংসদের বিভিন্ন কমিটিতে সংখ্যানুপাতে সভাপতি ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা ভারসাম্যহীন অবস্থা বিরাজমান। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত ব্যক্তিরাই বিচার বিভাগে নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। যদিও সংবিধানে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শের একটা বিধান আছে। বিচার বিভাগে অতিমাত্রায় দলীয়করণের কারণে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছু করার সুযোগ নেই।

বর্তমানে প্রচলিত বিচারক নিয়োগ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে একটি কমিটির মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভারতে  রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার উপস্থিতি থাকে। বিচারক নিয়োগ কমিটি প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। বিচারপতি অপসারণের ক্ষেত্রে বর্তমান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল থাকতে পারে।

ড. তোফায়েল আহমেদ

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা। এতে তাদের নির্বাচন করার একটা অভিজ্ঞতা হবে। তবে তার আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ঠিক নেই; কেন্দ্রীয় সরকারই এখানে স্থানীয় সরকার হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারের বর্তমান কাঠামোয় নির্বাচিত সদস্যের নির্বাচনের তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। আর সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও জনগণেরও কোনো আগ্রহ থাকে না। নতুন কাঠামোতে সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ করতে হবে।

মেয়রদের স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন সব ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। মেয়র ভালো কাজ না করলে তাকে বদলানোর সুযোগ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাকে পরিষদ ছেড়ে চলে যেতে হবে না। কেবল আরেকজন ব্যক্তি মেয়রের দায়িত্ব নেবেন। এটা একটা গুণগত পরিবর্তন।

উপজেলা পরিষদ কার্যকারিতা হারিয়েছে। কারণ, সংসদ সদস্যের নির্দেশ ছাড়া উপজেলা পরিষদ কাজ করতে পারে না। এখানে সংস্কার করতে হবে।

জেলা পরিষদ শুধু ত্রাণ কিংবা অনুদান বণ্টনের জন্য নয়। জেলা পরিষদই স্বাধীনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারি কর্মচারীরা কেবল তাদের সাহায্য করবেন। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্যের কোনো কর্তৃত্ব রাখার প্রয়োজন নেই। সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্ব থাকবে শুধু সংসদে। লোকাল গভর্নমেন্ট রেগুলেটরি অ্যাক্টের মাধ্যমে এসব করে নিতে হবে।

ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠাগুলোকে একই আইনের মধ্যে নিয়ে আসা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। আমাদের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হচ্ছে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে। সেখানে পরিবর্তন এনে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

দেশে কোনো সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাঁচ বছরব্যাপী স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলতেই থাকে। তাই এ নির্বাচনব্যবস্থাকে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন, যেন সরকার গঠনের ছয় মাসের মধ্যেই সব স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ

অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী একাধারে সরকারপ্রধান এবং সংসদীয় ও রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ভারসাম্যহীন। রাষ্ট্রপতির সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। রাষ্ট্রপতি সাধারণত দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। ফলে সাংবিধানিক সব পদেই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে বিচারক নিয়োগসহ আরও কিছু সাংবিধানিক পদে স্বাধীনভাবে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হোক।

গণতান্ত্রিক শাসনপ্রক্রিয়া কার্যকর ও শক্তিশালী করতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সংস্কার অপরিহার্য। তাত্ত্বিক দষ্টিকোণ থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন ঠিকই কিন্তু তার মযার্দা অন্য মন্ত্রীদের সমান হয়। কিন্তু সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যেসব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রকৃতপক্ষে ‘প্রধানমন্ত্রীশাসিত’ সরকার কার্যকর রয়েছে। সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়েছে যে ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবে।’  মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গৃহীত হয় না, এখানে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী অনুসরণ করে আমাদের সংবিধানেও প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা মন্ত্রিসভার অন্যদের সমপর্যায়ে নিয়ে আসা হোক। এ ক্ষেত্রে ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করা যেতে পারে।

ব্যক্তিগতভাবে কোনো মন্ত্রী নৈতিক স্খলনের অপরাধে অপরাধী হলে তাঁকে অবশ্যই সংসদে জবাবদিহি করতে হবে। তাই যেকোনো মন্ত্রীর ব্যক্তিগত জবাবদিহির বিষয়টিও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিত করবেন—বাংলাদেশের সংবিধানেও এ ধরনের বিধান রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে সংসদ সদস্যদের এই ক্ষমতা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তিনি তাঁর পদ হারাবেন। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দল ও সংসদীয় দলের একচ্ছত্র নেতা বিধায় সংসদ সদস্যরা সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করেন না। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা এভাবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য হন। তাই ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন জরুরি।

‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ, মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, ড. তোফায়েল আহমেদ, ড. মোহাম্মদ রাশেদ আলম ভূঁইয়া ও অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন। এছাড়া অনলাইনে যুক্ত হন অধ্যাপক নিজাম আহমেদ, অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী ও হারুন রশিদ।

অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে থাকে। ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ আইনি ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করেছে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধারক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব খাটানোর পথ সহজ করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কারচুপিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই বাংলাদেশে নিবার্চনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের বিকল্প নেই।

এ ছাড়া স্বাধীন নির্বাচন কমিশনার প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ অ্যাক্ট-২০২২ পরিবর্তন করে সার্চ কমিটিতে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতাকে অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। এ প্রক্রিয়ায় সিভিল সোসাইটির মতামত দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনকে জেলা প্রশাসনের অধীনে না রেখে একটি ডি ফ্যাক্টো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হিসেবে কাজ করতে হবে।

২০২৩ সালে নির্বাচনী আইন ও বিধি পরিবর্তন করে নির্বাচন কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ভোটের দিনের আগে কোনো প্রার্থীর মৃত্যুর ঘটনা ব্যতীত সমগ্র নির্বাচনী এলাকার ভোট বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে না। শুধু কিছু ভোটকেন্দ্রের ভোট স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে। এ আইন বাতিল করে কমিশনকে শক্তিশালী করা দরকার। নির্বাচন কমিশনের জন্য নিজস্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন।

বর্তমান আইনে জাতীয় নির্বাচনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ প্রার্থী এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করেন। অর্থভিত্তিক রাজনীতি ও নির্বাচন বন্ধ করার জন্য বিধি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য ‘বেস্ট ইলেকটোরাল প্র্যাকটিস অ্যাওয়ার্ড’ চালু করা দরকার।

স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্ট তদারকি করা জরুরি। নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট সব ধরনের সহিসংতা, হত্যা ও হয়রানি রোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ভোট গণনার ‘ফটো কুইক কাউন্ট’ করা দরকার। যেন প্রয়োজনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা এ রেকর্ড নিরীক্ষণ করতে পারে।

অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন

অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সরকারের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমাদের সংবিধানে সরকারের এ তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। জাতীয় সংসদকে শক্তিশালী করতে কিছু সংস্কার প্রয়োজন।

প্রথমত, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন করে অর্থ বিল ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সদস্যদের ভোটদানের স্বাধীনতা প্রদান করা দরকার।

দ্বিতীয়ত, সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান বাতিল করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণ আসনে নির্দিষ্টসংখ্যক নারী প্রার্থী মনোনয়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। একইভাবে দলের সাধারণ সম্পাদককে সরকারের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।

চতুর্থত, বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা সহজ সংখ্যাধিক্য পদ্ধতি এবং আনুপাতিক পদ্ধতির সংমিশ্রণে সংসদ সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংসদের মোট আসন থাকবে ৪০০টি। এর মধ্যে ৩০০ জন সদস্য বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন এবং বাকি ১০০ জন সদস্য ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ পদ্ধতিতে দলীয় প্রার্থী তালিকা থেকে নির্বাচিত হবেন। একজন ভোটার দুটি ভোট প্রদান করবেন—একটি ব্যালটে পছন্দের প্রার্থীকে এবং অপর একটি ব্যালটে পছন্দের রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবেন। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে দলগুলো আসন পাবে। এর ফলে সংসদে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ বাড়বে, অন্যদিকে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একক আধিপত্য কমে আসবে।

পঞ্চমত, নাগরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য সংসদীয় কমিটির বৈঠকে গণশুনানির বিধান করা যেতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রকে সুষ্ঠুভাবে বিকশিত করতে চাইলে নির্বাচন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা ও সংসদীয় রীতি-পদ্ধতি যুগোপযোগী করার বিকল্প নেই।

ড. মোহাম্মদ রাশেদ আলম ভূঁইয়া

সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে ছায়া মন্ত্রিসভা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। ছায়া মন্ত্রিসভার মূল লক্ষ্য দেশ পরিচালনায় দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সংসদে বিরোধী দলের মুখপাত্রদের একটি গ্রুপ নিয়ে গঠিত হবে, যারা বিরোধী দলের নেতার নেতৃত্বে, সরকারের বিকল্প মন্ত্রিসভা হিসেবে কাজ করবে এবং একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মুখপাত্র হিসেবে প্রতিপক্ষকে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ করার জন্য নিযুক্ত হবে। বর্তমানে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, নিউজিল্যান্ড, জাপান, মালয়েশিয়াসহ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছায়া মন্ত্রিসভা কার্যকর রয়েছে।

ছায়া মন্ত্রিসভা সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ড যাচাই-বাছাইয়ের পাশাপাশি বিকল্প নীতি প্রস্তাব করে থাকে। এ ছাড়া সরকারি দলের উপস্থাপিত বাজেটের বিপরীতে ছায়া মন্ত্রিসভা বিরোধী দলের অবস্থান থেকে বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করবে। এভাবে বিরোধী দল নিজেকে কার্যকর বিকল্প সরকার-ইন-ওয়েটিং হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৫-৭৬ নম্বর অনুচ্ছেদে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিসংক্রান্ত ধারাতে বিরোধী দলের ভূমিকা ও ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের নীতিগত সন্নিবেশ দরকার। ছায়া মন্ত্রীদের প্রয়োজনীয় জনবল ও গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দ করা খুবই জরুরি।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে করা যেতে পারে। এর ফলে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ওপর প্রধানমন্ত্রী একচ্ছত্র প্রভাব খাটাতে পারবেন না। প্রতি আসনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের পাশাপাশি আরেকটি ব্যালট পেপারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সুযোগ রাখা দরকার। রাষ্ট্রপতি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যেমন প্রধান বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় নিরপেক্ষতার সঙ্গে নিয়োগ দিতে পারবেন। ফলে এ সংস্থাগুলো আগের তুলনায় অধিকতরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।

বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যক্তির মতপ্রকাশ, চিন্তার স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও বিশৃঙ্খলা মোকাবিলার অজুহাতে অনেকগুলো দমন, নিপীড়নমূলক আইন ও সংস্থা তৈরি করা হয়েছে। এ আইন ও সংস্থাগুলো দিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। তাই মানুষের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বাধা দেওয়া আইন ও সংস্থা বাতিল করতে হবে।

হারুন রশিদ

পিএচডি গবেষক ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, ক্যান্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার জন্য একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন গঠনতন্ত্র থাকা দরকার। বাংলাদেশে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের সংবিধানেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব রয়েছে, যা তাদের মাঠের রাজনীতিতেও প্রতীয়মান। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় গঠনতন্ত্রে সাধারণ সদস্যদের অধিকার–সংক্রান্ত কোনো বিধান নেই। অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টিসহ অনেক রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে এ ধরনের বিধান আছে। গঠনতন্ত্রে অবশ্যই দলের সম্মেলন আয়োজনের সময়সীমা ও পদ্ধতি যথাযথভাবে উল্লেখ থাকা জরুরি। একটি রাজনৈতিক দলে বিভিন্ন কারণে সদস্য বা স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব হতে পারে। এসব নিরসনে দলীয় গঠনতন্ত্রে যথাযথ বিধান থাকা উচিত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলীয় প্রধানসহ নেতা নির্বাচনের জন্য ভোট কার্যত অনুপস্থিত। প্রার্থী মনোনয়ন, নির্বাচন ও দলের কার্যনির্বাহী কমিটির ভোটদানসহ গণতান্ত্রিক নিয়োগপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছ বিধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রধান দুটি দলের গঠনতন্ত্রে তাদের নেতা নির্বাচনে গোপন ব্যালট পদ্ধতির কোনো বিধান অন্তর্ভুক্ত করেনি। এ ছাড়া দুটি প্রধান দলে দলীয় প্রধানের মেয়াদকাল দেওয়া থাকলেও পুনর্নির্বাচন নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। বিএনপিতে দলীয় প্রধানকে প্রয়োজনে পদ থেকে অপসারণের সুযোগ থাকলেও তা খুবই অস্পষ্ট ও প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া আওয়ামী লীগে দলীয় প্রধানকে প্রয়োজনে পদ থেকে অপসারণের কোনো বিধান নেই। উভয় দলেই দলের ভেতরে পদপ্রত্যাশীদের মনোনয়ন–সংক্রান্ত কোনো বিধান নেই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে দলীয় প্রধান ও সাধারণ সম্পাদক পদাধিকারবলে নেতা হয়ে যান। একটি আদর্শ দলীয় গঠনতন্ত্র নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতে দলের সদস্যদের যুক্ত করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গঠনতন্ত্রে সাধারণ সদস্যদের ইশতেহার তৈরিতে অংশগ্রহণে যুক্ত হওয়ার কোনো বিধান নেই। আওয়ামী লীগ একটি সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নেয়। আর বিএনপিতে এ–সংক্রান্ত কোনো বিধানই নেই।

মোহাম্মদ জাকারিয়া

প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, দি এশিয়া ফাউন্ডেশন

আজকের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় এসেছে। আশা করা যায়, নীতিনির্ধারকেরা তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

এ বছর এশিয়া ফাউন্ডেশনের ৭০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশন শুরু থেকেই সুশাসন, আইনের শাসন, নির্বাচন ও বিচারের অধিগম্যতা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে।

আমরা নাগরিক সমাজ, এনজিওর সঙ্গে কাজ করি। গণমাধ্যম আমাদের রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। স্বাধীন গণমাধ্যম মানুষের মত প্রকাশের সুযোগ করে দেয়, মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করে। গত দুই দশকে বেশির ভাগ গণমাধ্যম মানুষের কণ্ঠস্বর, দুর্নীতি ও অনিয়ম তুলে ধরার বদলে কোনো নির্দিষ্ট মতের প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক মুনাফা লাভের মাধ্যম হিসেবেও কাজ করেছে। এখন সময় এসেছে, মানুষ কথা বলতে পারে—এমন গণমাধ্যম নিশ্চিত করার। সব গণমাধ্যমকর্মীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আলোচনাও হওয়া দরকার।

সুপারিশ

*        এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী হতে হলে দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।

*        দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ পদ্ধতি প্রবর্তন করে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

*        প্রদেশভিত্তিক ফেডারেল সরকারব্যবস্থা প্রণয়ন করা দরকার।

*        সংরক্ষিত নারী আসনের পরিবর্তে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী তালিকায় ৩৩ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে।

*        সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সদস্যদের ভোটদানের স্বাধীনতা প্রদান করা দরকার।

*        সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

*        বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে ছায়া মন্ত্রিসভা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

*       প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার।

*        স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচনের বিধান বাতিল করে, কমিশনারদের পরোক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচনের পদ্ধতি প্রণয়ন করা জরুরি।