সংবিধান সংস্কারে জোর দিতে হবে

‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের অভিমত।

প্রকৃত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক সংস্কার দরকার। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও গণতান্ত্রিক চর্চা দরকার। গতকাল মঙ্গলবার ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের আলোচনায় এমন অভিমত উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে বক্তারা কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরেন। এগুলোর মধ্যে আছে এক ব্যক্তি যাতে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা, সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি চালু করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা করা, সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।

দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন, রামরু ও রাজনীতি চর্চা কেন্দ্র যৌথভাবে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো মিলনায়তনে ওই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এই গোলটেবিল বৈঠকের প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

গোলটেবিল আলোচনায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে সূচনা বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, যে নতুন সময় ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা সবাইকে ভাবাচ্ছে। একটি নতুন বন্দোবস্তের দিকে যাওয়ার চেষ্টা ও চেতনা কাজ করছে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক জায়গায় সংস্কারে জোরালোভাবে কাজ শুরু করেছে। কিন্তু মূল সমস্যা রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ কে কীভাবে নিচ্ছেন, এসব জায়গায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দায়িত্ব রয়েছে।

তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, সংবিধানে দ্রুত পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান সরকার সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে, নাকি তার জন্য কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি (গণপরিষদ) প্রয়োজন, তা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করা যাবে। তিনি বলেন, সংবিধানকে দুষ্পরিবর্তনীয় করতে দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করা যেতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালু করা যায় কি না, সেটাও ভাবতে হবে। তিনি সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনব্যবস্থা তুলে দিয়ে দলগুলো যেন ৩৩ শতাংশ নারী মনোনয়ন দেয়, সে ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন।

সামাজিক চুক্তি করা যেতে পারে

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি চালু হলে সংসদের কাছে সরকারের জবাবদিহির সম্ভাবনা অনেক বাড়বে বলে মনে করেন সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। তিনি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বপদ্ধতি প্রচলন করা, কেউ দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন বিধান করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা, সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলো যতটা সম্ভব শর্তহীন করা, রাজনৈতিক দলের জন্য আইন করা, বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন ও সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে আনা, সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন।

এসব সংস্কার কে করবে, এমন প্রশ্ন রেখে মুসলিম চৌধুরী বলেন, অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা যায় না। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সামাজিক চুক্তি করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারগুলোর বিষয়ে কাগজে লিখে সব দলের সই নেওয়া যেতে পারে যে তারা এগুলোর বাস্তবায়ন করবে। অবশ্য নির্বাচিত হওয়ার পর কোনো দল সেটা না–ও করতে পারে। আবার দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তখনো এটা আটকে যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে তিনি গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব দেন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি জোরালো সমর্থন পাচ্ছে। এখন ৮৭টি দেশ এই পদ্ধতির চর্চা করছে। তিনি বলেন, আসলে এখন দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রীয় সরকারই স্থানীয় সরকার হয়ে গেছে। তিনি মনে করেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় শুধু সদস্য ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হওয়া উচিত। তাঁরা মিলে একজনকে স্পিকার বা চেয়ারম্যান ঠিক করবেন।

তিন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য দরকার

অনলাইনে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, সংকটের কারণ রাষ্ট্রের তিন বিভাগের (আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। নির্বাহী বিভাগ বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা দিন দিন বেড়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। তবে বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা কঠিন। নির্বাহী বিভাগ আর সংসদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একই সঙ্গে সংসদে কার্যকর বিরোধী দল দরকার। তিনি মনে করেন, দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন বিধান করা হলে পরিবারতন্ত্র নিরুৎসাহিত হবে।

সংসদবিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দীন আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ করে ফেলা হচ্ছে কি না, সেটাও দেখতে হবে।

তাদের সঙ্গে আলোচনা দরকার। তাদের বাদ দিয়ে কিছু করলে সুফল আসার সম্ভাবনা কম। সরকার যত দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে, তত ভালো। সরকার একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলে আরও আলোচনার সুযোগ থাকবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন বলেন, ব্রিটেনেও সংসদীয় ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেখানে শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা কাজ করে, বাংলাদেশে যেটা নেই। এখানে প্রধানমন্ত্রী যা চান, সংসদে তা–ই হয়। দেশের সংসদে সংসদীয় কমিটি, প্রশ্নোত্তর পর্ব ইত্যাদি কাগজে–কলমে শক্তিশালী, বাস্তবে নয়। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি হয় না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সংস্কার দরকার। তিনি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া, নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা, নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার, বিচার বিভাগ হস্তক্ষেপমুক্ত করা, একই ব্যক্তি যাতে একই সঙ্গে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে না পারেন, সে বিধান করার প্রস্তাব দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, সংবিধানে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে প্রধানমন্ত্রীর কিছু ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া যায়।

অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশেদ আলম ভূঁইয়া, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি প্রার্থী হারুন–অর–রশীদ মাহাদী বক্তব্য দেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মোহাম্মদ জাকারিয়া। গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।