প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কর্মসংস্থান: সমস্যা ও সমাধানের পথ
আইএলও বাংলাদেশ ও ইউএনপিআরপিডির সহায়তায় বিবিডিএন ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কর্মসংস্থান: সমস্যা ও সমাধানের পথ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। আলোচকদের বক্তব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
মনসুর আহমেদ চৌধুরী
ট্রাস্টি, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন)
পিটার বেলেন
চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বাংলাদেশ
সালমা মাহবুব
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)
ড. মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন
নির্বাহী পরিচালক, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)
মির্জা নুরুল গণি শোভন
সভাপতি, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব)
ফারজানা শারমিন
যুগ্ম সচিব, বিকেএমইএ
খোন্দকার সোহেল রানা
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর, সাইটসেভার্স বাংলাদেশ
নাজমা আরা বেগম পপি
ন্যাশনাল প্রজেক্ট সাপোর্ট অফিসার্স, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ
প্রিয়তা ত্রিপুরা
প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, উইম্যান উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডাব্লিউডিডিএফ)
মো. জাহিদুল কবির
লিড, ডিসঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক
আজিজা আহমেদ
হেড অব অপরেশন্স, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন)
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
মনসুর আহমেদ চৌধুরী
ট্রাস্টি, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন)
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি কমিশন করার উদ্যোগ নিয়েছে। অন্তত চারটি কমিশনের কাছে আমাদের সুপারিশ করতে হবে। প্রথমত, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার–সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবন্ধীদের নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী প্রত্যেকের জন্য সুবিধাজনক উপায়ে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সংবিধান সংস্কার–সংক্রান্ত একটি কমিটি করা হয়েছে। এ কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে সুপারিশ করতে হবে। এটি শুধু সুরক্ষিত নয়, আইনে লেখা আছে, এর সঙ্গে যদি অন্য কোনো আইন সাংঘর্ষিক হয়, তবে সে আইনটি বাতিল হবে। ২০১৩ সালের আইনে প্রতিবন্ধী নারীদের কথা বলা হয়নি। ২০০৮ সালে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী অধিকার সনদের সর্বশেষ অ্যাডহক কমিটির মিটিংয়ে আমি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করি। সেখানে আমরা নারী প্রতিবন্ধী ও শিশু প্রতিবন্ধীদের পৃথক দুটি ধারা সংযোজনের দাবি জানিয়েছিলাম। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে অনেক বিতর্কের পর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদে এ দুটি ধারাই সংযোজিত হয়েছিল। সুতরাং, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে এই জায়গাগুলোতে আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রশাসনিক সংস্কার–সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছেও আমাদের কিছু সুপারিশ করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের চাকরি নিশ্চিতের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে হবে। সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা কিন্তু সরকার নিজেই। আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, সেখানে কেন আমাদের প্রতিবন্ধী ভাইবোনেরা চাকরি পাবে না। প্রাথমিকের শিক্ষক হওয়ার অধিকার ও যোগ্যতা থাকার পরও তারা কেন চাকরি পায় না? আমি পাইনি, ৫০ বছর আগে সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারিনি। আমাকে একটি মাত্র কারণে চাকরি দেওয়া হয়নি, তা হচ্ছে আমি চোখে দেখি না, আমি নাকি শ্রেণিকক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এটাই হচ্ছে একটা অজুহাত। অথচ আমি সেই সুদূর নরওয়ের থমসন ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। অথচ আমি নিজের দেশে সে সুযোগ পাইনি।
আর চতুর্থত, বিচারব্যবস্থা সংস্কারে যে কমিশন হয়েছে, সেখানেও আমাদের নজর দিতে হবে, সুপারিশ দিতে হবে। যাতে করে এভিডেন্স অ্যাক্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় ক্ষেত্রে বাক্প্রতিবন্ধী মানুষের বক্তব্য, ফরিয়াদ যেন আদালতের বিচারক গ্রহণ করতে আইনগতভাবে বাধ্য হন। তাদের সাক্ষী হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে আদালতে ইশারা ভাষার প্রচলন করতে হবে।
পিটার বেলেন
চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বাংলাদেশ
আইএলওর ম্যান্ডেট হলো সামাজিক ন্যায়বিচারকে এগিয়ে নেওয়া, যার মাধ্যমে সর্বজনীন ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে অবদান রাখা। সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি। সম্প্রতি আইএলও একটি বৈশ্বিক জোট গঠন করেছে সামাজিক ন্যায়বিচারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এই জোটের মূলনীতিগুলো বাংলাদেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, যার মধ্যে অন্যতম হলো কারিগরি দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের জন্য ন্যায়সংগত সুযোগ তৈরি করা। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং এরপর কর্মক্ষেত্রে সংহত হওয়া প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য একটি মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকার। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। শুধু চাকরি প্রদান করাই যথেষ্ট নয়; কর্মস্থানে তাদের ধরে রাখতে হলে সেগুলোকে তাদের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী অভিযোজিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ এখনো রয়েছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে এবং কিছু সুযোগ তাদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষণ করা উচিত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি প্রদানকে বোঝা হিসেবে দেখা উচিত নয়; বরং তাদের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তারা অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে আসে এবং ইতিবাচক করপোরেট ভাবমূর্তি গঠনে ভূমিকা রাখে। দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে, তাদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ সুবিধা ও অবকাঠামো আয়োজনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। পাশাপাশি নিয়মিতভাবে এসব বিধানের স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক পৃথক ডেটা তৈরি করা অত্যাবশ্যক। এ ধরনের ডেটা ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়বদ্ধ রাখা কঠিন হবে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য অনেক চমৎকার নীতি রয়েছে। এখন কাজ হলো এসব নীতির বাস্তবায়ন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উভয়ের মধ্যে দায়বদ্ধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দায়বদ্ধতা ছাড়া সবচেয়ে ভালো নীতিও সফল হতে পারে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ইস্যুগুলো মূলধারার মনোযোগ পায় না। অনেক চমৎকার উদ্যোগ রয়েছে, যা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।
বৈশ্বিকভাবে অনেক বড় ও সুপরিচিত কোম্পানি রয়েছে, যাদের বিস্তৃত বাজার রয়েছে। এসব কোম্পানি তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করবে। এটি আইএলওর গার্মেন্টস সেক্টরে কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে, তারা তাদের সম্পদ ও প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পাবে। তাদের অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে; শুধু কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা আমাদের আবিষ্কার করতে হবে।
আইএলও কর্মসংস্থান সহায়তা সেবা নিয়ে কাজ করছে, যাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংযুক্তির সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি আইএলও কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে লিঙ্গসমতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ওপর কাজ করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এসব সংলাপ থেকে নতুন ধারণা ও উদ্ভাবন উদ্ভাসিত হবে।
আজিজা আহমেদ
হেড অব অপরেশন্স, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন)
আজকের গোলটেবিল বৈঠকে আমরা এখানে একত্র হয়েছি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে, যা শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবিকা নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের বৃহত্তর লক্ষ্যকে প্রভাবিত করে। এ বৈঠক আইএলও- ইউএনপিআরপিডি প্রকল্পের অংশ।
ইউএনপিআরপিডি (জাতিসংঘের প্রতিবন্ধীদের অধিকারবিষয়ক অংশীদারত্ব) একটি অনন্য প্রকল্প, যেখানে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সরকার এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলো (ওপিডি) একসঙ্গে কাজ করছে, যার লক্ষ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা। ইউএনপিআরপিডি জাতীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সহায়তা প্রদান করে, যাতে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক কনভেনশন (সিআরপিডি) কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়।
আজকের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা এবং বিদ্যমান সুযোগ ও সম্ভাব্য সমাধানগুলো নিয়ে আলোচনা করা।
বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে—উভয় দিক থেকে। সমাজের সব স্তরে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান আলোচনা চলছে। আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো আমাদের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করি। আমরা মনে করছি, এর ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব।
আমরা জানি, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে, ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল, তবে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং অন্য অংশীদারদের সঙ্গে অর্থবহ সম্পৃক্ততার অভাবে এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আগামী দিনেও যেন এ ধরনের সমস্যা না হয়।
সম্প্রতি প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, শারমিন মুরশিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে কিছু সুপারিশ পেশ করেছে, যা পরিবর্তনের একটি রোডম্যাপ প্রদান করে। এ ধরনের পদক্ষেপগুলো তখনই কার্যকর হবে, যদি আমরা সবাই—সরকার, সুশীল সমাজ, বেসরকারি খাত এবং উন্নয়ন সহযোগীরা একসঙ্গে কাজ করি।
আজকের আলোচনায় আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলব, তার মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূলধারার দক্ষতা উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, কাজের ক্ষেত্রে স্থানান্তর, কর্মস্থলে অন্তর্ভুক্তি ও স্থায়িত্ব এবং অর্জিত দক্ষতা ও কর্মসংস্থানকে সহায়তার জন্য সামগ্রিক প্রবেশগম্যতা। সেই সঙ্গে আমরা সরকারের ভূমিকা এবং জাতীয় নীতি ও আন্তর্জাতিক মানগুলোর ওপরও গুরুত্বারোপ করব। আমরা কীভাবে প্রতিবন্ধী নারীদের সহায়তা করতে পারি, অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি এবং বাস্তব ও টেকসই পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অংশীদারত্বগুলোকে শক্তিশালী করতে পারি—সে বিষয়েও আলোচনা করব।
সালমা মাহবুব
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)
আমরা দেখেছি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো, সেখানে বৈচিত্র্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কোনো প্রতিনিধিত্ব দেখতে না পাওয়াটা দুঃখজনক।
একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তারা রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে কাজ করার কথা বলছে। সে জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে আমরা তাদের একটি রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করেছি যাতে তা একটি রূপরেখা হিসেবে কাজ করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়গুলো আমরা এখনো মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি। সেখানে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে যেসব বিষয়ে আলাপ–আলোচনা করে থাকি, তার মধ্য থেকে ১৬টি পয়েন্টের সুপারিশ সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার কাছে পেশ করেছি। অন্তর্বর্তী সরকার দুটি পদ্ধতিতে কাজ করতে পারে। প্রথমত, তাৎক্ষণিকভাবে কী করা যায় এবং দ্বিতীয়ত, স্বল্পমধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে করা যেতে পারে, এমন কিছু খাতভিত্তিক সুপারিশ।
তাৎক্ষণিকভাবে করা যেতে পারে এমন কিছুর ক্ষেত্রে আমরা উপদেষ্টামণ্ডলীতে প্রতিবন্ধীদের একজন প্রতিনিধিকে যুক্ত করার কথা জানিয়েছি। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত একজন সহযোগী হিসেবে যেন নেওয়া হয়। আমরা অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী অধিদপ্তর সচল করার আহ্বান জানিয়েছি।
প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতির ব্যাপারে কিছু সুপারিশ করেছি। এ ক্ষেত্রে নবম থেকে দ্বাদশ গ্রেড পর্যন্ত ২ শতাংশ এবং ১৩তম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত ৫ শতাংশ রাখার সুপারিশ করেছি। এ ছাড়া প্রতিবন্ধিতার মাত্রাভেদে আমরা ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা মাসিক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করার কথা বলেছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ফোকাল পয়েন্ট বা মুখপাত্র রাখার সুপারিশ করেছি। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা কার্যক্রম সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসার কথা বলেছি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবহনে ভাড়া রেয়াতের প্রস্তাব করেছি। সংবিধান সংশোধনের কথা চলছে। আমরা সংসদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কোটা রাখার কথা বলেছি। এ ছাড়া রাষ্ট্রের সব অংশীজন সভায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
আইন, নীতি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র সবই আমাদের আছে। কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিকঠাক তথ্য আমরা পাচ্ছি না। প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোয় প্রবেশগম্যতা ও উপযুক্ত শৌচাগারের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা অনুযায়ী কাজের ধরন ও সুযোগের বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবও রয়েছে। এসব বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
ড. মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন
নির্বাহী পরিচালক, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে অবশ্যই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়েই এগোতে হবে। পুনর্বাসনের পর তাঁদের কাজের ব্যবস্থা না করা হলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। পুনর্বাসনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁদের স্বনির্ভর করা। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পড়াশোনা করলেন, পুনর্বাসিত হলেন, দক্ষতা অর্জন করলেন, কিন্তু তিনি যদি কর্মক্ষম না হন, তাহলে প্রকৃত অর্থে তিনি পুনর্বাসিত হন না। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের চাহিদা বিবেচনায় পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ একান্ত প্রয়োজন।
পুনর্বাসনের পেছনে কাজ করেন রিহ্যাবিলিটেশন পেশাজীবীরা। কিন্তু এখনো সরকারি খাতে তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়নি। কেবল কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই মানুষগুলোকে পুনর্বাসন করে, তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। সরকারি খাতে হেলথ টিম, রিহ্যাবিলিটেশন টিমের সঙ্গে থেরাপিস্টদের যদি সংযুক্ত করা হয়—ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্টসহ তাঁদের সমমর্যাদা দেওয়া হয়, তাহলে পুনর্বাসিত হয়ে একটা পর্যায়ে তাঁরা সমাজে যেতে পারবেন।
প্রতিবন্ধী মানুষের দক্ষতা উন্নয়নে কারিগরি প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি এসব প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। পার্টনারদের সহযোগিতায় আমরা বিনা মূল্যে বাংলাদেশ টেকনিক্যাল বোর্ডের অধীন এসব প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিলিং অ্যান্ড লিংকিং কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৫০০ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এখন পোশাক খাতে কাজ করছেন। আত্মকর্মসংস্থানের বিষয়টিও বেশ জরুরি। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবছর ১০০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তাঁদের বাসস্থান বা আশেপাশে গিয়ে কিছু করছেন। আমরা তাঁদের কিছু সিড মানি দিই, তাঁরা সেটা কাজে লাগান। শপ কিপিং, পোলট্রি, টেইলারিং অ্যান্ড ড্রেস মেকিং, মোবাইল সার্ভিসিং, বেসিক ইলেকট্রনিকস ট্রেনিং, লাইভ স্টকসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।
বিবিডিএন ও আমরা যৌথভাবে জব ফেয়ার আয়োজন করেছি। এ ছাড়া আমরা জব সিলেকশন প্রোগ্রাম করি, যেটাও খুব উপকারে আসে। আগামী সপ্তাহে আমাদের একটি জব সিলেকশন প্রোগ্রাম রয়েছে, যেখানে পোশাক খাতের ৪০টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নির্বাচন করবে কারা কারা চাকরি করবেন। সুতরাং চাকরির সুযোগ তৈরি করে দেওয়া এবং আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত পুনর্বাসন বলে আমরা মনে করি। আমাদের প্রশিক্ষণগুলোকে সফল করার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হচ্ছে আবাসন। ভ্রমণ করে এসে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা তাঁদের জন্য কষ্টসাধ্য। পাশাপাশি তাঁদের যেন এসব প্রশিক্ষণ পেতে কোনো অর্থ খরচ না হয়, সেটিও লক্ষ রাখতে হবে।
মির্জা নুরুল গণি শোভন
সভাপতি, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব)
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা যাঁরা কাজ করছি, তাঁদের একে অপরের কাজের পরিধি সম্পর্কে জানা জরুরি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা কত, কোন বিষয়ে তাঁর দক্ষতা আছে, তা নিয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কেবল চাকরি নয়, তাঁরা উদ্যোক্তা হতে পারেন। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিটিবির সহযোগিতায় উদ্যোক্তাদের জন্যও কারিকুলাম করা হয়েছে। এগুলো পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করে তঁাদের ইন্ডাস্ট্রিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে সুযোগ করে দিলে তাঁরা শিখতে পারবেন।
যেহেতু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলো বিভিন্নমুখী, সেহেতু সেখানে একেক জনের একেক ধরনের বিশেষায়িত কাজ করতে পারার সুযোগ থাকে। এখন এসব কাজ শিখে ভালো একজন উদ্যোক্তা হওয়ার পর তারা নিজেরা যখন প্রয়োগ করতে যায়, সেখানে আমাদের অনেকগুলো সমস্যা আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন রিফাইন্যান্সিং স্কিম আছে ১৩টি। এর অধিকাংশই এসএমই-সংক্রান্ত। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটা বিশেষ স্কিম চালু করা, তহবিল গঠন করার বিষয়টি বোঝাতে পারি। একজন উদ্যোক্তার সফল হওয়ার প্রথম কাজটিই হচ্ছে আর্থিক সহায়তা পাওয়া। যেহেতু তাদের সবাইকে চাকরি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোনো প্রণোদনা দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ডেস্ক বা সেল করার ব্যবস্থা করা গেলে সেখানে কাজের পরিধি বাড়বে। সরকারিভাবে বিসিকের পাশাপাশি বেসরকারি খাত বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ–তেও এ ধরনের কার্যক্রম থাকা প্রয়োজন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে, অচিরেই দেশ চালাবে রাজনৈতিক সরকারই। সুতরাং রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে জাতীয়ভাবে একটা অঙ্গীকার আদায়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
ফারজানা শারমিন
যুগ্ম সচিব, বিকেএমইএ
পেশাজীবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাসা থেকে কারখানা বা অফিসে আসতে হয়। প্রতিবন্ধীবান্ধব যানবাহনব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। তাহলে তাঁকে কে কারখানায় নিয়ে আসবেন?
দক্ষতা উন্নয়নে আমাদের যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমগুলো আছে, সেখানে আমরা প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি। ১১ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের সবাইকে হয়তো আমরা প্রশিক্ষণে আনতে পারছি না। এখনো ব্রেইল সিস্টেমের মডিউল আমরা তৈরি করতে পারিনি।
কর্মস্থলে এখনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা অনুযায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। আবার কিছু ইন্ডাস্ট্রি আছে, যারা প্রতিবন্ধীবান্ধব সুন্দর শৌচাগারের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু পরিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে এ ব্যক্তিদের আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে ধরে রাখতে পারছি না।
জিআইজেডের অর্থায়নে সিডিডি এবং সিআরপি একটা জব ইনক্লুশন প্রোগ্রাম করেছিল। উপযুক্ত ডেটাবেজ না থাকায় বিকেএমইএ থেকে আমরা পর্যাপ্ত দক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পাই নি। সিডিডির সে অনুষ্ঠানে আমরা একটা ডেটাবেজের নকশাও দিয়ে এসেছিলাম। এতে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে জেলা এবং জেলা থেকে সেন্টারে ডেটা ব্যবস্থাপনা কী রকম হবে এবং প্রধান সার্ভার তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, তা ছিল। ইন্ডাস্ট্রির মানুষ কীভাবে সেখানে সংযুক্ত হবেন এবং কর্ম-বেকারত্বের বিষয়গুলো ব্যবস্থাপনা করবেন, সে সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়েছিল।
ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে সবাই কেবল অপারেটর তৈরি করতে চায়। অপারেটর কেবল একটি পদ। আরও অনেকগুলো পদ ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। কারও হয়তো এমন প্রতিবন্ধকতা আছে যে তাঁর পক্ষে অপারেটর হওয়া সম্ভব নয়। তখন তিনি অন্য কাজ করতে পারবেন। ফ্যাক্টরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আবাসন সুবিধার মতো কোনো সুবিধা দেওয়া যায় কি না, তা ভাবতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো যখন সরকারের কাছে ভবনের নকশা জমা দেয়, তখনই তা প্রতিবন্ধীবান্ধব কি না, যাচাই করতে হবে।
খোন্দকার সোহেল রানা
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর, সাইটসেভার্স বাংলাদেশ
আমরা, সাইটসেভার্স, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করি। আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব থাকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে একত্রে কাজ করা। এ ক্ষেত্রে যাদেরকে আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অংশীজন বলছি, তারাও কি বিষয়টিকে সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন? না দেওয়ার কারণ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে যেকোনো কাজে একটি মন্ত্রণালয়ে কিংবা অধিদপ্তরে গেলে সেখান থেকে অন্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়; কিন্তু কেন? কারণ, এখানে সমন্বয়ের অভাব। যেমন ধরুন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, সেটিও সমাজকল্যাণে; অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এই সমস্যা নিরসনে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বারবার বলতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে আশা করি কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে। সময় লাগবে, তবে পরিবর্তন আসবে। এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী।
প্রতিবন্ধীবিষয়ক জাতীয় কর্ম পরিকল্পনার তৃতীয় থেকে দশম অধ্যায়ে কর্মসংস্থান এবং এ সম্পর্কিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, প্রবেশগম্যতা, ন্যায়বিচার, অধিকারসহ নানান বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্ম পরিকল্পনার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সম্পৃক্ততা রয়েছে; কিন্তু যখনই প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে কোনো মন্ত্রণালয়ে যাওয়া হয়, তখন আমাদেরকে শুধুই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পথ দেখানো হয়। এসব কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের অধিকার নিয়ে আমরা যারা কাজ করছি, তাদের মধ্য হতাশ হওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়।
বর্তমানে দেশে যে সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান, আমরা আশা করি এ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, সুরক্ষা ও তাদের কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
নাজমা আরা বেগম পপি
ন্যাশনাল প্রজেক্ট সাপোর্ট অফিসার্স, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ
প্রতিবন্ধী নারীদের চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সেটি আরও বেশি। একজন প্রতিবন্ধী নারী আইনগতভাবে যে অধিকারগুলো পাওয়ার কথা, সেগুলো এখনো অনুপস্থিত। প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ২০১৩–এ নারীদের জন্য আলাদা কিছুই বলা নেই। একটি গবেষণা অনুসারে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে আইন বা রক্ষা কবজগুলো আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে নারীদের বিষয় খুবই নগণ্য পরিমাণে এসেছে।
কর্মসংস্থানের ঘাটতি থাকলেও কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষেরা কাজ করছেন। বেসরকারি খাতগুলোতে প্রতিবন্ধী নারীদের অংশগ্রহণ তেমন নেই। এর একটি বড় কারণ হলো, তারা এই সুযোগের বিষয়ে জানতে পারেন না। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের চেয়ে দক্ষতা, কর্মক্ষমতা কম– এই কথা বলে বেসরকারি খাতগুলো প্রতিবন্ধীদের নিতেও চায় না।
এমন অসংখ্য প্রতিবন্ধী মানুষ আছেন, যাঁরা স্নাতকোত্তর শেষ করেও চাকরি পাচ্ছেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁর জন্য বিষয়টি অনেক বেশি হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একজন সাধারণ, সুস্থ মানুষ অন্তত শারীরিক শ্রম কিংবা এমন কিছু একটা করে পেট চালাতে পারেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সেটিও সম্ভব হয় না।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ের যেকোনো কাজে তাদের সংগঠনগুলোকে যুক্ত করতে হবে। কারণ, তাদের কী দরকার, কীভাবে হলে ভালো হয়, সেটা তারাই ভালো জানবে। প্রতিবন্ধীদের সংগঠনগুলোকে যুক্ত করা না গেলে প্রকল্প যত বড়ই হোক না কেন, ফলপ্রসূ করা যাবে না।
প্রিয়তা ত্রিপুরা
প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, উইম্যান উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডাব্লিউডিডিএফ)
প্রতিবন্ধী নারীরা উদ্যোক্তা হওয়ার পথে দুই ধরনের বাধার শিকার হন। প্রথমত, তিনি নারী, দ্বিতীয়ত, তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তাঁদের দক্ষতাবিহীন ধরেই কাজ শুরু করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা তাঁদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে বেতের ঝুড়ি কিংবা অন্যান্য হাতের কাজ নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
প্রতিবন্ধী নারীদের আগ্রহের জায়গাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। যেমন অনেক প্রতিবন্ধী নারী আছেন, যাঁরা বিউটি পারলারে কাজ করতে ইচ্ছুক। তাঁদের সে দক্ষতাও আছে।
সে ক্ষেত্রে তাঁকে যদি আমরা পোশাক খাতে কাজ দিই, তাহলে ফলপ্রসূ হবে না। সুতরাং তাঁদের দক্ষতার দিকটি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় আর্থিক বিষয়টি তাঁদের হাতে থাকে না। দেখা যায় পরিবারের অন্য কেউ একজন এটির দেখভাল করেন। অর্থাৎ নিজেদের অর্থের দিকটিও নিজেদের হাতে থাকে না। স্বল্প ও বৃহৎ পরিসরে প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধী নারীদের স্থিতিশীল করতে আরও কাজ করতে পারেন। প্রশিক্ষণের বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে হবে।
মো. জাহিদুল কবির
লিড, ডিসঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক
একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে যখন আমরা অন্তর্ভুক্তির মধ্যে নিয়ে আসতে চাই, তখন তাঁর কোথায় কোথায় বাধা আছে, আমরা সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের সমাজের অনেকের ধারণা যে একটা র্যাম্প করে দিলেই বোধ হয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদা পূরণ হয়ে যাচ্ছে! বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১১ ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ আছেন। প্রতিটি ধরনের মধ্যে আবার মাত্রাভেদে ভিন্নতা রয়েছে। প্রতিবন্ধী পুরুষ ও প্রতিবন্ধী নারীর অভিজ্ঞতা এক নয়, আবার যাঁরা শহরে বেড়ে উঠেছেন আর যাঁরা গ্রামে বেড়ে উঠেছেন, তাঁদের প্রতিবন্ধকতাও ভিন্ন। সুতরাং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তাঁদের বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব এখনো খুবই কম, অনেক ক্ষেত্রে তা শূন্যের কোঠায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইনে প্রতিটি পর্যায়ে কমিটি করার কথা আছে, কিন্তু যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের রাখা হয় না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় যে কমিটি, সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব কীভাবে অপ্রতিবন্ধী মানুষ করে! প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব জরুরি।
কোনো কোটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়, ওটা হচ্ছে একটা সাময়িক সমাধান। প্রতিবন্ধী মানুষ এখনো অনেক বেশি বেকার, সুতরাং তাঁদের জন্য কোটা কেন ৫ শতাংশ বা তার বেশি হবে না? পাঁচ/দশ বছর পর যখন প্রতিবন্ধী মানুষ অনেকেই সরকারি চাকরিতে চলে আসবেন, তখন আবার সেটা কমানো যেতে পারে।