অসচেতনতা ও দ্রুত শনাক্ত না হওয়ায় যক্ষ্মা এখনো দেশের বড় স্বাস্থ্যসমস্যা। দেশে দিনে গড়ে ১ হাজার ৩৮ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন। গড়ে ১৩ জনের যক্ষ্মা ওষুধ প্রতিরোধক। পর্যাপ্ত ওষুধ সেবন না করা, অসম্পূর্ণ চিকিৎসা, ভুল ওষুধ সেবনের কারণে যক্ষ্মায় আক্রান্ত এসব ব্যক্তির দেহে ওষুধ কাজ করে না। দিনে গড়ে ১১৫ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যাচ্ছেন। অথচ শুরুতে ধরা পড়লে এবং নিয়ম মেনে চিকিৎসা নিলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রোগ ভালো হয়। আজ ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার স্টপটিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস: যক্ষ্মা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বেসরকারি অংশীদারত্ব’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বক্তারা জানান, সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মার সংক্রমণ রয়েছে এমন ৩০টি দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে যক্ষ্মা নির্মূলে উন্নয়ন সহযোগীরা তহবিল দেয়। তবে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হলে এই তহবিল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে দেশের বেসরকারি সংস্থা এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে যক্ষ্মা নির্মূলে এগিয়ে আসতে হবে। যক্ষ্মা নির্মূলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বৈঠকে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, কোভিডে সবার একসঙ্গে কাজ করার চর্চা রয়েছে। কোভিডের মতো যক্ষ্মা নির্মূলে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। যক্ষ্মার সঙ্গে বসবাস করার একধরনের অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে। এই আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ‘যক্ষ্মায় দিনে এক হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হন। কোভিড ও ডেঙ্গুতেও দিনে যত বেশি শনাক্ত হয়, তার চেয়েও এ হার বেশি। যাঁর কাশি হয়েছে, তিনি মাস্ক পরে যক্ষ্মা ছড়ানো প্রতিরোধ করতে পারেন।’
আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের (আইডিডি) প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী সায়েরা বানু বলেন, যক্ষ্মায় আক্রান্ত সব রোগীকে শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়নি। যক্ষ্মা যে এখনো একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা, অনেকে সেটিই জানেন না। যক্ষ্মা নির্মূলে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যক্ষ্মা ফুসফুস ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গে হয়। সীমিত সম্পদের মধ্যে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় করে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) লাইন পরিচালক মো. মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, যক্ষ্মা শনাক্তে সারা দেশে ৬২২টি অত্যাধুনিক জিনএক্সপার্ট পরীক্ষাযন্ত্র রয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা ও নতুন করে আক্রান্তের হার ৮০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার।
উন্নয়ন সহযোগী ইউএসএআইডির সংক্রামক রোগ (আইডি) বিভাগের টিম লিডার সামিনা চৌধুরী বলেন, যক্ষ্মা নির্মূলে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের করণীয় সম্পর্কে জানাতে হবে। যক্ষ্মার বিরুদ্ধে ভয় দেখিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অপরাধবোধ না ঢুকিয়ে তরুণদের সম্পৃক্ত করে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
বৈঠকে আইসিডিডিআরবির পক্ষে যক্ষ্মা পরিস্থিতি নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির সহকারী বিজ্ঞানী শাহরিয়ার আহমেদ। প্রবন্ধে বলা হয়, বৈশ্বিক জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ টিউবারকিউলোসিস ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত। ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি ও থুথু থেকে রোগের জীবাণু বাতাসে মিশে সংক্রমণ ছড়ায়। বাংলাদেশে ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় ভুগছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৫২ শতাংশ, নারী ৪০ শতাংশ এবং শিশু ৮ শতাংশ।
প্রবন্ধে বলা হয়, বেসরকারি লাভজনক সংস্থাগুলো নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সরকারের তহবিল, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, নজরদারি ব্যবস্থা ইত্যাদি নীতিনির্ধারণী বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে। এ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, চিকিৎসাসেবা দেওয়া, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বাড়ানো, চিকিৎসা, ওষুধ ও টিকা বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্ত হতে পারে বেসরকারি সংস্থাগুলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, যক্ষ্মার অর্থনৈতিক বোঝাও রয়েছে। ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, একটি ওষুধে কাজ হয় দেশের এমন যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হয় ২৭৫ ডলার। একাধিক ওষুধ প্রতিরোধক যক্ষ্মায় খরচ হয় ২ হাজার ৪৪৩ ডলার। তাই প্রতিরোধে মনোযোগ দিতে হবে।
ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক মো. আকরামুল ইসলাম বলেন, যক্ষ্মা নির্মূলে তহবিল যেন বন্ধ না হয়, সে জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আর সরকারি অর্থায়ন বাড়াতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল যক্ষ্মা নির্মূলে কার্যকর ফল পেতে অনিয়ম দূর করার আহ্বান জানান।
অতিথিদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন নগদ লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি স্বর্ণলতা রায়, এসিআই লিমিটেডের পরিচালক (মার্কেটিং অপারেশন) মো. মুহসিন, বেক্সিমকো পেট্রো মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান রুবিনা খান, বিজিএমইএর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সমন্বয়ক সৈয়দ জাকির হোসেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামান, গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ ফাত্তাহ ও যক্ষ্মা নির্মূলে ইউএসএআইডির জোট এসএমসির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান খান।
বৈঠকে যুব প্রতিনিধিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যক্ষ্মার চিকিৎসা নিতে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচারাভিযান, বিভিন্ন খাতের কর্মীদের যক্ষ্মা পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন।
যুব প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন সংগীতশিল্পী জয়ীতা তালুকদার, তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের এ টু আই প্রকল্পের জাতীয় পরামর্শক শাহরিয়ার হোসেন, মিস বাংলাদেশ ২০১৭ জেসিয়া ইসলাম, আইনজীবী ও উদ্যোক্তা নিশাত আনজুম, স্থপতি ফওজিয়া হাসান, চিকিৎসক শারমিন আহমেদ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য গবেষক রুবিনা হক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন।
গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।