গোলটেবিল বৈঠক
নবজাতকের মৃত্যু রোধে পদক্ষেপ নিন
‘বিশ্ব অকাল-জন্ম দিবস’ উপলক্ষে এ বৈঠকের আয়োজন করে ন্যাশনাল নিউবর্ন হেলথ প্রোগ্রাম, ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও প্রথম আলো।
নবজাতকের মৃত্যু কমাতে না পারলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হারও কমানো যাবে না। বর্তমানে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুর ৬৫ শতাংশই ঘটছে শিশুর জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে। ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জন নবজাতকেরই মৃত্যু হচ্ছে শূন্য থেকে এক দিনের মধ্যে। নবজাতকের মৃত্যু রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে।
গতকাল সোমবার ‘সকল নবজাতক শিশুর জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এ কথা বলেছেন।
কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল নিউবর্ন হেলথ প্রোগ্রাম, ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও প্রথম আলো ‘বিশ্ব অকাল-জন্ম দিবস’ উপলক্ষে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
গোলটেবিল বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকল্প ব্যবস্থাপক চিকিৎসক মো. জহুরুল ইসলাম দেশে নবজাতকের জন্ম, মৃত্যু, মৃত্যুর কারণ, করণীয় বিষয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, দেশে বছরে ৩০ লাখ নবজাতক জন্মে। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখই জন্ম নিচ্ছে অপরিণত সময়ে। স্বল্প ওজন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় সাত লাখ নবজাতক। এই নবজাতকেরা বেঁচে থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা পোহাতে হচ্ছে।
গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের সভাপতি শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, নবজাতকের মৃত্যু রোধে সরকারের অনেক দায়বদ্ধতা আছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি হয় সরবরাহ করলাম না, আবার সরবরাহ করলেও তা নষ্ট হলে মেরামত করলাম না—সরকারকে এমন করলে হবে না। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের কাছ থেকে সেবা কিনে নিতে পারে সরকার, এতে কম মূল্যে মানুষ সেবা পাবে।
অধ্যাপক সহিদুল্লা বলেন, বেসরকারি খাতে নবজাতক চিকিৎসার প্রটোকল মানতে হবে। প্রফেশনাল বডিকেও একইভাবে সব নীতিমালা মেনে চলতে হবে। দাতা সংস্থাগুলোকে সেবা পেতে কোন জায়গায় ঘাটতি আছে তা চিহ্নিত করতে হবে। নবজাতকের চিকিৎসায় ইনকিউবেটরসহ যেসব জিনিস লাগে, তা যাতে বাইরে থেকে আমদানি না করে দেশেই তৈরি করা যায় তার শুরুটা করতে হবে।
শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ করে বলেন, অন্য রোগীদের থেকে লাভ করলেও শিশুদের সেবা দিয়ে লাভ করবেন—এমন চিন্তা বাদ দিতে হবে। তিনি নবজাতকের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ, মডিউল, গাইডলাইন শুধু তৈরি করে ফেলে না রেখে তা বাস্তবায়ন করা, শিক্ষা কারিকুলামে নতুন তথ্য সংযোজন করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
দেশের ৫১টি জেলায় ৬২টি নবজাতকের সুরক্ষায় বিশেষায়িত স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট (স্ক্যানু) চালু করেছে সরকার। সেগুলো ভালোভাবে চলছে কি না, তার নজরদারির বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেন অধ্যাপক নাজমুন নাহার। নবজাতকের মৃত্যু রোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মায়া ভেনডেনেন্ট নবজাতকের মৃত্যু রোধে ইউনিসেফের সহায়তায় ক্যাঙারু মাদারকেয়ারসহ নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। অপরিণত শিশু জন্মের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বায়ুদূষণ, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন। তিনি মায়েদের কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেন।
বারডেমের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, অপরিণত শিশু জন্ম ঠেকানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে পরে নবজাতকের চিকিৎসায় খরচ বাড়ে এবং নবজাতকের নানা জটিলতায় তেমন কোনো সুফল মেলে না। তিনি নবজাতকের মৃত্যু রোধে নবজাতকের বাবা, মা, পরিবারের সদস্যদের ক্ষমতায়িত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। স্কুলে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিএসএমএমইউর নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, মায়ের ডায়াবেটিস বেশি হলে, রক্তচাপ বেশি থাকলে মাকে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রসবের আগে থেকেই বিষয়গুলো জানাতে হবে। বর্তমানে প্রসবের পর মা ও নবজাতককে কোনোভাবেই যাতে আলাদা করা না হয় সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াসহ অন্য বিষয়গুলো নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তিনি নবজাতকের অন্ধত্ব প্রতিরোধে আরওপি স্ক্রিনিংয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, অপরিণত শিশু জন্ম প্রতিরোধে শিশুবিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদেরও সমান ভূমিকা আছে। প্রসবের সময় একটু বিলম্বিত করার চেষ্টা করা, প্রসব-পূর্ব সময়ে মায়ের অপুষ্টি আছে কি না, মায়ের জরায়ুতে কোনো সমস্যা আছে কি না, হরমোনজনিত কোনো সমস্যা আছে কি না, এ ধরনের বিষয়গুলো মাকে জানাতে হবে। আর প্রসবের সময় শিশুবিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনির হোসেন ক্যাঙারু মাদারকেয়ারসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে নিওনেটাল ফোরাম সব সময় পাশে থাকবে বলে উল্লেখ করেন।
বেসরকারি হাসপাতাল ল্যাবএইডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিকিৎসক এ এম শামীম বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জায়গা নিয়ে সমস্যা নেই। আধুনিক যন্ত্রপাতিও আছে। বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে পারে। তখন স্বল্প মূল্যে জনগণকে ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালের গ্রুপ মেডিকেল ডিরেক্টর চিকিৎসক আরিফ মাহমুদ বলেন, অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়ার পর কোনো কোনো মা-বাবাকে সন্তান নিয়ে হাসপাতালে কয়েক মাসও থাকতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক খরচ হয়। সরকার স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে হেলথ ইনস্যুরেন্স চালু করার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব বাড়াতে পারে।
গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পলাশ কুমার সাহা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম খান, আইসিডিডিআরবির সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর হাসান রাসেখ মাহমুদ, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য উপদেষ্টা গৌতম বণিক ও প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক সাব্বীর আহমেদ।
গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।