টিকাদানে জনসম্পৃক্ততা: সাফল্য, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘করোনা টিকাদানে জনসম্পৃক্ততা: সাফল্য, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২। এ আলোচনা সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
শামসুল আলম
প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
মো. শামসুল হক
পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর, এমএনসিএএইচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
বদিউল আলম মজুমদার
কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ মোস্তাক হোসেন
উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
বে-নজির আহমেদ
সাবেক পরিচালক, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
মো. শহীদুল ইসলাম
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, নন–কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
আবু জামিল ফয়সাল
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
মো. রফিকুল ইসলাম
পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন
রোমেন রায়হান
সহযোগী অধ্যাপক, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বদরুল হাসান
সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ার চেঞ্জ ম্যানেজার, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
খায়রুল আলম
প্রকল্প পরিচালক, ইউএসএআইডির ‘মামণি’ মাতৃ ও নবজাতক উন্নয়ন প্রকল্প, কোভিড-১৯, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
সোহরাব হাসান
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
সাকিনা সুলতানা
প্রকল্প পরিচালক, কোভিড-১৯ নির্মূল প্রকল্প, দি হাঙ্গার প্রোজেক্ট বাংলাদেশ
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা শিগগিরই চলে যাবে—এমন সম্ভাবনা কম। নানাভাবে এটা থেকে যাবে। নতুন কিছু সাব–ভেরিয়েন্ট এসেছে। এর মধ্যে এমন কিছু ভেরিয়েন্ট আছে, যার লক্ষণীয় কোনো উপসর্গ থাকবে না। কিন্তু শরীরের ক্ষতি যা করার, সেটা করে যাবে। তাই এখনো আমাদের মাস্ক পরার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। আমাদের সাফল্য হলো আমরা অনেক সহজেই টিকা পেয়েছি। এশিয়ায় আমাদের টিকা নেওয়ার হারও অনেক বেশি।
সাকিনা সুলতানা
গত দুই বছর করোনায় আমাদের জীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সরকারসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও জনসম্পৃক্ততায় দেশের মানুষ টিকা নিয়েছেন। ফলে কারোনার সংক্রমণও কমে এসেছে। এখন আমরা প্রায় একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। কিন্তু এক মাস ধরে করোনার সংক্রমণ আবার কিছুটা বাড়ছে।
দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-ইউনিসেফ, সাজেদা ফাউন্ডেশন, এডাব, বাংলাদেশ কমিউনিটি রেডিও অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন—আমরা সাবই মিলে কোভিডকালীন একটি প্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছি।
এ প্রকল্পের নাম হলো কোভিড-১৯ প্রতিরোধ, ঝুঁকি নিরূপণ, যোগাযোগ, জনসম্পৃক্ততা ও িটকাবার্তা যোগাযোগ জোরদারকরণ প্রকল্প।
এটি দেশের ২২টি জেলার ১৫৪টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা উঠান বৈঠক, স্কুল ক্যাম্পেইন, পথনাটক, লোকসংগীত ইত্যাদি করেছি। স্থানীয় টিভি কেব্লের মাধ্যমে প্রচার করেছি। কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, ফেসবুক বুস্টিংয়ের মতো ডিজিটাল মাধ্যমেও আমরা কাজ করেছি এবং জনগণকে টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছি।
আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে করোনার বিরুদ্ধে সচেতনতার কাজ করেছি। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সভা আয়োজন করেছি। ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে করোনার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করেছি। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় টাউন হল মিটিং করেছি। করোনার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি।
বর্তমানে দেশে প্রথম ডোজ গ্রহণের হার ৭৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের হার ৭১ শতাংশের বেশি। বুস্টার ডোজ নিয়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সের কিশোরদের মধে৵ ১ কোটি ৭৩ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৮ জন টিকা নিয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে ১ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ৩৫০ জন। ৫ থেকে ১১ বছরের শিশুদের মধে৵ টিকা নিয়েছে ১১ লাখ ৯০ হাজার ৩২৯ জন।
কিন্তু টিকা গ্রহণে কিছু মানুষের নেতিবাচক মানসিকতা আছে। অনেকে বলেন টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। অনেকে ভাবেন, অসুস্থ হয়ে পড়বেন; অনেক নারী ও বয়স্ক মানুষ টিকা গ্রহণের প্রক্রিয়া বুঝতে পারেননি; অনেকে দূরত্বের জন্য টিকা নেননি; দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের চার মাস পর বুস্টার ডোজ নেওয়ার কথা অনেকে ভুলে যান। কিছু ভ্রান্ত ধারণাও পেয়েছি। যেমন দুগ্ধদান ও গর্ভবতী মা এবং প্রতিবন্ধী মানুষকে টিকা নেওয়া ঠিক না। অনেকে মনে করেন টিকায় সমস্যা হতে পারে। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিলে করোনার টিকা গ্রহণে আরও সাফল্য আসবে।
বদিউল আলম মজুমদার
আমাদের অনেকেরই করোনার অভিজ্ঞতা আছে। আমি নিজে দুবার আক্রান্ত হয়েছি। আমরা অতিমারি শুরুর প্রথম থেকেই জনসম্পৃক্ততামূলক কাজ শুরু করেছি। করোনা সহজে যাবে না। এর সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে চলতে হবে। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবী আছেন। তাঁদের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে করোনাসহনীয় পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা অনেক অনুষ্ঠান করেছি। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করেছি। নানা ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে আমরা এ সিদ্ধান্তে এসেছি যে কমিউনিটি মবিলাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। আমার বুঝেছি, করোনা প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। তাই আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই ডাকের মতো ‘যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে কাজ শুরু করেছি।’
আমরা ১ হাজার ২০০ গ্রামে এই কাজ করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছি। ইউনিসেফসহ কয়েকটা অংশীদার প্রতিষ্ঠান মিলে এই কাজ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় অর্জন করেছি। বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় সফল। কারণ, টিকাদানে সফলতা অর্জন করেছে। মৃত্যুর হারও অনেক উন্নত দেশের তুলনায় কম।
করোনা মোকাবিলায় আরও কীভাবে সফল হওয়া যায়, টিকাদানে কীভাবে আরও সফলতা আনা যায়, শিশু–কিশোরদের আরও কীভাবে টিকাদানের আওতায় আনা যায়, সেসব বিষয় নিয়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মহামারি চলতে থাকবে। এ জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। চিকিৎসা করে এর সামাধান করা যাবে না। আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিরোধের জন্য স্থানীয় সরকার, সাধারণ মানুষ, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে যেন তারাই তাদের রক্ষার দায়িত্ব নেয়।
এ জন্য নাগরিকের শরীরচর্চা, খাদ্যদ্রব্যের নিয়ম মানা, দুশ্চিন্তা না করা, নিয়মিত ঘুমসহ সব বিষয় তাদের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা কোভিড–সহনীয় গ্রাম তৈরির কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সফলও হয়েছি।
এটা আমাদের দেশ। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদেরই ঠিক করতে হবে। এই দুর্যোগ থেকে আমরা অনেক শিখেছি। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যেন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিই। সবাইকে ধন্যবাদ।
মোস্তাক হোসেন
জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে একটা মহামারি চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ এর অন্যতম প্রস্তাবক। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক না থাকলে আমাদের উন্নয়ন, অর্থনীতি, শিক্ষা—সব ক্ষেত্রেই বিপর্যয় হবে। করোনার সময় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা হচ্ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিটি জেলায় কার্ডিয়াক ইউনিট করার কথা বলেছেন। হৃদ্রোগ যেন না হয়, এর জন্য কী করছি? প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে কার্ডিয়াক ইউনিট থাকলেও রোগী সামাল দেওয়া যাবে না। তাই রোগ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।
তরুণদের শরীরচর্চার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের সাইকেল দিতে হবে। পার্কের ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব খাতে যা খরচ হবে, এর বহুগুণ সুবিধা পাওয়া যাবে।
যেকোনো মূল্যে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতেই হবে। অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস, কিডনির জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি যেন আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সে জন্য নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, মানসিক চাপমুক্ত থাকা, তামাক ও অ্যালকোহলের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এক–দুই দিন টেলিভিশনে বা সভা করে এটা বললে হবে না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রচার করতে হবে।
স্বাস্থ্যের পাঁচটা উপাদান হলো—স্বাস্থ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, চিকিৎসা, রোগীর পুনর্বাসন, পেলিয়েটিভ কেয়ার। এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে যদি আমরা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে না পারি, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে বিপদে পড়ব।
২০৩০ সালের মধ্যে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু আর আট বছরে আমরা কতটুকু পারব? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ব্রিটেনকে বোমায় বিধ্বস্ত করেছিল। তখন তাদের স্বাস্থ্য বলে প্রায় কিছু ছিল না। কিন্তু তারা ১৯৪৭ সালেই তাদের নাগরিকদের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসে। তারা মনে করেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক না হলে সবকিছু ভেঙে পড়বে। তাই ব্রিটেন, সুইডেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ অনেক দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
টাকার কথা চিন্তা করলে হবে না। করোনা মোকাবিলায় কীভাবে টাকা পেয়েছি। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সেভাবেই টাকা আসবে। আমাদেরও টাকার কথা চিন্তা না করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বদরুল হাসান
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বাংলাদেশ, চীন ও পাপুয়া নিউগিনির সঙ্গে আমার কাজের অভিজ্ঞতা আছে। পাপুয়া নিউগিনিতে এখন পর্যন্ত টিকা নিয়েছে সম্ভবত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে চায়না বুস্টার ডোজ অনেক আগে দিয়েছে। আমরা লক্ষ্যমাত্রার ১১০ শতাংশ প্রথম ডোজ, ১০২ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজ, বুস্টার ডোজ প্রায় ৩৭ শতাংশ দেওয়া হয়েছে। চীন ও বাংলাদেশ টিকাদানে এত ভালো করেছে কারণ এর মধ্যে রয়েছে জনসম্পৃক্ততা ও সরকারের দক্ষতা।
চীনে গত জুলাইয়ে বেইজিং সাংহাইতে কিছু রোগী ধরা পড়েছিল। সেখানকার ১০ লাখ মানুষকে রাতারাতি স্ক্রিনিং ও চিকিৎসার আওতায় এনেছে। আমার চীনে যাওয়ার ভিসা, টিকিট—সবই ছিল কিন্তু যেতে পারিনি। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু মানুষ গিয়েছিল।
টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ, জনসম্পৃক্ততা অনেক বেশি ছিল। এর মধ্যেও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। অনেকে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন না। চট্টগ্রামসহ কোনো কোনো জায়গায় আমাদের ভাষাগত সমস্যা রয়েছে। আমাদের পরিকল্পনায় জনসম্পৃক্ততা আছে কি না, দেখতে হবে।
কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে সরকারের কোন বিভাগের কী উদ্যোগ আছে, সেটি নিয়ে আমরা একটা গবেষণা করেছি। যেকোনো কাজের সাফল্যের ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততা একটা বড় বিষয়। টিকাদানে আরও জনসম্পৃক্ত বাড়ানোর জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।
বে-নজির আহমেদ
জনসম্পৃক্ততাকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হয়। জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হয়। এটা কখনোই হয়নি। যে যেভাবে পেরেছে, কারোনার ক্ষেত্রে সে সেভাবে কাজ করেছে। ফলে জনগণ অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়েছে।
জনগণের জন্য জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হয়। সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও নাগরিক সমাজকে টিকাদানে সম্পৃক্ত করা জরুরি ছিল, সেটা হয়নি। স্থানীয়ভাবে তাঁরা অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে কাজ করেন।
ইপিআইয়ের প্রথম দিকে মেডিকেল অফিসার ছিলাম। তখন ইপিআইয়ের হার ছিল ২ শতাংশ। আমাদের জনসম্পৃক্ততা শুরু হয়েছে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আমাদের সভা হয়েছে। সে সভায় ওয়ার্ডের সদস্যরা ছিলেন। এটা একটা অনন্য সফলতা অর্জন করেছে। এর ফলে আমাদের ইপিআই ২ শতাশং থেকে ৮৫ শতাংশ হয়েছে। সেটা টেকসইও হয়েছে।
করোনা টিকাদানে অনেক ঘাটতি ছিল। সরকারের কোনো কর্মসূচিতে একজনও বাকি থাকবে না। কিন্তু প্রান্তিক, বয়স্ক, নিম্নবিত্ত—এসব শ্রেণির প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এক ডোজ টিকাও পাননি। তাই টিকাদানের সফলতার্ নিয়ে প্রশ্ন থোকেই যায়। যেকোনো মূল্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসা দিয়ে কোনো দিনই স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি করতে পারব না। রোগ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করতে হবে।
মো. শহীদুল ইসলাম
দাউদকান্দি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বে ছিলাম। সেখানে প্রায় তিন লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছিল।
আমার মনে হয় ১৯৭১ সালে একবার জনসম্পৃক্ত হয়েছিল আর কোভিডকালীন হয়েছে। কারণ, টিকাদানে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছি। কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার, সেটা আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু করোনায় আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কোনো কিছুর অভাব হয়নি। কোনো দেশই শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আমাদের চিকিৎসাসেবায় জনবল বাড়াতে হবে। গবেষণা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে একটা আন্তর্জাতিক মানের ভ্যাকসিন সেন্টার ও গবেষণা ইনস্টিটিউট করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন বলে মনে করি।
আবু জামিল ফয়সাল
স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা দরকার। স্বাস্থ্যের সঙ্গে খাদ্য, অভ্যাস, ক্রয়ক্ষমতা ইত্যাদি জড়িত। এই সবকিছুর মধ্যে একটা সমন্বয় দরকার। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় শুরুতে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা ছিল। পরে তাদের ভূমিকা কমে গেল।
ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় তেমন কিছু করেনি। ইউনিসেফের সঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কিছু কাজ করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রায় কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না। কোভিড মোকাবিলায় স্থানীয় সরকারের অনেক বেশি সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একটা জটিল প্রক্রিয়া। এখানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো দায়িত্ব নেই। আবার স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব আছে। কিন্তু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা প্রয়োগের অভাব ছিল।
কোভিড–পরবর্তী মানসিক অবস্থা থেকে শুরু করে দেহের মধ্যে অনেক রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটা নিয়ে কাজ করতে হবে।
যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা—সব ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রাধিকার দিয়ে টিকা দেওয়া হয়নি। মাস্ক পরার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু এর গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোমেন রায়হান
যে সিনেমায় ভিলেন যত বড়, এর হিরো তত বড়। হাত ধোয়া, মাস্ক পরাকে যদি হিরো বলি, এর আগে ভিলেন কোভিড কত বড়—সেটা যদি মানুষের কাছে প্রমাণ করতে না পারি, তাহলে আমরা হাতও ধোব না, মাস্কও পরব না।
অনেক সময় নিয়ম মানার জন্য বাধ্য করতে হয়। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারিনি। আমাদের সারা দেশে একটি ভাষা। ফলে সহজেই আমরা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারি।। টিকা যারা নেয়নি, তাদের একটি বড় অংশ হলো তরুণ। তারা মনে করে, করোনায় তাদের কিছু হবে না। এখন তরুণদের লক্ষ্য করে টিকা দিতে হবে। কোভিডের আগেও আমরা হাত ধুতাম। জাপানিরা প্রায় সব সময় মাস্ক পরে। এগুলো ভালো অভ্যাস। এটা কেন করাতে পারছি না।
বয়স্কদের আচরণ পরিবর্তন করা হয়তো সম্ভব না। স্কুল থেকে এটা শুরু করতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ার চেঞ্জ কমিউনিকেশন যুক্ত করা হয়েছে। এটাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
যেকোনো সমস্যার সময় আন্তমন্ত্রণালয়ে সমন্বয় খুব জরুরি। তাহলে পরস্পরের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি থাকে না। কাজের গতি বাড়ে।
সোহরাব হাসান
অনেক বিষয় আলোচনায় এসেছে। আমার আগে যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই মাননীয় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন যে কী পরিকল্পনা করতে হবে।
স্থানীয় সরকারের ধারণাই আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা সবকিছু ওপর থেকে চাপিয়ে দিতে চাই। এটা অনেক ক্ষেত্রে ভালো হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এর সুফল পাওয়া যায় না।
দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে সমাজ। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয় সবাইকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারিনি। সেটা স্থানীয়, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র—সব ক্ষেত্রে একই রকম। এখানে মনে করা হয়, আমি যেটা করি, সেটা আমার সাফল্য—এটা যে জনগণের সাফল্য, বাংলাদেশের সাফল্য, সে ধারণা নেই। এটা অনেক ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথম দিকে টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজ—তাদের মধ্যে যে সমন্বয়ের দরকার ছিল, সেটা হয়নি।
আমাদের তরুণসমাজ, খেলোয়াড়, শিল্পী—তাঁদেরও সেভাবে যুক্ত করতে পারিনি। আবার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে টিকা সেভাবে পৌঁছায়নি। ঢাকা শহরে প্রায় ৩০ লাখ বস্তিবাসী আছে। তাদের হয়তো অধিকাংশই টিকা পায়নি। আবার শ্রমজীবী, চর ও হাওরাঞ্চলের মানুষ, পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলের মানুষ টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব পায়নি।
এসব বিষয় কার্যকর উদ্যোগ নিলে জনসম্পৃক্ততা আরও বাড়বে বলে মনে করি।
খায়রুল আলম
স্থানীয় পরিকল্পনা সেই ফার্স্ট সেক্টর থেকে শুরু হয়েছে। ইপিআইতে আমরা দারুণ সমন্বয় দেখেছি। আমার ২২ বছরের কর্মজীবনে টিকাদানে অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। শুরুর দিকে টিকা দিতে গিয়ে অনেক খারাপ অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক অভিভাবক ফোনে বলেন যে তিনি টিকাকেন্দ্রে গেছেন কিন্তু এখনো টিকদানকারী আসেননি।
কমিউনিটি ক্লিনিককে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারলে টিকাদানসহ অনেক ক্ষেত্রে সফলতা আসবে। আমাদের তথ্য প্রদানে সমস্যা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তথ্য দিতে পারিনি। এ জন্য এখনো অনেকের মধ্যে টিকার ব্যাপারে অনাস্থা আছে। টিকাদানসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিকের সঠিক ব্যবহারের একটা কৌশলপত্র থাকা উচিত।
মো. রফিকুল ইসলাম
সরকারি-বেসরকারি যেকোনো আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যদি নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে হয়, তাহলে সেটা খুব সহজেই জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমরা করোনা টিকার মতো অতীতেও দেখেছি প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের ভুল ধারণা রয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ও পলিও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে দেখেছি নবজাতকের মা-বাবা যখন টিকাকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেন, তখন অনেক মুরব্বি নিষেধ করতেন। করোনার সময় অনেকে বলতেন, যারা করোনার টিকা নেবে, তাদের প্রজননক্ষমতা কমে যাবে। কিন্তু যখন ইমাম সাহেব মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেন, মসজিদে এ বিষয় আলোচনা করেন, তখন মানুষ খুব সহজে গ্রহণ করে।
পলিও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা দেখে পাকিস্তান, আফগানিস্তান উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে জনসম্পৃক্ততার কাজ করলে সেখানে সাফল্য আসবে।
মো. শামসুল হক
৮ মার্চ ২০২০ প্রথম কোভিড শনাক্ত হয়। ৪ জুন ২০২০ পৃথিবীর নেতারা ভার্চ্যুয়ালি এটা নিয়ে আলোচনা করেন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আলোচনায় যুক্ত হন। সেদিনই প্রথম চিন্তা করা হয় কীভাবে এর ভ্যাকসিন তৈরি করা যাবে। প্রথমে আমরা একটা গভীর সমুদ্রে ছিলাম। আমরা জানতাম না কোন দিকে তীর আছে। শুধু আমেরিকাতেই কয়েক লাখ মানুষ মারা গেছে।
স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনার শুরুতেই বলেছিলেন, যেকোনো মূল্যে টিকা সংগ্রহ করতে হবে। ২০২০ সালের ৯ জুলাই আমরা কোভ্যাক্সে স্বাক্ষর করি। পৃথিবীর খুব কম দেশ তখন স্বাক্ষর করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্সের গাইডলাইন মেনে প্রথমেই আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি। সেই পরিকল্পনা দেখে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ৩১ ডিসেম্বর ২০২০-এ লিখেছে, দুই বছরে বাংলাদেশ ১৪০ মিলিয়ন টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। তবে এটা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। এর বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আমরা সেই অসম্ভব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।
আমরা প্রায় ১০ হাজার ভ্যাকসিন ক্যারিয়ার সংগ্রহ করেছি। কোথাও টিকা না পেয়ে প্রথমে ভারতের কাছ থেকে তিন কোটি ভ্যাকসিন কিনে শুরু করলাম। কিন্তু ভারত আমাদের ঠিকভাবে টিকা দিতে পারেনি। এটা একটা কঠিন সময় ছিল। তখন আমরা সারা পৃথিবীর কাছে টিকার জন্য আবেদন করি। চীনের সঙ্গে ৭ কোটি টিকার চুক্তি হয়।
২০২১ সালের ৩ জুলাই তাদের কাছে থেকে টিকার প্রথম চালান পাই। তখন অনেক দেশ টিকা দিতে চাইল। এ জন্য ২০২১ সালের ৩ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১১ কোটি ৯ লাখ ডোজ টিকা পাই। কিন্তু কোন দেশ থেকে কত ডোজ পাব, সেটা আমরা জানতাম না। তাই এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৩২ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে ১৮ কোটি কিনেছি। ১৪ কোটি ডোনেশন পেয়েছি।
চায়নার টিকা নিয়ে কিছু দেশে যেতে পারবে না। এর মধ্যে সৌদি আরব ছিল। তখন পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়। গাজীপুরে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে দ্রুত টিকা দিয়েছি। আমাদের মোট ১৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ পেয়েছে ৯৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ৯১ শতাংশ মানুষ। এসব উদ্যোগের জন্যই কোভিড, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের মধ্যেও আমরা সারা পৃথিবীর সঙ্গে চলতে পারছি।
টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলাম, সেটা অর্জন করেছি। বুস্টার ডোজ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা করেছি।
শামসুল আলম
বাংলাদেশ সফলভাবে করোনা মোকাবিলা করেছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের দেশে প্রশংসা করার রেওয়াজ নেই। সংবাদপত্র অনেক সময় মনে করে, চমকপ্রদ নেতিবাচক সংবাদই সংবাদ। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকে হয়তো এই ধারণাটা এসেছে।
জাপানের একটি সম্মানজনক ইনস্টিটিউট বলেছে, পৃথিবীর পাঁচটি দেশ কোভিড ব্যবস্থাপনায় সাফল্য দেখিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম। রয়টার্সের একটা রিসার্চ অ্যানালাইসিসে এসেছে যে পৃথিবীর ১০টা দেশ শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যায় পড়তে পারে। বাংলাদেশ এর মধ্যে নেই। এ গবেষণা বলেছে যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা থেকে অন্যরা শিখতে পারে।
চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে ইউএনডিপির একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেখানে তারা বলেছে, বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে চার ধাপ এগিয়েছে। কোভিডে আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে বিপর্যয় ঘটতে পারত। আমরা যে কোভিডের ক্ষেত্রে ভালো ব্যবস্থাপনা করেছি, মানবসম্পদে চার ধাপ এগোনো তারই প্রতিফলন।
যুক্তরাষ্ট্রে মাস্ক ব্যবহারের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। অনেক দেশে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা হয়েছে। আমাদের দেশে সেটা হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা টিকাদানে এগিয়ে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করা যাবেই না। টিকা নিয়ে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ অনেক ইতিবাচক। আমাদের ইমাম সাহেবরা টিকার ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা নিয়েছেন।
বাংলাদেশ পৃথিবীর এমন একটি দেশ, যারা প্রথম থেকেই টিকা সংগ্রহ করতে পেরেছে। কোভিডের সময় দুই মাসের বেশি অফিস বন্ধ ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় বাজার খোল থাকত।
এ অবস্থায় ২০১৯-২০ সালে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পরের বছর ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কোভিডকালীন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ভারতসহ অনেক দেশে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জনসম্পৃক্ততার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। অর্থনীতিকে ধরে রাখার জন্য সরকার সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে। কোভিড ব্যবস্থাপনায় এর চেয়ে ভালো কী করা যেত আমি ঠিক বলতে পারব না।
করোনা হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। কিন্তু আরও মহামারি আসবে। সে জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগে স্থানীয় পর্যায়ের তরুণেরা, মেম্বর, চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সাংসদ—এঁদের সম্পৃক্ত রাখতে হবে। মসজিদের ইমাম, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক, সামাজিক সংগঠন, নারী সংগঠন, ক্লাব, সমবায় সমিতি, সরকারি বেসরকারি সংগঠনসহ সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
দুর্যোগ শেষ হয়ে যাবে না। ভবিষ্যতে এমন মহামারি আরও আসবে। সে জন্য আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের ভ্যাকসিন সেন্টার ও গবেষণা ইনস্টিটিউট তৈরি করতে হবে। যেন আমরাই সবার আগে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে আশা করি।
ফিরোজ চৌধুরী
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। কোভিড ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ যথেষ্ট ভালো করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশ কিছু সুপারিশ এসেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদিকে মনোযোগ দেবে বলে আশা করি।
সুপারিশ
ভবিষ্যতে দেশে করোনার মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মানের ভ্যাকসিন সেন্টার ও গবেষণা ইনস্টিটিউট করতে হবে।
করোনা চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
করোনা টিকার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া আরও সহজ করা দরকার।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
রোগ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করতে হবে।
টিকাদানে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজে লাগাতে হবে।
চিকিৎসাসেবায় জনবল ও গবেষণা বাড়াতে হবে।
শ্রমজীবী, চর ও হাওরাঞ্চল, পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলের মানুষকে টিকা প্রদানে আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
টিকাদানে জনসম্পৃক্ততা আরও বাড়ানোর জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।
নাগরিকদের নিজেকেই নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদে্যাগ নিতে হবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজন।