গোলটেবিল বৈঠক
তিন কৌশলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
দেশে পানিতে ডুবে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি শিশু মারা যায়। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে মায়েদের ব্যস্ততার সময় বেশির ভাগ শিশুর মৃত্যু হয়।
দেশে পানিতে ডুবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩০টি শিশু মারা যায়। এসব মৃত্যুর ৮০ শতাংশই বাড়ি থেকে ২০ মিটারের মধ্যে ঘটে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পুকুর, ডোবা ও বালতির পানিতে। শিশুদের একটু দেখভাল করে রাখাসহ তিন কৌশলে এসব মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। গতকাল রোববার সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস: পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে অংশীজনদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আজ ২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে।
গোলটেবিলে বক্তারা সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুদের সাঁতার শেখানো, অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে এলাকাভিত্তিক দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং গ্রামে মায়েরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকার সময় শিশুদের নজরে রেখে পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়।
বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে এলাকাবাসীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনে একবার যদি গেঁথে যায় প্রতিরোধের কাজটি তাঁরও দায়িত্ব, তাহলে এলাকার শিশুদের দেখভাল করে নিরাপদে রাখতে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন পরিচালক মো. রোবেদ আমিন বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যুর অনেক ঘটনা নথিভুক্ত হয় না। এসব বিবেচনায় নিয়ে এনসিডিসি পানিতে ডোবা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মকৌশলের খসড়া তৈরি করেছে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
সভাপতির বক্তব্যে সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, একটি শিশুর জীবনের জন্য একটি মুহূর্তও গুরুত্বপূর্ণ। পানিতে ডোবা নীরব মহামারিও একটি বড় সমস্যা।
বৈঠকে ড্রাউনিং প্রিভেনশন পার্টনারশিপের প্রকল্প প্রধান এষা হোসেন বলেন, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুকে এখনো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোন মন্ত্রণালয় কী কাজ করবে, তা নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছে।
বৈঠকে সিআইপিআরবির উপনির্বাহী পরিচালক আমিনুর রহমান বিভিন্ন জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, দেশে বছরে পানিতে ডুবে ১৯ হাজার মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে শিশু প্রায় ১৪ হাজার ৫০০। এদের মধ্যে আবার ১০ হাজারের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী মোট শিশুমৃত্যুর ৫৮ শতাংশই পানিতে ডুবে হয়। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত মায়েদের কাজের ব্যস্ততার সময় ৬০ শতাংশ মৃত্যু ঘটে।
সিআইপিআরবি কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এলাকাভিত্তিক দিবাযত্ন কেন্দ্র ‘আঁচল’ এবং ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার ও উদ্ধার কৌশল শেখাতে ‘সুইমসেফ’ নামের দুটি কার্যক্রম পরিচালনা করে কার্যকর ফল পাওয়া গেছে। বরিশালের তিনটি উপজেলায় ‘ভাসা’ প্রকল্পের আওতায় ওই দুই কার্যক্রমের সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ডুবে মৃত্যুর উপক্রম হওয়া যেসব শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের দিকেও নজর দিতে বলেন দুর্যোগ ফোরামের আহ্বায়ক গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, পানিতে ডোবার পর পর ২–৩ সেকেন্ড অক্সিজেনের অভাব শিশুদের ওপর বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সম্পৃক্ত করলে কার্যকর ফল আসবে।
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশনের মহাসচিব আবদুল জলিল চৌধুরী বলেন, পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যমকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, পানিতে ডোবা প্রতিরোধে নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে কী চাইতে হবে, সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মা–বাবাকে কী বলতে হবে, সে সম্পর্কে তথ্য দিলে সে অনুযায়ী গণমাধ্যম কাজ করবে।
বাংলাদেশ আর্লি চাইল্ডহুড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের ভাইস চেয়ার মাহমুদা আকতার বলেন, পানিতে ডোবা প্রতিরোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আরও বক্তব্য দেন, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনিশিয়েটিভের এদেশীয় সমন্বয়ক রুহুল কুদ্দুস, ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রতিনিধি সদরুল হাসান মজুমদার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য শাখার জাতীয় পরামর্শক ইসাকুল কবির,
বৈঠকের সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।