২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ

ইউনিসেফ বাংলাদেশ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২। আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

ইউনিসেফ বাংলাদেশ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ছবি : প্রথম আলো

অংশগ্রহণকারী

শামসুল আলম

প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

সুলতানা সাঈদা

অতিরিক্ত সচিব (বাজেট কার্যক্রম ও মূল্যায়ন), সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়

শেলডন ইয়েট

কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

মোস্তাফিজুর রহমান

বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

বজলুল হক খন্দকার

চেয়ারম্যান, সানেম; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইশরাত শবনম

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, প্রাইভেট সেক্টর, ডেলিগেশন অব দ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন টু বাংলাদেশ

মামুনুর রশিদ

প্রোগ্রাম পলিসি অফিসার, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)

সৈয়দা মুনিরা সুলতানা

জাতীয় প্রকল্প সমন্বয়ক (শিশুশ্রম), আইএলও বাংলাদেশ

এম এ রাজ্জাক

চেয়ারপারসন, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‍্যাপিড)

হাসিনা বেগম

সামাজিক নীতিবিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

জাফর সাদিক

উপদেষ্টা (ইনভেস্টমেন্ট ইন চিলড্রেন), সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনার জন্য সবাই কিছু না কিছু চাপে পড়েছে। তবে শিশুরা একটু বেশিই ভোগান্তির শিকার হয়েছে। তাদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরে যেতে পারেনি। ঝরে পড়েছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়ের সংখ্যা বেশি। মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাদের অনেককেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুদের জন্য সরকারের কার্যক্রম অবশ্যই আছে। তবে আলাদা করে শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তায় নির্দিষ্ট করে যদি কিছু বরাদ্দ থাকে, সেটা অবশ্যই ভালো হয়। এসব বিষয় নিয়েই আজ আলোচনা হবে বলে আশা করি।

শেলডন ইয়েট

শিশুদের সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে কাজ করতে পেরে ইউনিসেফ গর্বিত। আমরা সবাই করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে জানি। পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত নেই, যেখানে করোনার প্রভাব পড়েনি। করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাবে সমাজের অন্য সবার চেয়ে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্য, জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শিশুরা এগুলোর কারণে অনেক ভুগেছে। এ কারণে শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা জানি, মহামারির কারণে বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। করোনার কারণে যেসব দেশে অনেক দিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এটি পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক একটি বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে এটা। শুধু বাংলাদেশে নয়, বরং সারা বিশ্বে এই চিত্র একই।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মহামারির আগে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৬ কোটি শিশু শ্রমে লিপ্ত ছিল। মহামারির পর এই সংখ্যা আরও বেড়েছে এবং বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের আয় কম থাকায় অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

ল্যানসেটের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আরও প্রায় ৪০ লাখ শিশুর অপুষ্টির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। মহামারি ও স্বল্প আয়ের কারণে শিশুরা বেশি ভুগেছে। তবে বাংলাদেশ এ সমস্যাগুলোর সমাধানে চমৎকার সাফল্য দেখিয়েছে। এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো করেছে। তবে শিশুদের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমগুলো আরও বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

অন্য অনেকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে সহযোগিতা ছিল, তা অনবদ্য। কিন্তু এটাও সত্য, শিশুদের জন্য যে বরাদ্দ বা কার্যক্রম, তা অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা জরুরি। এখন যদি আমরা শিশুদের সহযোগিতা না করি, তবে ভবিষ্যতে তারা ভুগবে। এতে শুধু শিশুরাই নয়; বরং পুরো জনগোষ্ঠীই ভুগবে।

মোস্তাফিজুর রহমান

বিগত এক দশকে শিশুমৃত্যুর হার কমা, মাতৃমৃত্যুর হার কমা, খর্বকায়ের হার কমা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু কোভিড অতিমারির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এসব অর্জন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অতিমারির সময় বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রায় ৫ লাখ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে এবং শতকরা ১৬ ভাগের বেশি শিশু শ্রমবাজারে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ (পেনশন বাদে) যেখানে অর্থবছর ২০১৮-১৯–এ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, তা ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে এ হার অপরিবর্তিত থেকে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি ব্যয়ে সামাজিক সুরক্ষা খাতের অংশও একইভাবে আগের বছরের তুলনায় অপরিবর্তিত থেকে গেছে।

কোভিডের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যে ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তার মধ্যে শিশু-নির্দিষ্ট কোনো প্যাকেজ ছিল না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য যে প্যাকেজ নেওয়া হয়েছিল তাতে শিশুদের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল শতকরা ১ দশমিক ৮৭ ভাগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বরাদ্দের নিরিখে হিসাব করলেও শিশুদের অংশের তেমন পরিবর্তন হয়নি। অথচ এই বাজেটে শিশুস্বাস্থ্য, শিক্ষা, ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহের শিকার শিশুদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এই বরাদ্দ আরও অনেক বেশি হওয়ায় প্রত্যাশিত ছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি সমন্বিতকরণের লক্ষ্যে গৃহীত উদ্যোগকে যৌক্তিক সমাপ্তিতে নিতে হবে এবং শূন্য থেকে চার বছর বয়সী সব শিশুকে এই কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এটা সামাজিক সুরক্ষা বাজেটে রাখতে হবে। প্রস্ফুটিত শিশু প্রতিবেদন ২০১৮–এর অভীষ্ট অনুযায়ী, শিশু বাজেট মোট সরকারি ব্যয়ের ২০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে মিলে’র ব্যবস্থা করতে হবে। এটা শিশুদের পুষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি পৃথক ‘শিশু অধিদপ্তর’ গঠন করতে হবে। যেটি শিশুদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন কর্মসূচিকে সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করবে।

ইউনিয়ন পরিষদের নারী ও শিশুকল্যাণ কমিটিকে তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকরভাবে শিশু–নির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নজরদারি বাড়াতে হবে। যেসব শিশু শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকার, তাদের একটি পৃথক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এনে সহায়তা দেওয়া জরুরি। সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার তালিকায় শিশুবিষয়ক সূচকগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।

শিশুবিষয়ক কর্মসূচি পরিকল্পিত ও সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের ভান্ডার গড়ে তুলতে একটি সমন্বিত ‘ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সরকার শিশুদের জন্য ‘আপৎকালীন তহবিল’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যে তহবিল থেকে শিশুদের প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া যেতে পারে

এম এ রাজ্জাক

শিশুদের সুরক্ষার জন্য কোনো পরিকল্পনা করতে হলে, তা অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে হয়। এতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা যায়। আজ আমি যে বিনিয়োগ করছি, তার ফলাফল পাব ১০ বছর পর। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো দক্ষিণ কোরিয়া। তারা সামাজিক সুরক্ষা খাতে কী পরিমাণ ব্যয় করেছে, সেদিকে তাকাতে পারেন।

আমাদের যে সামাজিক সুরক্ষা কৌশল আছে, তা নিঃসন্দেহে অনবদ্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক উন্নয়নশীল দেশেও এমন কৌশল বিরল। এতে সরকারেরও সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর পিছিয়ে পড়েছি। সেখানে প্রায় ১০০-টির বেশি সূচক ছিল। এগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে আমরা ঠিকঠাক কাজ করতে পারিনি।

এখানে আরও একটি বাধা হলো সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক কম। এতে অনেকগুলো পর্যায়ে অল্প খরচ করা যায়। এর কারণে কোনো ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া যায় না। প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ে ভর্তুকির ক্ষেত্রে সরকারের সফলতা আছে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে যারা যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে তেমন একটা সফলতা নেই। যদি বয়সের কাঠামো চিন্তা করি, তবে তারাও তো শিশু। সেখানে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। অর্থাৎ সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়নি।

চা-শ্রমিকদের প্রসঙ্গে বলি, যদি আমরা মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট সবাইকে দিতে পারতাম, তবে তাদের দারিদ্র্যের মাত্রা ২ থেকে ৩ শতাংশ কমে যেত। এ বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারলে তাদের আয়ের মাত্রাও ৩ থেকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। গত মার্চ মাসে আমি বলেছিলাম, চা-শ্রমিকদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৬২ শতাংশ। সম্প্রতি তাদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে। এখন ৬২ শতাংশ থেকে কমে দারিদ্র্যের হার হয়েছে ৪২ শতাংশ। এটি কিন্তু বড় একটি প্রভাব। এর কারণ হলো প্রতিদিন ৫০ টাকা করে তাদের আয় বাড়বে। এ ছাড়া চা-বাগানের মালিকদের বলা আছে, তারা ছয় দিন কাজ করলে সাত দিনের মজুরি পাবে। এ ক্ষেত্রে যদি তাদের, মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট-এর আওতায় আনতে পারি, তবে তারা মাসে ৮০০ টাকা করে বেশি পাবে। সে ক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে প্রভাব পড়বে।

সৈয়দা মুনিরা সুলতানা

আইএলও গত ১০০ বছরে যে বিষয়টি প্রচার করছে, তা হলো সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কাজের ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই কেবল সমাজে শান্তি আসবে। আর এ কাজ করতে গিয়ে আমাদের প্রথম উদ্যোগ হলো, শিশুশ্রম দূর করা। শিশুশ্রম নিরসন মানে হলো শিশুরা স্কুলে যাবে, কাজে নয়। কিন্তু আমরা এখান থেকে বের হয়ে ৫ মিনিট হাঁটলেই প্রায় ১০ জনের মতো শিশুকে দেখতে পাব, যারা কাজ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ লাখ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। যারা ১৮ বছর বয়স শেষে আমাদের শ্রমবাজারে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে প্রবেশ করবে। এটা অর্থনীতিতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এপ্রিল-মে মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিবিএসের সঙ্গে শিশুশ্রম নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করার সময় দেখেছি, করোনাকালে আটটি জেলার ২৫টি পরিবারের মধ্যে ২৪টি পরিবারেই শিশুদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা কাজে পাঠানো হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা মহামারি পরিবারের আয়ের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলার কারণে এসব ঘটেছে। শুধু একটি পরিবারে কোনো আয় কমেনি ওষুধের দোকান থাকার কারণে।

আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, শিশুশ্রমিকেরা কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসছে না। স্কুলের যেসব কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে, এগুলো শুধু স্কুলের শিশুরাই পাচ্ছে। কিন্তু যারা স্কুলে যাচ্ছে না, তাদের এসবের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। গত বছর হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে। সেখানে অনেক শিশুশ্রমিক ছিল। তাদের বয়স ১৫ বছরের ওপরে হলেও তারা কাজ করতে এসেছিল মূলত করোনার কারণেই।

শিশুদের জন্য যে বাজেট দেওয়া হয়, তাতে দুটি মন্ত্রণালয় অগ্রাধিকার পায়। একটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং অন্যটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এখানে ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা চোখে পড়ে। শিশুশ্রম বিষয়টি দেখার দায়িত্ব শ্রম মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয়ে কখনো কোনো বাজেট দেখিনি এই শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য। আমার জানামতে, শ্রম মন্ত্রণালয় ২৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পেয়েছিল। সেই প্রকল্প শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা শুরু হয় ২০২২ সালে। তা–ও মাত্র ১ লাখ শিশুকে লক্ষ্য করে। এভাবে ১৭ লাখ শিশুকে শিশুশ্রম থেকে বের করে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

মামুনুর রশিদ

এসডিজির প্রথম পাঁচটি লক্ষ্যমাত্রার প্রতিনিধিত্ব করছে মা ও শিশু সুরক্ষা কর্মসূচি। এ বছর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ১০ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মা ও শিশু সুরক্ষার জন্য, যা এই মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটের ২৮ শতাংশ। শুধু টাকাটা হস্তান্তর করে পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে না। ২০১৮ সালের ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়, শুধু টাকা, খাবার কিংবা আচার-আচরণ পরিবর্তন দ্বারা পুষ্টি নিশ্চিত করা অসম্ভব, যদি না এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় না হয়। বিদ্যালয় খাদ্য কর্মসূচি ২০২১ সালে শেষ হওয়ার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা পুনরায় চালু করা গেল না। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। এখানে কেন আমরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিলাম না? ২০০৯ সালে বিদ্যালয় খাদ্য কর্মসূচি নীতিমালা প্রণীত হয়। এই নীতিমালায় বিভিন্ন ধরনের যেমন মধ্যাহ্নকালীন খাবার, গরম খাবার ইত্যাদি নানা বৈচিত্র্য রাখা হয়েছে।

মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, ২৯ শতাংশ পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ২৯ শতাংশ পরিবারকে আমরা যদি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে পারি আর আমাদের চরম দারিদ্র্যের হার যদি ২০ শতাংশের নিচে হয়, তাহলে কেন আমরা এই জায়গায় সফল হতে পারছি না? তার মানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে আমাদের ঘাটতি রয়ে গেছে। সেখানে তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা।

মা ও শিশু সুরক্ষা কর্মসূচিতে উন্নয়ন সহযোগীদের পাশাপাশি সরকারকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। গত দুই অর্থবছরে এই প্রোগ্রামে আমরা কোনো ধরনের বরাদ্দ বৃদ্ধি দেখতে পাইনি। এ বছর ২০ শতাংশ বরাদ্দ বেড়েছে। শহর এলাকার দারিদ্র্যের প্রকৃতি ভিন্ন। তাই শহরে কর্মসূচিও ভিন্ন হতে হবে।

ইশরাত শবনম

ইউরোপীয় ইউনিয়ন শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে। ২৪ কোটি ৭০ লাখ ইউরো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আর্থিক চুক্তির মাধ্যমে কর্মসূচি চালু করছি। এই মুহূর্তে চারটি উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান সম্পূর্ণ শিশুসুলভ। আর অন্যগুলোও শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট সাপোর্ট দিয়ে থাকে।

এখানে আমার অনেক সহকর্মী রয়েছেন, যাঁরা মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট প্রোগ্রাম িনয়ে কাজ করছেন। আমাদের সবার লক্ষ্য তথ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিকে উন্নত করা যেন উপকারভোগী চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে সেবা প্রদান পর্যন্ত একটি কাঠামোগত পরিবর্তন আনা যায়। আসলে মাদার অ্যান্ড চাইল্ড বেনিফিট প্রোগ্রামটি কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় রয়েছে। এদের প্রতিটিরই আলাদা এমআইএস রয়েছে। এদের এমআইএসগুলো যদি আন্তসম্পর্কিত হয় তাহলে সমন্বিত সেবা প্রদান, বাজেট ব্যবহার ও কর্মসূচির সর্বোত্তম প্রয়োগ নিশ্চিত হবে।

পরবর্তী বছর আমরা যেসব সুপারিশপত্র পাব, সেগুলো নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করব, যেন এমআইএস কার্যকর করা যায়। আমাদের যাঁরা এমআইএসের বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁরা উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পেরেছেন যে এই কাজ কঠিন নয়। শুধু এখানে আমাদের ও সরকারের অঙ্গীকার প্রয়োজন। বরাদ্দের দিকটি চিন্তা করলে বোঝা যাবে, খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। এখানে শুধু অঙ্গীকার এবং উদ্যোগের প্রয়োজন।

হাসিনা বেগম

প্রথমে আমি মাঠপর্যায়ের একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে চাই। গত সপ্তাহে খুলনার দাকোপ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। প্রতিদিন দুবার ভাটার কারণে এগুলো একেকটি দ্বীপে পরিণত হয়। সেখানে যেতে পাঁচ ধরনের যানবাহন ব্যবহার করতে হয়েছে। আমরা কথা বলেছিলাম ১২–১৩ জন মায়ের সঙ্গে, যাঁরা স্তন্যদানকারী মাতৃভাতার সুবিধা নেন। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই সুবিধার টাকা তাঁরা কীভাবে ব্যবহার করেন! ১১ জন উত্তর দিয়েছেন, এই টাকা তাঁরা বছরে একবার উত্তোলন করতে পারেন। তাঁরা উপজেলা পর্যায়ে যান তিন মাস পরপর। কিন্তু এসব এলাকা দুর্গম এবং উপজেলা শহর থেকে অনেক দূরে।

গর্ভবতী মায়ের পক্ষে তিন মাস পর গিয়ে টাকা উত্তোলন করা অসম্ভব। তাই তাঁরা বছরে একবার টাকা উত্তোলন করেন। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তাঁরা টাকাগুলো কী করেন। কেবল একজন বলেন, কিছু টাকা তিনি ব্যয় করেন পুষ্টিকর খাবার কেনার জন্য আর বাকি ১০ জনই ব্যয় করেন ঘরের চাল মেরামত, মেয়ের বিয়ে প্রভৃতি বাবদ। প্রসঙ্গটি আমি আনলাম, এই জন্য যে বেশি বরাদ্দ আর কম বরাদ্দের কথা উঠছে, এই বিষয় বোঝানোর জন্য। বরাদ্দ যা–ই হোক, আমরা যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে সঠিকভাবে এটার ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে এটার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

বজলুল হক খন্দকার

২০১৫ সালে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র তৈরির জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলাম ।

২০১৬ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৪৭ শতাংশ পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু যেসব পরিবারে শিশু ছিল, তাদের ৫৪ শতাংশের বেশি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি ৩৫ শতাংশ পরিবারকে কোনো না কোনো ভাতার আওতায় আনি। তাহলে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পরিবার শুরুতেই বাদ যাচ্ছে। এটা একটি সমস্যা। আবার শহর থেকে গ্রামের শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ বছরই আমরা হাউসহোল্ড সার্ভে এবং মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) নিয়ে কাজ করছি। সেখানে আমরা বিভাগভেদে ঝুঁকির পার্থক্য পাই। এ ক্ষেত্রে তিন ধরনের বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। তাহলে আমরা কোন জায়গায় কোন ধরনের নীতিমালা প্রয়োগ করব, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

করোনার কারণে প্রায় দুই বছর বিদ্যালয় বন্ধ ছিল। এই ক্ষতি কীভাবে দূর করা যায় সে জন্য বিশ্বব্যাংক গবেষণা করেছে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে হিসাব করতে হবে। কারণ, সময়ের কোনো পরিপূরক নেই। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, ১০ বছরের একটি শিশু কোনো সাধারণ গল্প ভালোভাবে বুঝতে ও পড়তে পারছে না—করোনার আগে এই হার বিশ্বব্যাপী ছিল ৫০ শতাংশ। সেই হার এখন বেড়ে হয়েছে ৭০ শতাংশ। নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে এই সময়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ এ হিসাবে আছে কি না বলতে পারছি না। তবে ইন্দোনেশিয়ার হিসাবমতে, মোট ক্ষতির পরিমাণ ২৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের মোট জিডিপির ২১ শতাংশ।

মা ও শিশুদের জন্য সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যদিও তা যথেষ্ট নয়। আমরা হিসাব করেছি, প্রথম শিশুর জন্য ১ হাজার টাকা, দ্বিতীয় শিশুর জন্য ৮০০ এবং তৃতীয় শিশুর জন্য কোনো টাকা দেব না। এ ক্ষেত্রে আমরা সহজ কিছু শর্ত যোগ করেছি। কীভাবে পুষ্টিকর খাবার রান্না করা যায় বা তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে মাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সেখানে ৩০০ টাকার মতো দেওয়া হবে পরিবারকে। তা ছাড়া তাদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে হবে এবং শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। এভাবে রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৭০ শতাংশ, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে ৬০ এবং ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৪০ শতাংশ খরচ করা হবে। এতে ২০২১ সালে মোট খরচ হবে জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৫ সালে হবে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।

জাফর সাদিক

আজকের আলোচনায় শিশুরা থাকলে তাদের কথা শোনা যেত। শিশুরা তাদের কথা বলতে চায়। তাদের বলার জায়গাটা যদি আমরা তুলে ধরতে পারি, তাহলে সমস্যা কোথায়, সেটা জানতে পারব। তাদের চাহিদা কী, তারা কী বলতে চায়—এসব বিষয় জানা প্রয়োজন।

তাহলে শিশুদের সমস্যা শিশুদের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। সামাজিক সুরক্ষায় যে বাজেট, সেখানে তো শিশুদের জন্য বরাদ্দ আছে। তা ছাড়া এটাকে আমরা একটা ক্রস কাটিং জায়গা থেকে দেখতে পারি। কারণ. এতে বিনিয়োগ করা হলে আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন জায়গায় সুবিধা পাব।

শুধু বরাদ্দ হলেই হবে না। এখানে বাস্তবায়নের বিষয় আছে। সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দকৃত অংশের বাস্তবায়নের তথ্য কিন্তু সহজলভ্য নয়। এ বিষয়ে যত্নবান হওয়া দরকার। এ তথ্যগুলো যদি সহজলভ্য করা যায়, তবে পরবর্তী সময়ে যাঁরা এগুলো নিয়ে গভীরভাবে কাজ করবেন, তাঁদের সুবিধা হবে।

সুলতানা সাঈদা

আমাদের দেশে ১২০টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে ৫৪টি নিয়ে কাজ করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ২৩টি ভাতা কার্যক্রম। আমরা যদি ১০ বছর পেছনে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে ভাতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমরা কতটা বাস্তবায়ন করতে পারছি, এই প্রশ্ন থেকে যায়।

আমাদের কর্মসূচিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই শিশুবান্ধব কর্মসূচি। সারা দেশে ১৪টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে। এগুলো পথশিশু উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। করোনা–পরবর্তীকালে ১০ হাজার শিশু এতিম হয়েছে। আমাদের কিন্তু ৪ হাজার ৭০টি বেসরকারি এতিমখানা আছে। মাদকাসক্ত ও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত শিশুদের জন্য রয়েছে শিশু উন্নয়নকেন্দ্র। পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য রয়েছে ছোটমণি নিবাস। স্বল্প আয়ের কর্মজীবী মায়েদের জন্য আছে দিবাযত্ন কেন্দ্র। এখন মূল কাজ হলো, এসব তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আমাদের দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে তিনটি।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন কাজ করে। সারা দেশে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সাহায্য সেবাকেন্দ্র আছে। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এ ধরনের কেন্দ্র আরও ১২২টি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ কথাটি খুবই ভালো লেগেছে। আমরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষা ভাতা এবং বেদে, অনগ্রসর, হিজড়া সবাইকে ভাতা দিচ্ছি। এখানে প্রকৃত উপকারপ্রার্থীরা ভাতা পাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। তাহলেই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমি ইউনিসেফের জ্ঞাতার্থে একটা বিষয় তুলে ধরব। আমাদের রাজস্ব বাজেট বাড়ছে। এই রাজস্ব বাজেটের সঙ্গে যেসব প্রকল্প আমরা হাতে নিচ্ছি, সেগুলো শিশুবান্ধব এবং সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রকল্প, যা বরাদ্দ অনুসারে নেওয়া হয়ে থাকে। আমরা বাংলাদেশ শিশুবান্ধব সামাজিক সুরক্ষা নামে একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি।

এটি ২২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকার একটা প্রকল্প। এখানে ১০৯৮ নম্বরে একটি হেল্পলাইন আছে, যা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো শিশু তার অসুবিধার কথা জানাতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা বাল্যবিবাহ ও শিশু নির্যাতন রোধ করেছি।

শামসুল আলম

স্বপ্ন দেখানো সহজ। কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন। তবে এটাও ঠিক, গত সাড়ে ১৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। ২০০৯ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে উত্তরণ, তা সম্ভব হয়েছে রূপকল্প থাকার কারণে।

সরকার ২০১৫ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছর মেয়াদি যে সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র গ্রহণ করেছে, তাতে ন্যায়বিচার ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং আয়বৈষম্য কমিয়ে আনাই মূল লক্ষ্য, যা জনকল্যাণমুখী সরকারের পরিচায়ক। করোনাকালে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ কিছুটা কমে এসেছিল, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। এটা হয়েছে অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিশেষ নজর দেওয়ার কারণে। ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এটি কিন্তু কম নয়!

১০০টি উপজেলায় বয়স্ক ভাতা দেওয়া হলো। বিদেশফেরত ব্যক্তিদের পুঁজি সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটাও সামাজিক সুরক্ষার অংশ। যদিও ১২০টি সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে এসব নাম নেই।

শিশুদের সামাজিক সুরক্ষায় মধ্যাহ্নকালীন খাবার একটা কার্যকর পদ্ধতি, বিশেষ করে ঝরে পড়া রোধ করা ছিল আমাদের লক্ষ্য। ২০ শতাংশ ঝরে পড়ার হার আরও কমিয়ে আনার জন্য এটা চালু করা হয়।

সরকার চায় এই কর্মসূচি চালু থাকুক। ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও এতে সাহায্য করুক, সেই আবেদন সরকার রেখেছে। শিশুদের জন্য যে উপবৃত্তি ও বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দেওয়া হয়, সেটাও কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার অংশ হতে পারে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা সব দরিদ্র মানুষকে ২০২৫ সালের মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে।

সবকিছু বাস্তবায়ন করতে না পারলেও রূপকল্প ২০৪১–এ আমরা যা কিছু বলেছি, তার অনেকগুলোরই বাস্তবায়ন করেছি। ২০১০ সালে বলেছিলাম, ২০২১ সালে মাথাপিছু আয় হবে ২ হাজার ডলার। কিন্তু তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারে। এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে। খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলেছিলাম, যা প্রায় অর্জিত হয়েছে। আমরা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারের কথা বলেছিলাম। তা–ও কিন্তু ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হয়েছে, যেমন রাজস্ব। তবু আমরা গত বছর ১৬ শতাংশ রাজস্ব বাড়িয়েছি।

কেউ কেউ বলেন, করোনার কারণে ১৪ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ শ্রমে যোগদান করেছে। কারও বাল্যবিবাহ হয়েছে। দুই বছরে এটা হয়ে থাকবে হয়তো। কিন্তু এটা পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হয়েছে।

সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে সব শিশুর স্কুলে আসা নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে গ্রামে মুদ্রাস্ফীতি বেশি। তাই যারা সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ভাতা পাবেন, তাঁদের ভাতার পরিমাণ যেন শহরের তুলনায় কিছুটা বেশি হয়।

প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিকের তুলনায় দেড় গুণ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তা ছাড়া ৯০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের জন্য স্বাভাবিকের দ্বিগুণ পেনশন দেওয়ার কথা ভাবছি। এগুলো সরকার নীতিগতভাবে গ্রহণ করেছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে।

ফিরোজ চৌধুরী

শিশু সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের শিশুরাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিশু সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • ভবিষ্যৎ নির্মাণে শিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে।

  • শিশুদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরি।

  • কোভিডের জন্য এতিম হওয়া ‍শিশুদের সুরক্ষায় বিশেষ উদে্যোগ নিতে হবে।

  • মা ও শিশুর সুরক্ষা উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি করতে হবে।

  • শিশুশ্রম বন্ধে শ্রম মন্ত্রণালয়কে সচেতনভাবে কাজ করতে হবে।

  • শিশু সুরক্ষায় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আরও গুরুত্ব দরকার।

  • শিশুদের স্কুলে যাওয়া যেন বন্ধ না হয়, সে জন্য মধ্যাহ্নকালীন খাদ্য বিতরণসহ এ ধরনের উদ্যোগ চালু রাখতে হবে।

  • শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকার শিশুদের পৃথক সামাজিক সুরক্ষা দরকার।

  • শিশুদের জন্য ‘আপৎকালীন তহবিল’ রাখতে হবে।

  • শিশুবিষয়ক কর্মসূচির সঠিক তদারকি ও বাস্তবায়ন প্রতিবেদন থাকা জরুরি।