হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য রোধ এবং যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষা
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির উদ্যোগে ২৯ আগস্ট ‘হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য রোধ এবং যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
অংশগ্রহণকারী
নাছিমা বেগম
চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
আরমা দত্ত
সংসদ সদস্য
শামীম হায়দার পাটোয়ারী
সংসদ সদস্য
মোকতার হোসেন
পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা), সমাজসেবা অধিদপ্তর
তাসলিমা ইয়াসমীন
সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়
মো. শাহ জাহান
উপপরিচালক (বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া জনগোষ্ঠী) সমাজসেবা অধিদপ্তর
আনিসুল ইসলাম হিরু
চেয়ারপারসন, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি
উম্মে ফারহানা জেরীফ কান্তা
পরিচালক, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি
জয়া সিকদার
সভাপতি, সম্পর্কের নয়া সেতু
অনন্যা বণিক
প্রেসিডেন্ট, সাদাকালো
শোভা সরকার
জুনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার, ব্লাস্ট
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
মানুষের চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণার মধ্যে এখনো পশ্চাৎপদতা রয়ে গেছে। ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াদের অনেক ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। কিছু পরিবারও তাদের স্বীকার করতে চায় না। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ নিয়েই আজ আলোচনা হবে।
তাসলিমা ইয়াসমীন
গত বছর ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে একটি পলিসি ব্রিফ তৈরি করেছিলাম। যেখানে আমরা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা দেখার চেষ্টা করি। এ সহিংসতা ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া মানুষদের ক্ষেত্রে কেমন, সেখানে আইনি সুরক্ষার ক্ষেত্রে ফারাক কতটুকু এবং সে ক্ষেত্রে আইনি পরামর্শ কী দেওয়া যেতে পারে—বিষয়গুলো সেখানে এসেছিল।
বেশ কয়েকটি জায়গায় বাইনারি লিঙ্গের পাশাপাশি অন্যান্য বা তৃতীয় লিঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এটা সব জায়গায় নেই এবং একেক জায়গায় একেকভাবে এটাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন জাতীয় পরিচয়পত্রে হিজড়া লিঙ্গ বলা হচ্ছে। হিজড়া তো কোনো লিঙ্গ পরিচয় হতে পারে না। একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষের লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তনের কোনো নীতিমালাগত প্রক্রিয়া আমাদের নেই। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পুরোনো দণ্ডবিধি থেকে শুরু করে সব জায়গায়ই বাইনারি লিঙ্গের বাইরে চিন্তা করা হচ্ছে না।
আমাদের আইনি কাঠামোতে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের কথা একেবারেই নেই। ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক প্লেসে অনেক ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। আইনি সুরক্ষা না থাকায় সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গবেষণায় এসেছে, আইনের ৩৭৭ ধারাটি তাঁদের ভীতি প্রদর্শনের জন৵ ব্যবহার করা হয়। এ আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। আমাদের একটি আলাদা ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইন প্রয়োজন।
অনন্যা বণিক
বর্তমান সময়ে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিজড়া কমিউনিটি তৈরি হয়েছে, যারা ভিক্ষাবৃত্তি করতে চায় না। এসব মানুষ কাজ বা চাকরি করতে চান। সমাজে বৈষম্য রোধ করতে চাইলে নারী-পুরুষের পাশাপাশি ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের নিয়ে আসতে হবে। এমন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, যেখানে আমরা ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা সহজে যুক্ত হতে পারব। কর্মক্ষেত্রে একটি সহনশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে এ বৈষম্য এমনিতেই কমে যাবে। তখন শিক্ষা ও পারিবারিক সহায়তা বিষয়টি আসবে। মানুষের মানবিক গুণাবলি পরিবার থেকেই তৈরি হয়। সে জন্য বৈষম্য রোধে পরিবারের সমর্থন, শিক্ষা ও চাকরির ব্যবস্থা করা জরুরি। ট্রান্সজেন্ডার মানুষের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। দেশের বাইরে আমাদের জনগোষ্ঠীর অনেকে যৌন পেশার সঙ্গে জড়িত। অনিরাপদ যৌনকাজ করতে হচ্ছে তাঁদের। এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকিতে আছেন তাঁরা। ওই ব্যক্তিরা যখন দেশে ফিরবেন, তখন তাঁরা দেশকেও ঝুঁকিতে ফেলবেন। সে জন্য বিমানবন্দরে তাঁদের জন্য এইচআইভি শনাক্তকরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
শোভা সরকার
আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, সেখানে আমাকে আলাদা করে দেখা হচ্ছে না। পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে যখন দেখি আমার নারীসুলভ আচরণ, আমি একজন নারী, তখন থেকেই আমাদের প্রতি বৈষম্য শুরু হয়। এ আচরণের জন্যই আমরা বাড়িঘর, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের আচরণকে কেন সাধারণভাবে নেওয়া হবে না? বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য। আমার মধ্যে বৈচিত্র্য আছে, কাজেই সৌন্দর্যও আছে। আমাদের জন্য শিক্ষা খুবই জরুরি। সরকার আমাদের নিয়ে কাজ করছে। এটা ঠিক যে হিজড়াদের বিরুদ্ধে রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজি ও ভিক্ষাবৃত্তির অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব কেন করে, তা আমাদের ভাবতে হবে। প্রতিটি অফিসে অন্তত একজন করে ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে চাকরি দিলে রাস্তায় কোনো ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া থাকবে না।
জয়া সিকদার
এখন আমাদের দেশে ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। এ জায়গায় ট্রান্সজেন্ডার মানুষের প্রতিনিধি রাখা প্রয়োজন ছিল। ট্রান্সজেন্ডার প্রতিনিধি ছাড়া এটা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে বলে সেখানকার কোনো কিছু আমরা জানতে পারছি না। ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলে ট্রান্সজেন্ডার–বান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি করা দরকার। উপমহাদেশে হিজড়া সংস্কৃতি অনেক পুরোনো সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিকে সম্মানের জায়গা থেকে দেখতে হবে। আমাদের দেশে নীতিমালাতে এটাকে বারবার লিঙ্গ হিসেবে নিয়ে আসা হয়। ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে সকলকে চিহ্নিত করে করে সেই বৃহত্তর ছাতার মধ্যে হিজড়াকে আনা দরকার। ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি আগে ও হিজড়া শব্দটি পরে আসা প্রয়োজন। কেননা ট্রান্সজেন্ডার শব্দের ভেতরেই হিজড়া যুক্ত রয়েছে।
মো. শাহ জাহান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে এসেছে, দেশে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯। ২০১৬ সালে আমাদের এক জরিপে এ সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৯৩। আমাদের জরিপটা করা হয়েছিল ডাক্তারি পরীক্ষার ভিত্তিতে। ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিজড়াদের ফেলা যায়৷ কিন্তু হিজড়া একটি সংস্কৃতি। আর ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক বৈচিত্র্যের কারণে। সম্প্রতি সরকার এ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি তথ্যভান্ডার তৈরির নির্দেশ দিয়েছে, যেন এ তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া যায়। ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা নানা দিক থেকে বৈষম্যের শিকার। বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কিছু ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই রয়েছে। ভাতা প্রদান এর মধ্যে অন্যতম। সারা দেশে ২ হাজার ৬০০ জনকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ১ হাজার ২২৫ জন ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছর কর্মক্ষম ১ হাজার ২০ জন ট্রান্সজেন্ডারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ জনগোষ্ঠীর জন্য আইনি সুরক্ষার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আমরা ইতিমধ্যে এ কাজটি শুরু করেছি। ট্রান্সজেন্ডার মানুষের প্রতি বৈষম্য রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
উম্মে ফারহানা জেরীফ কান্তা
সময়ের সঙ্গে ট্রান্সজেন্ডার তথা হিজড়া কমিউনিটির মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। আমাদেরও শেখার জায়গা তৈরি হয়েছে। আমরা এখন কাজের ক্ষেত্রে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ ও ‘হিজড়া’ দুটি শব্দই ব্যবহার করি। কারণ, এ বিষয়ে একটি গেজেট হয়েছে এবং সেখানে হিজড়া লিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ জায়গাটা আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টতে (এসডিজি) কাউকে পেছনে না রেখে এগোনোর কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র তার একটি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন করতে পারবে না। আমাদের সংবিধানে প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শেষে সম্ভাব্য নিয়োগদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আরও সময়োপযোগী পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। সমাজসেবার প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিশ্চিতকরণের বিষয়টি সমাজসেবার পরিকল্পনায় রাখা দরকার।
মোকতার হোসেন
ট্রান্সজেন্ডারবিষয়ক আলোচনাটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এত দিন জনসংখ্যার একটা নির্দিষ্ট অংশকে আমরা কিছুটা এড়িয়ে চলছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। ট্রান্সজেন্ডার মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রথমেই পরিবারে নজর দিতে হবে। সন্তান ট্রান্সজেন্ডার অথবা বিশেষভাবে সক্ষম হয়ে জন্মগ্রহণের ক্ষেত্রে মা-বাবার কোনো কর্তৃত্ব নেই। তাই এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হবে। একটা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা অশোভন হিসেবে দেখা হতো। এখন পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার ও ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের বিষয়েও পাঠ্যক্রমে থাকা উচিত। শিশুরা শৈশব থেকেই ট্রান্সজেন্ডার মানুষের সম্পর্কে জানলে ও অভ্যস্ত হলে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সহজ হতো। এসব মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
আনিসুল ইসলাম হিরু
আমরা যৌনতা ও যৌন আচরণের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করি। সে জায়গা থেকে লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষ সব সময় বৈষম্যের শিকার হয়। এ বৈষম্য শুরু হয় পরিবারে, তারপর সমাজে ও রাষ্ট্রে। ২৫ বছর ধরে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি এ জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছে। এ জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি আছে। সেই ভিত্তিতেই বিভিন্ন জায়গায় কাজ হচ্ছে। বিদেশে কোনো ফর্ম বা ভিসার ক্ষেত্রে নারী, পুরুষের পাশাপাশি ‘আদার্স’ (অন্যান্য) লেখার অপশন থাকে। সেখানে আমরা এটাকে শুধু ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দ দিয়ে বেঁধে দিচ্ছি। সবাই তো আর তৃতীয় লিঙ্গ নয়৷ অনেকেই হয়তো অন্য পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়। এ জায়গায় কাজ করতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক কারিকুলাম বোর্ডের সঙ্গে কাজ করছি। সেখানে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে সপ্তম শ্রেণিতে একটি সহায়ক বই পড়ানো হচ্ছে, যেখানে এ জনগোষ্ঠী ও তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, সে বিষয়ে বলা আছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তাদের একটি শাখায় ট্রান্সজেন্ডার মানুষ নিয়োগ দেওয়ায় সেখানে তার জন্য আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা করেছে। এ ধরনের উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
নাছিমা বেগম
হিজড়াদের নিয়ে করা নীতিমালায় তাদের প্রস্তাবেই ‘হিজড়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। হিজড়া হিসেবে জন্ম নেওয়া সন্তানের কোনো অপরাধ না। একই সঙ্গে এটা মা–বাবারও কোনো অপরাধ না। এটা প্রকৃতিগত কারণেই হয়ে থাকে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা মানুষ। এ জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের মা–বাবাকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। এ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগা। কেননা, তারা মা–বাবার সাহচর্য, ভাই-বোনের স্নেহ পায় না। কোনো অভিভাবক এদের বাড়ি থেকে বের করে দিলে সেই অভিভাবককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের মতো দায়িত্বে এ জনগোষ্ঠীকে অবলীলায় চাকরি দেওয়া যায়। এ জনগোষ্ঠীর সফল ব্যক্তিদের বিভিন্ন মিডিয়ায় তুলে ধরে অন্যদের উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী
আমাদের সংবিধানে সবার জন্য সমতার কথা বলা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার বা লিঙ্গ রূপান্তরিত নারী ও পুরুষ সবারই প্রথম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার দরকার। স্কুলে যাওয়া, স্বাস্থ্যসেবার জন্য ডাক্তারি পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। সংবিধান অনুযায়ী সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া যাবে, যা বৈষম্যমূলক মনে হলেও। অর্থাৎ তাদের যোগ্যতা কম থাকা সত্ত্বেও কোটায় চাকরি ও সহায়তা দেওয়া যাবে। দুই দশক আগে, ২০০১ সালে ভারতে গিয়ে সেখানে সব জায়গায় হিজড়াদের তীব্র উৎপাত দেখেছি। পরবর্তী সময়ে তাদের ক্ষমতায়ন হওয়ায় এখন তারা কোনো উৎপাত করে না। এ জন্য তাদের স্বনির্ভর করতে হবে। কোভিড–পরবর্তী সময়ে হিজড়াদের জন্য থাকা প্যাকেজগুলো যেন কমে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
আরমা দত্ত
আলোচনায় এসেছে হিজড়া একটি সংস্কৃতি। তাই সংস্কৃতির চোখ দিয়ে এদের দেখতে হবে। আমাদের দেশে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমরা কখনো ভাবিনি যে ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আলোচনায় বসা সম্ভব। ছোটবেলায় কোনো বাড়িতে শিশু জন্মালে এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা সেজেগুজে আসত। আনন্দ করত। গত ২৫ বছরের এ পরিবর্তনের জন্য ‘বন্ধু’ কাজ করে যাচ্ছে। এ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যাবে কোথায়? প্রথমেই তারা পরিবার ও সমাজে বৈষম্যের শিকার। সে জন্য তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা আবশ্যক। সরকার তাদের ট্যাক্স অব্যাহতিসহ অনেক সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে। ট্রান্সজেন্ডারদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি জরুরি। তাদের কল্যাণে বিল পাস করা জরুরি। এ জন্য সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে ৭-৯ জনের একটি কমিটি করে সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটা খসড়া প্রস্তুত করা যেতে পারে, যা অক্টোবরে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা সম্ভব। এরপর আমরা এটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যেতে চাই। সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটা ককাস করা যেতে পারে।
ফিরোজ চৌধুরী
আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সম্মানিত অতিথি ও আলোচকদের প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।