সংলাপ
জেন্ডার বিষয়ে তরুণদের আচরণগত মনোভাব অন্বেষণ
আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস উপলক্ষে গত ১০ অক্টোবর ২০২২ ব্র্যাক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে। আলোচনার নির্বাচিত অংশ এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
অংশগ্রহণকারী
দীপু মনি এমপি
শিক্ষামন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
রাশেদা কে চৌধূরী
নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান;
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
ফরিদা পারভীন
মহাপরিচালক, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর
নেহাল আহমেদ
মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর
মিজানুর রহমান
সাবেক চেয়ারপারসন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
আসিফ সালেহ
নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক
ফাহমিদা খাতুন
নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
প্রধান নির্বাহী, বেলা
মেহ্জাবীন হক
অধ্যাপক, শিক্ষা ও কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কে এ এম মোরশেদ
জ্যেষ্ঠ পরিচালক, ব্র্যাক
এস এম মনজুর রশিদ
কর্মসূচি প্রধান (অ্যাডভোকেসি), ব্র্যাক
করভী রাখসান্দ
প্রতিষ্ঠাতা, জাগো ফাউন্ডেশন
অরুনিমা তাহসিন
সদস্য, ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম
শাহরিয়ার কবির ফাহিম
সদস্য, ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম
সঞ্চালনা
নবনীতা চৌধুরী
পরিচালক, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি, ব্র্যাক
নবনীতা চৌধুরী
ব্র্যাকের পক্ষ থেকে সবাইকে শুভেচ্ছা। ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার’। এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বরাবরের মতো এবারও আমরা কন্যাশিশু দিবস পালন করছি। এ বিশেষ দিন সামনে রেখে ব্র্যাক ‘জেন্ডার বিষয়ে বাংলাদেশে যুবসমাজের মনোভাব কী’ এ বিষয়ে পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফল আপনাদের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। গবেষণায় যুবসমাজকে প্রাথমিক রেস্পনডেন্ট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ, আপনারা জানেন যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশই তরুণ। তাঁরাই ভবিষ্যতে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। তাই সমাজে তরুণেরা জেন্ডার বিষয়ে কী মনোভাব পোষণ করছেন, তা না জেনে কোনো পদক্ষেপও নির্ধারণ করা সমীচীন হবে না। কাজেই প্রচলিত ধারণা বা পারসেপশনের ওপর ভরসা করার পরিবর্তে, একটি প্রকৃত গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে চেয়েছি, আমাদের তরুণেরা জেন্ডার বিষয়ে কী ভাবেন।
কে এ এম মোরশেদ
১৮ থেকে ৩৫ বছরের যুবকেরা আমাদের আগামী, জাতির ভবিষ্যৎ। সমাজের এ অংশ আমাদের কথা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যমসহ সব মাধ্যমের কথা শুনে একটি মত গঠন করে। এ মতটি শিগগিরই সমাজের প্রভাবশালী মতে পরিণত হয়। সে জন্য যুবদের মতামত নিয়ে গবেষণা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ যুবসমাজ কী ভাবছে, তা জানলে আমাদের কর্মসূচিগুলো যথাযথ হয়। আমরা এ রকম চারটি গবেষণার পরিকল্পনা নিয়েছি। এ প্রজন্ম জেন্ডার নিয়ে কী ভাবছে, তা জানা আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা নির্ধারক হতে পারে। এ গবেষণার ফলাফলের নেতিবাচক দিকগুলোর সমালোচনা করার কিছু নেই। এটাকে ব্যবহার করে নেতিবাচক দিকগুলো যেন মোকাবিলা করা যায়, সে জন্যই আমরা যুবসমাজ ও জেন্ডার নিয়ে প্রথম গবেষণাটি করলাম, যা আপনাদের সামনে আজ উপস্থাপিত হবে। সব ফলাফল আমাদের পছন্দ হবে না। অপছন্দের ফলাফলগুলো পছন্দের জায়গায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় রয়েছে।
মেহ্জাবীন হক
ব্র্যাকের ‘অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ’ বিভাগের উদ্যোগে নভেম্বর ২০২১ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত দুই ধাপে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। আট বিভাগের আট জেলায় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ২ হাজার ৭৯০ জনের ওপর জরিপটি করা হয়।
বাংলাদেশের যুবদের জেন্ডার নর্মের প্রতি মনোভাব উন্মোচন করা আমাদের গবেষণাটির উদ্দেশ্য ছিল। যেকোনো সমাজে নারী–পুরুষের ভূমিকা, কে কী কাজ করবে, বৈশিষ্ট্য কেমন হবে—ইত্যাদি সে সমাজ বলে দেয়, এটাকে জেন্ডার নর্ম বলা হয়ে থাকে। সমাজে নারী–পুরুষের আচরণ কেমন হবে, তা এ জেন্ডার নর্ম দ্বারাই নির্ধারিত হয়। আমাদের দেশে জেন্ডার নর্ম পরিমাপের কোনো স্কেল তেমনভাবে নির্ধারিত নেই বিধায় আমরা একটি জেন্ডার নর্ম স্কেল তৈরি করেছি। এ ছাড়া এ গবেষণায় আরও কিছু স্কেল ব্যবহার করা হয়েছে। এ গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান ছিল।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ‘মেয়েদের উচ্চ স্বরে কথা বলা উচিত নয়’ বলে মনে করছেন ৮২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। ৬৩ শতাংশ মনে করেন, ‘পোশাকের কারণে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হন’। ‘ছেলেদের রাগ থাকা উচিত’ মনে করেন ৭৭ শতাংশ। ৭১ শতাংশ মনে করেন, ‘ছেলেদের কাঁদা উচিত না’। ‘স্বামী যথেষ্ট আয় করলে স্ত্রীর চাকরি করার দরকার নেই’ বলে মনে করেন ৭৫ শতাংশ। ছেলেমেয়ের মতামতের আলাদা পরিসংখ্যানে জেন্ডার সমতার প্রতি মেয়েদের অনেক বেশি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়। ‘নারীর চেয়ে পুরুষের চাকরি করার অধিকার বেশি’ বলে মনে করেন ৫১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। ‘মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরিবারের’ এমন মনে করেন ৬২ শতাংশ। ৭৩ শতাংশ মনে করেন, ‘পরিবারের বড় খরচগুলোর ক্ষেত্রে শেষ কথা পুরুষের’। ‘পরিবারের ছোট খরচের ক্ষেত্রেও শেষ কথা পুরুষের হবে’ বলে মনে করেন ৭১ শতাংশ।
অংশগ্রহণকারী যুবদের ৫০ শতাংশের বেশির ঝোঁক ছিল অসমতাভিত্তিক জেন্ডার নর্মের প্রতি। গ্রামে বেড়ে ওঠা অংশগ্রহণকারীদের চেয়ে শহরে বেড়ে ওঠা অংশগ্রহণকারীরা জেন্ডার নর্মের প্রতি বেশি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্তত এইচএসসি পাস ব্যক্তিরা জেন্ডার নর্মের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। অংশগ্রহণকারীদের অভিভাবকেরা এইচএসসি পাস হলে অংশগ্রহণকারী জেন্ডার নর্মের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
অরুনিমা তাহসিন
দক্ষিণ এশিয়ায় এ বিষয়ে পরিমাণগত কাজই বেশি হয়েছে, গুণগত কাজের একটা ঘাটতি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আজ উপস্থাপিত গবেষণায় গুণগত কাজের দিকটা গুরুত্ব পেয়েছে। পরিবারে সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। এটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, ছেলেদের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে। যেসব পেশা নারীর বলে গণ্য করা হয়, এমন পেশায় আসা থেকে ছেলেদেরও বিরত রাখা হয়। যেমন নাচের ক্ষেত্রে। এ সংস্কৃতি পরিবার থেকেই আমরা পাই। শৈশবের অভিজ্ঞতা আমাদের চিন্তা ও পছন্দকে অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবিত করে। ফলে বৈষম্য ও অবহেলার মধ্য দিয়ে বড় হওয়া মানুষের কাছে এটাই একমাত্র বাস্তবতা বলে মনে হয়। এর বাইরে তিনি চিন্তা করতে পারেন না। নারীদের জন্য এ রকম আওয়াজ তোলা অনেক কর্মসূচি হচ্ছে। কিন্তু সেখানে আমরা ছেলেদের অংশগ্রহণ কম দেখি। আজকের এ রিসার্চ প্রতিবেদনে ছেলেদের ধারণাও বিবৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা কম সমতাসূচক আচরণ করছে। সে জন্য তাদের যুক্ত করে কর্মসূচি করা দরকার।
শাহরিয়ার কবির ফাহিম
আমাদের সমাজে ধর্ষণ ও সহিংসতার জন্য দায়ী করা হয় পোশাক, চরিত্র ইত্যাদি বিষয়কে। কোনো জায়গায় ছিনতাই হলে সেখানে ছিনতাইকারীকে দোষারোপ করা হবে, নাকি আমি কেন সে রাস্তায় গেলাম, এ প্রশ্ন তোলা হবে? আমি কেন সে রাস্তায় গেলাম এ প্রশ্ন করা হয় না। তাহলে একজন নারী কী পোশাক পরছেন, সে প্রশ্ন কেন করা হবে? ধর্ষক জাত বা পোশাক দেখে ধর্ষণের ঘটনা ঘটায় না। সে তার বিকৃত মানসিকতার জন্যই ধর্ষণ করে থাকে। এ জন্য নারী কী পোশাক পরেছে, কাকে সঙ্গে নিয়েছেন, এগুলো কোনোভাবেই দায়ী নয়। ধর্ষণের শিকার নারীদের দোষারোপ করা হলে অনেক সম্ভাব্য ধর্ষক ধর্ষণে সাহস পাবে। সে জন্য ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
করভী রাকসান্দ
গবেষণায় আসা বিষয়গুলো খুব অবাক হওয়ার মতো নয়। এ বিষয়গুলো আমরা জানি, কিন্তু স্বীকার করতে চাই না। একটা গবেষণার মাধ্যমে এ বিষয়গুলো নিয়ে এলে তা অস্বীকার করার সুযোগ থাকে না। সে জন্য ব্র্যাককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, শিক্ষামন্ত্রী সবাই নারী। এত সফলতা থাকতেও আমাদের জেন্ডার সমতা ও নর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতে হয় কেন? ছেলেরা কাঁদে না, আমরা বেশির ভাগ মানুষ এটা শুনে বড় হয়েছি। গোলাপি শার্ট পরলে আমার বন্ধুরা হাসত। ছোটবেলায় ছেলেদের বন্দুক আর মেয়েদের পুতুল কিনে দেওয়া হয়। আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রমে ‘জীবনের জন্য খেলাধুলা’ নামে একটি শারীরিক শিক্ষা বই আছে। এ বইয়ের ছবিগুলোর বেশির ভাগে ছেলেদের দেখানো হয়েছে। মেয়েদের একটি ছবি পেয়েছি। যেখানে মেয়েটি ক্রিকেট বা ফুটবল নয়, ভলিবল খেলছে।
আমরা কিছু কর্মশালা ও কর্মসূচি করে তরুণদের মনোভাব পরিবর্তন করে ফেলতে চাইছি। এভাবে হঠাৎ পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ বিষয়গুলো ছোটবেলা থেকেই শিশুদের শেখাতে হবে। তরুণদের মানসিকতার পরিবর্তন শুরু করতে হবে স্কুল পর্যায় থেকে এবং সেখানে অভিভাবকদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ফাহমিদা খাতুন
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখন শ্রমবাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ। এটা এখনো আমরা ৫০ শতাংশে নিয়ে যেতে পারিনি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটা ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু তারা কোথায় কাজ করছে? অনানুষ্ঠানিক খাতেই তারা বেশি কাজ করছে। যেখানে চাকরির নিশ্চয়তা ও আয় কম। সে জন্য ৩৬ শতাংশ শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের পরেও নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য অনেক বেশি। কারণ, ৩৬ শতাংশের ৮০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তাই তাদের আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়ে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আনুষ্ঠানিক খাতে আনার জন্য দক্ষতা ও শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবারে মা-বাবা উচ্চশিক্ষিত হলে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু এরপরেও আমার অনেক বন্ধুবান্ধবকে মেয়ে ও ছেলেদের মধ্যে পার্থক্য করতে দেখেছি। একটা মেয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাবার কথা হলো মেয়েটার তো বিয়েই হয়ে যাবে। কেন তিনি লাখ লাখ টাকা দিয়ে তাকে ডাক্তারি পড়াবেন। মনের গভীরে এ ধারণার শিকড়টা রয়ে গেছে। এই পরিবর্তন পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। কারণ, আবার গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে এসেও উচ্চশিক্ষিত হয়ে উচ্চপদে আসীন হয়েছেন, এমন নারীও রয়েছেন। মেয়েদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নিয়ে আসা আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত। এ জন্য শিক্ষা, দক্ষতা ও অর্থ, এ তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিকতার পরিবর্তনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনা গুরুত্বপূর্ণ।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
নারী অধিকার, শিশু অধিকার, পরিবেশের অধিকার, প্রতিবন্ধী অধিকারসহ যেকোনো অধিকারের মূল্যবোধ একই। ফলে যে কৌশল পরিবেশের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে , তা নারী অধিকার রক্ষায়ও কাজ করবে বলে আমি মনে করি। নারীর অধিকারকে ঐতিহাসিকভাবেই আমরা বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখে থাকি। এসব বিষয় নিয়ে আমরা সব সময় সমমনারা নিজেরা নিজেদের মধ্যেই কথা বলি। আমাদের চেয়ে ভিন্নভাবে ভাবা মানুষ আজ এখানেও উপস্থিত নেই। অথচ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি শুনলে হয়তো ভালো হতো। আমরা জানতে পারতাম কেন তারা জেন্ডার সমতার বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন।
কিছুদিন আগে আমাদের নারীরা সাফ ফুটবলজয়ী হয়ে এল। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সুযোগ–সুবিধা না থাকা পরিবার থেকে এসেছে। অনগ্রসর ও পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এসে জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। তখন মূলধারার সব গণমাধ্যম এ নিয়ে লিড নিউজ করেছে। আমাদের মূল্যবোধে নারীর প্রতি সম্মান রয়েছে, কিন্তু আমরা সব ক্ষেত্রে সেটার প্রতিপালন করতে পারিনি। সেখানে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির ব্যর্থতা আছে। আমি আমার ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি পাব—এটা জেনেই আমি বড় হয়েছি। এটা মেনেই যখন আমি বড় হই, তখন আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বড় হতে পারি না। এখানে রাষ্ট্রের একটা অবস্থান নিতে হবে।
মিজানুর রহমান
আমরা যাঁদের কথা বলছি বা যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের সঙ্গে তাঁদের ভাষায় কথা বলতে হবে। যে ভাষাটি তাঁরা বুঝবেন, সে ভাষায় কথা বলতে হবে। অর্থনৈতিক সমতা না এলে, সম্পদের সমান বণ্টন না হলে কীভাবে সমতার সমাজ তৈরি হবে? আমাদের দেশে আইন থাকলেও তা অনেকে মান্য করেন না। কারণ, দেশের অনেক কর্তাব্যক্তিই আইন মানেন না। যদি জীবনের অন্য জায়গায় অসমতা থাকে, তবে শুধু জেন্ডার নর্ম ঠিক করে সমতা আসে না। যথাযথ আইন না থাকলে বা আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল হলে সমতা আসবে না।
আজকের গবেষণায় এসেছে, অনেক জায়গায়ই নারী ও পুরুষ একই রকমভাবে ভাবছে। অর্থাৎ নারীরাও সমাজকে পুরুষের দৃষ্টিতে দেখে। এটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটা কীভাবে মোকাবিলা করবেন? পুরুষতান্ত্রিকতা নারীর ভেতর জেঁকে বসলে, তা সরাবেন কী করে? সে জন্য বিনিয়োগ করতে হলে তা অবশ্যই শিক্ষায় করতে হবে। অনেকে সচেতনতা কার্যক্রমের কথা বলেছেন। পারিবারিক সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ স্যালি অ্যাংকল মারি এ কথা তখনই বোঝাতে পেরেছেন, যখন তিনি তা চার্চের মাধ্যমে বলেছেন। আমাদেরও ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ইমামদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে এ কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছালে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে।
ফরিদা পারভীন
আমাদের ভিশন হচ্ছে জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ ও সুরক্ষিত শিশু। আমাদের মিশন হলো নারী ও শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীকে উন্নয়নের মূল স্রোতোধারায় সম্পৃক্ত করা। আজকের গবেষণায় মাধ্যমে আমাদের অনেক করণীয় এসেছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় অনেক ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। গতানুগতিক কাজের বাইরেও আমরা স্যোশাল অ্যান্ড বিহেবিয়ার চেঞ্জ কমিউনিকেশনের (এসবিসিসি) ওপর এখন অনেক গুরুত্ব দিচ্ছি। ছোটবেলায় আমরা শুনতাম মেয়েরা ঘরে থাকবে আর ছেলেরে ঘরের বাইরে কাজ করবে। এখন এ অবস্থা বদলেছে।
মেয়েরা সবকিছু করতে পারবে না, তাদের লম্বা চুল রাখতে হবে, মেয়েদের আপাদমস্তক শরীর ঢেকে পোশাক পরতে হবে, ছেলেরা যা খুশি পরবে—এ চিন্তাচেতনা থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে এসেছে। এরপর কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর সব দেশেই এ রকম ঘটে। আমাদের যুবসমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ দরকার। সারা দেশে আমাদের ছয় হাজারের বেশি কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে। এসব ক্লাবের ৩০ জন সদস্যের মধ্যে ২০ জন করে মেয়েশিশু আছে। তাদের মানসিকতা ও সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনে আমরা কাজ করছি। সবার সহযোগিতায় আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।
নেহাল আহমেদ
আমাদের পড়াশোনাটা কমে গেছে। ছোটবেলায় দেখতাম আমার মা আর কিছু না পড়লেও শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়তেন। এখনকার কজন মা গল্পের বই পড়েন? আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন গল্প ও প্রবন্ধের বই পড়ে না বললেই চলে। শুধু পাঠ্যক্রম চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা দিয়ে কতক্ষণ হবে? ভেতর থেকে তো আসতে হবে।
বাংলাদেশে কয়েকটা ধারার শিক্ষা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাকের শিক্ষার ধরন আলাদা। আবার ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা আরেক ভিন্ন জগৎ। মাদ্রাসা ও অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলাদেশ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের সংকট শিক্ষার মধ্যে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নতুন পাঠ্যক্রমে একটু আশার আলো দেখছি, যা পরীক্ষা ও ফলাফলনির্ভর হবে না। যেখানে সবাই আনন্দের সঙ্গে শিখবে।
রাশেদা কে চৌধূরী
নারীর বিষয় নিয়ে প্রধানত নারীরাই বেশি আলোচনা করেন। আজ এখানে অনেক পুরুষ আছেন। সে জন্য ভালো লাগছে। আজকের গবেষক দল দারুণ কাজ করেছেন। আগের থেকে আমরা কত দূর এগিয়েছি, সে তথ্য থাকলে ভালো হতো। আগের চেয়ে আমাদের পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। সত্তরের দশকে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ছিল সমতাভিত্তিক। সেটা তো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি৷ আশির দশকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের ছবিতে ছিল: বাবা মাঠ থেকে ফিরে, ভাই স্কুল থেকে এসে খেতে বসেছে আর মা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন এবং বোন তাদের বাতাস করছে। এগুলো এখন নেই৷ অনেক বদল হয়েছে। জেন্ডার উপযুক্ত আচরণের কথা এসেছে। এখন তো এখানে তৃতীয় লিঙ্গও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ইউএনএফপিএর এক গবেষণায় এসেছে অষ্টম শ্রেণি পাস করা নারীর সন্তান নিরক্ষর ও অপুষ্টিতে ভোগে না। পাঠ্যক্রমে ভাষাগত পরিবর্তন এসেছে। এখানে আমি সরকারকে ধন্যবাদ দেব। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকারের বিষয় সপ্তম শ্রেণি থেকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগে শিক্ষকেরা এ অধ্যায় বাসা থেকে পড়ে আসতে বলতেন। এখন শ্রেণিকক্ষে এগুলো পড়ানো হয়। একটা পরিবর্তন হয়েছে।
প্রস্তাবিত নতুন পাঠ্যক্রমে বিষয়ভিত্তিক বিভাজন থাকছে না। শিক্ষক প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকেরা কতটুকু জেন্ডার সংবেদনশীল, তা জানা দরকার। ইমামের প্রশিক্ষণের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। সেগুলোর সুফল কেন পাচ্ছি না, তা–ও খতিয়ে দেওয়া দরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মক্তবভিত্তিক প্রাক্–প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমরা কি এটার কোনো মূল্যায়ন করেছি? এখানে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের অনুরোধ করব।
দীপু মনি
আমাদের দেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু যেতে হবে আরও বহু বহু দূর। সাম্যের জায়গায় যাওয়ার লক্ষ্য আমাদের রয়েছে। আমরা সবাই সেখানে যেতে চাই। আমাদের দেশের মধ্যে একটা পক্ষ-বিপক্ষ আছে। এখানে আমরা সবাই একটি পক্ষ। আমাদের একটি প্রতিপক্ষ আছে। তারা এ সমতায় বিশ্বাস করে না। তারা নারীকে দমিয়ে রাখতে চায়।
আলোচনায় নারীর অবস্থান, শিক্ষা ও সম্পদের অধিকার, পোশাক ও চলাফেরার স্বাধীনতা, কাজের সুযোগসহ সব কটি বিষয় এসেছে। ধর্ষণ নিয়েও কথা হয়েছে। যতক্ষণ সমাজ মনে করবে ধর্ষণের কারণে নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটে, ততক্ষণ কেউ না কেউ এটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে। সম্ভ্রম নিশ্চয়ই নারীর কোনো বিশেষ অঙ্গে থাকে না। অতএব ধর্ষণের সঙ্গে সম্ভ্রমের কোনো সম্পর্কই থাকা উচিত না। আমি কখনোই মনে করি না যে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সম্ভ্রমহানি হয়েছিল। একদল পশু তাঁদের ওপর নির্যাতন করেছিল।
আইনি কাঠামোয় নারীকে নিয়ে অনেক বৈষম্য ছিল। সেগুলো এ সরকার দূর করেছে। ১৯৯৭ সালে আমরা নারী উন্নয়ন নীতিমালা করলাম। সেখানে নারীর সম্পত্তি, প্রজনন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অধিকারের কথা বলা ছিল। কিন্তু সেটা ২০০৫ সালে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। নারীর অধিকার চূড়ান্ত রকম রাজনৈতিক অধিকার। নারী অধিকারের জন্য দৃশ্যমানতা অসম্ভব জরুরি। আজকে নারী সব জায়গায় দৃশ্যমান। এখন পাইলট, শান্তিরক্ষী বাহিনীসহ সব জায়গায় আছে। রাজনীতি দিয়েই সারা জীবন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কাজেই নারীর অধিকার চাইলে সঠিক রাজনীতিটাও করতে হবে।
আমরা পরিবেশ ও নির্ধারকগুলো ঠিক করিনি। কিন্তু হঠাৎ করে একটা ফলাফল চাইছি। সে জন্য শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজকের প্রজন্ম আমাদের প্রজন্ম থেকে অনেক বেশি মেধাবী। তাদের ঠিকভাবে পড়ালেখায় উদ্বুদ্ধ না করতে পারলে সেটা আমাদের ব্যর্থতা। শিক্ষাব্যবস্থা নিরানন্দ হলে তো সে পড়বে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সনদ ও পরীক্ষাসর্বস্ব হয়ে গেছে। আমাদের সবাই মিলে সেটা বদলাতে হবে। এ কাজটি অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এ পাঠ্যক্রমের কাজ আমরা ভীষণ উৎসাহ নিয়ে করছি। যার পরীক্ষামুলক কার্যক্রম চলছে ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ পাঠ্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়কে আমরা জেন্ডার লেন্স দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। এ শিক্ষাক্রমটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আগামী পাঁচ বছরে পরিবর্তন দেখতে শুরু করব। ১০ বছর পরে একটা বড় পরিবর্তন দেখব। সে জন্য আপনাদের সবার সহযোগিতা দরকার।
আসিফ সালেহ
আমরা সবাই নারীর সমতা আনয়নে বিষয় নিয়ে কাজ করছি। ফলে কর্মকৌশলে সমন্বয়ের বিষয়টিও খুব জরুরি। অবশ্যই শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাজ করছে সরকার। সরকারের পাশাপাশি সহায়ক সংগঠন হিসেবে এনজিওগুলো আছে। সহযোগিতার ভূমিকাটা কী ধরনের হবে? কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারি—সমন্বয়ের সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা দরকার। সে জন্য সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করতে হবে।
আসলে যুদ্ধটা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এ পুরুষতন্ত্রের মধ্যে পুরুষ যেমন রয়েছেন, নারীও রয়েছেন। এ জায়গাগুলোতে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে। শুধু সরকার সেটা হয়তো পারবে না। সরকারের দিক থেকে নীতিমালার দিকগুলো আসবে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তনে আমাদের পরিবার, সমাজ—সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে।
বাহাত্তর সালের বাংলাদেশের নারীদের চিত্র বর্তমানে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের অনেকগুলো উদ্যাপন করার আছে। পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার সূচকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ শতাংশ। এটাকে ৫০ শতাংশে নিতে হবে। বাস্তবতা হলো আমাদের এগোনোর গতি স্লথ হয়ে গেছে কি না। কেন আরও নারী কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন না? তখন কিছু বাস্তবিক সমস্যার কথা এসেছে। যেমন বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র নেই। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হবে না, এ নিশ্চয়তা নেই। এখন এ সমস্যাগুলো সমাধানের সময় এসেছে। এগুলো সমাধান করতে পারলে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে নিয়ে আসা সম্ভব। এসব জায়গায় আমরা সবাই একটা কর্মকৌশল ঠিক করে কাজ করলে সহজে এগোতে পারব। শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা হিসেবে আমরাও আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে চাই।
এস এম মনজুর রশিদ
আজকের উপস্থাপন করা গবেষণার ফলাফল কেবল গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আজকের আলোচনায় আসা মূল্যবান পরামর্শগুলো নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে আরও কাজ করতে চাই। নীতিমালা তৈরিতে এগুলো প্রভাব ফেলবে—এ বিশ্বাস আমাদের আছে। একসঙ্গে আমরা যেন এগুলো এগিয়ে নিতে পারি। সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে পারি। আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা সবাই অবদান রাখব। যুবভাবনা আমাদের কাজের ক্ষেত্রে একটি ভাবনা। কারণ, নারী–পুরুষের সমতায়নের জায়গাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
নবনীতা চৌধুরী
আজ উপস্থাপিত গবেষণাটি থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, জেন্ডার–সমতার বিষয়ে আর্থসামাজিক অবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থাননির্বিশেষেই ৫০ শতাংশের বেশি তরুণ–তরুণীর মনোভাব নেতিবাচক। তরুণ নারী–পুরুষের আচরণ ও মনোভাব পরিবর্তনে আমরা যথেষ্ট কাজ করছি কি না, সেটা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার বা সম্পদের অধিকার নিয়ে আমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারী বা পুরুষ উভয়ের সঙ্গে যথেষ্ট কথা বলেছি কি না, সেটাও ভাবতে হবে। নারীর পোশাক ধর্ষণ ও সহিংসতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়—এসব আলাপ আমরা পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট তুলতে পেরেছি কি না—এ গবেষণাটি আবারও আমাদের সেসব প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। এই গবেষণাতেই আমরা দেখি, হয়তো এসব দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষা বড় প্রভাবক হতে পারে। কারণ, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া ছেলেমেয়েরা এবং এদের মধ্যে যাদের অভিভাবকেরাও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত অন্তত পড়েছেন, তাঁরা জেন্ডার সমতা বিষয়েও তুলনামূলক ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আমরা তাই এ বিষয়ে আলোচনা জারি রাখতে চাই। একটা বড় আশাবাদের মধ্য দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ হচ্ছে। কারণ, শিক্ষাক্রমের একটা বড় পরিবর্তনের কথা আমরা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে জানতে পারলাম। সবাইকে ধন্যবাদ।
সুপারিশ
–লিঙ্গসমতার প্রতি যুবদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন।
–নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য সম্পত্তি, কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষায় প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা দরকার।
–লিঙ্গসমতা অর্জনে ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষকদের সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।
–সব প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্ন রাখার নির্দেশনা দিয়ে তা বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
–শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জেন্ডার সংবেদনশীল নতুন পাঠ্যক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
–লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করতে নারী ও কন্যাশিশুবান্ধব নীতিমালা প্রয়োজন।
–সংশ্লিষ্ট সরকারি ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগগুলোর মধ্যে সমন্বয় দরকার।
–আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে উপযুক্ত কর্মকৌশল প্রণয়ন জরুরি।
–সম্পত্তিতে নারীর সম–অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে অবস্থান নিতে হবে।