গোলটেবিল বৈঠক
নারীর অপুষ্টি দূর করতে চাই নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন
নতুন পুষ্টিনীতি ও পুষ্টি কর্মসূচিতে জেন্ডার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে সবাই মিলে।
নারীরা বৈষম্যের মধ্যে আছে। এ বৈষম্য আরও প্রকট পুষ্টির ক্ষেত্রে। দেশের গর্ভবতী নারীদের প্রায় অর্ধেক রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। নারীর অধিকারহীনতা ও নারীর অপুষ্টি একসুতায় গাঁথা। পরিস্থিতি পরিবর্তনে নীতি, কৌশল ও কর্মসূচিতে পরিবর্তন দরকার।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পুষ্টিতে জেন্ডার সমতা অর্জন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহযোগিতায় নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
গোলটেবিল বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক বলেন, গত শতকের আশির দশকের শুরুর দিকে নারী অধিকারকর্মীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, ‘শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার’। এই স্লোগানের মধ্যে নারীর পুষ্টি নিশ্চিত করা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করার বিষয় আছে। বর্তমান সময়ে অল্পবয়সী মেয়েরা ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে সেবা নিতে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুষ্টি ও অধিকার দুটিই ক্ষুণ্ন করে নির্যাতন।
পুষ্টির ক্ষেত্রে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যের একধরনের বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল। বৈঠকের শুরুতে সেই বিশ্লেষণের ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির রিজিওনাল জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যাডভাইজার (এশিয়া) ফারহানা হাফিজ। তিনি বলেন, রক্তস্বল্পতায় ভোগেন দেশের প্রায় অর্ধেক গর্ভবতী নারী এবং প্রসবের সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান না ৪১ শতাংশ মা। ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী বলেছে, পরিবারে ছেলেদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখনো গর্ভবতী নারীদের ঘরে আটকে রাখা ও কম খাবার দেওয়ার প্রবণতা আছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাতৃ ও শিশু পুষ্টিবিষয়ক জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা ফারিয়া শবনম বলেন, গত ৩০ বছরে পুষ্টির বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেশ পিছিয়ে পড়েছে। সমস্যার মূল কারণ না জেনে কর্মসূচি প্রণয়ন করা ঠিক নয়। দেশে রক্তস্বল্পতা বেশি হওয়ার বেশ কিছু কারণের একটি হলো থ্যালাসেমিয়া। সুতরাং পরিপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে কর্মসূচি বা প্রকল্প নিতে হবে।
ব্র্যাক ও নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল একসঙ্গে কাজ করতে পারে উল্লেখ করে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির প্রধান মাসুমা বিল্লাহ বলেন, নারীর হাতের কাছে যে সম্পদ আছে, তা দিয়েই তঁার পুষ্টির চাহিদা মেটে কি না বা কতটুকু মেটানো সম্ভব, সেটা জানানো দরকার। পুষ্টির তথ্য নারী কতটা ব্যবহার করতে পারছে, সেটিও দেখা দরকার।
আলোচনায় অংশ নিয়ে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর আসফিয়া আজিম বলেন, নারীর অপুষ্টি দূর করতে হলে সংশ্লিষ্ট নীতি ও কৌশলগুলো জেন্ডার লেন্স দিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ২০১৫ সালের জাতীয় পুষ্টিনীতিতে জেন্ডারের যথাযথ অন্তর্ভুক্তির অভাব তুলে ধরেন, যেখানে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ আছে। আসফিয়া আজিম বলেন, নতুন পুষ্টিনীতি ও পুষ্টি কর্মসূচিতে জেন্ডার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে সবাই মিলে।
গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার হেলথ টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট মোমেনা খাতুন বলেন, কানাডা সরকারের কাছে জেন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেসব প্রকল্প বা কর্মসূচিতে জেন্ডার কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকে, সেসব প্রকল্প কানাডা সরকার প্রাধান্যের সঙ্গে বিবেচনা করে।
নিজের গবেষণা ফলাফল উদ্ধৃত করে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ জুলিয়া আহমেদ বলেন, আত্মতৃপ্তির অনেক কথা শোনা যায়। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে কিশোরীদের আয়রন ট্যাবলেট দেওয়া হয়। কিশোরীরা তা নিয়ে বাড়িতে ফেরে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোরীরা আয়রন ট্যাবলেট ঠিকমতো খায় না।
নারী অধিকার সংগঠন নারীপক্ষ বহু বছর ধরে নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি গবেষণা করে। এলাকাভিত্তিক পুষ্টি পরিকল্পনার ওপর জোর দেন নারীপক্ষের সভাপতি গীতা দাস। তিনি বলেন, একটি এলাকায় সাধারণত চার ধরনের মানুষ দেখা যায়। এরা হচ্ছে: জানে না ও মানে না; জানে না, কিন্তু মানে; জানে কিন্তু মানে না (এরা বিপজ্জনক) এবং জানে ও মানে (এদের কাজে লাগানো উচিত)।
পুষ্টি গবেষণার গুরুত্ব বিষয়ে বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) হেলথ সিস্টেম অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর সোহানা সফিক। তিনি বলেন, নারীদের খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য কম, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে পুষ্টি বিষয়ে পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি আছে, গ্রামের তুলনায় শহরের পুষ্টি পরিস্থিতি বেশি খারাপ। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্বের ঘাটতি আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তিনি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পুষ্টিবিষয়ক ফোকাল পারসন ও গবেষণা কর্মকর্তা ফারহানা আখতার। তিনি বলেন, পুষ্টির আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, কিশোর-কিশোরীদের অপুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাসের মতো বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দিতে হবে।
কর্মজীবী নারীরা সকালে কোনোরকমে খেয়ে বাসা থেকে বের হন। কাজ শেষে বাসায় ফিরে সঠিক খাবার খান না বা খেতে পারেন না। পাশাপাশি কর্মস্থলে অনেক সময় সঠিক খাবারের ব্যবস্থা থাকে না। বিষয়টি একাধিক আলোচকের কথায় উঠে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, অনেক কর্মস্থলে ভালো খাবার পাওয়া যায় না।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর সায়কা সিরাজ বলেন, জেন্ডার ও পুষ্টি খাতে বরাদ্দ বেশ। কিন্তু নানা জটিলতায় বরাদ্দ ঠিকমতো ব্যয় হয় না। ১২৭টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর প্রতিটি কর্মসূচিতে জেন্ডার ও পুষ্টি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে।
দুই ঘণ্টা স্থায়ী গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েন্স অ্যান্ড ক্যাম্পেইন পরিচালক নিশাত সুলতানা, মেরী স্টোপস বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন ব্যবস্থাপক মনজুর নাহার, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনালের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান আফসানা হাবিব শিউলী এবং আয়াত এডুকেশনের প্রকল্প পরিচালক লায়লা করিম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।