প্রজননস্বাস্থ্য
মাসিক, বয়ঃসন্ধি নিয়ে মন খুলে কথা বলতে দিন
ইউএসএআইডি ‘সুখী জীবন’ প্রকল্পের অধীনে পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই কর্মশালার আয়োজন করে।
মাসিকের সময় কী খাবার খাওয়া যাবে, কী খাওয়া যাবে না? রক্তস্রাব বেশি হওয়া কি সমস্যা? দাড়ি ঠিক সময়ে ওঠে না কেন? টিটি (টিটেনাস বা ধনুষ্টঙ্কার) টিকা কি নিতেই হবে?—প্রজননস্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয়ে এমন নানা প্রশ্ন ছিল কিশোর-কিশোরীদের।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের মিলনায়তনে ‘কৈশোর ও যুববান্ধব প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা’ শিরোনামের কর্মশালায় অংশ নিয়ে কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়।
ইউএসএআইডি ‘সুখী জীবন’ প্রকল্পের অধীনে পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই কর্মশালার আয়োজন করে। এতে সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো বন্ধুসভা। এর আগে সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে কৈশোর ও যুববান্ধব প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার তিনটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের কর্মশালা ছিল এ পর্বের শেষ আয়োজন।
কর্মশালায় অংশ নিয়ে কিশোর-কিশোরীরা জানায়, মাসিক স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া হলেও এটা নিয়ে এখনো খোলামেলা আলোচনা হয় না। অনেক সময় ছেলেরা মাসিকের প্রসঙ্গে হাসিঠাট্টা করে। উল্টোভাবে ছেলেরাও তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা নিয়ে কথা বলার জায়গা পায় না।
দাড়ি-গোঁফ না উঠলে বন্ধু-সহপাঠীরাও হাসাহাসি করে। তারা এসব বিষয়ে মন খুলে কথা বলতে চায়। মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, কামাল আহমেদ মজুমদার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রূপনগর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঢাকা কমার্স কলেজ ও ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির দুই শতাধিক শিক্ষার্থী কর্মশালায় অংশ নেয়।
ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের কিশোর-কিশোরী ও যুববিশেষজ্ঞ ফাতেমা শবনম বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে মন খুলে কথা বলতে হবে। কিশোর-কিশোরীরা যেন প্রজননস্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয় নিয়ে যথাযথ তথ্য পেতে পারে, সে জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
তিনি বলেন, তাঁর কৈশোর সময়েও শুনেছেন মাসিকের সময় টক খাওয়া যায় না। আসলে মাসিকের সময় টক, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া যায়। রক্তস্রাব বেশি অর্থাৎ দিনে পাঁচবারের বেশি প্যাড পরিবর্তন করতে হলে ও দীর্ঘ সময় ধরে হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের আঞ্চলিক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ঢাকার ফারহানা হক প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করে জানান, কৈশোরে মাসিক অব্যবস্থাপনা, ১৮ বছরের আগে বিয়ে ও অধিক সন্তান জন্ম দিলে নারীর জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপদ গর্ভধারণের জন্য ১৫ বছর বয়স থেকে ৫ ডোজ টিটি টিকা নেওয়া জরুরি।
সবার শরীরে হরমোন একই সময়ে সমানভাবে সক্রিয় না-ও হতে পারে। এ কারণে কারও দাড়ি-গোঁফ কিছুটা দেরিতে উঠতে পারে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কণ্ঠস্বর পরিবর্তনও এমন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
কর্মশালায় চারটি বিষয়ে দলগত অংশগ্রহণের পর কিশোর-কিশোরীরা যার যার দলের পক্ষে মতামত তুলে ধরে। হামিদ এলাহী সাদ, ফাতেমা অন্তু, সানজিদা খান, সানজানা ইসলাম, জারিন সুবাহ রাফা, মেহজাবিন সিনথিয়া, নাঈমা ইসলাম, আব্দুল কাইউমের মতো কয়েকজন জানায়, প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করার জন্য পরিবারের সদস্য ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। এটা যে লজ্জার কোনো বিষয় নয়, তা নিয়ে মন খুলে কথা বলতে দিতে হবে, বিদ্রূপ করা যাবে না।
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বলেন, আগে প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনাকে পাপ মনে করা হতো। অথচ প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে পদে পদে বিপদে পড়তে হয়। এর গুরুত্ব বুঝেই সরকার পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই কর্মশালা থেকে পাওয়া শিক্ষা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, মাসিক, বয়ঃসন্ধিকালীন বিভিন্ন বিষয়ে সমাজের সংস্কার ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে হবে। এই আধুনিক সময়ে দেশে একজন নারীর পরবর্তী মাসিকের সময় কখন, কোন সময়ে মা হওয়া নিরাপদ ও মাতৃত্ব সম্পর্কে জানার জন্য অ্যাপ থাকা দরকার।
কর্মশালায় ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক আবু আখতারুজ্জামান ভূইয়া তুলে ধরেন বিভিন্ন সরকারি হেল্পলাইন নম্বর ও সেবাকেন্দ্রগুলোর তথ্য। তিনি বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অনলাইনে অনেক অসত্য তথ্য ছড়ানো হয়। কিশোর-কিশোরীদের এসব এড়িয়ে প্রকৃত তথ্য জানতে হবে। এ ক্লিক করে কিশোর বাতায়ন থেকে কিশোর-কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা, প্রেমের সম্পর্ক, বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে।
কর্মশালাটি সঞ্চালনা করেন ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের যোগাযোগ ও তথ্যাদিবিষয়ক ব্যবস্থাপক রিদওয়ানুল মসরুর।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী বলেন, সামাজিক সংস্কার ভেঙে কৈশোর ও যুব বয়সীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিতভাবে কাজ করার বিকল্প নেই।
কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার, চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সভাপতি ইব্রাহিম তানভীর, সিলেট বন্ধুসভার সাংগঠনিক সম্পাদক সমীর বৈষ্ণব, ময়মনসিংহ বন্ধুসভার সদস্য মেহেদী হাসান ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সদস্য শারমিন আক্তার।