প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আইনি ও সামাজিক সুরক্ষায় করণীয়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আইনি ও সামাজিক সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৫ জুলাই ২০২৪। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
এম এ মান্নান
সভাপতি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী
রাশেদ খান মেনন
সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী
সারা হোসেন
অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট
নুজহাত জাবিন
কান্ট্রি ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ
মেঘনা গুহ ঠাকুরতা
নির্বাহী পরিচালক, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিইব)
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকারকমী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন
হেলেনা তালাং
জাতীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
নাদিরা পারভীন
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, নাগরিক উদ্যোগ
শোভা সরকার
সহযোগী আউটরিচ কর্মকর্তা, ব্লাস্ট
উজ্জ্বল মাহমুদ
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার, ডব্লিউডিডিএফ
আহমদ ইব্রাহিম
উপদেষ্টা, সামাজিক ন্যায়বিচার ক্লাস্টার, ব্লাস্ট
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
এম এ মান্নান
সভাপতি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী
আমি হাওর অঞ্চলের মানুষ। সেখানে অনেক বেশি দরিদ্র মানুষের বাস। সেসব মানুষের কষ্ট দেখেছি। তাঁদের কষ্ট অনুভব করতে পারি। আজকের আলোচনা শুনে যা বুঝলাম, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলতে বোঝানো হচ্ছে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা। এর মধ্যে দলিত আছেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন। আছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও। আমাদের সরকারের লক্ষ্য হলো, কেউ পিছিয়ে থাকবে না। সবাইকে নিয়ে সামনে এগোতে হবে।
দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছেন। তবে কয়েক বছর আগেও দলিত মানুষদের যে অবস্থা ছিল, এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকে এখন ব্যবসা–বাণিজ্য করছেন। অনেকে ভালো আয়মূলক কাজের সঙ্গে আছেন। কেউ বিদেশে গিয়েও নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। এভাবে অনেক দলিত নিজের জীবনমানের উন্নয়ন করছেন।
অধিকাংশ দলিত মানুষের শিক্ষা নেই। যথেষ্ট আয় না থাকার জন্য তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারেন না। আমরা বলছি কেউ পেছনে থাকবে না। তাহলে দলিত মানুষদের সন্তানসহ সব অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানুষকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সরকারের ভাবনায় সেটি আছে এবং সরকার সে লক্ষে৵ কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, তেমনি স্বাস্থ্যের বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে কোনো মানুষই সফলতা অর্জন করতে পারে না। সে দিন দিন পিছিয়ে পড়ে। এ জন্য অনগ্রসর মানুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এই সব মানুষদের শুধু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নয়, তাঁদের বাসস্থানেরও অভাব রয়েছে। আপনারা জানেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করেছেন। এ দেশে যাঁদের ঘর নেই, তাঁদের ঘর দিচ্ছেন। ফলে ঘরহীন মানুষ যখন থাকার একটা জায়গা পাবেন, তখন তাঁরা নানা কাজের মধ্য দিয়ে তাঁদের অবস্থা উন্নয়নের সুযোগ পাবেন।
এই সরকার দরিদ্রবান্ধব সরকার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সংসদে অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু দলিত অসহায় মানুষদের নিয়ে আলোচনা আগের থেকে কমে গেছে। তরুণ সংসদ সদস্যদের এসব বিষয়ে আরও এগিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। সংসদে এই সব অনগ্রসর জনগোষ্ঠী নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। শুধু দলিতদের নিয়ে একটি সংসদীয় ককাস করা হবে।
সরকার তাঁদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করছে এবং ভবিষ্যতে আরও করবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, কেউ পিছিয়ে থাকবে না। সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই একটি উন্নত–সমৃদ্ধ দেশ নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
রাশেদ খান মেনন
সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী
দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও হিজড়াসহ চারটি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আজ আলোচনা হলো। এই আলোচনা ও সমস্যা অনেক পুরোনো। অগ্রগতিও কিছু হয়েছে। ১৯৮৯ সালে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। অনেক সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি হলো; কিন্তু বাস্তবায়নে এখনো সমস্যা রয়ে গেছে। তেমনি আলাপ আলোচনা করতে করতে ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন হলো। আইন হিসেবে এটা একটি যুগান্তকারী আইন। সবর্ণ নাগরিক হিসেবে কার্ড প্রদান, চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ প্রায় সব বিষয় সেখানে আছে। কিন্তু আইনের পর একবারও জাতীয় কমিটি বসেনি। এই কমিটির সবাই সচিব। তাঁরা সব সময় ব্যস্ত থাকেন। একবার জাতীয় কমিটির সভার জন্য সচিবদের আসতে বলা হলো। একজন মাত্র সচিব এসেছিলেন, কারণ তাঁর একজন সন্তান প্রতিবন্ধী। জেলা ও উপজেলা কমিটি রয়েছে। তাদের কোনো বাজেট নেই যে তারা মিটিং করবে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে যখন সব ধরনের কোটা বাতিল হয়ে গেল, তখন আমি বারবার বলেছিলাম, প্রতিবন্ধীদের কোটা বাদ যেতে পারে না।
প্রান্তিক ও দলিত মানুষদের জন্য স্থানীয় সরকারের সংবেদনশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কমলাপুরের টিটিপাড়া কলোনি উচ্ছেদ হলো। আমি অন্তত ১০ বার কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই তাঁদের পুনর্বাসনের কথা বলেছিলেন, কিন্ত তাঁদের পুনর্বাসন হয়নি। মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিলররা এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভাবেন কি?
প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী আইনটি অনেক ভালো আইন ছিল। এ আইন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সবাই এটাকে ভালো বলেছেন;
কিন্তু আজ পর্যন্ত সংসদে উত্থাপন করা হয়নি। আমি মনে করি, সংসদে বৈষম্যবিরোধী আইন পাস করতে হবে। সংসদের পরবর্তী
অধিবেশনে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। আগে এসব বিষয়ে সংসদে যেমন আলোচনা হতো, এখন সেটি তেমন দেখা যায় না। সংসদে নতুন যাঁরা এসেছেন, এসব বিষয়ে তাঁদের আরো সংবেদনশীলতা আশা করি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ সবাইকে যুক্ত করে কীভাবে বৈষম্যবিরোধী আইনটি পাস করানো যায়, সে ব্যাপারে সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে।
সারা হোসেন
অনারারি নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কথা বলার আলাদা কোনো জায়গা নেই। তাঁরা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যেতে পারেন; কিন্তু সেখানে গিয়েও অধিকাংশ সময় তাঁদের সমস্যার সমাধান হয় না। তাহলে তাঁরা যাবেন কোথায়? কিছুদিন আগে মিরনজিল্লা কলোনি উচ্ছেদ হয়েছে। দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষ এমন নানা সমস্যায় পড়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অনেকে বলেছেন বৈষম্যবিরোধী আইন নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, এই আইন পাস হওয়া জরুরি। তাহলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
হেলেনা তালাং সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য আলাদা ভূমি কমিশনের কথা বলেছেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমাদের ভালো হাউজিং পলিসি আছে। সেখানে প্রান্তিক মানুষের আবাসনের কথা খুব ভালোভাবে বলা হয়েছে; কিন্তু বণ্টনের সময় প্রান্তিক মানুষেরা বঞ্চিত হন। স্থানীয় সরকার সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাজউক অনেক আবাসন প্রকল্প করে; কিন্তু সেখানে দলিত অসহায় প্রান্তিক মানুষের জন্য তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে কোটার প্রয়োজন আছে। আলোচকদের প্রায় সবাই দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কোটার কথা বলেছেন। তাঁদের জন্য অবশ্যই কোটার ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানে সবার সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে যদি প্রয়োজন হয় দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, হিজড়াসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার নির্বাহী আদেশে কোটা দিতে পারে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। তাঁরা যেন অন্যায়ের শিকার না হন, এ জন্য তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। প্রান্তিক মানুষের জন্য বৈষম্যবিরোধী আইনের মতো নতুন আইন করা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়। ফলে একই আইন সব সময় সমানভাবে প্রযোজ্য থাকে না। এ জন্য কোনো কোনো আইনের পরিবর্তন ও সংশোধন করার প্রয়োজন হয়। আবার আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে অনেক সময় অনেকে ন্যায্য বিচার পান না। তাই আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সে ক্ষেত্রে নজরদারি প্রয়োজন।
মেঘনা গুহ ঠাকুরতা
নির্বাহী পরিচালক, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিইব)
দলিতসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও ভূমি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। শিক্ষা ও ভূমি হলো এমন এক অধিকার, যার মধ্যমে তাঁরা জীবিকাসহ অন্যান্য অধিকার অর্জন করতে পারেন। রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিইব) থেকে আমরা অনেক আগে থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে কাজ করছি। মাননীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন জানেন যে ভূমি নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি। ভূমিসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছি। ২০০০ সালে আমরা ভূমি নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন আমরা ভূমি অধিকার, ভূমি বণ্টন, ভূমিহীনতার কথা বলেছি। এখন একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। যাঁরা ঋষি জনগোষ্ঠীর মানুষ, তাঁরা এত বেশি প্রান্তিক হয়েছেন যে, তাঁরা তাঁদের শ্মশান পর্যন্ত রক্ষা করতে পারছেন না। নদীভাঙনে যেমন এগুলো চলে যাচ্ছে, আবার অনেক সময় দখলে হচ্ছে। তখন আমরা ব্লাস্ট ও জেলা প্রশাসকের সহায়তায় তাঁদের শ্মশানঘাট রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছি। আজকের গোলটেবিলে উপস্থিত দুজন সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আছেন, তাঁদের অনুরোধ করব, তাঁরা যেন এ বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন।
কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ ও রাখাইনের বাস। সেখানে আমরা কিছু স্কুল ও কলেজে কাজ করেছি। অভিযোগ পেয়েছি, সেখানে অনেক শিক্ষকও রাখাইনদের বলেন, ‘তোরা তো শুঁটকি খাস।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক মানুষই শুঁটকি খায়। তারা লেখাপড়া করছে। তারা শুধু পাস করলেই হবে না। তাদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস দিতে হবে। তারা যেন হীনম্মন্যতায় না ভোগে। এ জন্য তাদের পাশে আমাদের থাকতে হবে। তারা কোনো বিপদে পড়লে আমরা তাদের সহায়তা করতে পারি। কিন্তু তাদের হয়ে সব সময় কথা বলতে পারি না। ওরা নাটক মঞ্চায়ন করতে চাইল, উদীচীর একজন ছেলে সহায়তা করল। জীবনে রামুতে কখনো র্যালি হয়নি। ওরা র্যালি করল। ওরা র্যালির ব্যানারে লিখল ‘আমরা মগ না, রাখাইন’।
অনেক জায়গায় দলিতরা সেলুনে চুল কাটাতে পারেন না। হোটেলে খাবার খেতে পারেন না। রংপুরের এক এমপি বলেছিলেন, কে তোমাদের এসব বিষয়ে নিষেধ করে, আমি তোমাদের সঙ্গে খাব। এভাবে যদি সব জনপ্রতিনিধি এগিয়ে আসেন, তাহলে একটা পরিবর্তন আসবে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার জন্য অনুরোধ করি।
নুজহাত জাবিন
কান্ট্রি ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ
অনেক বছর যাবৎ আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করছি। এরপরও সমস্যা রয়েছে। এখন সবই সম্মিলিতভাবে তাদের কথা ভাবতে হবে। তাদের আইনগত বিষয়, চাকরি, পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন বিষয় বেসরকারি ও মানবাধিকার সংস্থার কাজ আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করতে পারি। বেসরকারি সংস্থা হিসেবে আমাদের বড় ভূমিকা হলো সচেতনতা তৈরি করা।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ নিজেরা জানেন না তাঁর অধিকারগুলো কী। কোথায় গেলে এই সেবাগুলো পাবেন, সেটা তাঁরা জানেন না। আবার যাঁরা সেবা দেন, তাঁরাও ঠিকভাবে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেন সম্মিলিতভাবে তাঁদের সমস্যাগুলোর কথা, দাবি জানানোর কথা বলতে পারেন, সে জন্য তাঁদের আমরা সচেতন করতে পারি। আবার তাঁরা যে সম্মিলিতভাবে কিছু করবে, সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই। কারণ, তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদা পূরণে এত কাজ করতে হয় যে তাঁরা অন্য কিছু করার সময় পান না।
স্থানীয় প্রশাসনের যে সেবাকেন্দ্র আছে, সেখানে কীভাবে এই জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, কীভাবে এই সেবাকেন্দ্রগুলোকে আরও কার্যকর করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করেত হবে। তাঁদের কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করা দরকার। কিছুদিন আগে ব্লাস্ট থেকে তাদের আইনের সেবা পাওয়ার ঘাটতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে। আইনপ্রণেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এ ধরনের বিষয় খুব জরুরি। শেষ কথা বলতে চাই, কাউকে পেছনে নয়, সবাই মিলে তাঁদের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যেন আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিতে পারি।
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকারকমী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন
নদীভাঙন, প্রকৃতিক ও মানুষের সৃষ্টি দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হবে যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তারা অনেক করেছে। আজকের আলোচক উজ্জ্বল মাহমুদ, শোভা সরকার জনেন যে তাঁদের প্রতিনিয়ত কত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলতে হচ্ছে। কত কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।
অভিযোগ পাওয়া যায়, দলিত জনগোষ্ঠীর শিশুদের দিয়ে স্কুল ঝাড়ু দেওয়া হয়, টয়লেট পরিষ্কার করানো হয়। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসতে দেওয়া হয়। হেলেনা তালাংয়ের কথা শুনে আমার নিজের শৈশব মনে পড়ছিল। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, তখন ঠিকভাবে বাংলা বলতে পারতাম না। আর সেই আমি এখন বাংলা ভাষায় অধিকার বিষয়ক লেখালেখি করি। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, অনেক সংগ্রাম করে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে।
যেকোনো পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত নিতে গেলে পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয়। দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, ট্রান্সজেন্ডাসহ এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তাদের পরিসংখ্যান জরুরি। পরিসংখ্যান ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিলে সেটা প্রান্তিক মানুষের জন্য ফলপ্রসূ হবে না। প্রত্যেক মানুষের মাতৃভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেকে বাংলায় লিখতে পড়তে পারে, কিন্তু মাতৃভাষায় লিখতে–পড়তে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিজেও কোটা না থাকলে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতাম না। এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন করতে হলে প্রচলিত ধারার বাইরেও কখনো কখনো তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
হেলেনা তালাং
জাতীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
খাসি (খাসিয়া) জনগোষ্ঠীর মধ্য আমি প্রথম মেয়ে, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এটা হয়তো আমার পরিবার ও দেশের জন্য গর্ব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, প্রথম দিকে ক্লাসের কেউ আমার সঙ্গে কথা বলত না। সবাই মনে করত আমি বোবা। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিতে পারতাম না। বাংলা শিখতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। শুধু মুখস্থ করতাম। পরীক্ষায় লিখতাম। এভাবে পাস করে যেতাম, কিন্তু অনেক কিছু বুঝতাম না।
আমরা যে পুঞ্জি বা গ্রামে বাস করি, সেখানে কমিউনিটি স্কুল আছে। কোনো সরকারি স্কুল নেই। আমাদের স্কুলে কোনো স্থায়ী শিক্ষক থাকেন না। সিলেটে খাসি মেয়েদের লেখাপড়ার খুব খারাপ অবস্থা। শিক্ষা যদি সবার অধিকার হয়, তাহলে তাহলে আমরা পিছিয়ে থাকব কেন? খাসি শিশুদের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাবে।
এ মুহূর্তে পানচাষিদের অবস্থা খুবই খারাপ। ভাইরাসে তাদের ফসল নষ্টা হয়ে যাচ্ছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করি, তারা যেন পানচাষিদের সহযোগিতার করে। এখনো আমাদের জন্য শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা রাখা জরুরি বলে মনে করি।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, সেটা হলো সমতলের অধিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। খাসিরা যৌথ মালিকানায় বসবাস করছে। কিন্তু যৌথ মালিকানার আইগত কোনো স্বীকৃতি নেই। এ জন্য খাসি, গারোসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজ ভূমিতে বসবাস করা প্রতিনিয়ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে তাদের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য একটা পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা দরকার।
নাদিরা পারভীন
কর্মসূচি ব্যবস্থাপক, নাগরিক উদ্যোগ
দলিত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সুরক্ষায় আমরা কাজ করি। তবে তাদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত, সেটা জানার জন্য আমাদের একটা জরিপ করা জরুরি। এতে তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ ও সব ধরনের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। দলিত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, তারা যখন সেবা নিতে যায়, তখন অনেক ক্ষেত্রে বলা হয় যে চিকিৎসক নেই। অভিযোগ পাওয়া যায়, চিকিৎসক দেখানোর সুযোগ পেলেও অধিকাংশ চিকিৎসক অন্য রোগীদের মতো চিকিৎসা সেবা দেন না। এ–ই হলো তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা! আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, রংপুর, দিনাজপুর—এসব এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেদিন ক্লিনার আসে না, সেদিন দলিত শিক্ষার্থীদের দিয়ে স্কুলের আঙিনা ঝাড় দেওয়া হয়, টয়লেট পরিষ্কার করানো হয়। শ্রেণিতে তাদের পেছনের বেঞ্চে বসতে হয়। পত্র–পত্রিকায় এসব লেখা হয়েছে। কিন্তু দলিতদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো অনেক রেস্টুরেন্টে তারা খেতে পারে না।
আমরা একটা বৈষম্যহীন আইন করেছিলাম। এটা পাস করতে হবে। একটা আইন থাকলে অন্তত আওয়াজ তোলা যায়। আপনারা জানেন, টিটিপাড়া ও গোপীবাগের কিছু এলাকা রেলওয়ে সম্প্রসারণের জন্য সরকার অধিগ্রহণ করেছে। তখন বলা হয়েছিল, তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের জন্য কিছু করা হয়নি। মাত্র অল্প কয়েকজন কিছু সুবিধা পেয়েছিল বলে জেনেছি।
দলিত জনগোষ্ঠীর জীবন–জীবিকা টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের ভূমি অধিকারসহ যাবতীয় অধিকার দিতে হবে। এ জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
শোভা সরকার
সহযোগী আউটরিচ কর্মকর্তা, ব্লাস্ট
আমরা যারা ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। তারপরও আমাদের বিভিন্ন আতঙ্কের শিকার হতে হয়। রাস্তাঘাটে সমস্যায় পড়তে হয়। ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন, পাঠ্যপুস্তকের একটা গল্প নিয়ে অনেক বিতর্কের জেরে আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। আমরা পরিবার ও সমাজ থেকে বঞ্চিত–বিতাড়িত জনগোষ্ঠী। তারপরও যদি ভয়ভীতি দেখান হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব?
অনেকে মনে করেন, ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা পুরুষ থেকে নারী হয়, আসলে তা নয়। জন্ম থেকেই তার মধ্যে নারীর বৈশিষ্ট্য থাকে। যত বড় হয়, ততই আরও বেশি নারীর মতো হয়ে ওঠে। এর বেশি কিছু নয়। আমাদের জেন্ডার আইডেনটিটি নিয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরকে অনুরোধ করব, তারা যেন এ সমস্যা নিরসন করে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সুবর্ণ নাগরিকের কার্ড পান। ভাতাও পান। আমাদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, যেদিন থেকে আমাদের আইডেনটিটি তৈরি হবে, সেদিন থেকে আমরাও কার্ড ও ভাতা পাব। সমাজসেবা অধিদপ্তর যেন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দ্রুত বিবেচনা করে। আমাদের যদি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে ভিক্ষাবৃত্তিতে কেউ যুক্ত হবে না। আমরা নিজেরা কোনো না কোনো কাজের মাধ্যমে আয় করে চলতে পারব। আমাদের মধ্যে যারা লেখাপড়া করছে, তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সনদ থাকা সত্ত্বেও একটা প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের দুজন সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে আমরা আরও বেশি এগিয়ে যেতে পারব।
উজ্জ্বল মাহমুদ
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার, ডব্লিউডিডিএফ
আজ আমি একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধি হিসেবে আজ এখানে এসেছি। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সৈনিক। আমি চারতলা থেকে পড়ে গিয়ে আমার মেরুদণ্ডে অনেক আঘাতপ্রাপ্ত হই। সাত মাস চিকিৎসার পর আমার অকালীন অবসর হয়। মেরুদণ্ডে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও কঠিন শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে পারেন।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আইনি সুরক্ষার বিষয়ে আজকের উপস্থাপনায় বেশ কয়েকটি সুপারিশ এসেছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আরও উপকৃত হবে বলে আমরা মনে করি। স্ট্রোক, হৃদ্রোগসহ ছয় ধরনের ব্যাধির চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। আমি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করতে চাই, প্রয়োজনে নীতিমালা সংশোধন করে হলেও যেন মেরুদণ্ডে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এই সুবিধা দেওয়া হয়।
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন মাথায় রেখে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ২০১৩–এর সার্বিকভাবে কার্যকর করার লক্ষে্য সর্বস্তরে উল্লেখিত কোটা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আহমদ ইব্রাহিম
উপদেষ্টা, সামাজিক ন্যায়বিচার ক্লাস্টার, ব্লাস্ট
ব্লাস্ট–এর গবেষণার আলোকে আমরা বাংলাদেশের ৮টি জেলায় গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুপারিশ সংগ্রহ করি। সার্বিকভাবে সেই সুপারিশগুলো উপস্থাপন করছি।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদাসমূহ নিশ্চিত করতে, বিদ্যমান নীতিমালা; যেমন জাতীয় স্বাস্থ্য ২০১১, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২০-২০২৫, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ২০১৫, জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় পরিকল্পনা ২০১৩-২০১৫ এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১–এর মতো কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করা। একটি জাতীয় তথ্যভান্ডার তৈরি করা, যা কার্যকরভাবে ওই জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার সূচক ও অগ্রগতির মূল্যায়নকে কার্যকরভাবে প্রতিফলিত করবে। পাশাপাশি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোর নিজস্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে প্রবেশের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে কোটাপদ্ধতি অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তা, পরিষেবা প্রতিষ্ঠান এবং উপজেলা ও জেলা লিগ্যাল এইড কমিটিকে আরও সংবেদনশীল হতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। নাগরিক সংগঠনের সুপারিশসমূহ বিবেচনায় রেখে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় বৈষম্যবিরোধী আইন বাস্তবায়ন করা।
দলিত জনগোষ্ঠীর সমাজসেবা কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং দলিত নারীদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। সরকার এবং এনজিওদের যৌথ প্রচেষ্টায় সংবেদনশীলতা তৈরির মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য দূর করা। আবাসন অবস্থার উন্নতি মাথায় রেখে তাদের সম্মতি সাপেক্ষে উন্নত আবাসন বাস্তবায়ন করা এবং অপরিকল্পিত উচ্ছেদ রোধ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নির্দেশিকা সংশোধন সাপেক্ষে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বিশেষত নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। জাতীয় তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনগ্রসর ব্যক্তিদের আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া। ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০–এর ৯৭ ধারার অধীনে একটি বিধিমালা তৈরি করা, যাতে অ-আদিবাসীদের কাছে ভূমি হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারিত থাকবে।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় প্রতিবন্ধী ভাতা বাড়ানো, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে তাঁদের যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ প্রকল্প সফল করার নিমিত্তে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করার যথাযথ নির্দেশিকা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া।
মানবাধিকার সংস্থা, মন্ত্রণালয় এবং লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ সম্প্রদায়ের সহযোগিতার মাধ্যমে এ জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংজ্ঞা তৈরি করা। লিঙ্গসমতা এবং বৈষম্য রোধে কর্মক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন করা। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির কার্যকারিতা এবং আয় বৃদ্ধির বাধা দূর করা। লিঙ্গবৈচিত্র্যময় ব্যক্তিদের জন্য উত্তরাধিকার বিষয়ে ব্যক্তিগত আইন প্রয়োগ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চলমান সব উন্নয়নমূলক প্রকল্পের বাস্তবায়নের মাপকাঠি হিসেবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্তর্ভুক্তির কেপিআই নিয়ে আসতে হবে।