বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা: বর্তমান প্রেক্ষাপট ও গবেষণা
প্যানেল আলোচক
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি
অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান
পরিচালক, বারডেম একাডেমি ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
অধ্যাপক ডা. হাফিজুর রহমান
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ইউনাইটেড হাসপাতাল; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
অধ্যাপক ডা. মো ফিরোজ আমিন
বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনলোজি বিভাগ, বারডেম, ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডা. ফারিয়া আফসানা
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বারডেম; প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডা. শাহাজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ। জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডা. মির্জা শরীফুজ্জামান
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ; অর্গানাইজিং সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডা. এম সাইফুদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ; সায়েন্টেফিক সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডা. আফসার আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, নিটোর; অফিস সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি।
মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন
ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক, বিপণন বিভাগ, দি এক্মি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড
ফেরদৌস খান
নির্বাহী পরিচালক, বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ, দি এক্মি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা:
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি
বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে কতজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তা আমরা জানি না। বলা হয়ে থাকে, দেশে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর বাইরেও বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রি-ডায়াবেটিস অবস্থায় রয়েছে।
ডায়াবেটিস হওয়ার কারণগুলোকে দুই ভাগ করা যেতে পারে। একটি জেনেটিক্যাল, অন্যটি পরিবেশগত। আমাদের জীবনযাত্রার নেতিবাচক পরিবর্তন থেকে ডায়াবেটিস হতে পারে। বর্তমানে অনেক মানুষ মুটিয়ে যাচ্ছে। মুটিয়ে যাওয়া থেকে ডায়াবেটিসসহ অন্য অনেক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়গুলো চাইলে পরিবর্তন করা যায়। ফিনল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশ এ মুটিয়ে যাওয়া রোগ কমিয়ে ফেলেছে; কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে তা বাড়ছে।
কীভাবে মানুষের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌছাতে হবে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। এসব গবেষণায় বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের যুক্ত করা যেতে পারে। ডায়াবেটিক সমিতি মসজিদের ইমামদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছে, যেখানে দেখা গেছে তাদের মাধ্যমে বললে এসব বিষয় মানুষ গুরুত্ব সহকারে শোনে। কারণ, ধর্মে সুস্থ জীবনযাপনে জোর দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোও মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন করতে পারে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সচেতনতা জরুরি। এর পরেও ডায়াবেটিস হলে তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সব রকম শারীরিক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। বর্তমানে প্রযুক্তির অনেক বিকাশ হয়েছে। ফলে এ–সংক্রান্ত চিকিৎসাসেবা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়েও দেওয়া সম্ভব। আমরা ডায়াবেটিক সমিতি থেকে কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল কেয়ার নামে এ সেবা চালু করেছি।
আমাদের শরীরে অনেক হরমোন তৈরি হয়। এর মধ্যে সব কটি হরমোন বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক নয়; কিন্তু শরীরে ইনসুলিন তৈরি না হলে রোগীর মৃত্যু হবে। তাই রোগীকে নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়। তাই এর চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। ফলে অনেকের পক্ষেই এ ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব না। আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের মতো ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা’ কার্যক্রম চালু হলে এটি সহজ হবে।
ডায়াবেটিস বিষয়ে মানুষকে প্রভাবিত ও সচেতন করতে নিত্যনতুন স্লোগান বের করা দরকার। নন কমিউনিক্যাবল ডিজিজের মধ্যে কেবল ডায়বেটিস সচেতনতায় বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। এটা আমাদের বড় অর্জন। এ বিষয়ে আমরা খসড়া নীতিমালা তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। এটি এখনো কার্যকর হয়নি। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান
পরিচালক, বারডেম একাডেমি ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী তাঁদের রোগ সম্পর্কে জানেন না। এই রোগ প্রায়ই তখন ধরা পড়ে যখন এটি গুরুতর জটিলতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা।
চীনের ‘দ্য কুইং স্টাডি’, আমেরিকার ‘ডিপিপি স্টাডি’, ফিনল্যান্ডের ‘ডিপিএস প্রকল্প’ এবং ভারতের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্যোগ দেখিয়েছে যে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করলে ৫০-৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব।
কীভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাত্রার ফলে শারীরিক সক্রিয়তা কমে যাচ্ছে। মানুষ এখন দীর্ঘ সময় ধরে মুঠোফোন, ল্যাপটপ বা টিভির স্ক্রিনে ব্যস্ত থাকে। এতে চোখ ও হার্টের ওপর চাপ বাড়ে। বিপরীতে শারীরিক পরিশ্রম কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে ওজন ও মেদ বৃদ্ধির সমস্যা বাড়ছে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হলো ঝুঁকি কমানো। যে ইনসুলিনের উৎপাদনপ্রক্রিয়া জন্মের সময় থেকেই শুরু হয়, তা সঠিকভাবে কার্যকর হতে হলে মায়ের গর্ভকালীন পুষ্টির গুরুত্ব অপরিসীম। গর্ভাবস্থায় মায়ের সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী ধাপে ডায়াবেটিস ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুলপর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ডায়াবেটিস সচেতনতা বাড়ানো, পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তাঁদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও শারীরিক পরিশ্রমে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। যাঁরা ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে যাতে জটিলতা সৃষ্টি না হয়। সেই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে।
আমরা যদি একত্রে কাজ করি, তবে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে একটি বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সুস্থ জীবনযাত্রা, সামাজিক উদ্যোগ এবং গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের ডায়াবেটিস পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. হাফিজুর রহমান
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ইউনাইটেড হাসপাতাল; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডায়াবেটিস রোগটি যদি সঠিক সময়ে শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে এর ফলে জটিলতা বাড়বে এবং মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাবে। তাই রোগটি দ্রুত শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকিতে কারা আছেন, তা আমাদের জানা দরকার। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমরা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। যদি কারও মা–বাবা বা ভাইবোন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকেন, যদি কেউ শারীরিক পরিশ্রম না করেন, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করেন, ব্লাডপ্রেশার বেশি থাকে, রক্তে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
ইদানীং কম বয়সী তরুণ–তরুণীদের ওজন বৃদ্ধির ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক চক্রও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বয়স ও ওজন বৃদ্ধির সঙ্গেও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
যদি কারও ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত তৃষ্ণা, দুর্বলতা অনুভবের মতো লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দ্রুত তাঁর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিত। তবে যাঁদের কোনো উপসর্গ নেই, তাঁদের জন্য বয়স ও ওজনের ভিত্তিতে স্কেলিং করতে হবে। ৩০ বছরের বেশি বয়স এবং বিএমআই ২৩-এর বেশি হলে তাঁদের স্কেলিং প্রয়োজন। প্রতিবছর অন্তত একবার করে স্কেলিং করতে হবে। আর যাঁদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে আরও ঘন ঘন স্কেলিং করা প্রয়োজন।
প্রথমে খালি পেটে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা হয়। এরপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে ২ ঘণ্টা পরে ব্লাড সুগার টেস্ট করা হয়। যদি খালি পেটে ব্লাড সুগার ৭ মিলিমোল/লিটারের বেশি হয় অথবা গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর এটি ১১.১ মিলিমোল/লিটারের বেশি হয়, তাহলে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধরা হয়। এ ছাড়া হিমোগ্লোবিন এ১সি পরীক্ষা করা হয়, যা তিন মাসের গড় রক্তে শর্করার মাত্রা নির্দেশ করে। এটি যদি ৬.৫ শতাংশ বা এর বেশি হয়, তাহলে ডায়াবেটিস নিশ্চিত ধরা হয়।
প্রি-ডায়াবেটিস রোগীদেরও শনাক্ত করা জরুরি। যদি খালি পেটে ব্লাড সুগার ৬.১ থেকে ৬.৯ মিলিমোল/লিটার হয় অথবা গ্লুকোজ খাওয়ার পরে ৭.৮ থেকে ১১ মিলিমোল/লিটারের মধ্যে থাকে, কিংবা হিমোগ্লোবিন এ১সি ৫.৭ শতাংশ থেকে ৬.৪ শতাংশের মধ্যে থাকে, তাহলে তাঁরা প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন। সঠিক সময়ে প্রি-ডায়াবেটিস রোগীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া গেলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. মো ফিরোজ আমিন
বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনলোজি বিভাগ বারডেম; ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডায়াবেটিস কখন হয়? ধরা যাক আগে আমার শরীরে আমি ১০ ইউনিট ইনসুলিন তৈরি করতাম, তখন তা আমার শরীরের গ্লুকোজ লেভেল ঠিক রাখতে পারত; কিন্তু এখন এক্সারসাইজ না করা, অতিরিক্ত খাবার খাওয়া, রাত জাগা ও অন্যান্য কারণে ওজন বেড়ে যাওয়ার ফলে আমার শরীর থেকে এখন ৫০-৬০ ইউনিট ইনসুলিন তৈরি হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ইনসুলিন কাজ করতে গিয়ে শরীরের জন্য মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং এতে শরীরে ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
শিশুদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে হলে কিছু বিষয়ের প্রতি আমাদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। শিশুদের জীবনযাত্রার ধরনে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই টিভি ও কম্পিউটার স্ক্রিন ও মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের শারীরিক পরিশ্রম ও মাঠে খেলার অভ্যাস কমে গেছে। স্কুলের পড়াশোনার চাপ, কোচিংয়ের বাড়তি চাপ এবং মাঠের অভাব শিশুদের শারীরিক সক্রিয়তাকে প্রভাবিত করছে।
অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির কারণে এখন ১৩-১৪ বছর বয়সেই ফ্যাটি লিভারের মতো সমস্যাগুলো ধরা পড়ছে, যা আগে মূলত পরিণত বয়সে দেখা যেত। আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে এই বয়সের শিশুদের লিভারে ফ্যাট জমেছে।
শিশুদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে ফাস্টফুডের প্রতি আসক্তি কমানোর জন্য স্কুলের আশপাশে অস্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান এবং ফাস্টফুডের দোকান নিষিদ্ধ করার মতো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে হেলদি ফুড এবং ব্যায়ামের প্রচারণা বাড়ানো উচিত। বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে পুষ্টিকর খাবার ও শারীরিক সক্রিয়তার গুরুত্ব তুলে ধরা যেতে পারে।
পপুলেশন অ্যাপ্রোচ ছাড়া আমরা শিশুদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারব না। শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি নয় বরং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে নিয়ে একটি বৃহৎ প্রচারণা ও কার্যক্রম গড়ে তোলা জরুরি। শিশুদের খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কার্যকলাপ এবং জীবনযাত্রার অভ্যাসের মধ্যে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পপুলেশন অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে স্কুল, পরিবার ও সমাজে শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্পন্ন খাবার এবং নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপের প্রতি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে। সঠিক শিক্ষা, প্রচারণা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারব।
ডা. ফারিয়া আফসানা
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বারডেম; প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এটি একদিকে মায়ের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে শিশুর ভবিষ্যতেও ডায়াবেটিসের আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তাই সঠিক জীবনযাপন, পুষ্টিকর খাদ্য, নিয়মিত শারীরিক কার্যক্রম এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। এ ছাড়া বংশগত ডায়াবেটিস, পলিসিস্টিক ওভারিস সিনড্রোম (PCOS) এবং থাইরয়েড রোগ থাকা নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি যেসব মেয়েশিশু স্থূলতার শিকার, তারা ভবিষ্যতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই শিশু বয়স থেকেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে স্ক্রিনিং করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT) করা উচিত। যদি প্রথম পরীক্ষায় ডায়াবেটিস শনাক্ত না হয়, তবে ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহে আবার পরীক্ষা করানো আবশ্যক।
যেসব নারীর ডায়াবেটিস রয়েছে, গর্ভধারণের আগে তাঁদের অন্তত তিন মাস আগে থেকেই ব্লাড সুগার এবং HbA1c নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ সময় এমন ওষুধ দেওয়া দিতে হবে, যা গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এ পর্যন্ত ৫৪টি প্রি-কনসেপশন কেয়ার কর্নার প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে স্বল্প মূল্যে স্ক্রিনিং, পরামর্শ ও প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়া যায়।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকা নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক রোগীর ওজন ও উচ্চতা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকা তৈরি করা হয়। দিনে ছয়বার নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া হালকা হাঁটাচলা বা হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে। তবে গর্ভকালীন কোনো জটিলতা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলা দরকার।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। এ সময় ইনসুলিন থেরাপি একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি। যদি জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হয়, তবে অবশ্যই ইনসুলিনের সাহায্য নিতে হবে।
ডা. শাহাজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ। জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণার বাজেট অত্যন্ত স্বল্প। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা আন্তর্জাতিক গ্রান্ট সংগ্রহেও সক্ষম হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গবেষণায় অংশীদারত্ব করেছে, যা একটি ইতিবাচক দিক।
বাংলাদেশের ডায়াবেটিক রোগীর সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে এখনো নির্ভুল তথ্য নেই। এটি একটি বড় ঘাটতি, কারণ সঠিক ডেটা ছাড়া এত বড় রোগী জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর চিকিৎসাব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি গবেষণায় নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের মোট বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের সময় ডায়াবেটিস একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উঠে এসেছে।
ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক হলো ডায়াবেটিক এডুকেশন ও লাইফস্টাইল মডিফিকেশন। ডায়াবেটিক এডুকেশনের মাধ্যমে রোগীদের সচেতন করা এবং তাঁদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে প্রণোদিত করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের ডায়াবেটিক গবেষণার ক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। বর্তমানে যে এডুকেশনাল পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা মূলত আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের একটি বাংলা সংস্করণ। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এটি কি বাংলাদেশের রোগীদের জন্য সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর? এই এডুকেশনাল পদ্ধতির পাশাপাশি রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি মোটিভেশনের জন্য কোন পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে, তা নির্ধারণের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ডায়াবেটিক রোগীদের নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার প্রধান কারণ, গবেষণায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর পাওয়া গেলেও সময়ের সঙ্গে সেগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং আমাদের গবেষণার ক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করতে হবে।
ডা. মির্জা শরীফুজ্জামান
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ; অর্গানাইজিং সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডায়াবেটিস কেবল ‘সুগার বেশি’ হওয়া নয়; এটি একটি বিপাকীয় সমস্যা, যা শরীরের প্রোটিন, চর্বি ও অন্যান্য উপাদানের বিপাকপ্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করে। ডায়াবেটিসের ধরন ভিন্ন হতে পারে এবং প্রত্যেক রোগীর চিকিৎসা একই রকম হওয়ার কথা নয়।
অনেক রোগী মনে করেন যে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা মানেই একধরনের ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণ। কেউ ওষুধে ভালো থাকে, আবার কেউ ইনসুলিন নিতে বাধ্য হয়। এটা ডায়াবেটিসের কারণ ডায়াবেটিস রোগীর জটিলতা এবং ঝুঁকির মাত্রার ভিন্নতার কারণে হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার লক্ষ্য শুধু রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ নয়; বরং রোগীর জটিলতা প্রতিরোধ করা। আগে ‘ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ’ সফল চিকিৎসার চিহ্ন ছিল। কিন্তু বর্তমান গবেষণা বলছে, শুধু সুগার নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়, বরং রোগীদের হার্ট অ্যাটাক, কিডনি বিকল হওয়া বা স্ট্রোকের মতো বড় ঝুঁকি শনাক্ত ও প্রতিরোধ করাও প্রয়োজন।
আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা শক্তিশালী এবং আমাদের দেশেই দক্ষ চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় ওষুধ রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
দেশের মাটিতেই এখন উন্নত মানের ঔষধ তৈরি হচ্ছে যা বিভিন্ন গবেষণা দ্বারা প্রমানিত। সম্প্রতি, আমার নের্তৃত্বে Emlino Exemplify trial নামে একটি প্রোজেক্ট আমরা শেষ করেছি, যেখানে আমরা অনেক আশানুরুপ ফলাফল দেখতে পেয়েছি।
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ৯৭ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন করতে সক্ষম। আমাদের ড্রাগনীতির সফলতার ফলস্বরূপ এটি সম্ভব হয়েছে।
আমাদের দেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় উন্নত দেশের গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়, তাই আমাদের চিকিৎসা বিশ্বমানের। আমাদের দেশে নিজস্ব গাইডলাইন তৈরির ক্ষেত্রে এখনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন।
ডা. এম সাইফুদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ; সায়েন্টেফিক সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সুষম খাদ্য একটি অপরিহার্য দিক। সারা দিনের খাবারে ৫০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ১০-১৫ শতাংশ প্রোটিন এবং বাকি ৩৫ শতাংশ ফ্যাট থাকা উচিত। একটি আদর্শ প্লেট মডেলের মাধ্যমে রোগীদের বোঝানো হয়, যেখানে প্লেটের অর্ধেক থাকবে শাকসবজি, এক–চতুর্থাংশ থাকবে কার্বোহাইড্রেট (ভাত–রুটি) এবং আরেক চতুর্থাংশ প্রোটিন।
ডায়াবেটিক রোগীদের আমরা দিনে তিনটি বড় খাবার এবং তিনটি স্ন্যাকস খাওয়ার পরামর্শ দিই। এর মধ্যে সকালে ৮টায় নাশতা, বেলা ১১টায় হালকা খাবার, বেলা ২টায় মধ্যাহ্নভোজ, বিকেল ৫টায় হালকা স্ন্যাকস, রাত ৮টায় ডিনার এবং রাত ১১টায় ঘুমানোর আগে হালকা খাবার খাওয়ার নিয়ম মেনে চলা উচিত। অল্প করে বারবার খেলে রক্তে শর্করার ওঠানামা কম হয়। সবাইকে আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
আমি জোর দিয়ে বলব, কিটো ডায়েট অবৈজ্ঞানিক ও বিপজ্জনক। ব্যালান্স ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট ৫০ শতাংশ রাখা উচিত। বিপরীতে কিটো ডায়েটে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি এবং কার্বোহাইড্রেট প্রায় নেই, যা দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি বিকল, ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এ ধরনের ডায়েট পরিহার করা উচিত।
কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের পাশাপাশি মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট, যেমন ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম, দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সাধারণত সবুজ শাকসবজিতে পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিক রোগীদের প্রতিদিন একটি ডিম কুসুমসহ খাওয়া যেতে পারে। ডিমের কুসুমে হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর উপাদান রয়েছে। দুধ প্রতিদিন এক থেকে দুই কাপ খাওয়া যেতে পারে, তবে দুধের সর এড়িয়ে চলা উচিত।
ডা. আফসার আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, নিটোর; অফিস সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে সৃষ্ট জটিলতাগুলোকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়। তাৎক্ষণিক জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস, হাইপারসমোলার হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেট এবং হাইপোগ্লাইসেমিয়া। এই জটিলতাগুলো রক্তে শর্করার ভারসাম্য নষ্ট করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।
ডায়াবেটিসের জটিলতা প্রতিরোধে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি হাইপোগ্লাইসেমিয়া এপিসোডে গড়ে ৬১৭ মার্কিন ডলার খরচ হয়। উন্নত দেশে এই খরচ প্রায় দ্বিগুণ। সচেতনতা বাড়িয়ে এবং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে এই খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ডায়াবেটিস একটি সাইলেন্ট কিলার। এর কোনো লক্ষণ প্রকাশের আগেই এটি রোগীদের গুরুতর জটিলতায় ফেলে দেয়। নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে এই জটিলতাগুলো শনাক্ত করা সম্ভব এবং এগুলো অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। গবেষণার ফলাফল আমাদের নীতিনির্ধারণে সাহায্য করবে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
মানসিক স্বাস্থ্যের গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসের কারণে পরিপাকতন্ত্রের ক্যানসার, বিশেষ করে লিভার, এন্ডোমেট্রিয়াল ও ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাপ্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা ডায়াবেটিসের রোগীরা প্রায়ই মানসিক চাপে ভোগেন। এটি তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে প্রতি পাঁচজন ডায়াবেটিসের রোগীর মধ্যে একজন মানসিক চাপের শিকার হন, যা চিকিৎসাপ্রক্রিয়া ও ফলাফলের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন
ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক, বিপণন বিভাগ, দি এক্মি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড
বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা উন্নত করায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। কোম্পানিগুলো ইনসুলিন, ওরাল ইপোগ্লাইসেমিক এজেন্ট, ওরাল সেমাগ্লুটাইড, সপ্তাহে এক দিন খাওয়ার ওরাল হাইপোগ্লাইসেমিক এজেন্ট ওমারিগ্লিপটিন, ইমিগ্লিমিন ও ওরাল-অ্যান্টিডায়াবেটিক ওষুধ তৈরি করছে।
এর পাশাপাশি ডিএমএফ, সিইপি গ্রেড ম্যাটেরিয়াল, বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স টেস্টের মাধ্যমে আমরা উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ মানের ওষুধ বাংলাদেশেই প্রস্তুত করছি।
তা ছাড়া ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে অবিরাম গবেষণার ভূমিকা অপরিসীম। যেই ওষুধগুলো বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে, সেইগুলো আমাদের রোগীদের কেমন উপকারে আসছে তারও সুদক্ষ গবেষণা প্রয়োজন। তারই ধারাবাহিকতায় একমির যুগান্তকারী উদ্যোগ Emlino Exemplify Trial; আমাদের দেশে আমাদের ট্রায়াল। বাংলাদেশের ৮২২ জন ডায়াবেটিস রোগীর অংশগ্রহণে এই ট্রায়াল আমরা সম্পন্ন করেছি, যার ফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এভাবেই আমাদের পক্ষ থেকে সব সময়ই ক্রমবর্ধমান ডায়াবেটিসের হার নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।
রোগীদের ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধের স্থানীয় উৎপাদন, কৌশলগত সহযোগিতা এবং উন্নত থেরাপির প্রবর্তনের মাধ্যমে উন্নত ডায়াবেটিস চিকিৎসায় সক্রিয়ভাবে অবদান রাখছে। দেশে ক্রমবর্ধমান ডায়াবেটিসের বোঝা কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টির এই চলমান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফেরদৌস খান
নির্বাহী পরিচালক, বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ, দি এক্মি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড
এক্মি বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এক্মির পক্ষ থেকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষামূলক সেশন, বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা প্রচারের জন্য তথ্যসামগ্রী বিতরণ।
আমরা মনে করি, ডায়াবেটিস মোকাবিলায় গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। এই গবেষণা কাজে আমাদের নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসকেরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকদের গবেষণায় আমরা পাশে আছি। সেই রকম একটি প্রয়াস থেকে এক্মি ‘Emlino Exemplify Trial’ চালু করে। এই গবেষণার ফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এ ধরনের উদ্যোগের লক্ষ্য বাংলাদেশে টাইপ–২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিকিত্সার মান উন্নত করা।
তা ছাড়া ডায়াবেটিসকে আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ডিজাইন করা নতুন ওষুধ প্রবর্তনের মাধ্যমে এক্মি তার পণ্যের লাইন প্রসারিত করেছে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং জটিলতা মোকাবিলায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। আমাদের মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করতে হবে যে আমরা দক্ষ এবং আধুনিক চিকিৎসা প্রদান করতে সক্ষম। ডায়াবেটিস রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং তাঁরা একটি সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবেন।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এ ধরনের সচেতনতামূলক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করার জন্য প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। আমি আশা করি ভবিষ্যতে এ রকম কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।
সুপারিশ
বাংলাদেশের ডায়াবেটিস গবেষণার ক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করতে হবে।
ঘন ঘন প্রস্রাব, দুর্বলতা, অতিরিক্ত তৃষ্ণা দেখা দিলে দ্রুত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিত।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও শারীরিক পরিশ্রমে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এড়াতে অতিরিক্ত ওজন পরিহার করা দরকার।
একবারে বেশি না খেয়ে ডায়াবেটিসের রোগীদের অল্প করে বারবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
শিশুদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্তি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত, তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই।