মানব পাচারের ধরন পাল্টে গেছে। পাচারপ্রক্রিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করছে পাচারকারীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও পাচারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধে উদ্যোগী সংস্থাগুলোকে প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ হতে হবে এবং অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার ‘সাম্প্রতিক মানব পাচার প্রেক্ষিত: সময়োপযোগী উদ্যোগ’ শিরোনামের গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সহযোগিতায় উইনরক ইন্টারন্যাশনালের ‘আশ্বাস প্রকল্প’ আয়োজিত বৈঠকের প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক পাচার প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উইনরক ইন্টারন্যাশনালের এদেশীয় প্রতিনিধি ও আশ্বাস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক দীপ্তা রক্ষিত ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, টিকটকার হৃদয়ের জায়গায় এখন অনেক হৃদয় যোগ হয়েছে। এদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন শিক্ষিতরাও। পাচারের ধরন পাল্টে গেছে। সুতরাং পাচার প্রতিরোধে আগের উদ্যোগগুলো যথেষ্ট কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, শ্রম অভিবাসনপ্রক্রিয়ায়ও মানব পাচারের ঘটনা ঘটতে পারে, বিষয়টিকে সরকার সেভাবে স্বীকার করছে না। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও গা বাঁচিয়ে চলছে। অথচ বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকে দাসের মতো জীবনযাপন করছেন। করোনার সময় ফেরত আসা শ্রমিকেরা পাচারের শিকার হয়েছিলেন। অথচ তাঁরা সরকারি ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে মানব পাচারের পেছনে নাকি রাঘববোয়ালেরা আছেন; কিন্তু তাঁদের চিহ্নিত করা হয় না।
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, পাচার প্রতিরোধে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
সমাজ ও পরিবারে নারী ও কন্যাশিশুদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা, নারীর অবদানকে স্বীকৃতি না দেওয়া, নারী-পুরুষে বৈষম্য এবং প্রচলিত রীতিনীতির কারণে নারী ও শিশুরা পাচারের ঝুঁকিতে পড়ছে বলে উল্লেখ করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পাচার প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থাগুলোকে কার্যকর করা, জবাবদিহির আওতায় আনা এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী বলেন, টিকটকসহ নানা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে প্রেম বা গোপন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে—এমন ভয় দেখিয়ে ফাঁদে ফেলছে পাচারকারীরা। অর্থ আদায় করছে। প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে অভিভাবকেরা তেমন দক্ষ নন বা তাগিদও অনুভব করেন না।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, পাচার প্রতিরোধে আইন, বিধিমালা সবই আছে; কিন্তু সেসবের সঠিক প্রয়োগ নেই। মানব পাচারের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। পাচারের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীর সুরক্ষা নেই। তিনি আন্তদেশীয় পাচারের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার থেকে পুনর্বাসনের প্রতিটি পর্যায়ে দুই দেশের সমন্বয়ের বিষয়ে ওপর জোর দেন।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, পাচার প্রতিরোধের বিষয়টি রাষ্ট্র বা গণমাধ্যমের গুরুত্বের তালিকায় জায়গা পাচ্ছে না। মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবসহ নানা কারণে বিদেশ যেতে চায়। রাষ্ট্রও চায় মানুষ বিদেশ যাক। মানুষের মধ্যে পাচার ও নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাওয়া মানুষের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটির পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, পাচারকারীরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তিতে দক্ষতা বাড়িয়েই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো পাচারকারীদের ধরতে পারে।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও চলচ্চিত্র পরিচালক ফুয়াদ চৌধুরী তাঁর পরিচালিত নারী পাচারকে কেন্দ্র করে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মেঘনা কন্যার কথা তুলে ধরেন। পাচার প্রতিরোধে গণমাধ্যম, এনজিও ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
উইনরক ইন্টারন্যাশনালের বি-পেমস্ অগ্রযাত্রা প্রকল্পের পরিচালক নাসির চৌধুরী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কীভাবে পাচারের ঝুঁকি বাড়ছে তা তুলে ধরনে। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে আছে এমন জেলার মানুষের জন্য জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা, বিকল্প আয়ের সংস্থান করা, অর্থনৈতিক সহায়তায় ব্যাংক-বিমার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার সুপারিশ করেন।
আন্তসীমান্ত মানব পাচারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ায়ের কান্ট্রি ডিরেক্টর তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ ধরনের পাচারের ক্ষেত্রে দুই দেশের ভিন্ন আইন থাকে। ফলে পাচারের শিকার ব্যক্তিকে উদ্ধারে দীর্ঘদিন লেগে যায়।
আইএলও বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাহনুমা সালাম খান বলেন, পাচারের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো দায় নিতে চায় না। মানুষ কেন দেশ ছাড়তে চায়, সে বিষয়ে গবেষণা করা, সচেতনতা বাড়ানো এবং পাচারকারী চক্রকে প্রতিহত করতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক সাজেদুল কাইয়ুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল ইউ চৌধুরী, উন্নয়নকর্মী আবদুল্লাহ জাফর, বিএনএসকের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর শেখ মুজিবুল হক, দ্য ডেইলি স্টার-এর এনজিও অ্যান্ড ফরেন মিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত তানজিম ফেরদৌস, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর স্টাফ রিপোর্টার কামরান সিদ্দিকী, ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাপক নয়ন আল আমিন, প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন প্রমুখ।
বৈঠকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্পের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক এস কে নাজমুল ইসলাম। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।