আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী: চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও করণীয়
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরডি) ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী: চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৭ জুন ২০২২। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
মুস্তাফা কে মুজেরী
নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
মো. আবুল বশর
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
ফাহমিদা খাতুন
নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
মো. আরফান আলী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যাংক এশিয়া লি.
তানভীর সুলতানা
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, পিকেএসএফ
সায়মা হক বিদিশা
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডারবৈষম্য’বিষয়ক গবেষণা দলের সদস্য
সানজীদা আখতার
সহযোগী অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শাহাদাত হোসেন
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ডাচ্–বাংলা ব্যাংক লি.
শেখ মো. মনিরুল ইসলাম
চিফ এক্সটারনাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার, বিকাশ
কোহিনুর ইয়াসমীন
প্রধান নির্বাহী অফিসার (সিইও), তরঙ্গ
সুতপা চৌধুরী
পরিচালক, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি
লীলা রশিদ
সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডারবৈষম্য’বিষয়ক গবেষণা দলের সদস্য
আয়েশা বানু
অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডারবৈষম্য’বিষয়ক গবেষণা দলের সদস্য
মোখলেসুর রহমান
প্রতিষ্ঠাতা, (সিআরডি) ও ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডারবৈষম্য’বিষয়ক গবেষণা দলের সদস্য
আরিফ জাওয়াদ
আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডারবৈষম্য’বিষয়ক গবেষণাকাজের গবেষণা সহকারী
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
সুপারিশ
■ আর্থিক অন্তর্ভুক্তিসংক্রান্ত জেন্ডার বিভাজিত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা জরুরি, যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
■ সব ধরনের আর্থিক সেবায় নারীর প্রবেশাধিকার সহজ ও নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেন তাঁর পছন্দ অনুযায়ী সেবা নিশ্চিত করা যায়।
■ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কেবল নীতিমালা থাকাই যথেষ্ট নয়। তাঁরা যেন সহজে ব্যাংকঋণ নিতে পারেন, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
■ ডিজিটাল আর্থিক সেবায় নারীর অংশগ্রণের পথ সহজ হতে হবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
■ আর্থিক সিদ্ধান্তে নারীর অংশগ্রহণ, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেন তিনি কেবল ঋণের বোঝা বহনকারী ব্যক্তি না হন।
■ সামগ্রিকভাবে নারীর অধস্তন অবস্থার পরিবর্তন না আনতে পারলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতেও তাঁর শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এই লক্ষ্যে সাবইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবার ভাবনার মধ্যে এই বিষয় নিয়ে আসার জন্য সিআরডিকে ধন্যবাদ। আমরা নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা বলছি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি। আমরা সব ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডে নারীর আরও অংশগ্রহণ চাই। নারীরা কী কী বাধার সম্মুখীন হন, এ বিষয়ে করণীয় কী—সেটিই আজকের আলোচনার বিষয়। আমাদের অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে কাজ করছে। এসব বিষয় আলোচনায় আসবে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে আশা করি।
লীলা রশিদ
২০১৭ সালের গ্লোবাল ফিনডেক্স ডাটা এবং ২০১৮ সালের আইএফসির সার্ভে ডাটা সূত্রে বাংলাদেশে ৬৫ থেকে ৬৮ শতাংশ উপার্জনক্ষম নারী আর্থিক সেবার বাইরে রয়েছেন। গ্লোবাল ফিনডেক্স ডাটার তথ্যমতে, বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান পুরুষের চেয়ে ২৯ শতাংশ পিছিয়ে। ধারণা করা হয় যে সেবার বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নেওয়া হলে এ বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে।
৩২ শতাংশ নারী প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবা পেয়ে থাকলেও তাঁদের অধিকাংশই কেবল প্রাথমিক সেবার মধ্যেই আবদ্ধ। একজন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার জন্য ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ নেওয়ার সুযোগ এখন পর্যন্ত খুবই সীমিত। নারীদের জন্য আরও বৃহৎ পরিসরে সব আর্থিক সুবিধা নেওয়ার সুযোগ এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি।
২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশলপত্রে বলা হয়, সম্পূর্ণভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলতে একজন উপার্জনক্ষম মানুষের সঞ্চয়, ঋণ, পরিশোধ, লেনদেন এবং বিমাসহ সব ধরনের আর্থিক সেবায় সহজে এবং নিরাপদে প্রবেশাধিকারের সুযোগ তৈরিকে বোঝানো হয়েছে। সে সুযোগ একজন নেবেন কি না, সেটি তাঁর স্বাধীন সিদ্ধান্ত। কিন্তু তিনি চাইলে যেন প্রয়োজনীয় সেবাটি নিতে পারেন সেই সুযোগ তাঁর জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে। ওই কৌশলপত্রে সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে শতভাগ জনগণকে আর্থিক সেবার মধ্য নিয়ে আসার অঙ্গীকার করেছে।
বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর আওতায় ১১ কোটি ৬০ লাখ ডিপোজিট হিসাব, ১ কোটির ওপর ঋণ হিসাব ও প্রায় ১০ কোটি এমএফএস হিসাব রয়েছে। এগুলোর মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতায় প্রায় ১ কোটি গ্রাহকের মধ্যে ৪২ শতাংশ নারী। কিন্তু শাখা ব্যাংকিংয়ের আওতায় ঠিক কতজন নারী আর্থিক খাতের সঙ্গে যুক্ত আছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এমএফএসের আওতাধীন নারী গ্রাহকসংখ্যার সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও জানা যায় যে এখানে রয়েছেন প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী।
আর্থিকভাবে অন্তর্ভুক্ত ৩২ শতাংশ নারীর মধ্যে ২২ শতাংশ নারী ব্যাংকিং (শাখা ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং এবং এমএফএস), ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান এবং ২ দশমিক ৫ শতাংশ সমবায় সেবার মাধ্যমে আর্থিক সেবার সঙ্গে যুক্ত আছেন। পোস্ট অফিসের এমএফএস সেবার মাধ্যমেও কিছু নারী সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন।
এসব নারীর মধ্যে যাঁরা কোনো না কোনোভাবে আর্থিক খাতের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছেন, তাঁদের অধিকাংশই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ৬৮ শতাংশ নারী, যাঁরা যুক্তই হতে পারলেন না, তাঁদের গল্পটা প্রায় অজানাই রয়ে গেল। পরিশেষে, নারীদের কীভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সব সেবা আরও অর্থপূর্ণভাবে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে সবাই আরও গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন বলে আশা করি।
কোহিনুর ইয়াসমীন
আমি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি পণ্য উৎপাদন করি। প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করি। কারখানায় কোনো পণ্য উৎপাদিত হয় না। আমার সব পণ্য বাইরে রপ্তানি হয়। ২৭টি দেশে পণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানির নিয়ম–নীতি জেনে গেছি। সেখানে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশের নিয়ম–নীতির জন্য অনেক সমস্যা হয়। বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কয়েক প্রকার পণ্য সরবরাহ করি। কোভিডের সময় যে প্রণোদনা দেওয়া হলো, নারী হিসেবে সেটা আমাদের পাওয়া অনেক কষ্টকর। এত ধরনের কাগজপত্র চায়, যা একজন নারীর পক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
স্থানীয় একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আমার ব্যবসা পরিচালনা করি। প্রথমে একটি ব্যাংক থেকে আমাকে প্রণোদনার টাকা দিতে চাইল না। আমার চ্যালেঞ্জ ছিল যে এই টাকা আমাকে পেতেই হবে। ব্যাংককে বললাম, কী কারণে আমাকে প্রণোদনার টাকা দেওয়া হবে না সেটি অনুগ্রহ করে জানান। এরপর অবশ্য চেষ্টা করে পেয়েছিলাম।
আমার জানামতে আর একজন নারী পেয়েছিলেন। কিন্তু অনেক নারী প্রণোদনার টাকা নেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই প্রয়োজনীয় দলিলপত্র না দিতে পারায় ওই টাকা তাঁরা নিতে পারেননি। নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা জরুরি।
সুতপা চৌধুরী
২০০৬ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কর্তৃপক্ষ তৃণমূল পর্যন্ত তদারক করে। আমাদের মূল কাজ হলো, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান প্রশিক্ষণ ও তদারক করা। আজ পর্যন্ত সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ৭৪১টি। কিছু প্রতিষ্ঠান সাময়িক অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ব্যাংক, পিকেএসএফ ও ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহকদের সঞ্চয়ের মাধ্যমে তহবিল দিয়ে গঠিত হয়। মাইক্রো ফাইন্যান্স চলে।
৭৪১টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। নারীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক এগিয়ে আছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ৯১ শতাংশ নারী। নারীরা যে ঋণ নিচ্ছেন, সেই ঋণের ব্যবহার নিয়ে আমরা যে খুব সন্তুষ্ট, সেটি বলা যাবে না। আমাদের এ খাতে সিআইবি শুরু করতে অনেক দেরি হয়েছে।
আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে নারীদের যে ঋণ দেওয়া হয়, তার সীমা ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু সব নারী নিজে এই টাকা ব্যবহার করেন না। কেউ তাঁর ছেলেকে দেন। কেউ তাঁর স্বামীকে দেন। আবার নিজেও ব্যবহার করেন। মাইক্রো ফাইন্যান্সে আসার আগে আমি একটি পল্লি উন্নয়ন সংস্থায় ছিলাম। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় মনে হয়, ৯০ ও ২০০০–এর দশকে যেসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ ছিল, কেন যেন সেটি কমে এসেছে।
আগে নারীরা দোকান করা, কাপড় বিক্রি করাসহ অন্যান্য যে পরিমাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেটি কমে আসছে বলে মনে করি। এ জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। আশা করি, ভবিষ্যতে মাইক্রো ফাইন্যান্সে নারীর আরও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি হবে।
তানভীর সুলতানা
পিকেএসএফের ৯০ শতাংশ নারী গ্রাহক। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো নারীদের পক্ষে আসলে সব কাগজ দেওয়া সম্ভব হয় না। তাঁরা তেমন প্রচলিত ব্যাংকিং কাজ করেন না। এসডিজি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজন নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। এ ভাবনা থেকেই পিকেএসএফ নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কাজ করছে। আমরা সরাসরি গ্রাহকদের অর্থ দিই না।
আমাদের ২৭৮টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একেবারে অতি দরিদ্র মানুষের মধ্যে অর্থ সরবরাহ করি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তারা সহজেই ঋণ নিতে পারেন। কারণ, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই ঋণ নারীরা কীভাবে ব্যবহার করবেন, এ বিষয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
নারীরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আসছেন, কিন্তু তাঁরা অর্থ ব্যবহার করছেন কি না, সে বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। নারীদের মধ্যে যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁরা ভালোভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আছেন। শুধু ঋণ নিলে বা হিসাব খুললেই নারীরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আসবেন না। নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে স্বাবলম্বী করতে হবে। পিকেএসএফের আর্থিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত এমন প্রায় ২৫ লাখ নারী আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে এসেছেন। উদ্যোক্তাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণ। এ জন্য অনেকে সফল হতে পারছেন না। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শুধু আয় দারিদ্র্য দূর করলেই যে একজন নারী ভালো থাকবেন তা কিন্তু নয়। তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পারিবারিক সংস্কৃতি এমন অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয়। আমরা এ বিষয়ে কাজ করি। এসএমই ফাউন্ডেশন মেলার আয়োজন করে।
সেখানে তাঁরা তাঁদের পণ্যগুলো দেশি–বিদেশি ক্রেতাকে দেখাতে পারেন। এমন আরও মেলার আয়োজন করা দরকার। সর্বোপরি তদারকির কোনো বিকল্প নেই। শুধু অর্থ দিয়ে বসে থাকলে হবে না।
সানজীদা আখতার
নারীর অন্তর্ভুক্তির জন্য দুটি কাজ করতে হবে। এক. তাঁকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে। দুই. কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে। এ দুই জায়গাতেই নারীর বাধা রয়েছে। দেশের নারীদের কতকগুলো ধরন রয়েছে। দরিদ্র নারী, মধ্যবিত্ত ও ধনী নারী, শহর ও গ্রামের নারী, পাহাড়ি নারী, উপকূল অঞ্চলের নারী, কর্মজীবী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ধরনের নারী রয়েছেন। একেক শ্রেণির নারীর একেক ধরনের সংগ্রাম রয়েছে।
একজন নারীকে অনেক সময় নিয়ে ঘরের কাজ করতে হয়। এটি তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। আবার নারীর কোথায় যাওয়া–আসার একধরনের বাধা রয়েছে। আমাদের মতো নারীদেরও ব্যাংক বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লাইন দিয়ে সেবা নেওয়া কঠিন। সেখানে একজন দরিদ্র নারীর জন্য আরও কঠিন।
কয়েকটি সেমিনারে শুনেছি, এজেন্ট ব্যাংকিং খুব ভালো, কারণ এটা বাড়ির কাছে থাকে। কিন্তু সেখান থেকে তাঁকে যখন কোনো বড় প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়, তখন বিভিন্ন প্রকার বাধার সামনে পড়তে হয়। মাইক্রো ফাইন্যান্স থেকেও ঋণ নেওয়া কিছুটা সহজ। নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধাগুলো বিবেচনা করতে হবে। পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা ডিজিটালি বেতন পাচ্ছেন।
কিন্তু যে নারীর প্রযুক্তির শিক্ষা নেই, তাঁকে কিন্তু স্বামী বা অন্য কারও সাহায্য নিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকছে না। নগদ টাকা পেলে হয়তো নিজের কাছে কিছু টাকা রেখে দিতেন।
একজন মধ্যবিত্ত নারী কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে চান না। এ ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এ জায়গায় কাজ করতে হবে। একজন নারীর বিভিন্ন বাধা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাঁর কাছে শোনা দরকার তিনি কীভাবে বাধার মুখে পড়েন। নীতিনির্ধারণের সময় এসব বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন। একজন আলোচক বলেন, আগে নারীরা দোকান করতেন, কাপড় বিক্রি করার জন্য এখন আগের মতো বাইরে আসছেন না। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কোনো একটি চাপ হয়তো তাঁরা অনুভব করেন।
নারী যখন ঋণ নিয়ে তাঁর স্বামী বা ছেলেকে দেন বা সামান্য কারণে মোবাইল ব্যাংকিং করেন, সেটিতে তাঁর সত্যিকার আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে কি না, সেটি আপনাদের গবেষণা দলের ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি।
মনিরুল ইসলাম
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী আমরা জানি যে বর্তমানে ১০ কোটি ৯১ লাখ মোবাইল ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে ৬ কোটি ৩১ লাখ পুরুষ গ্রাহক। আর ৪ কোটি ৫৬ লাখ নারী গ্রাহক। এ সংখ্যা নগদের গ্রাহকের বাইরে। কারণ, তাঁরা এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের মধ্যে আসেননি। বিকাশের বর্তমান গ্রাহক ৬ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ পুরুষ গ্রাহক ও ৪২ শতাংশ নারী গ্রাহক। ১ শতাংশ অন্যান্য।
আমাদের সমাজে সাধারণত পুরুষের হাতে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে আমরা একটি বাধা দেখেছি সেটা হলো হিসাব খোলার সময় ‘নো ইওর কাস্টমার ফরম’ পূরণ করতে হয় (কেওয়াইসি)। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত তথা দিতে হয়। নারীরা এখানে খুব অস্বস্তি অনুভব করেন।
পরবর্তী সময়ে ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি ফরম এল। এটা সবার জন্য সহজ হলো। আগে মুঠোফোনে রিচার্জ করার জন্য দোকানে যেতে হতো।মুঠোফোন নম্বর দিতে হতো। এসব বিষয়ে নারীরা স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। এখন ঘরে বসে সবাই মুঠোফোনে রিচার্জ করেন। ২০১১ সালে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাব ছিল। আজ ২০২২ সালে ৬৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ব্যাংক হিসাব আছে। শুধু টাকা গ্রহণ–প্রদান করলে তো আর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হয় না। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে ন্যানো লোন শুরু করলাম।
২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আমরা এই লোন দিই। ভবিষ্যতে এটা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। শিক্ষার্থীরা মুঠোফোনের মাধ্যমে তাদের ভাতা পাচ্ছে। বিকাশের মাধ্যমে অনেক ধরনের বিল এখন ঘরে বসে পরিশোধ করতে পারবে। লোন, সঞ্চয়—সবকিছু অ্যাপভিত্তিক। অ্যাপ ব্যবহারের জন্য স্মার্টফোন প্রয়োজন। কিন্তু দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনো সাধারণ ফোন ব্যবহার করে। তাই এখানে আমাদের কাজ করতে হবে। নারীদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য তাঁদের সচেতন করতে হবে।
বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এমএফএস ব্যবহারকারী অন্য নারীদের থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। চাহিদার ভিত্তিতে আর্থিক ও প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, এটা খুব প্রয়োজন।
শাহাদাত হোসেন
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি আরও কীভাবে বেগবান করা যায়, সেটিই আজকের আলোচনার বিষয়। সেদিকেই জোর দেব। ২০১১ সালে আমরাই প্রথম মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল ব্যাংকিং শুরু করি। আমাদের গ্রাহকসংখ্যা হলো প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ নারী। আমাদের প্রায় ২২০টি ব্রাঞ্চ আছে। ৯৯টি সাব–ব্রাঞ্চ। ১ হাজার ৪০০টি ফার্স্ট ট্র্যাক। ৬ হাজার ২৮৩টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট। ৩ লাখ ২৩৪টি রকেট আউটলেট। এসব কর্নার থেকে আমরা প্রায় ৪ কোটি ২৫ লাখ গ্রাহককে সেবা দিচ্ছি।
১০ টাকায় হিসাব খুলেছি। এখন খুব অল্প সময়ে হিসাব খোলা যায়। বৈদেশিক লেনদেন ছাড়া সব ধরনের লেনদেন এই এমএফএসের মাধ্যমে হচ্ছে। আমরা প্রায় দুই হাজার পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন পরিশোধ করি। তাঁদের বেতন আমরা রকেট হিসাবে দিই। তাঁরা তাঁদের রকেট নম্বর ও পিনের মাধ্যমে টাকা পেয়ে যাচ্ছে। হাতে টাকা পেলে অনেক সময় একে ওকে দিতে হতো। এখন কিন্তু প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারছে।
আমি বিভিন্নভাবে এমএফএস হিসাব খুলতে উৎসাহিত করি। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ১০০ কোটি টাকার ন্যানো লোন করেছে। এ টাকাও আমরা এমএফএসের মাধ্যমে দিতে পারব। শুধু সেটা না, সরকারের প্রতিটি ভাতাই এমএফএসের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ডিজিটালি পেমেন্ট প্রসিডিউর শুরু হয়। এর মাধ্যমে প্রায় সব ধরনের পরিশোধ ডিজিটালি করা যাচ্ছে। গ্রামে একটা ব্যাংকের ব্রাঞ্চ করা অনেক কঠিন, তবে এজেন্ট ব্যাংক খোলা খুব সহজ। আমাদের প্রায় ৫০ লাখ এজেন্ট ব্যাংক গ্রাহক আছে।
এসব গ্রাহকের ৩৮ শতাংশ নারী। সেবাগুলোকে আরও একটু তদারক করতে হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারীদের যেসব বাধা আছে, সেটা দূর করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সায়মা হক বিদিশা
নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে দেখতে হবে কোন ধরনের সেবা তাঁরা ব্যবহার করছেন। কেন ব্যবহার করছেন। এর উদ্দেশ্য কী। সেবাগুলো হলো এমএফএস, এমএফআই (মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউট) ও নানা ধরনের ব্যাংকিং সেবা। ক্রয়–বিক্রয়, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা ও বেতন-ভাতার মাধ্যমে নারীরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছে ঋণ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ—এসব কার্যক্রমের মধ্য
দিয়ে নারীরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আসছেন কি না, এটি একটি বিষয়। এর মধ্য দিয়ে তাঁর ক্ষমতায়ন হচ্ছে কি না, সেটিও দেখতে হবে। এখন আমাদের জন্য জরুরি হলো একটি তথ্যভান্ডার। আমরা সেটা করতে চাই।
১২ হাজার নারী-পুরুষের কাছ থেকে খানাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হবে। একটি জরিপ করে নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অবস্থা দেখতে চাই। এসব পরিবারের মধ্যে আমরা জরিপ করতে চাই। সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা এ জরিপের মাধ্যমে পাব না। সে জন্য আমরা আরও কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করব। এর মাধ্যমে আমরা তাঁদের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারব। আজকের আলোচনায় প্রাতিষ্ঠানিক, কাঠামোগত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ডকুমেন্টেশন, প্রযুক্তিসহ অনেক সমস্যার কথা এসেছে।
নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে হতে পারে এমন কিছু সমস্যা রয়েছে, যেমন নলেজ গ্যাপ, বোঝাপড়ার অভাব। কিন্তু দেখতে হবে যে নারীরা এর কারণে পিছিয়ে আছেন কি না। একবার একটি জরিপে আমরা দেখলাম, কিছু নারী বলছেন যে তাঁদের এটা দরকারই নেই, তাঁরা অনুভব করছেন না যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি তাঁদের প্রয়োজন। আবার একধরনের নারীর কোনো সঞ্চয় নেই; যে কারণে তাঁরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি চিন্তা করেন না।
আসলে কারা কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আছেন, সেটা দেখতে হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে বাধা দেওয়া হয়। মনে করা হয়, সে যদি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে চলে যায়, তাহলে পরিবারে জেন্ডার ভারসাম্য থাকবে না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে এবং একটি পরিকল্পিত সমাধানের দিকে যেতে হবে।
মো. আরফান আলী
আজকের আলোচনার তিনটা বিষয়—চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও করণীয়। আমরা মনে করি যে নারীরা যেন আরও বেশি করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আসেন।
২০১৪ সালে আমরা চিন্তা করলাম কীভাবে মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা নিয়ে যাওয়া যায়। সেই ভাবনা থেকেই আজকের এজেন্ট ব্যাংকিং। আজ যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কথা বলা হলো, সেটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিতে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। এজেন্ট ব্যাংকের সূতিকাগার ‘একটি বাড়ি একটি খামার’, যা এখন ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পে রূপান্তরিত হয়েছে।
ওই সময় আমরা গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা সুযোগ পেলাম। ২০১৪ সালে আমরা মুন্সিগঞ্জের পাইলট প্রোগ্রাম করলাম। আজকের দিনে যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সহজ হয়েছে কারণ, আর্থিক সেবা মানুষের কাছে চলে গেছে। খরচও কমেছে। এমএফএসের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এজেন্ট ব্যাংকের সেটা নেই। প্রতিটি গ্রামে যেন ১৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে আর্থিক সেবাকেন্দ্র পাওয়া যায়, আমরা সে চেষ্টা করেছি। এজেন্ট ব্যাংক থেকে আরটিজিএস, বিইএফটিএন, সোশ্যাল সেফটি নেট, রেমিট্যান্স, ডিপোজিট, ইনস্যুরেন্স, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগসহ সব ধরনের সেবাই এখান থেকে দেওয়া হচ্ছে। ৫২ হাজার মাইক্রো মার্চেন্ট এজেন্ট এখন ব্যাংক এশিয়ার পক্ষে পেমেন্ট দেয়।
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, পোস্ট অফিস, সিটি ডিজিটাল সেন্টার—এসব আমরা ব্যাংকে রূপান্তর করেছি। সমন্বয়ের ভিত্তিতে এসব সেবা নারীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা যেভাবে সেবাকেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠা করেছি, এর মাধ্যমে এমনিতেই নারীদের ক্ষমতায় হবে। আমাদের ব্যাংকের ৬৩ শতাংশ হিসাব নারীদের।
২০২৬ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক সবার যে ব্যাংক হিসাবের লক্ষ্যমাত্রা সরকারের রয়েছে, সেটা সম্পন্ন হবে বলে আশা করি। সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। নারীদের যদি শুধু ঠেকিয়ে না রাখি, তাহলেই তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে যাবেন।
ফাহমিদা খাতুন
দেশের অর্ধেক নারী। তাঁরা শ্রমবাজারে আসছেন। তবে আরও বেশি করে আসা প্রয়োজন। শ্রমবাজারে এখন নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এমনকি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নারীরা ভালো করছেন। নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অনেক সুযোগ আছে। অনেক ধরনের আর্থিক উপকরণ আছে। কিন্তু সেটা কীভাবে কাজে লাগানো যাবে, সেটা হলো প্রশ্ন।
কোভিডের সময়ও আমাদের দেশের নারীরা ভালো করেছেন। আর্থিক খাতের অনেক প্রসার হচ্ছে। অনেক ধরনের সেবা বাড়ছে। সেবার গুণগত মান বাড়ছে। প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। নারীদের চ্যালেঞ্জের যেন শেষ নেই। তাঁরা খুব ইনফরমালি ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকে না। এ জন্য দিনের পর দিন ঘুরেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পান না। সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা অনেক সময় তিনি তাঁর ছেলে, স্বামী বা অন্য কারও মুঠোফোনের মাধ্যমে আনছেন। এসব কারণে তিনি তাঁর পুরো টাকা নিজে ব্যবহার করতে পারেন না।
এসব ক্ষেত্রে আর্থিক শিক্ষার বিষয়টিও জরুরি। আমি নিজে যখন টাকা পাঠাই, তখন খুব দুশ্চিন্তায় থাকি যে টাকাটা ঠিকভাবে পৌঁছাল কি না। আমাদের দেশে স্কুল ব্যাংকিং আছে। এ ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা জেনে যাচ্ছে, কীভাবে আর্থিক লেনদেন করতে হয়। নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। আপনারা এ বিষয়ে কাজ করবেন জেনে খুশি হলাম।
কারণ, তথ্য খুব জরুরি। সঠিক তথ্য ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। নারীরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আছেন। কিন্তু তাঁরা যেন আরও বেশি সংখ্যায় আসতে পারেন, সে জন্য সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
মো. আবুল বশর
২০১৭ সালের ফিডেক্স গ্লোবাল জরিপে আমাদের জেন্ডার গ্যাপ ৩২ শতাংশ। আজকে উপস্থাপনায় যে তথ্য জানানো হয়েছে, আমরা এর সঙ্গে একমত পোষণ করছি। কোভিডের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এর সুদ ৯ শতাংশ। কিন্তু সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি দেবে। আর ৪ শতাংশ উদ্যোক্তারা দেবেন। নারী-পুরুষ সবাই এ ঋণ নিতে পারবেন। আমরা সব সময় নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দিয়েছি। যারা তারল্যসংকটে ভুগবে, তাদের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার সুযোগ রাখা হয়েছিল। ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আরও একটি তহবিল শুধু নারীদের জন্য রাখা হয়েছে।
মাত্র ৫ শতাংশ সুদে নারী উদ্যোক্তারা এ টাকা ব্যবহার করতে পারেন। আমাদের কাছে এখনো এ তহবিল রয়ে গেছে। নারী উদ্যোক্তারা সম্পূর্ণ টাকা নেননি। যেসব ব্যাংককে আমরা অনুমোদন দিয়েছি, তাদের প্রায় ১০ হাজার শাখা আছে। আমরা প্রতিটি ব্রাঞ্চকে কমপক্ষে তিনজন নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু বাস্তবে কী দেখি, বড় ঋণগ্রহীতাদের নিয়ে তারা ব্যস্ত। এ জন্যই হয়তো আমাদের দেশে পি কে হালদাররা সৃষ্টি হচ্ছে।
কেউ যদি ঋণ নিতে এসে সমস্যায় পড়েন, তাহলে আমাদের ডেস্ক আছে, সেখানে কথা বললে সমস্যার সমাধান হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এই সুযোগ আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরা এ বিষয়ে সচেতন নন। আমি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিভাগে কাজ করি। আমাদের ৫০০ কোটি টাকার তহবিল আছে শিক্ষার্থীদের জন্য। আমাদের আরও তিন হাজার কোটি টাকার তহবিল আছে, যেখান থেকে ৫ শতাংশ সুদে নারী উদ্যোক্তা ঋণ নিতে পারেন। আমরা আর্থিক জ্ঞান ও ধারণার জন্য গাইডলাইন তৈরি করছি। আর্থিক জ্ঞানের বুকলেট তৈরি করছি। এখান থেকে খুব সহজেই নারী উদ্যোক্তাসহ বিনিয়োগকারীরা ধারণা নিতে পারবেন।
মুস্তাফা কে মুজেরী
আজকের আলোচনার প্রধান বিষয় হলো আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারীদের বাধা কোথায়। সত্যি কথা বলতে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, যেদিক থেকেই বলা হোক না কেন, আমরা এখনো জেন্ডার সমতা আনতে পারিনি। এই সমাজব্যবস্থা তাদের পিছিয়ে রেখেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে শুধু আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারীরা সফল হবেন, সেটি আমি মনে করি না।
জেন্ডার সমতার লড়াইটা একসঙ্গে করতে হবে। কারণ, একটা আরেকটার ওপর নির্ভরশীল। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জন হতে হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে যেন সব নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হয়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নো ফ্রিল (খরচবিহীন অ্যাকাউন্ট) অ্যাকাউন্টের একটি উদ্যোগ আছে। এটা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যে খুব কাজ করেছে, তা কিন্তু না। আমাদের প্রধান কাজ হলো নারীর আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করার ব্যাপারে কাজ করতে হবে। প্রত্যেক নারী যেন আর্থিকভাবে সক্ষম হন। তারপর তিনি চিন্তা করে দেখবেন যে তিনি কোন আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অংশগ্রহণ করবেন। ইনস্যুরেন্স করবেন, না ব্যাংকে হিসাব করবেন, না লোন নেবেন—সেটা একান্তই তাঁর নিজস্ব ইচ্ছা। কিন্তু সমাজের কাজ হলো তাঁকে আর্থিকভাবে সক্ষম করে তোলা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নারীবান্ধব কোনো প্রকল্প আছে কি না। দেখা যায়, একটি প্রকল্পে নারী-পুরুষ সবাই আসছেন। সেখানে নারীরা হয়তো পিছিয়ে পড়ছেন। নারীদের সামাজিক বাধাগুলো দূর করতে পারলে তাঁদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাধা খুব সহজে দূর করা যাবে। এ ক্ষেত্রে সবাই মিলে কাজ করতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খুব জরুরি। সংশ্লিষ্ট সবাই এ ক্ষেত্রে কাজ করবেন বলে আশা করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।